একটি প্রস্তাবনা ।। কমলা দাস

ভারতের মাদ্রাজে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত কবি, ছোটগল্পকার ও কলাম লেখক কমলা দাস। জন্মেছেন ১৯৩৪ সালে। ইংরেজি ও মালয়লাম — দুই ভাষাতেই লিখতেন তিনি। নারীর যৌনতা, শরীর, অভিজ্ঞতা, রাজনীতি প্রভৃতির উন্মুক্ত অভিব্যক্তির মাধ্যমে স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করেছেন কমলা দাস। ২০০৯ সালের ৩১ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইংরেজি থেকে তাঁর ‘‘An Introduction’’ শীর্ষক কবিতার অনুবাদ করেছেন মোহাম্মাদ নুরুল  ইসলাম

 

একটি প্রস্তাবনা

আমি রাজনীতি বুঝি না,

তবে ক্ষমতায় থাকা মানুষের চেহারা চিনি,

নেহেরু থেকে সব নাম, আমি দিন কিংবা মাসের মত বার বার বলতে পারি।

আমি মালাবারে জন্ম নেয়া এক বাদামি চেহারা,

এক ভারতীয় মানুষ,

তিন ভাষায় কথা বলি,

দুই ভাষায় লিখি,

আর একটি ভাষায় স্বপ্ন দেখি।

তারা বলে, ইংরেজি তোমার মায়ের ভাষা নয়,

তুমি লেখাজোকা ইংরেজিতে করো না।

ক্রিটিক, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, তোমরা সবাই

দূরে যাও, আমাকে একা থাকতে দাও একটুখানি।

যে ভাষা আমার পছন্দ, যে ভাষায় আমি কথা বলতে চাই, তোমাদের এত আপত্তি কোথায়? হোক তা যেকোনো ভাষা?

যে ভাষায় আমি কথা বলি, সে আমার আপন হয়ে যায়,

তার আকৃতি-বিকৃতি কিংবা অদ্ভুত ভঙ্গিমা

সব আমার, একান্তই আমার।

এই ভাষা; আধা ইংরেজ, আধা ইন্ডিয়ান

মনে হয় কৌতুকময় তবুও নিরেট সত্য

আমার মতো, হুবহু মানুষের মত

তুমি কি বুঝো না?

আমার আনন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ এই ভাষা,

কাকের কাকা’র মত, সিংহের হুংকারের মত

এই ভাষা আমার কাছে প্রিয়,

মানুষের ভাষা, মনের ভাষা

যা থাকে একান্ত ভেতরে, এখানে,

এই মন দেখে শুনে সচেতন,

অন্য কোথাও নয়,

আকর্ণ অন্ধ ঝড়ে-পড়া গাছের কথা নয়,

মৌসুমী মেঘমালার কথা নয়,

বাদলের কথা নয়,

নয় কোন জলন্ত চিতার অবান্তর বিড়বিড়ানি।

ছোট্ট শিশু ছিলাম আমি,

লম্বা হলাম, অঙ্গ ফুলে উঠলো,

কতেক জায়গায় চুল গজালো,

তারা বলে দিলো, আমি বড় হয়ে গেছি।

কী চাইতে হয় না জেনেই, আমি তার কাছে চেয়ে বসি

‘ভালোবাসা’,

সে, ষোল বছরের যৌবন টেনে এনে,

শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল,

আমাকে প্রহার করে নি সে, কিন্তু

আমার ব্যথিত নারীদেহে লেগেছিল চরম আঘাত।

একটি বোঝা আমাকে চাপা দেয়,

স্তনযুগল, গর্ভাশয়ের ওজন আমাকে পিষে ফেলে।

করুণ, কাতর স্বরে জমে যাই নিজের মাঝে।

অতঃপর একদিন নারীত্বের এই খোলস ছেড়ে,

চুল ছেটে, ভাইয়ের ট্রাউজার পরে,

শার্ট গায়ে নেমে পড়ি জীবনপথে।

তারা বলতো, শাড়ি পরো, মেয়ে হও, বউ সাজো।

কাপড়ে কারুকাজ করো, রান্না করো,

চাকরের সাথে ঝগড়া করো,

মানিয়ে নাও, মানিয়ে নাও।

গলা ফাটা আওয়াজে প্রকারবিদরা চেঁচিয়ে বলে,

সাথেই থাকো।

মাঝের দেয়ালে বসে থাকা কিংবা বাহারি পর্দার

ফাঁকে আমাদের জানালা দিয়ে দেখার কোন

সুযোগ নেই আর।

এ্যামি হও, বা কমলা হও

কিংবা হতে পারো মাধবীকুট্টি।

একটি নাম, একটি চরিত্র বেছে নেয়ার

এখনি সঠিক সময়।

অভিনয়ের খেলা চলবে না,

চলবে না কোন সিজোফ্রেনিয়ার ভাণ,

হতে পারবে না তুমি যৌন-পিপাসু নারী।

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হতাশ তুমি,

উঁচু গলায় কাঁদতে মানা তোমার।

আমি দেখা পেলাম তার, এক পুরুষ সে,

ভালোবাসলাম তাকে, একটি নামকে নয়,

সে প্রতিটি পুরুষ, যে চায় নারীকে,

যেমন আমি, এক নারী,

যে চায় ভালোবাসা,

যে প্রতিটি নারীর ছবি।

সে, ক্ষুধার এক ক্ষিপ্র নদী

আমি, অপেক্ষার অবিশ্রান্ত সাগর নিরবধি।

আমি তোমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করি, তুমি কে?

উত্তরে বলবে, এটা আমি।

আমি দেখি যারাই নিজেদেরকে আমি বলে

সকলেই বন্দী এই বিশ্বে

যেমন তলোয়ার থাকে নিজের খাপে।

এই আমি ই কোন এক অজানা শহরে

রাতের আঁধারে, পানীয় হাতে দাঁড়িয়ে থাকি

একা, সম্পূর্ণ একা, রাত ১২টার পরে।

আমিই হাসি,

আমিই ভালোবাসি শরীরে সজোরে,

পড়ি চরম লজ্জায়,

আমি পড়ে থাকি মরণ বিছানায়

গলায় ঘর্ঘর শব্দ।

আমি পাপী, আমি পির,

আমি প্রিয়তম, আমি প্রতারিত।

কোন উল্লাস তোমায় না ছুঁলে

তা আমার ও নয়,

কোন বেদনা তোমায় না ছুঁলে

তা আমার ও নয়।

আমি ও নিজেকে আমি বলি।

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here