এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এই মুহূর্তের গল্প; যে গল্পের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। চমৎকার ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র। এই গল্প নিশ্চিতভাবে টেনে নেবে আপনাকে। কারণ আপনিও সম্ভবত জড়িয়ে আছেন এই উপন্যাসের সঙ্গে।
ওয়ান-ইলেভেন সরকার যে টিকবে না তার নানা লজিক সে আমার সামনে তুলে ধরেছিল। ওকে আমার কিছুটা এন্টি-স্টাবলিশমেন্ট মনে হতো। হয়ত কোনো হতাশার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সে নিজে এসব বলত। তার কথা ঠিক হোক বা বেঠিক, কোনো কিছুকে গ্রহণ করে নেয়ার স্বভাব তার ছিল না। কিছু করতও না সে। রাজনীতি তো না-ই। খুব অলস ছিল। জামা-কাপড়ের ঠিক ছিল না। হয়ত একই কাপড় দিনের পর দিন পরে থাকত। আর একটা অদ্ভূত স্বভাব ছিল দিনে দুবার গোসল করা। সেটা সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার। যত শীতই থাকুক হলের বাথরুমের ঠান্ডা পানিতে গোসল করে শুতে আসত সে। আর তার ঠান্ডা লাগত না তেমন। দেখতে সে ছিমছাম স্বস্থ্যের অধিকারী ছিল। চোখ দুটা ছিল জ্বলজ্বলে। মাথায় পাতলা চুল ছিল। মুখটা ছিল শিশুদের মতো, অবুঝ একটা হাসি দিত। আমার ওকে ভালোই লাগত। মাঝে মাঝে যে বিরক্তি তৈরি হতো সেটা বন্ধুত্বেরই ঘটনা বলে বুঝে নিতাম। একটা মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন থাকার পর তাকে নিয়ে কিছু বিরক্তি তৈরি হবে না এতটা মোহ অন্তত দুই ছেলের সম্পর্কের মধ্যে থাকার কথা না।
আমাদের মধ্যেও ছিল না। স্বাভাবিক বন্ধুই ছিলাম আমরা। হলে সে ওঠার পর অমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে যেমন অনিশ্চয়তা, কারো কারো মধ্যে সংশয়, সন্দেহ, স্বার্থপরতা, না-বুঝতে পারার ব্যাপারগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন হাসনাতই আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। ওর তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। আমার সঙ্গেই থেকেছে, খেয়েছে। সে কারণে সে আমাকে রাজনৈতিক বয়ান দিয়ে দিয়ে স্যাটিসফাই করতে চেয়েছে — এমনটা হতেও পারে। সেটা খারাপ কিছু না নিশ্চয়। জলি বলত, ‘সবাই আসলে খারাপ, কারণ বিশুদ্ধ ভালো বলে কিছু নাই। তোকে ঠিক করে নিতে হবে খারাপের মধ্যে ভালোটাকেই আসলে। তুই তো লেখক হবি, ভালোর প্রতি আদর্শবান হলে তোর চলবে না, আবার খারাপের প্রতি নিউট্রাল হলেও না, তুই যদি এতটাই বিশুদ্ধতাবাদী হতে চাস তাহলে খারাপের মধ্যেই ভালোটা তোকে বেছে নিতে হবে।’
আর খারাপ নিয়ে সবচেয়ে সিডাকটিভ কথাটা বলেছিল জলির সেই ফুপু, তার আপন ফুপু না, পাতানো ফুপু। একই এলাকার তারা। জলির বাবা ওই ফুপুর মাকে খালা ডাকতেন বলে উনি তার ফুপু হন। তবে বাবাদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক না থাকলেও জলির সঙ্গে সেই ফুপুর সম্পর্ক ছিল। বয়সে তিনি সামান্যই বড় জলির। সেই ফুপু বলতেন, সবচেয়ে খারাপ শব্দটা হচ্ছে খারাপ। এই শব্দটার মধ্যেই সব খারাপ লুকিয়ে আছে। যখন কেউ কাউকে বলে তুই খুব খারাপ, তখন আসলে তাকে সে সবরকম খারাপ একবারে বলে দেয়। এই কথা বলে সেই ফুপু হাসতেন, তার হাসি আমার ভেতর দিয়ে বয়ে যেত। আমার ভেতরে আরেক আমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠত কোনো এক অভিলাষের আশায়। সেই লাস্যময়ী লিসা আমার জীবনের আরেক গোপন।
