আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি। ফারসি গদ্যসাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয় তেরো শতকে রচিত এই গদ্য। বইটি ইংরেজিতে Discourse of Rumi নামে পরিচিত। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন সায়মন আলী।
কেউ একজন বলল, “আমাদের প্রভু তো কিছু বলেন না।”
রুমি প্রত্যুত্তরে বললেন, “বেশ, তোমার বক্তব্য অনুযায়ী আমার চিন্তাশক্তি তাহলে তোমাদের আমার সান্নিধ্যে এনেছে। আমার এ চিন্তাশক্তি “কী ব্যাপার তোমাদের?” — বলে তোমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে নি। কথাবার্তা ছাড়া চিন্তাশক্তি তোমাদেরকে এখানে টেনে এনেছে। আমার বাস্তব অস্তিত্ব যদি তোমাদেরকে আমার কথা ছাড়াই আমার কাছে নিয়ে আসে আর তোমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেয় তো কথার চমৎকারিত্ব কোথায়? কথা হচ্ছে বাস্তবতার ছায়া, বাস্তবতার কেবল একটি ছায়াই মাত্র। ছায়াই যদি বাস্তবতার কাজ করে তো বাস্তবতা এর চেয়ে কতটুকুই বা বেশি?
কথা একটি নিমিত্ত মাত্র। আত্মিক বন্ধন একজনকে আরেকজনের কাছে টেনে আনে, কথা নয়। অলৌকিকতা ও মুজেজার অধিকারী নবিগণের বা মহাপুরুষগণের সাথে আন্তঃসম্পর্ক ছাড়াই যদি তাঁদের অনুসারীগণ তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে পায় তবে সেই অলৌকিকতার কোন অর্থ হয় না। আমাদের ভেতরের কোন এক অদৃশ্য উপাদানই আমাদেরকে টানে আবার আমাদেরকে চলাফেরায় সাহায্য করে। রজনের মধ্যে এমন কিছু থাকে না যার দ্বারা খড়কুটো তাতে আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু রজনের সাথে পশমী কাপড় ঘষে দিলে তাতে খড়কুটো আকৃষ্ট হয়, রজনের গায়ে লেগে যায় (উল্লেখ্য, রুমি এখানে স্থির বিদ্যুতের উদাহরণ দিচ্ছিলেন)। সুতরাং এখানে রজনের মধ্যে যে পরিবর্তনটি ঘটে তা সম্পূর্ণই অভ্যন্তরীণ আর তাই খোলা চোখে তা দেখা যায় না।
চিন্তা আমাদের পরিচালিত করে। বাগানের চিন্তা আমাদেরকে বাগানের কাছে নিয়ে আসে, দোকানের চিন্তা আমাদের দোকানের দিকে নিয়ে যায়। যাই হোক না কেন, এসব চিন্তার মাঝে একটি সূক্ষ্ম কারচুপি থাকে। কোনো জায়গায় যাবার আগে তুমি কি কখনো ভাবো নি যে জায়গাটি ভালোও হতে পারে আবার সেখানে গিয়ে হতাশাও পেতে হতে পারে। তখন সে চিন্তাভাবনাগুলো একটি পর্দার মতো কাজ করে, যার আড়ালে কেউ একজন সুপ্ত থাকেন। দিনের আলো যখন তাকে সে সুপ্তাবস্থা থেকে বাস্তবতায় টেনে আনে তখন সেই পর্দা সরে যায় আর সেখানে কোন হতাশা থাকে না। তখন তুমি যা বাস্তব তা ই দেখতে পাবে, এর বেশি কিছুই নয়।
তো আমার আর কথা বলার দরকার কী? বাস্তবে যেটি দেখা যায়, তা বিভিন্ন রূপে প্রদর্শিত হতে পারে। আমরা হাজারো রকমের বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার অধিকারী। আমরা বলে থাকি, “আমি সেমাই খেতে চাই”, কেউ বলি “আমি রুটি খেতে চাই”, কেউ বা হালুয়া খেতে চাই, কেউ ছানা খেতে চাই, কারো খেঁজুর বা অন্যান্য ফল খেতে ইচ্ছে হয়। আমরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য খেতে চাই, কিন্তু এর মূলে একটি ব্যাপারই নিহিত এবং তা হচ্ছে ক্ষুধা। তোমার কি দেখো নি যে, যখন আমাদের একটি জিনিসে সকল চাহিদা পূরণ হয়ে যায় তখন আমরা সচরাচর বলে থাকি, “আর কোনকিছু প্রয়োজন নেই।” সুতরাং শত শত ব্যাপার নয়, আমাদেরকে একটি ব্যাপারই টেনে আনে।
