বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
রিয়াকে শুকনা লাগছে। জার্নি করে এসেছে এটাও একটা কারণ হতে পারে। বললাম, তোকে শুকনা লাগছে কেন? বলে, থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ। ও নাকি শুকাতেই চায়। কারণটা এবার বুঝেছি, আমার জামা পরে আছে সে। তাই ঢিলা হয়েছে। ও বাসায় থাকা মানে টিভির আর নিস্তার নেই। রাত নেই দিন নেই সারাক্ষণ ফুল সাউন্ডে টিভি দেখে। টিভি দেখতে দেখতে ড্রয়িংরুমেই হা করে ঘুমিয়ে থাকে। টিভি টিভির মত চলতেই থাকে। দাদির সঙ্গে এ-নিয়ে তার ঝগড়া চলতেই থাকে। আগে বাবাকে ভয় পেতো। বাবা এখন দিনদিন নরম হয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগ সে হাড়ে হাড়ে নেয়।
গোসল করে ভেজা চুলে ড্রয়িংরুমে বসা আমার একপ্রকার অভ্যাস। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে মাথা ব্যথা ধরিয়ে ফেলছে। বললাম, ‘এই রিমোট দে।’ ও নাকি একটা সিনেমা দেখে। ‘কই তোর সিনেমা?’ টিভির দিকে চোখ রেখে আমি বললাম। এখন অ্যাড হচ্ছে। অ্যাড শেষ হলে আবার ঐ চ্যানেল দিবে। আমি বেশ বিরক্ত হলাম। বিশেষ করে ওর ফাজলামিতে। রিমোট চাইলাম। ও দিবে না কেন? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি?
শোভনের প্রতি এতো ডেডিকেটেড হওয়ার কিছু ছিলো না। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলাম আমি। এই সিনেমাগুলোই আমাকে স্পয়েল করেছে।
আসলেই রিয়া সিনেমা দেখছে। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’। ম্যাক্সে এই সিনেমা যে কতবার দেখাবে। অনেকবার দেখলেও সিনেমাটা ভালো লাগে। এটা আমাকে নস্টালজিক করে দেয়। এই বয়সে রিয়ার এইসব সিনেমা দেখার মুশকিল আছে। আমার জীবনে এই ছবিগুলোর বাজে প্রভাব এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শোভনের প্রতি এতো ডেডিকেটেড হওয়ার কিছু ছিলো না। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলাম আমি। এই সিনেমাগুলোই আমাকে স্পয়েল করেছে। ট্যুর শেষ করে সবে বাসায় ফিরলো কাজল। গানটাও চমৎকার। আসলে সবকিছুর প্রোপার কম্বিনেশন হলেই এ-রকম দারুণ একটা মুভি হতে পারে। এখন কাজলের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে প্রেম। অথবা সে নিশ্চিত হয়, সে আসলে প্রেমে পড়েছে। সিনেমাটা দেখার সময় নিজেকে একদম কাজলের মত লাগে। মনে হয় আমিই সিমরান। কিন্তু জীবন মোটেই সিনেমার মত নয়। শোভন ঠিকই বিয়ে করেছে তার খালাতো বোনকে। আমি কী করছি না করছি এতে তার কী যায় আসে!
