নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান।
প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান
চার
ওইউয়োর আনিয়ুম্বা, তাবান লো লিয়োং এবং আমি, আমরা তিনজন প্রভাষক আমাদের প্রত্যাখ্যান ও দৃঢ়োক্তির বিষয়ে ছিলাম খুবই জোরালো। আমাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল :
আমরা ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাধান্যকে প্রত্যাখ্যান করছি। সংক্ষেপে আমাদের লক্ষ্য হলো প্রথমে কেনিয়া, তারপর পূর্ব আফ্রিকা আর তারপর আফ্রিকাকে আমাদের কেন্দ্রে পরিণত করা। বাকি সবকিছুই বিবেচিত হবে আমাদের পরিস্থিতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ও আমাদেরকে বুঝার ক্ষেত্রে তাদের অবদানের প্রক্ষিতে… এর মাধ্যমে আমরা অন্যান্য, বিশেষত পশ্চিমা ধারাকে প্রত্যাখ্যান করছি না। একটি আফ্রিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি ও সাহিত্যবিষয়ক পাঠদান কোন পথে ও প্রেক্ষাপটে চলা উচিত, আমরা শুধু সেই পথটাই নির্দেশ করছি।৬
আমরা একটি নতুন নীতিমালা প্রস্তাব করেছিলাম যেখানে পাঠদান করা হবে কেনিয়ান ও পূর্ব আফ্রিকান সাহিত্য, আফ্রিকান সাহিত্য, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য এবং পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্য। আমরা উপসংহারে বলেছিলাম :
আমরা বিভাগে আফ্রিকান কেন্দ্রিকতা স্থাপন করতে চাই। এই বিষয়টি অনেকগুলো দিক থেকেই যৌক্তিক। এর অন্যতম হলো শিক্ষা আসলে আমাদের নিজেদের বুঝতে পারার উপায়। নিজেদের সম্পর্কে বুঝতে পারা সম্পন্ন হলে আমরা বাইরের দিকে দেখি এবং আমাদের চারপাশের মানুষ ও বিশ্বকে বুঝতে যাই। আফ্রিকাকে সবকিছুর কেন্দ্রে রাখা হলে আমাদের সবকিছুই দেখতে হবে আফ্রিকান প্রেক্ষাপটে, কোনভাবেই অন্য দেশের বা সাহিত্যের উপাঙ্গ বা উপগ্রহ হয়ে থেকে নয়।৭
কিন্তু আমাদের সবচেয়ে সাহসী আহ্বান ছিল জাতীয় প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে মৌখিক সাহিত্যকে (ওরাটিউর) স্থান দেয়া :
মৌখিক সাহিত্য প্রাচুর্যপূর্ণ এবং বহুমুখী… এই শিল্প মরে যায়নি; এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য… মৌখিক সাহিত্যের সাথে ঘনিষ্ঠতা নতুন গঠন ও কৌশলের পথ দেখাতে পারে; আর পারে লালন করতে চিন্তাগত দৃষ্টিভঙ্গি, যা গঠিত হবে নতুন ধরনসমূহের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ইচ্ছা থেকে… এভাবে আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যে মৌখিক ঐতিহ্যের অধ্যয়ন হতে পারে একটি পৃথক সংযোজন (পরিবর্তন নয়)। দেশজ মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য আবিষ্কার ও ঘোষণার মাধ্যমে এই নতুন সাহিত্য এক দিকে সেই ধারার দিকে এগিয়ে যাবে যা একে ধারণ করে, তাই একে উৎসাহ দেয়া উচিত; অন্যদিকে এর ফলে নিজের শেকড় না হারিয়েই অন্যান্য চিন্তাকে গ্রহণ ও অঙ্গীভূত করা সম্ভব হবে।৮
কৃষক সমাজের জীবনের ভেতর ওরাটিউরের শেকড় প্রোথিত। এগুলো প্রাথমিকভাবে তাদেরই রচনা, তাদেরই গান আর তাদেরই শিল্প, যেগুলো ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক কালে জাতীয় ও প্রতিরোধী সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। আর আমরা তিনজন প্রভাষক আহ্বান জানাচ্ছিলাম সাহিত্য ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহ্যের প্রতি কেন্দ্রিকতার।
পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি লম্বা বিতর্কে গ্রাস করে – একবার যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯৬৯ সালের পূর্ব ও কেন্দ্রীয় আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাইরোবি কনফারেন্স অব ইংলিশ অ্যান্ড লিটারেচার ডিপার্টমেন্টস-এর সকল অংশগ্রহণকারীরাও-পাঠ্যক্রমের নীতিমালাটি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রাসঙ্গিকতা, সম্পর্ক ও প্রেক্ষাপটের ক্রমে আফ্রিকান ওরাটিউর; আফ্রিকানদের লেখা মহাদেশীয়, ক্যারিবিয়ান ও আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্য; এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ‘তৃতীয়’ বিশ্বের সাহিত্য; ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ বাকি বিশ্বের সাহিত্য দ্বারা