লোকায়ত রীতির গান

ছবি : গণেশ পাইন

রাজু অনার্য মূলত কবি; বেশ কিছু নজরকাড়া গল্প লিখেছেন। তাঁর আরেক ভালোবাসার অধ্যায় লোকায়ত ধারার গান। লালন, হাসন রাজা, আবদুল করিম প্রমুখের কাব্য ও সংগীত ধারায় রাজু অনার্যের গান বিস্ময়-জাগানিয়া। তার গানের ভাণ্ডার থেকে কিছু গান উপস্থাপন করা হল সহজিয়ায়।

 

শুদ্ধ সুপথ তুমিই দেখাও আবার কুপথে করাও ভুল
ভাল মন্দ সবই তোমার, আমি তোমার খেলার পুতুল।।

 

তোমার হুকুম ছাড়া গাছের পাতা দেয়না গো সাড়া
পশু-পাখি কেউ ডাকে না, ফোটে না বাগানের ফুল।।

 

মওলা তুমি দিলে ইশারা জন্মিল ইসা পিতা ছাড়া
আবার ভাসাইয়া নবী ইউনুসেরে তুমিই দিলা কূল।।

 

গড়াইয়া বেহেস্ত মনোহরা দরজাতে করিয়া খাড়া
সাদদাতেরও প্রাণ কাড়িলা নড়িল না একচুল।।

 

শিক্ষা বিধান দিয়া শেষে মকরমকে এক আদেশে
ঘুরাইছো শয়তানের বেশে করাইতে মানুষের ভুল।।

 

অধম রাজু ভেবে কয় পাপ-পূণ্য তো আমার নয়
ভক্তি জানাই তোমার দরবারে মওলা করিও কবুল।।

চালাবি যদি হাওয়ার গাড়ি ঠিক সাইডে থাক
জ্ঞানেন্দ্রিয় অন্তঃচক্ষু সদায় সজাগ রাখ ।।

 

ওরে তারাহুরা করিস না তুই, ও
তোর ধৈর্য ডুরি হাতে রাখ
আসার বেলা বাম সাইড নে
যাইতে গাড়ি ডাইনে রাখ।।

 

আসা যাওয়ায় চক্করে কি করে ব্রহ্মদ্বারে
না খুললে তার কপাট
ও তার বদ্ধ কপাট খুলতে চাইলে
সুষুম্নাতে বসে থাক।।

 

মূলাধার গঞ্জের শেষে যদি চন্দ্র-সূর্য মিশে
খুলে দেয় পথের কপাট
অধীন রাজু বলে দয়াল গুরুর কৃপা হইলে
মিলবে অধর ধরার ঘাট।।

গরল রস পাশ কাটিয়ে অমৃত পান জানতে হয়
একই ভাণ্ডে বিষ ও মধু রাইখাছেন সাঁই দয়াময় ।।

 

অলিকুল দলে দলে বসিয়া বিষে ভরা ফুলে
ফুল হইতে নেয় যে সুধা বিষে তার হয় না ক্ষয় ।।

 

মাছরাঙা বসিয়া ধ্যানে চোখ তার মাছ সন্ধানে
ঝাপুই দিয়া শিকার ধরে পানি তার লাগে না গায় ।।

 

শুদ্ধ রসের রসিক যারা অমৃত পান করে তারা
পাশ কাটিয়ে বিষের নহর বিষ তারা পায় না ভয় ।।

 

ব্রহ্মদ্বারকে সজাগ রেখে ঘাটে গেলে ভাটার যোগে
রাজু কয় গুরুর কৃপায় ঘোলা জলে মাছ ধরা যায়।।

করণ ছাড়া নামিস না তুই বাবার পুকুরে
তার বাঁধা ঘাটে ফণা তুলে কাল নাগিনী বেড়ায় ঘুরে।।

 

তল ছাড়া সে পুকুর ঘাটে জল কভূ শুকায় না মোটে
দিবা নিশি জলের যোগান তিনটি কূপে দেয় তাহারে।।

 

মাসে মাসে জোয়ার এসে পুকুর যখন যায় গো ভেসে
ভাটার কালে খেলা করে মীন রূপে সাঁই পরোয়ারে।।

 

চেতন গুরুর সঙ্গী যারা তার রূপ দেখে হয় মাতোয়ারা
অলিয়ম সাধনা বলে সে মাছ মাথায় ধারণ করে ।।

 

বরশি গেঁথে অনুরাগে বারো মাসে বারো যোগে
ঘাটে যায় গুরুর সঙ্গে রাজু কয় সেইতো অধর ধরে।।

 

রূপ ছাড়া ভজলে কী আর অরূপ ধরা যায়
যেমনে আশা করে সেইরূপে সে ধরা দেয়।।

 