‘আমার খুদা লাগছে। আমি খামু।’ জোরেসোরে রিয়াকে শুনিয়ে আমি সোফা থেকে উঠলাম। ‘আপু প্লিজ। একটু দাঁড়া না। একসঙ্গে খামু।’ অনুনয়ের সুরে সে উত্তর দিলো।
সিমরান তার মাকে ডায়েরি পড়ে শোনাচ্ছে। কী অসাধারণ অভিনয় কাজলের। চোখ-মুখের কী চমৎকার ভঙ্গি। কী নিখুঁত অভিনয়।
চেয়ার টানার শব্দ হচ্ছে। বাবা বসেছে। আমাদের ড্রয়িংরুমে একটা সিঙ্গেল বেড ফেলা। টিভি দেখতে দেখতে কেউ শুয়ে একটু আরামও করে নিতে পারে। সেখানেই শুয়ে আছে রিয়া। ‘চল, বাবা, বইসা পড়ছে।’ রিয়া আমার পাশে এসে বসল।
রিয়ার আগমন উপলক্ষে আজ স্পেশাল রান্না। ভুড়ি রান্না করেছে মা। ডাল। ছোটো মাছের চচ্চড়ি। চিকন করে আলু কেটে রান্না করা। এটাও রিয়ার পছন্দের আইটেম। আমি আর রিয়া পাশাপাশি। হিয়া বসেছে বাবার পাশে। কথা চলছে দাদিকে নিয়ে। শেরপুরে দাদির সময় নাকি ভালই কাটছে। এরমধ্যে ঠান্ডা বাঁধিয়েছে। মা’র বিশ্লেষণ হলো, পানি বদল হয়েছে দেখে ঠান্ডা লেগেছে। হিরা চাচা আসবে বৃহস্পতিবার। দাদিকে দিয়ে যাবে। রাতে থেকে চলে যাবে শুক্রবারে। রিয়া যাবে শনিবার সকালে। মুখে চপচপ শব্দ করে খাচ্ছে রিয়া। বিরক্তিকর। খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
খাওয়ার পর বিছানায় শুইতে এতো আরাম লাগে! আহ্! আরামে চোখ বুজে আসে। ক্যালেন্ডারে লেখা দিয়া, রিয়া, হিয়া। আজ কত তারিখ? এ তো গত বছরের ক্যালেন্ডার। এখনো এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কেন? ড্রয়িং রুম থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। গান হচ্ছে মেহেন্দি লাগাকে রাখনা।
নীলাকে দেখা যাচ্ছে। বেগুনি একটা শাড়ি পরে আছে। খুব সুন্দর লাগছে। ফর্সা মেয়েদের বেগুনি রঙে মানায়। ওর কি বিয়ে হয়েছে নাকি? মনে হচ্ছে ফেসবুকে অনেকদিন দেখি না। মেসঞ্জোরে গিয়ে নক করলাম। কেমন আছো? অনেকদিন দেখি না? বিয়ে করেছো নাকি? উত্তরে হাহাহা রি-অ্যাক্ট দেয়। ট্রেনিংয়ে ছিলো। না, বিয়ে করেনি। তোমার পোস্টিং জানি কোথায়? চুয়াডাঙা। বললাম, একবার ঘুরতে যাবো চুয়াডাঙায়।
ভালো লাগছে না। মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মাঝে মাঝে এমনিতেই সব খারাপ লাগে। কারণ ছাড়াই। খুবই বিরক্তিকর। এই রোগের কোনো চিকিৎসাও নেই। বহুদিনের অবজার্ভেশনে একটা পথ অবশ্য বের করা গেছে। মনখারাপের কারণটা খুঁজে বের করাই হলো এর একমাত্র দাওয়াই। আরেকটা বিকল্প পথও আছে। যেটা করতে হবে, তা হলো, মনখারাপ হওয়ার একটা দৃশ্যমান কারণ তৈরি করতে হবে। কারণটাকে আশ্রয় করে মনকে খারাপ হতে দিতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে সান্ত্বনা অথবা যুক্তি দিয়ে মন ভালো করার চেষ্টা করতে হবে। এতে কাজ হয়। কানের ভেতরে অসচেতনভাবে পানি ঢুকে গেলে যা যা করতে হয়, ঠিক তাই। এই রোগের নাম হলো, মনের ভেতরে খারাপ লাগা ঢুকে যাওয়া।
: হ্যালো? কী করছো, তুমি?
: এই, পড়ছি, শুয়ে শুয়ে। তারপর তোমার কী অবস্থা, বলো?
: কেমন জানি ভালো লাগছে না। মাঝে-মাঝে এম্নিতেই ভালো লাগে না। কেন বলোতো? খুব খারাপ লাগছে! মেজাজ খারাপ হচ্ছে!
: হুম। বুঝছি। আচ্ছা, দিয়া, কখনো কি ভেবেছো, প্রশ্ন করেছো নিজেকে, সবসময় কেন আমরা নিজেদের ভালোলাগাতে চাই?