নতুন সাহিত্য পাঠ্যক্রমের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল যেখানে ইংরেজি ছিল মধ্যস্থতাকারী ভাষা। ১৯৬৮-৬৯ সালের বিতর্ক থেকে তৈরি হওয়া পাঠ্যক্রম আদতে ছিল এক ধরনের আপোস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পূর্ব আফ্রিকান কবিতাগুলোকে এতে শেখানো হতো ইউরোপিয়ান প্রেক্ষাপটে। ১৯৭৩ সালের পরে বিভাগের অধিকাংশ কর্মী হিসেবে ছিলেন আফ্রিকানরা। আর তখন থেকেই এই পাঠ্যক্রমের নতুন প্রেক্ষাপট দক্ষতার সাথে প্রতিফলিত হওয়া শুরু হয়, এর আগে এটি চলেছিল কোন প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই।
নিজেদের পরিবেশ থেকে শুরু করার এই পদক্ষেপের ফলে ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবির সাহিত্য বিভাগ এমন সব শিক্ষার্থী তৈরি করেছিল যারা গার্সিয়া মার্কেজ, রিচার্ড রাইট, জর্জ ল্যামিং, বালজাক, ডিকেন্স, শেক্সপিয়ার এবং ব্রেখটের চেয়ে কেনিয়ান ও আফ্রিকান সাহিত্যের সাথে তাদের গ্রামীণ ও শহুরে অভিজ্ঞতাকে বেশি সংযুক্ত করতে পারতেন। আর এটি ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাদের গ্রামে জেন অস্টিনের চরিত্রগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টার চেয়ে অনেক দূরের একটি বিষয়।
বিশ্ব সাহিত্যের অপরিমেয় মূল্য সম্পর্কে সচেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগও জাতীয় স্বাদেশিকতাকে বিদ্যমান পাঠ্যক্রমের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উগ্র স্বার্থের জন্যে জায়গা করে দিতে চায়নি। একজন কেনিয়ান শিশুকে বিশ্বসাহিত্য ও তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
পাঁচ
কিন্তু এটিই নাইরোবি লিটারেচার ডিবেটের সমাপ্তি ছিল না।৯ নাইরোবি স্কুলে ১৯৭৪ সালে ‘দ্য টিচিং অব আফ্রিকান লিটারেচার ইন কেনিয়ান স্কুলস’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবির সাহিত্য বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইংরেজি বিষয়ক পরিদর্শন বিভাগ। এতে অংশ নিয়েছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাহিত্য ও ইংরেজির দুইশ শিক্ষক; ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবি ও কেনিয়াত্তা ইউনিভার্সিটি কলেজের সাহিত্য বিভাগের কর্মী ও শিক্ষকগণ; দার এস সালাম, মাকারেরে ও মালাউই ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধিগণ; ইংরেজি বিষয়ক পরিদর্শন বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কেনিয়া ইন্সটিটিউট অব এডুকেশনের প্রতিনিধিগণ; তানজানিয়া ও উগান্ডার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষকগণ; ইস্ট আফ্রিকান কমিউনিটি, ইস্ট আফ্রিকান এক্সামিনেশন কাউন্সিল, ইস্ট আফ্রিকান লিটারেচার ব্যুরোর প্রতিনিধিগণ; কেনিয়া ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব টিচার্স (কেএনইউটি) এর ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিগণ; এবং চারটি প্রকাশনা সংস্থা, জোমো কেনিয়াত্তা ফাউন্ডেশন, ইস্ট আফ্রিকান লিটারেচার ব্যুরো, ইস্ট আফ্রিকা পাবলিশিং হাউজ ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। একে আরও বেশি ও প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার জন্যে এতে অংশ নিয়ছিলেন মোনা ও জ্যামাইকার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নাইজেরিয়ার ইউনিভারর্সিটি অব ইফে এবং নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সফরকারী প্রতিনিধিরা। এই আকর্ষণীয় জমায়েতটি ছিল এদাহ গাচুকিয়া ও এস. এ. আকিভাগার সভাপতিত্বে স্টিয়ারিং কমিটির দারুণ সাংগঠনিক প্রচেষ্টার ফল।
এই সম্মেলন স্পষ্টতই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল সেই একই প্রাসঙ্গিকতার সন্ধানে যার ফলে পূর্বে সাহিত্য বিভাগের পুনর্গঠন হয়েছিল। সম্মেলন থেকে নির্বাচিত ওয়ার্কিং কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছিল :
স্বাধীনতার আগে কেনিয়ায় শিক্ষা ছিল ঔপনিবেশিক নীতিমালার একটি হাতিয়ার যার দ্বারা কেনিয়ার মানুষদের উপনিবেশিত হিসেবে নিজেদের ভূমিকাকে গ্রহণ করতে শিক্ষা দেয়া হতো। স্বাধীনতার সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থাও আসলে ছিল ঔপনিবেশিকতারই উত্তরাধিকার, এ কারণেই সাহিত্যের পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল ইংরেজ শিক্ষকদের দ্বারা পাঠদানকৃত ইংরেজি সাহিত্যিক ঐতিহ্য। এই ধরনের একটি পরিস্থিতির অর্থই হলো একটি স্বাধীন আফ্রিকান দেশে থাকা কেনিয়ান শিশুদের তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা।১০
ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয়ে সম্মেলনের শেষে অনুমোদিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল :
দেশের প্রয়োজনের সাপেক্ষে বর্তমান ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ্যক্রম যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক নয়। এটি এমনভাবেই সংগঠিত যার ফলে একজন কেনিয়ান শিশু নিজেকে জানতে পারে লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত বিদ্যালয় থেকে এসব বিষয়ের রাশ সম্পূর্ণভাবে টেনে ধরা উচিত।১১
সমাজে সাহিত্যের ভূমিকা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানকৃত সাহিত্যগুলোর প্রকৃতি পরীক্ষণ এবং কেনিয়ার বর্তমান সময়ের চাহিদা নিরূপনের লক্ষ্যে আয়োজিত এই সম্মেলন থেকে সমসাময়িক সাহিত্যের উড্ডয়নের ভিত্তি হিসেবে মৌখিক সাহিত্যকে কেন্দ্র হিসেবে ধরার ডাক দেয়া হয়। তাঁরা বলেছিলেন একটি যথাযথ শিক্ষানীতিই পারে প্রথমত, শিক্ষার্থীদের তাদের নিজেদের সমাজের পরিবেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন এবং দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সমাজের পরিবেশ ও সংস্কৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক নিরূপনে। “আফ্রিকান সাহিত্য, আফ্রিকান ডায়াসপোরার সাহিত্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাগুলোর অন্যান্য সাহিত্যকে অবশ্যই পাঠ্যক্রমের মূল বিষয় হতে হবে।”১২ সম্মেলনের প্রস্তাবে উল্লিখিত নীতিমালার সাথে কনফারেন্স থেকে সভাপতি হিসেবে ডুগাল ব্ল্যাকবার্ন ও সচিব হিসেবে আর. গাচেচেকে নিয়ে গঠিত একটি ওয়ার্কিং কমিটি নীতিমালা ও পাঠ্যক্রম বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল। টিচিং অব লিটারেচার ইন কেনিয়া সেকেন্ডারি স্কুলস- রিকমেন্ডেশনস অব দ্য ওয়ার্কিং কমিটি শীর্ষক ৭৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটি ছিল মাসের পর মাসব্যাপী চলমান কঠোর পরিশ্রম ও অঙ্গীকারের ফলাফল।
দশ বছর পর প্রতিবেদনটিতে চোখ বুলালে যে কেউ থমকে যাবে। এই থমকে যাওয়া তাদের বিদ্যমান পাঠ্যক্রমের সমালোচনা কিংবা পরিবর্তনের জন্যে তাদের বিস্তারিত প্রস্তাবসমূহের জন্যে নয়, যদিও আজও এই বিষয় ও বিতর্কগুলো আকর্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক। এই থমকে যাওয়ার কারণ হলো এই সমালোচনা ও প্রস্তাবের পেছনে কাজ করা সচেতনতা।
প্যান-আফ্রিকান সচেতনতা বেশ শক্তিশালী। লেখকগণ আফ্রিকাকে একক সত্তা হিসেবে দেখেন আর একে সাব-সাহারান আফ্রিকা (কালো আফ্রিকা; আসল আফ্রিকা) ও উত্তর আফ্রিকা (আরবি; বিদেশি; ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকা) হিসেবে ভাগ করাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা চান একজন কেনিয়ান শিশু পরিচিত হবে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার সাহিত্যের সাথে :
আধুনিক উত্তর আফ্রিকা ও মহাদেশের অন্যান্য অংশের সাহিত্যে শতাব্দী প্রাচীন আরব সভ্যতার দারুণ প্রভাব দেখা যায়। সাহিত্যে তাদের এই প্রভাব এখন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাবিদদের দ্বারা অস্বীকৃত এবং উত্তর আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের সাহিত্য মূলত উপেক্ষিত।১৩
লেখকগণ পৃথিবীর চার কোণের সাথে আফ্রিকার সম্পর্ক জারি রাখতে চান। তাঁরা মূলত চান কেনিয়ান শিশুরা যেন জীববিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সংযোগ ও সংগ্রাম, বিশেষত আফ্রো-আমেরিকান ও ক্যারিবিয়ান সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয় :
প্রায়ই জানতে চাওয়া হয়, ক্যারিবিয়ান ও আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্য কেন অধ্যয়ন করবো? আফ্রিকার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা আফ্রো-আমেরিকানের সম্পর্ক কী?