অরূপের রূপ মনোহরা, রসময় সে রসভরা
দেখলি হবি পাগলপারা, অধর যদি ধরা দেয়।।

 

ধ্যান-জ্ঞানের ঘোরে, একবার রূপ দেখিলে রে
শমন জ্বালা তার থাকেনা, দিব্যকান্ত জ্যোতি হয়।।

 

অরূপ কেমন রূপটি ধরে তালাস কর সতী মা’রে
একান্নপীঠে একান্ন রূপ ভক্তকে মা দেখা দেয়।।

 

রূপ ভজিয়া চণ্ডীদাসে বাসুলীরে পাইয়া শেষে
ধোপীর দঃখে মরল হেসে আত্মায় আত্মা মাখা রয়।।

 

মিছামিছি তর্ক করে বৃথাই মানুষ মরছে ঘুরে
রাজু বলে মানুষে দেখ আসল মানুষ রসময়।।

জানিয়া নারীতত্ত্ব সাধনায় হওগা মত্ত
ত্রিবেণীতে তিনটি ধারা বইছে নিরবধি
ও তার প্রেম সাধনে সাধক হইবি যদি।।

 

জেনে কর নারী সঙ্গ, নারী হয় অমৃতের কুম্ভ
না জানিলে অপঘাতে প্রাণ যে হারাবি।
নারীতত্ত্ব জানতে পেরে ভোলাদেব মহেশ্বরে
নারীর চরণ নিছে বুকে দেখ কেমন ছবি।।

 

একটা নদীর তিনটি ধারা, দুইটি তাহার বিষে ভরা
মাঝ নদীতে মধুর নহর খাচ্ছে কেমন খাবি।
নেমে তার শুদ্ধ জলে ঝাপুই দিয়া স্নান করিলে
মানুষ রূপের কলেবরে দিব্য কান্তি পাবি।।

 

মনে থাকলে কামকুম্ভীর মার অনুরাগের তীর
সদায় সঙ্গের সঙ্গি বানাও চেতন গুরুর ছবি।
তৈয়ব চান্দের চরণ তলে ভক্তি দিয়া রাজু বলে
শুদ্ধ রসের রসিক হইলে দেখতে তারে পাবি।।

দেখনা ডুবে প্রেম সাগরে সেথায় কী ধন আছে
উপরে শেওলা ঝাঁজি, অতলে মনি মুক্তা রয়েছে।।

 

প্রেমের নিগুঢ় তত্ত্ব জেনে ব্রজ বালা গোপীগণ
কৃষ্ণ গুরুর পদে দিল কূল শীল মান বিসর্জন
জন্মের মতো মন মজায়ে দাসী হয়ে গিয়েছে।।

 

শুদ্ধ প্রেমে মন মজালে তার কি আর হয়রে মরন
চণ্ডাল পুত্র রুহিদাসে করছিল যে প্রেমের করণ
ও তার প্রতি লোকমায় স্বর্গপুরে ঘণ্টাধ্বনি বেঁজেছে।।

 

গুরুর কাছে প্রেম কি জেনে পঞ্চ রস ছেনে খাও
হিংসা, নিন্দা, লজ্জা, ঘৃণা মন থেকে দূরে সরাও
রাজু কয় এবার দুনিয়া খুঁজো মুর্শিদের রূপের মাঝে।।

শিকলে না বান্ধিয়া তোরে রাখিলাম হৃদয় পিঞ্জরে
দাগা দিয়া সেই অন্তরে দিলিরে তুই ফাকি
বড় বেঈমান পাখি রে তুই বড় বেঈমান পাখি।।

 

আসিয়া বসন্তকালে বসিয়া প্রেম বৃক্ষের ডালে
নাচে গানে মন কারিলি, করিয়া ডাকাডাকি
তোর প্রেমেতে দিয়া সাড়া, হইলাম আমি কূলহারা
কলঙ্কিনী নাম লইয়া কেন্দে ভাসাই আঁখি।।

 

সাজাইয়া বুকের পাঁজরে মাখাইয়া সোহাগ আদরে
ছোলা ছাতু যতন করে তোমার তরে রাখি
হাসি হাসি মুখে আসিয়া ভালবাসি বাসি কইয়া
বুকেতে মারিলি ছোরা বিচ্ছেদের বিষ মাখি।।

 

বান্ধিলাম হিয়াতে ঘর, পাখিরে তুই বসত কর
ভাসাইলি দুঃখের সাগরে ঘরের বেড়া কাটি
রাজু কয় তোর পিরীতে মজিয়া আত্মাতে আত্মা মিশাইয়া
আশা ছিল জনম জনম জোড়া বেন্ধে থাকি।।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here