এবং সে সমষ্টির মাঝে
আমরা কেবল পরীক্ষা হিসেবে ন্যাস্ত।
এ জগতের প্রতিটি বস্তুই আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে বিদ্যমান আর তাই তাদের মধ্যে একক বাস্তবতাটি লুক্কায়িত। একটি প্রবাদ আছে, “সাধু যদি হন একজন তো সাধারণ মানুষ হয় শতজন।” যার অর্থ হচ্ছে, সাধুর সমস্ত চিন্তাভাবনা, আকর্ষণ একটিমাত্র সত্যের উপর নিবিষ্ট যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনা সেই সত্যের হাজারো রূপের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু শত রকমের হোক বা পঞ্চাশ রকমের হোক কিংবা হোক ষাট রকমের, এই দুনিয়ার আসল রূপের বদলে প্রতিবিম্বিত রূপের মোহে নিজেদের হারিয়ে ফেলে তারা পরিণত হয়েছে চেহারাবিহীন পঙ্গু অবয়বে। নিজেদের মেধা-মনন ও আত্মিক সত্তা হারিয়ে তারা ঝাড়ফুঁক বা তন্ত্রমন্ত্রের জোরে পারদ বা তরল রুপার মতো কাঁপাকাঁপি করছে। তারা জানে না, তারা আসলে কে? সত্যি কথা বলতে কি সেই হাজারসংখ্যক মানুষ আসলে কিছুই না যখন সেই সাধুই শতজন কিংবা সহস্রজন বা সহস্রাধিক।
একদা এক রাজা একজন সৈনিককে একশ জনের রেশনের পরিমাণ রেশন দিয়ে দিলেন। সকল সৈন্য এর বিরোধিতা করলেও রাজা ছিলেন নির্বিকার। যুদ্ধের সময় একজন বাদে বাকি সকল সৈন্য রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালো আর সেই একজন সৈন্য একাই লড়ে যাচ্ছিল। রাজা তা দেখে বললেন, “তুমি এখানে এখনো আছো, তার কারণ আমি একজনকেই একশ জনের সমান হিসেবে পুষেছি।“
আমাদের উচিত পূর্বতম সকল সংস্কার ও ধারণার আবরণ খুলে ফেলে আল্লাহর একজন বন্ধুর সন্ধান করা। যা হোক, আমরা আমাদের পুরো জীবনে যতজনের সংস্পর্শে আসি তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকেন যার মধ্যে বৈষম্যের প্রবণতা থাকে না। এমন মানুষের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে আমাদের ভেতরকার বৈষম্যবোধও ধীরে ধীরে কমে আসে। এতে আমরাই দিনশেষে উপকৃত হই কিন্তু যার মাধ্যমে আমাদের এ পরিবর্তনটি ঘটে সেই প্রকৃত বন্ধুটি হয়তো আমাদের অজ্ঞাতে বা উপেক্ষায় এক প্রকার অচেনা থেকে যান।
এই তোষামোদকারীরা সর্বদা রাজার আশেপাশে থাকে, রাজার ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়, রাজার কাছ থেকে বিপুল উপঢৌকন লাভ করে আর এ অনিবার্য কারণেই তারা রাজার খায়েশ অনুযায়ী কথা বলে। এতে করে লোকে রাজার সমস্ত জাগতিক চিন্তাভাবনাগুলোকে পরম মনোযোগ সহকারে দেখে আর চাইলেও সেগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারে না।
বৈষম্য এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা প্রত্যেকের ভেতর সুপ্ত থাকে। তোমরা কি দেখ নি যে, পাগলের হাত-পা সব থাকলেও তার মধ্যে বৈষম্যবোধের অভাব রয়েছে? তোমাদের ভেতরের একটি সূক্ষ্মতম কণা হচ্ছে বৈষম্য। এখনো দিন রাত তোমরা তোমাদের শারীরিক পরিচর্যায় লিপ্ত থাকো সেটা কতটুকু ঠিক হচ্ছে না হচ্ছে তা না জেনেই। কেন তোমরা তোমাদের সমস্ত যত্ন শরীরের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছো আর সেই সূক্ষ্ম কণাটিকে গুরুত্ব দিচ্ছো না? কারণ সেই কণাটিকে ছাড়া শরীর বহাল তবিয়তে থাকতে পারে কিন্তু শরীর ছাড়া সেই কণাটির কোনই অস্তিত্ব নেই।