আর আমাদের সেই আড্ডামুখর দিন আর রাজনৈতিক গোলোযোগের সময়টায় যুক্ত হয় কমল। সেই ছাত্রলীগের কমল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্রলীগ করা, তাও আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, এটা কম ব্যাপার নয়। যে কারণে কমল আসলে পারসোনালিটি হিসেবে বড় চিল আমাদের কাছে। আমাদের সঙ্গে তার না-খাতির, না-বিরাগ অবস্থা ছিল। বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর সে হলে যাওয়া-আসা শুরু করে। যদিও কমল কখনো ক্যম্পাসেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নাই। সে রাজনীতিটাকে বড় জায়গা থেকে দেখত।
চেনা-জানা কম একজন ফখরুদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নয়া নাগরিক হয়ে উঠলাম যেন। আগেরগুলো এখন আবার করব কি না বুঝতে পারছিলাম না, কীসে দোষ, কীসে ভালো সেটাও বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির অফিসে যেত। ওর বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জ। আওয়ামী লীগে কিশোরগঞ্জের দাপট আছে। পরে ওয়ান-ইলেভেনের সময় কমল বলত নেতার নির্দেশেই সে ঝামেলায় যেত না। সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কোনো বাজে রেকর্ড তার নামে নাই। তার মতো ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার খেতে হয়েছে, এটা তার এলাকার জন্য বড় ঘটনা। সে মনে করে, রাজনীতিতে থাকলে মার খেতেই হবে। অবশ্য এতে হাসনাত হাসত, তার কথায় মার খেতে হবে কেন। গায়ে হাত তোলা কোনো সভ্য দেশে শোভা পায় না। রাজনীতি করতে গেলে মার খেতে হবে, এটা মেনে নেয়া মানে এ অসভ্যতাটাকে আরো জিইয়ে রাখা। কমলও ওর কথা শুনে হাসত। বলত, কি করবি বল একদিনে তো আর এসব চেঞ্জ হবে না। সবাই যখন মার খাওয়াটকে ক্যাপিটাল করবে, আমি আবার পিছায়ে থাকব কেন। অনেকে তো প্ল্যান করেই মার খায়।
আর কমল একদমই বিএনপিকে পছন্দ করত না। বিএনপির মেন্টাল গ্রোথ আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত না বলে তর্ক করত সে। কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর বিএনপির রাজনীতিকে সে ভুল মনে করত। তার ব্যাখ্যা, ‘বিএনপি একা একাই সব করতে চাইলে তো হবে না। কী লাভ হলো হাসান সাহেবকে প্রধান বিচারপতি বানানোর জন্য বয়স বাড়িয়ে। তিনি তো আর বিএনপির কথা রাখলেন না। আর এটা যদি বিএনপির চালও হয় যে, তারা হাসান সাহেবকে সরিয়ে দেওয়ার মুলা ঝুলিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাজিয়ে নির্বাচনে পার পেয়ে যাবে — সেটাও সবাই মেনে নেবে কেন? দেশে তো আরো পক্ষ আছে। আর বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পরদিন থেকেই আর মাঠ দখলে রাখতে পারে নাই। নির্বাচন খালি ভোটের ব্যাপার ভাবলে ভুল আছে। কারণ প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে। সবাই কি তাদের পক্ষে কাজ করত? ভোটটা কি বিএনপির কমত না তারা যত যা করেছে এই কয়বছর ক্ষমতা থেকে?’
হাসনাত আবার বলে যে, ‘বিএনপির প্রেসিডেন্টের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়োজনে তো সবাই গেল। আওয়ামী লীগও রাজি হলো। তাহলে বিএনপি লুজার কোথায়, তারা জিতেই তো যাচ্ছিল? আওয়ামী লীগ এত কিছু করে একবার ভোটে গেল না, আবার গেল, আবার ফিরে আসল — এগুলা কেন? বিএনপির সময়ে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা হইল, দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে দিল। আর লুটপাট তো আছেই, তারপরও বিএনপির ভোট কমছে এ ভরসায় আওয়ামী লীগ ভোটে গেলেই তো জিতে যায়- এত কিছুর কী আছে?’