ক) আমাদের রয়েছে একই জীব-ভৌগলিক শেকড়: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফ্রো-আমেরিকার মানুষরা আসলে আফ্রিকান যাদেরকে কয়েক শতাব্দী আগে নির্মমভাবে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
খ) দাসত্ব ও ঔপনিবেশিকতার অধীনে আমরা একই অপমান ও শোষণের অতীত ধারণ করি। এসব শক্তির বিরুদ্ধে মহিমান্বিত সংগ্রাম ও যুদ্ধের একই অভিজ্ঞতাও আমাদের এক করে।
গ) সমানভাবে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, সারা পৃথিবীর সকল কালো মানুষের সম্পূর্ণ মুক্তির জন্যে আমাদের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
আমাদের সাহিত্যের মতো তাদের সাহিত্যও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্যে আমাদের সংগ্রামের একই বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে।
এছাড়াও, আফ্রিকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষের পেছনে আফ্রিকান ডায়াসপোরার সদস্যদের অবদান রয়েছে। ব্লাইডেন, সি. এল. আর. জেমস, জর্জ প্যাডমোর, ডব্লিউ. ই. ডুবোইর, মারকাস গার্ভি এবং আরও অনেকে ছিলেন স্বাধীনতার জন্যে আফ্রিকানদের সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফ্রো-আমেরিকার সাহিত্যিক আন্দোলনগুলো আফ্রিকার সাথে সৃজনশীলভাবে মিথষ্ক্রিয়া করেছে। আইমে সিজেয়ার, ফ্রানজ ফানো, ক্লড ম্যাককে, ল্যাংস্টোন হিউস, লিওন দামাস, রেনে দেপেস্ত্রে, পল রবসন – সংস্কৃতি ও কলার ক্ষেত্রে এসব বড় বড় মানুষ আফ্রিকান সাহিত্যের উৎকর্ষে ইতিবাচক অবদান রেখেছেন।
তৃতীয় বিশ্ব তথা এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও এসব কথার অধিকাংশ সমানভাবে কার্যকর।১৪
আফ্রিকা; আফ্রিকান সম্পর্ক; তৃতীয় বিশ্ব; অর্থাৎ প্রতিবেদনটির লেখকগণ জাতীয় অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ছিলেন খুবই সচেতন। বিশ্ব সাহিত্যের অপরিমেয় মূল্য সম্পর্কে সচেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগও জাতীয় স্বাদেশিকতাকে বিদ্যমান পাঠ্যক্রমের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উগ্র স্বার্থের জন্যে জায়গা করে দিতে চায়নি। একজন কেনিয়ান শিশুকে বিশ্বসাহিত্য ও তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
প্রতিটি ভাষার রয়েছে তার নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি। আর মানসিক বিষয়াদি ও মূল্যবোধ বিচারে সক্ষম হয়ে উঠতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থীদের একান্ত পরিবেশ থেকে শুরু করে বিশ্বমুখী হওয়ার পাঠদানের নীতিমালার সাথে সাথে, বিদ্যালয়গুলোতে অ-আফ্রিকান সাহিত্য পাঠদানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কেনিয়ান শিক্ষার্থীদেরকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কালোদের অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। এ ধরনের অধ্যয়নে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান সাহিত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত কালো মানুষের সমাজ ও সাহিত্যে এগুলোর ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রভাব বর্ণনাসহ। সাথে সাথে লাতিন আমেরিকা ও এশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাহিত্যও অধ্যয়ন করতে হবে। সাহিত্যিক বিশিষ্টতা, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও আখ্যানের প্রতি আগ্রহের ভিত্তিতে ভারসাম্য আনাই হতে হবে নির্বচনের মাপকাঠি। এর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ভেতর