চোখ ও কানের বাতায়ন দ্বারা যে আলোক দ্যুতি ছড়ায় — সে আলোক কখনই ঐ নির্দিষ্ট বাতায়নের উপর নির্ভর করে না। যদি চোখ-কানের সেই বাতায়ন বন্ধও থাকে তবুও সে আলোক থেমে থাকে না। এটি কোনো-না-কোনোভাবে অন্য উপায়ে দ্যুতি ছড়াবার পথ খুঁজে নেবেই। সূর্যের সামনে বাতি রেখে তুমি নিশ্চয়ই বল না যে, “আমি এই বাতির আলোক দ্বারা সূর্যকে দেখছি?” আল্লাহ না করুন, তুমি যদি সূর্যের সামনে কোন বাতি নাও ধর তবু এটি তার মতো করে দ্যুতি ছড়াতেই থাকবে। তাহলে সূর্যের সামনে বাতি ধরলেই কী আর না ধরলেই কী?
রাজাদের সাথে মেলামেশা করার এটাই বিপদ। এ কথা বলার মানে এই নয় যে, এতে তোমার প্রাণ যাবার ভয় আছে। তোমার আয়ু শেষ হয়ে গেলে তুমি মৃত্যুবরণ করবেই, সেটা দুদিন আগে হোক কিংবা দুদিন পরে। সমস্যা তখনই হয় যখন বিশাল পরিসরের সুসংহত প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে রাজারা দৃশ্যপটে হাজির হন। তারা ধীরে ধীরে সূর্যের মতো বড় আলো হতে শুরু করেন। আর এ কাজে তাকে সাহায্য করে থাকে তার আশেপাশের তোষামুদে লোকজন। এই তোষামোদকারীরা সর্বদা রাজার আশেপাশে থাকে, রাজার ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়, রাজার কাছ থেকে বিপুল উপঢৌকন লাভ করে আর এ অনিবার্য কারণেই তারা রাজার খায়েশ অনুযায়ী কথা বলে। এতে করে লোকে রাজার সমস্ত জাগতিক চিন্তাভাবনাগুলোকে পরম মনোযোগ সহকারে দেখে আর চাইলেও সেগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারে না।
বিপদটা এখানেই, প্রকৃত সত্যগুলো উক্ত কারণে বিবর্ণ হতে হতে সত্যের মর্যাদা হারাতে থাকে। তুমি যদি রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোকে লালন কর তবে তোমার আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য অতীব জরুরি বিষয়গুলো তোমার কাছে নিতান্তই অচেনা হয়ে যাবে। যতই তুমি রাজার পথ অনুসারে চলবে ততই তোমার প্রিয় মানুষগুলোর দেয়া নির্দেশনাগুলো হারিয়ে যাবে। যতই তুমি বৈষয়িক লোকের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলবেন ততই তোমার ভালো লাগাগুলো দূরে সরে যেতে থাকবে। তাদের নির্দেশনানুযায়ী চললে তুমি তাদের শাসনের বস্তুতে পরিণত হবে। আর তুমি একবার তাদের শাসনে চলে গেলে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা তোমার উপর কর্তৃত্ব করার জন্য ক্ষমতা পেয়ে যাবে।
সাগরের কাছে পৌঁছতে পারা যেমন দুঃখের বিষয় তেমনি দুঃখের বিষয় হচ্ছে সাগরের কাছে পৌঁছতে না পেরে সাগরের বিপুল জলরাশির মাত্র এক কলসি জল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। সাগরে মুক্তো তো আছেই তাছাড়া সাগর থেকে মহামূল্যবান জিনিসও পাওয়া যায়। সে তুলনায় সাগরের পানি কতটুকুই বা মূল্যবান? বুদ্ধিমান মানুষরাই-বা তার মধ্যে কী এমন গৌরব খুঁজে পায়? সত্যের সাগরে এই পৃথিবীটা নিছকই সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের ফেনার মতো। সাধুর কাছে এই মহাসমুদ্র একটি জ্ঞানের ভাণ্ডার স্বরূপ আর এর প্রতিটি জলবিন্দুই একেকটি মুক্তো।