‘এত কিছু হবে না? তুমি হাসানের মতো লোকরে বসাইবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে, ভোটার তালিকা ম্যানিপুলেট করবা, আর এই যে আজিজ, আজিজ বিরোধী আন্দোলনটারে আওয়ামী লীগ যে একটা কালাচারাল ফেনোমেনা বানায়া ফেলছে- এসব বিএনপি পারবে না। ফলে তার নিজের বুঝা উচিত, মাঠ আর আশপাশ তার পক্ষে পরিস্থিতি নাই। অবশ্য তুই কইতে পারস যে আকবর আলী খান, সুলতানা কামালদের মতো ব্যক্তিরা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে গেছে, সেটা একটা গ্রহণযোগ্যতা তো তারা দিছেনই, আবার সরেও গেছেন। তাইলে এই সরে যাওয়ায় তো বিএনপি শ্যাষ’।
তুমুল সেসব তর্কের কয়েকদিন পরেই ওয়ান-ইলেভেন সরকার আসল দেশে। সেদিন হঠাৎ জলি ফোন দিল আমাকে সেই দীর্ঘ বিরতির পর, ‘কী রে তোরা কই, খবর কিছু রাখস? দেশে তো ক্যু হয়ে গেছে। আর্মি ক্ষমতা নিছে, সাবধানে থাকিস?’
বেশি কিছু আর বলল না সে। ওর ফোনে আমি অবাক হইলাম। যাক সে অন্তত দায়িত্বশীল আছে। আমরা তখন নারায়ণগঞ্জ। আমাদের এক বন্ধু নকিবের বাড়িতে। ঢাকায় থাকতে থাকতে বোর লাগছিল। এর মধ্যে কমল একটা ফরেইন বোতল আনল। সেটা কোথায় খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে নকিবদের কথা মনে পড়ল। নকিব আবার পারিবারিকভাবে লোকালি বিএনপি ঘরানার। শীতলক্ষ্যার পাড়ে অনেক রাত পর্যন্ত মদ খেলাম। তারপর দুপুর নাগাদ জলির ফোন পেলাম। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় ফিরে যাওয়ার। ক্যম্পাসে থাকাই নিরাপদ হবে ভাবলাম। খবর নিতে থাকলাম ফোন করে বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের সঙ্গে কমল আর নকিব, দুই দলের দুই পাণ্ডা থাকায় সুবিধা হলো খবর পেতে বিভিন্ন রকম। সবাই বলল সাবধানে থাকতে। আমরাও তা-ই ভাবলাম, সাবধানে থাকব।
হলে ফিরে এলাম। একটা কার ভাড়া করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ যাওয়া আর ফেরার জন্য। সেটা বাতিল করে পাবলিক বাসেই উঠলাম। প্রাইভেট গাড়ি চেকের মধ্যে পড়তে পারে। মানুষের মধ্যে খুব একটা বিকার যে ছিল তা বলা যাবে না। তারা আরো চুপচাপ ও অনিশ্চিত। ঘরে ফেরার তাড়া সবার মধ্যে। রাস্তা ফাঁকা। পলিটিক্যাল ক্যাওয়াজ নাই কোনো। কোনো হৈ চৈ নাই। অল আর কোয়ায়েট মনে হলো। এতক্ষণ যে বলটা বিএনপি আর আওয়ামী লীগের কোর্টে ঘুর ঘুর করছিল সেটা হাওয়ায় যেন মিলায়ে গেল। রাজনীতির গেমটা পুরো পাশা উল্টে দিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বুঝতে পারা গেল।
চেনা-জানা কম একজন ফখরুদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নয়া নাগরিক হয়ে উঠলাম যেন। আগেরগুলো এখন আবার করব কি না বুঝতে পারছিলাম না, কীসে দোষ, কীসে ভালো সেটাও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর আগে বিএনপি একবার অপারেশন ক্লিন হার্ট নামিয়ে বেশ নাস্তানাবুদ করেছিল। তখন মোড়ে মোড়ে আর্মি চেক করত। তখন মনে হতো ছবিতে দেখা একাত্তর সালে আছি। আমাদের বিরোধী পক্ষ পাকিস্তানি আর্মিরা চেক করছে বাঙালিদের। হয়ত খুলে-টুলেও দেখতে পারে কাটছি কি না। ওয়ান-ইলেভেনের শুরুতে যে কারণে আবার রাস্তায়-রাস্তায় চেক-টেক করবে কি না সেই সংশয়ে ছিলাম। যাই হোক, সেদিন ঢাকায় নিরাপদে ফিরলাম।
অনেকে পটপরিবর্তনের কারণে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কেউ কেউ আবার খুশিও ছিল। যাদের প্রতি হাসনাতের খুব রাগ। সে আগেই বলেছিল এদের বিষয়ে। কমলকে দেখলাম খুব শান্ত। তাকে নেতা বলেছেন শান্ত থাকতে। কোথাও না যেতে। বাড়িতেও যেন না যায়, ক্যম্পাসেই অথবা কোনো বন্ধুর সঙ্গে নিরাপদেই যেন থাকে আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। অপরদিকে নকিব আরো নিশ্চিন্ত। সে কখনো পলিটিক্স করে নাই। তার বাবা অত বড় ব্যবসায়ীও না। আর আমি আর হাসনাত তো এমনিতেই কারো সাতে-পাঁচে কখনো ছিলাম না। বাকি যে জলি সে আগে থেকেই তার মতো করে আছে। এক এক্স আর্মি অফিসারের ছেলের সঙ্গে চুটিয় প্রেম করছে। এখন নিশ্চয় এই প্রেম সে আরো উপভোগ করছে।
তবে সব পরিস্থিতির মধ্যেই উহ্য হয়ে ছিল আমার আর লিসার গোপন যোগাযোগ। জলিকে সে দিন নামিয়ে আসার পর হল গেটের সামনে রিকশা থেকে নামতেই তার ফুফু লিসা আমাকে ফোন দেন।
‘কী ফুয়াদ, খুব মন খারাপ হলো নাকি?’
