মানুষ হাসে কেন?

হাসতে নাকি জানেনা কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোন না কত হাসির
খবর বলে যাই।

খোকন হাসে ফোঁকলা দাঁতে
চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে

কাজল বিলে শাপলা হাসে
হাসে সবুজ ঘাস।
খলসে মাছের হাসি দেখে
হাসেন পাতিহাঁস।

বিখ্যাত এই ছড়াটি লিখেছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। শেষ লাইনটা ছিল মারাত্মক, ‘‘এত হাসি দেখেও যারা/ গোমড়া মুখে চায়,/ তাদের দেখে পেঁচার মুখেও/ কেবল হাসি পায়।’’ তবু অনেক মানুষই হাসতে পারেন না, হাসেন না, হাসতে চান না; কেউ কেউ আবার হাসাকেই মনে করেন ব্যক্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই মুখ ও চোয়ালের চারপাশে ইট-পাথরের দুর্গ গড়ে তোলেন; বোমা মারলেও হাসি ফোটে না। কারো মুখ আবার এমনিই হাসি-হাসি। কারো হাসি আবার কিলার হাসি — লেডি কিলার! মেইল কিলার হাসি নেই, তাও নয়। কেউ কেউ আবার হেসেই খুন। নানা রকম হাসি : মুচকি হাসি, অট্টহাসি, ক্যানক্যানে হাসি, মিনমিনে হাসি, দেঁতো হাসি…!

 

কেন হাসি?

কিন্তু কেন হাসি? হাসির কারণ নিয়ে কাজ করেন লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের সোফি স্কট; তিনি লিখেছেন, প্রতিনিয়তই আমরা হেসে থাকি। হাসার কাজটি করলেও আমরা খেয়াল করি না যে, আমরা কাজটি করছি। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি হাসেন কেন? তার জবাবে হয়তো অধিকাংশ মানুষই বলে থাকেন, কৌতুক ও হাস্যকর বিষয়বস্তুর কারণে হেসে থাকেন। সোফির মতে, মূলত তা নয়। মানুষ অনবরত হেসে থাকে। বরং কৌতুকের কারণে হাসার পরিমাণই কম।

প্রতি দশ মিনিটের আলাপচারিতায় মানুষ অন্ততপক্ষে সাত বার হেসে থাকে।

সোফির মতে, হাসি একটি সামাজিক আবেগ। সামাজিক বন্ধন জোরদার করার জন্য আমরা হেসে থাকি। তিনি বলেন, আমরা হাসার সময় অনেক নাক-মুখ দিয়ে অনেক অদ্ভুত শব্দ করে থাকি। তার মতে, হাসি হলো শব্দ করার সব চেয়ে আদিম উপায়। এমআরআই ইমেজের সূত্রে তিনি দেখিয়েছেন, হাসার সময় জিভ, চোয়াল, নরম তালু, ঠোঁট প্রভৃতিতে সত্যিকার সঞ্চরণ ঘটে না। হাসির সকল সক্রিয়তা তৈরি হয় বুকের পাঁজর থেকে।

 

সোফি একটি গবেষণার কথা বলেছেন, যেখানে দেখানো হয়েছে প্রতি দশ মিনিটের আলাপচারিতায় মানুষ অন্ততপক্ষে সাত বার হেসে থাকে। তাই বলে মানুষই একমাত্র হাস্যপ্রবণ প্রাণি, তা নয়। গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাংরাও হেসে থাকে। সোফির ভাষ্যে অন্য কোনো অচেনা সংস্কৃতির পরিসরে হাসি বা হাস্যকর বিষয় উৎপন্ন হলেও মানুষ হাসি শনাক্ত করতে পারে। সে জন্য সোফির কাছে হাসি হলো অবাচিক যোগাযোগ বা non verbal communication। সামাজিক যোগাযোগের অংশ হিসেবেই মানুষ হেসে থাকে।

 

হাসির কাজ

হাসি নিয়ে যতোই হাসি না কেন, হাসির কাজের তালিকা বিশাল আকৃতির! প্রবাদপ্রতিম বাক্যই আছে : হাসি হলো সেরা চিকিৎসা। হাসি সমস্ত শরীরকে আরামদায়ক ও স্বস্তিপূর্ণ করে তোলে। ঝরে যায় মন খারাপের মেঘ। হাসি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়। হাসি হৃদপিণ্ডের রক্তচলাচল বাড়ায় এবং হৃদপিণ্ডকে সক্রিয় ও সচল রাখতে সহায়তা করে।

 

১০ থেকে ১৫ মিনিটের হাস্যপূর্ণ মুহূর্ত কমিয়ে দিতে পারে আপনার ৪০ ক্যালরি পরিমাণ শক্তি। শরীর থেকে ঝরে যেতে পারে মেদ। হাসি কমিয়ে দিতে পারে আপনার রাগ ও ক্ষোভের ভার। অবশেষে হাসি আপনার জীবনকে করতে পারে দীর্ঘায়িত।

 

মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য হাসির ভূমিকা দারুণ। আপনি যখন হাসবেন তখন আপনার পক্ষে চিন্তিত, বিষণ্ণ কিংবা রেগে যাওয়া সম্ভব নয়। হাসি আপনার কাজের ক্ষমতা ও শক্তি বাড়িয়ে দেয়। অপ্রীতিকর মুহূর্ত থেকে বাঁচার উপায় হাসি। হাসি আপনাকে নিয়ে যেতে পারে অন্যের কাছাকাছি।

হাসির অন্ধকার দিকও আছে!