সাগরে চলমান জাহাজের অতিরিক্ত ভার কমাবার জন্য দ্রব্যাদি সাগরে ফেলে দেয়া হয় সেগুলো মূল্যবান হওয়া সত্ত্বেও ভেসে থাকা তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। এই পৃথিবীটা ঠিক সেইসব ফেলে দেয়া ভাসমান দ্রব্যের মতো, যা সমুদ্রের ঢেউয়ের ফলে সৃষ্ট ফেনার মতোই তুচ্ছ। কিন্তু জোয়ারের ফলে তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ আর সমুদ্রের বিপুল জলরাশির উত্তাল আন্দোলন এই ফেনাকেই অপূর্ব সৌন্দর্য দান করে। কিন্তু ফেনার এই সৌন্দর্য প্রকৃত সৌন্দর্য নয়, এটি একপ্রকার ঋণ করা সৌন্দর্য যা সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার কাছে ঋণী। এটি নকল সোনার মতোই আমাদের দৃষ্টিতে অতিরিক্ত চকচক করে ধরা দেয়।
মানুষ হলো আল্লাহর জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানস্বরূপ। কিন্তু এই জ্যোতির্বিজ্ঞানকে পাঠ করার জন্য একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী দরকার। একজন সবজি বিক্রেতা কিংবা একজন মুদি দোকানি যদি সে জ্যোতির্বিজ্ঞানটা খুঁজে পান তবে তা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হবে। কারণ সেখান থেকে তারা জানতেও পারবে না কীভাবে নক্ষত্ররাজি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত আছে, কীভাবেই বা জ্যোতিষ্কগুলো নির্দিষ্ট নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, মহাজাগতিক ঘটনাবলীর প্রভাবই বা কেমন ইত্যাদি? কিন্তু একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর হাতে সে জ্যোতির্বিজ্ঞান যথার্থ মূল্যায়ন পাবে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান যেমন মহাজাগতিক সমস্ত ঘটনা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে ঠিক তেমনি আমরাও আল্লাহর জ্যোতির্বিজ্ঞানস্বরূপ। কারণ :
আমরা আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি।
যাঁরা একটি মাত্র বাস্তবতাকে দেখার জন্য এবং সেটার বিভিন্ন রূপ নিজ জ্ঞানগরিমা দ্বারা বোঝার জন্য আল্লাহর পথে চলেন তাঁরা মুহূর্তে মুহূর্তে, পলকে পলকে আল্লাহর ইচ্ছাকেই দেখতে পান। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি অসীম সৌন্দর্য যার প্রকৃত রূপের সাথে প্রতিবিম্বিত রূপের কোন পার্থক্য নেই।
আল্লাহর কতিপয় সেবক রয়েছেন যারা জ্ঞান, দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি গুণাবলীর আবরণে ঢাকা থাকেন; যে গুণাবলী সাধারণের মাঝে অনুপস্থিত। আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও অত্যধিক কাতরতার ফলেই সে সেবকগণ নিজেদের এমন আবরণে ঢেকে রাখেন। এটা এমনই এক সৌন্দর্য যেমনটা সুন্দরী মেয়েদের দেখে মুতানাব্বী বলেন :
নিজেদের সৌন্দর্য ঢাকতে নয় বরং লম্পট চোখের আড়াল থেকে
নিজেদের সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে তারা সিল্ক পরিধান করেছে।
আরও পড়ুন ।। কিস্তি ১