সাহিত্যের প্রতি ক্রিটিক্যাল ভালোবাসা সঞ্চারিত করা যা পরবর্তী বছরগুলোতেও তাদের অনুসরণ করবে এবং এই অনুসরণ ফলদায়ক কাজে ব্যয়িত হবে তাও নিশ্চিত করা… কেনিয়ান সমাজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আমরা সুপারিশ করছি একটি পরিবর্তনশীল সমাজের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরা হয় এমন সাহিত্যের দিকে মনোযোগ দিতে, আরও নিশ্চিত করতে হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলোর অভিজ্ঞতা যেন এসব সাহিত্যে উঠে আসে।১৫
বিশ্বসাহিত্য পাঠদানের ব্যপারে তাঁদের সুপারিশগুলো ভাষা প্রশ্নের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। এতে ছিলেন তলস্তয়, গোগল, গোর্কি, দস্তয়েভস্কি (রুশ); জোলা, বালজাক, ফ্লবার্ট (ফরাসি); ইবসেন (নরওয়েজিয়ান); ফকনার, আর্থার মিলার, আপটন সিনক্লেয়ার, হেমিংওয়ে (আমেরিকান); ডিকেন্স, শেক্সপিয়ার, কনরাড, ইয়েটস, সিং (ব্রিটিশ ও আইরিশ); মান ও ব্রেখটের (জার্মান) মতো লেখকগণ। তাঁরা ইংরেজি ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বা অবশ্যম্ভাবীতা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু একই সাথে তাঁরা সকল বিদ্যালয়ে সোয়াহিলি ভাষা বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানান, বিশেষত ইংরেজি, সাহিত্য ও নাটকের শিক্ষার্থীদের জন্যে, সোয়াহিলি সাহিত্যের একটি স্পষ্ট কর্মসূচি বিদ্যালয়গুলোতে শুরু করতে হবে ও করতে হবে বাধ্যতামূলক।
প্রতিটি ভাষার রয়েছে তার নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি। আর মানসিক বিষয়াদি ও মূল্যবোধ বিচারে সক্ষম হয়ে উঠতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেহেতু আমরা ইংরেজির ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছি এবং তা একটি দীর্ঘ সময়ের জন্যে, আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তির শক্তি ও গভীরতা নির্ভর করবে আফ্রিকান সংস্কৃতির সাথে যোগসূত্র আছে এমন কোন ভাষায় এর অর্থবোধকতা সংরক্ষণের মাধ্যমে। সোয়াহিলি ভাষার কেনিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করতে হবে এবং তাই এখন পর্যন্ত এর উপর যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে।
এই লক্ষ্যপূরণের জন্যে একটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হতে পারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সোয়াহিলি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান।১৬
সূত্র ও টীকা
৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৬ —লেখক
৭ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫০ —লেখক
৮ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৮ —লেখক
৯ বিতর্ক ও কনফারেন্সটি পরবর্তীতে বিদ্যায়তনিক অভিসন্দর্ভের বিষয়েও পরিণত হয়েছিল— এজন্যে দেখা যেতে পারে, অ্যানে ওয়ামসলি, লিটারেচার ইন কেনিয়ান এডুকেশন— প্রবলেমস অ্যান্ড চয়েজেস ইন অথর অ্যাজ প্রোডিউসার স্ট্র্যাটেজি, স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভ, সাসেক্স ইউনিভার্সিটি—লেখক
১০ ওয়ার্কিং কমিটির সুপারিশ, পৃ. ৭ —লেখক
১১ পূর্বোক্ত, পৃ. ৮ —লেখক
১২ পূর্বোক্ত, পৃ. ৮ —লেখক
১৩ পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৯ —লেখক
১৪ পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১-২ —লেখক
১৫ পূর্বোক্ত, পৃ. ৭০-১ —লেখক
১৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ২১ —লেখক
পড়ুন ।। কিস্তি : ১৩