ভাষার মৃত্যু বলতে কী বোঝায়? যখন কোনো ভাষার আর ব্যবহারকারী থাকে না, এমনকি কেউ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও সেটি ব্যবহার করে না, তখন বলা হয় ওই ভাষার মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীতে প্রতি চোদ্দ দিনে গড়ে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে। এভাবে ২১০০ সালের মধ্যে বর্তমানের সাত হাজার ভাষার অর্ধেকের বেশি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
উদ্ভিদের প্রাণ আছে এটি জানা গেছে একশ বিশ বছর আগে। ভাষারও প্রাণ আছে, এটি এখন স্বীকার করে নেওয়া হয়। উদ্ভিদের মৃত্যু আছে; ভাষারও মৃত্যু হয়। উদ্ভিদ যেমন সারাজীবন বৃদ্ধি পেতে থাকে, ভাষাও তেমনি তার জীবদ্দশাকালে পরিবর্তিত হয়ে চলে। এত কথা বলার কারণ — উদ্ভিদের মৃত্যুকে আমাদের মেনে নিতে হয়; তেমনি, ভাষার মৃত্যুকেও মেনে নিন।
বাংলাদেশে বাংলার বাইরে আরও ৩৯টি ভাষা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পারস্পরিক যোগাযোগে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। এগুলো হলো কোডা, কন্দ, কোল, খাড়িয়া, খিয়াং, খুমি, পাংখোয়া, পাত্র, চাক, মালতো, মুন্ডা, রেংমিটচা, লুসাই ও সৌরা। এসব ভাষা ব্যবহারকারী লোক কয়েক বছর পরে পাওয়া যাবে না। এসব বিপন্ন ভাষা বাঁচিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। বড়জোর ভাষা-জাদুঘরে রাখা যায়।
ভাষার প্রয়োগকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কোনো ভাষার যদি দীর্ঘ চলার ইতিহাস থাকে, তবে ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছুর অবসান হয়।
বিপন্নপ্রায় প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরিবেশবাদীদের চিন্তা করতে দেখা যায়। একইভাবে বিপন্নপ্রায় ভাষাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই পরিকল্পনার কথাও কেউ কেউ বলেন। পরিকল্পনার একটি অংশ ওই ভাষার লিখিত সাহিত্য সংগ্রহ করা এবং তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাঠপর্যায়ে গিয়ে ওই ভাষা সংগ্রহ করে ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণ প্রণয়নের কথাও বলা হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মৃতপ্রায় ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করার কথা বলা হয়। কিন্তু এভাবে জোর করে অডিও, ভিডিও ও প্রিন্ট মাধ্যমে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। বিশেষ করে ভাষা-ব্যবহারকারীর সংখ্যা যদি কমে আসে, তবে কোনো উপায়ই আর থাকে না।
ভাষা বেঁচে থাকে মূলত মানুষের মুখে। ভাষিক যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যমের মধ্যে মৌখিক রূপটি সবচেয়ে শক্তিশালী। আর ভাষাকে দীর্ঘ মেয়াদে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে ভাষার লিখিত রূপ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি শিক্ষার্থীকে চূড়ান্তভাবে বাংলাতেই সব বিষয়ের পাঠগ্রহণ করতে হয়। আসলে, বিদ্যালয়ে আসার আগেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশু দ্বিভাষিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশে চাক, চাকমা, ত ঙ্গা, মারমা, মৈতেয় মনিপুরি, ম্রো ও রাখাইন ভাষার নিজস্ব লিপি ও বর্ণমালা আছে। বাকি বেশিরভাগ ভাষায় লেখার মাধ্যম বাংলা বর্ণ অথবা রোমান হরফ। অর্থাৎ চাইলেও সব ভাষায় বই প্রণয়ন করা ও পাঠদান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষে একাধিক ক্ষুদ্রভাষার শিশু থাকতে পারে। ফলে, একজন শিক্ষকের পক্ষে একাধিক ভাষায় একসঙ্গে পাঠদান করা প্রায় অসম্ভব।
রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবে একটি ভাষা সংকুচিত হতে পারে। যেমন, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে স্থানীয় ভাষা সংকুচিত হয়েছে; আর হিস্পানি ও পর্তুগিজ বড় জায়গা করে নিয়েছে। একইসঙ্গে দুটি ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন, আলজেরিয়ায় একইসঙ্গে আরবি আর ফরাসি চলছে। আবার একটি ভাষা থেকে আরেকটি ভাষা জন্মও নিতে পারে। যেমন, ষোলো শতকে বাংলা ভাষা থেকে জন্ম নিয়েছে অসমিয়া ভাষা।
ভাষার প্রয়োগকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কোনো ভাষার যদি দীর্ঘ চলার ইতিহাস থাকে, তবে ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছুর অবসান হয়। যেমন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই ভাষার জাতিগত ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাভ নেই।
আপনার বক্তব্য মেনে নিলাম। আমার প্রশ্ন এর পরের অংশে। ভাষার প্রয়োগ বলতে কী বোঝাতে চান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। এই পরিস্থিতি সম্পুর্ণ ভিন্ন। কেবল বহুভাষিক নয়, বহুসংস্কৃতির। সংস্কৃতির গতি বহুমুখী।একটা সাধারণ ঘটনা বলি। সরকারি ব্যাংকে যখন যাবেন খাগড়াছড়িতে, দেখবেন ব্যাংকের লোকজন জাতিভেদে ভাষা ব্যবহার করছে। চাকমা কর্মকর্তা চাকমার সঙ্গে চাকমা বলছেন, কিন্তু ত্রিপুরা বা মারমা গ্রাহকের সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করছেন। আবার কখনও এই গ্রাহক সহজ চাকমা বলছে চাকমা কর্মকর্তার সঙ্গে। চাকমা কর্মকর্তা আবার গ্রাহক শিক্ষিত ব্যক্তি হলে যে জাতিরই হোক না কেন, শুদ্ধ বাংলা বলেন। এই পরিমণ্ডলের চলমান বহুমুখী ভাষিক পরিস্থিতি বুঝে সমাধান পেতে আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান খুবই জরুরি। ধন্যবাদ আপনাকে এদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।
“ভাষার প্রয়োগকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কোনো ভাষার যদি দীর্ঘ চলার ইতিহাস থাকে, তবে ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছুর অবসান হয়। যেমন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই ভাষার জাতিগত ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাভ নেই।” এটি আমার একটা লেখায় উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করব।
তবে ‘ভাষার মৃত্যুকে মেনে নিন’ বাক্যটি সাংঘাতিক অর্থবহ এবং ভয়াবহো বটে। আমার মন্তব্য হলো কোন ভাষা শুধু ঐ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্পদ নয় , তা মানব জাতির সম্পদ। এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মানব জাতির দায়িত্ব। যে দেশে ঐ ভাষা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে সেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাঁর অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা। ভাষা যাদুঘর সৃষ্টি করা যেতে পারে।