যেহেতু জলি ফোন করেছিল তার ফোন থেকে, সে জন্য লিসার নাম্বার আমার কাছে সেভ করা ছিল। আমার বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না কে কথা বলছে। আর তার কণ্ঠ শুনেই জলিকে আনার সময় তার সঙ্গে দেখা হওয়ার ক্ষণটা মনে পড়ে গেল। আমি কলিংবেল বাজিয়ে তাদের তিন তলার বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। আগে কখনো এ বাসায় আমার যাওয়া হয় নাই। আমিও দেখি নাই লিসাকে কখনো। কথাও হয় নাই তার সঙ্গে আমার। কলিংবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তো ওপাশ থেকে একটা গভীর নৈঃশব্দ্য থেকে উঠে আসা কোনো জলতরঙ্গের মতো একটা ভয়েস জানতে চাইল ‘কে?’। আমি সহজেই উত্তর দিতে চাইলাম না। আবার শুনতে চাইলাম কণ্ঠটা। আবার যেন খুব ধীরে, ফিসফিসিয়ে কিছুটা, যেন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন শব্দ শুনতে পেলাম, ‘কে?’।
তারপর আবারো শুনতে চাইব ভাবলাম। কিন্তু নিজেকে আবার সজাগ করলাম। বললাম আমি ফুয়াদ, জলিকে নিয়ে যেতে এসেছি। পিপ হোলে একটা অন্ধকার দেখলাম। এরপর খুলে গেল দরজা ধীরে ধীরে। দরজা খুলল, মুখের সামনে আমি কাউকে দেখতে পেলাম না। দূরে একটা সোফায় জলি বসে আছে দেখা যাচ্ছে। আমি কেডস খুলে ভেতরে একটা পা দিলাম। একটা গন্ধ আসল নাকে। চুলবুল করে উঠল মুখের ভেতরটা। মনে হলো যেন ক্ষিধা পেয়েছে। বামে তাকিয়ে দেখলাম তাকে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দরজার পাশে শরীরটা আড়াল করে। তার টানা চোখ দুটো পুরোটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, সেখানে সম্ভাষণ। আমি ভাবলাম তার বাসায় এসেছি সম্ভাষণ তো জানাবেনই। এরপর সোফায় গিয়ে বসে তার দিকে আবার তাকালাম। তিনি খুব ধীরে কাজ সারছেন। কোনো শব্দ করছেন না। তার কিছুটা কার্লি চুল পিঠের মাঝামাঝিতে একটা তীক্ষ্ণ ভি শেপ নিয় শেষ হয়েছে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। গায়ের রঙ, এটাকে বলে মিডল স্কিন টোন। তবে মডারেট, চাপা নয় খোলা। একটা সাদার ওপর পেস্টের কাজ করা জামা পড়েছেন। পায়ে নুপুর। একপাশে ওড়না, আরেক পাশে চুল। কামিজটা ফ্রি সাইজ। তার ক্রিস ক্রস পায়ে হাঁটার ভঙ্গি, তার যে লয় আর নীরব ঘরে একটা হালকা নুপুরের শব্দ আমাকে মাতিয়ে দিল।
আমি তার দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। তিনি এক হাতে বুকের সামনের ওড়নার এক প্রান্ত ধরে জানতে চাইলাম কিছু খাব কি না। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে থাকার লজ্জা কাটাতে ততক্ষণে জলি আর সামনের দেওয়ালে ঝোলা টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বেশ পয়সাওয়ালার ঘর। ওনার হাজবেন্ড বাইরে থাকেন। একজন ইঞ্জিনিয়ার। উনিও বাইরে চলে যাবেন। একটা ছোট ছেলে আছে প্রায় চার বছর বয়স। বাসায় শাশুড়ি নিয়মিত থাকেন। শ্বশুর গ্রাম থেকে যাওয়া-আসা