হাসি বিষয়ক একই ধরনের কথা বলেছেন ডেভিড ডিসালভো। তিনি কাজ করেন মানুষের মন ও মস্তিষ্ক নিয়ে। বিখ্যাত ফোর্বস পত্রিকায় হাসির কার্যকারিতা প্রসঙ্গে বলেছেন, সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, বিষণ্ণতা দূরীকরণ, ব্যক্তিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, হৃদপিণ্ডের সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে হাসি ভূমিকা রাখে। দাম্পত্যযুগল যারা প্রচুর হাসিঠাট্টায় সময় কাটান তারা একটি সুস্থ সবল সম্পর্কে আছেন বলে ধরে নেয়া যায়।

 

হাসির আড়ালে অন্ধকার…

আরবি প্রবাদ, ‘‘অর্থহীন হাসি অমঙ্গলের ইঙ্গিত স্বরূপ।’’ বোঝা যায়, হাসির অন্ধকার দিকও আছে! এ বিষয়ে কাজ করেছেন শেফিল্ড হালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের বিশেষজ্ঞ লাইন এ বার্কার। তার মতে সত্য এই যে, হাসি সব সময় ইতিবাচক অথবা স্বাস্থ্যকর নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে হাসিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : স্বতঃস্ফূর্ত, মেকি, উত্তেজনাজাত হাসি। কিন্তু হাসির স্নায়বিক ভিত্তি সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে ওয়াকিবহাল হওয়া যায় নি। তবে বার্কারও বলেছেন, সামাজিক অভিযোজন, আবেগিক ও আচরণিক কার্যক্ষমতার বড় একটি অংশ হাসি এবং হাস্যরস গ্রহণের ক্ষমতা।

 

কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে হেসে ফেলার ভয়ে থাকে। অনেকে ক্ষোভ চেপে রাখেন হাসির মোড়ক দিয়ে। অনেকে আছেন, যারা হাসিকে ব্যবহার করে আঘাত করার অস্ত্র হিসেবে। এমন অনেকে আছেন, যারা ভাবেন অন্য কেউ তাকে নিয়ে হাসছেন, অন্যের হাসিকে ভয় পান। এই ভয় পিছু ছাড়ে না। বার্কার এগুলোকেই মোটাদাগে হাসির অন্ধকার দিক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মানসিক অস্বাভাবিকতার একটি নির্ণায়কও হতে পারে হাসি; ধরা যাক, কোনো মৃত বাড়িতে শোকার্ত পরিস্থিতিতে কেউ হাসছে।

 

হাসি কি হাস্যকর?

হাসি বিষয়টি হাস্যকর? ব্যাপার কিন্তু তেমন নয়! হাসি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিকরা হিউমার থেরাপির কথা বলে থাকেন। তাদের মতে, বিভিন্ন হাস্যকর অডিও-ভিডিও দেখে হাসির অনুশীলন মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা কমিয়ে আনে।

 

সায়েন্স ডিরেক্ট গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় নাতালি ভেন দার ওয়াল ও রবিন কক দেখিয়েছেন, স্বতঃস্ফূর্ত হাসির চেয়ে হাস্যকর কারণ ছাড়া উৎপন্ন হাসি বেশি ফলপ্রসূ। তাদের আরেকটি মত, প্রণোদনা বা প্ররোচনার মাধ্যমে তৈরি করা হাসি বিষণ্ণতা নিরসনে বেশি সহায়ক।

 

১৯৯৮ সালে ১১ জানুয়ারি শুরু হয় বিশ্ব হাসি দিবস। এর রূপকার ড. মদন কাটারিয়া। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী শুরু হয় হাস্যযোগ আন্দোলন বা ওয়ার্ল্ড লাফটার ইয়োগা মুভমেন্ট। ২৮ জুলাই ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে প্রথম উদযাপিত হয় বিশ্ব হাসি দিবস। এই দিবসের লক্ষ্য ইতিবাচক ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলা। হাসি ক্লাবের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকে এরকম কথা : “World Peace Through Laughter, The Whole World Is An Extended Family, Join a Community Laughter Club – it’s free!”

 

তাহলে দেখতে পাচ্ছি, হাসি মোটেও হাস্যকর বিষয় নয়; জীবনের জন্যই হাসি জরুরি। রুশ প্রবাদ বলছে, ‘‘একটি সুন্দর হাসি একটি ঘরে সূর্যের আলোর মতন।’’ অতএব, আসুন হাসি… হো হো হো… হা হা হা…

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here