রিয়া রুমে এসেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে ফোন রেখে দিলাম। বললাম, ‘কাল অফিসে গিয়ে দেখা হবে। ওকে, ভালো থেকো।’ আমার পাশেই সে শুয়ে পড়েছে। ও কি শুনে ফেললো, আমি কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলছিলাম? শোভনের বিষয়টা সে জানে। এটাও জানে, এখন আর রিলেশন নেই।
রিয়া আমার চেয়ে চার বছরের ছোটো। হিয়া আবার রিয়ার চেয়ে বছর তিনেকের ছোটো। বললাম, ‘তুই আমার শ্যাম্পু দিছস! একগাদা করে দ্যাস তুই। আমারটা দিবি না। তোরটা নিয়া আসবি সাথে কইরা।’
‘একশবার দিমু। হাজারবার দিমু। তোর বিছানাডা কি আরাম রে আপু! মনে হয় ঘুমায়া যাই! দ্যাক ত জ¦র নাকি?’ কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, স্বাভাবিক। বললাম, ‘ঠান্ডা যা এখান থাইক্যা। এগুলা তর ফাইজলামি। আমি জানি।’
অনেকক্ষণ গল্প হল রিয়ার সঙ্গে। দেড়টা বেজে যাচ্ছে। আমার সঙ্গেই থেকে যেতে বললাম। বলে, না-থাক। তাহলে নাকি ঘুমই আসবে না। গল্প করে করেই রাত পার হয়ে যাবে। একবার আমি আর রিয়া গল্প করতে করতে সকাল সাতটা বাজিয়ে দিলাম। আমাদের দুই বোনের একসঙ্গে থাকা মানেই আজান শুনতে হবে। আমারই ঘুম আসছিল। বললাম, কাল অফিস আছে, ভাগ।
নাক ফুটা করেছে রিয়ার। কেমন ঘা হয়ে আছে। বিভাসের হাতে সুঁই-সুতা, আর কাঠের হলুদ স্কেল। এই লোকটাই রিয়ার নাক ফুটা করে দিয়েছে। এখন আর সে বিভাস নয়। মাঝবয়সী কালো একটা লোক। বলছে, জগতের একটা মাপ আছে। মাপ ছাড়া কিছু হয় না। এদিকে ছাতা মাথায় আমি কোথাও যাচ্ছি। একটা আমগাছের নিচে অনেক মরা পাতা। আমি আম খুঁজতে লাগলাম। একটাও পাচ্ছি না। একটা মহিলা আগেই কুড়িয়ে ফেলছে সব। খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো। যেন আমাদের গাছের আম সে কুড়াচ্ছে কেন! তার সঙ্গে ঝগড়া করছি আমি। সে আমাকে বিশ্রী গালি দিচ্ছে। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। হঠাৎ আমার হুঁশ হয় — সে কোনো মহিলা নয়। মানুষরূপী একটা ভুত। একদম নগ্ন। তেলতেলে কালো তার পাছাটা। আমাকে সে ধরতে আসছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। বাসায় এসেছি অনেকদিন পর। দেখি বিশাল একটা হাড়িতে ধান সিদ্ধ করছে দাদি। কাউকে কিছু বললাম না। এতদিন কোথায় ছিলাম বা কী সমাচার! ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরেছে দাদি। গরমে ঘামতেছে। তখন বুঝলাম আমিও নগ্ন। সারা শরীরে একটা সুতাও নেই। আমার প্রস্রাব পেয়েছে খুব। আমি প্রসাব করছি। শোভন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ওকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। যেন সবকিছুর জন্য দায়ী হলাম আমি। আমার কেমন হাসি পেলো। আমি হাসলাম। পাজামার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বললাম, বাদামী ধান খুব ভালো। বিশাল একটা অন্ধকার চেপে বসেছে আমার ওপর। একচুল নড়াচাড়া করতে পারছি না। কেমন দম আটকে আসছে। পায়ের কাছে বসে আছে একটা শিয়াল । কিন্তু সে মানুষের মত। মরার মত পড়ে আছি আমি। একটু নড়লেই আমাকে সে খেয়ে ফেলবে।
প্রস্রাবের বেগ নিয়ে ঘুম ভাঙল। একদম ঘেমে গেছি। শীত শীত লাগছিল দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়েছিলাম। ঘেমে এখন অস্থির অবস্থা। চুল পর্যন্ত ভিজে গেছে। নিজেকে কেমন পাগলি পাগলি দেখাচ্ছে। তাকাতে পারছি না ঠিক মত। চোখ জ্বলছে। বাথরুমের ফ্লাশটা শোঁ শোঁ করে পানি রিকোভার করছে। ঘুম এখনো কাটেনি। এখন বেশ আরাম পাচ্ছি। বেশি বাজে না। সাড়ে তিনটার মত বাজছে। আরও তিন ঘণ্টা ঘুমানো যাবে।
ইমরানকে অ্যাকটিভ দেখাচ্ছে মেসেঞ্জারে। ঘুমায়নি নাকি? হয়তো মোবাইল ডাটা অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফেসবুকে কখনো রাত নামে না। এখানে সবসময় দিন। তার সঙ্গে আমার খুব সাবধানে কথা বলা উচিত। ও যেন কখনো এটা মনে না করে যে ওকে আমি তাচ্ছিল্য করছি। বরং তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কারণ, সে আমাকে ভালোবাসে।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১২