করেন। ননদ আছেন ঢাকার অন্যত্র তার স্বামী-সংসার নিয়ে। তার এক দেবর আছে সে সিলেটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মোটামুটি নির্ঝাঞ্ঝাট, নিরিবিলি পরিবার। আমি তার কিছু একটা খাওয়ার আহ্বান শুনতে পেলেও কী বলব বুঝে উঠতে না পেরে তার দিকেই তাকালাম। তার চোখে, তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। যেন কোনো গভীর থেকে তিনি তাকান। তার গায়ের রঙের সঙ্গে কালো চওড়া ভ্রু আর খোলা চোখ সহজে আকৃষ্ট করে ফেলল আমাকে।
আমাদের প্রথম আলাপ এখানে শেষ হলো। আমি ততক্ষণে হলের ক্যান্টিনে বসে আছি। নাশতা করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এই মহিলার কথা আমি যেন একেবারে বিভ্রান্তির বেনো জলে ভেসে গেলাম।
আবার জানতে চাইলেন, কিছু খাব কি না। আবার সেই জল পড়ার শব্দ হলো। আমি তাকে কিছু বলতে পারলাম না। মাথা নাড়লাম। তিনি হাসলেন। ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি। হাসতে হাসতে মুখে হাত দিলেন। তার শরীর দুলে উঠল। আমিও দুললাম তার সঙ্গে কিছুটা সময়। অল্পেই সমঝে নিলাম নিজেকে। জলি ধমকাল, কীরে এমন বোবা হয়ে গেলি কেন। কিছু না খেলে চল বেরিয়ে পড়ি। আমি তখন বললাম, আসলে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছি কি না। রেশ কাটছে না। আর এখন কিছু খাব না। একবারে হল গিয়ে খাব। কথা আর বাড়ালাম না। কিছু বললামও না জলির ফুফুকে। শুধু হেসে, মাথা নেড়ে নিচে নেমে গেলাম। তারপর রিকশায় উঠ পড়লাম দু’জনে। সেই গন্ধটা বের হওয়ার সময় আবার পেলাম। নিচে নামার সময় আমার আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেন লিসা। গন্ধ পেলাম, যেন কাঁচা আমের গন্ধ।
সেই লিসা ফোন দিলেন আমাকে জলিকে নামিয়ে দিয়ে এসে তার সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মনে মনে নিতে শুরু করার পরপরই।
‘কী বাসায় আসলা কোনো কথা বললা না। কিছু খেলাও না, শুধু দেখলা, হু,!’
তার এ হুঁ-এ যেন আমি ধরা খেয়ে গেলাম। আমি যে ওনাকে দেখেছি তিনি বোধহয় বুঝে গেছেন। কী বলব পাল্টা সে কথা খুঁজে পেলাম না তখনই। কিছুটা আমতা আমতা করে বলেই ফেলালম, ‘দেখার পর যদি মুখে কথা না আসে তাহলে কী করতে পারি বলুন।’
‘বাব্বা, কী এমন দেখলে বল তো যে মুখেই কথা জুটল না?’
‘না মানে আপনাদের বাসাটা খুব সুন্দর, দেখে ভালো লেগে গেল, মনে হলো থেকে যাই।’
‘হুম, আচ্ছা শোনো তোমাকে তুমি করেই বলে ফেললাম। কিছু মনে করো না, তোমরা তো আবার একে কী বলে কিছুটা আল্ট্রা মর্ডান, আপনি আপনি এসব করে বেড়াও, আমার আবার মনে ধরে গেলে তাকে তুমি বলে ফেলি।’
‘মনে ধরে গেল?’
‘যাবে না, জলির বন্ধু, ইউনিভার্সিটিতে পড়ো, টল ফিগার, ইয়ং ম্যান, আমার আবার ইয়ংদের খুব ভালোলাগে।’
‘আপনিও তো ইয়ং।’
‘আমি আবার ইয়ং হলাম কীভাবে। তোমাদের চেয়ে তো বড়। আর সংসার সামলাই, একটা বাচ্চা নামিয়ে ফেলেছি দুনিয়ায়। ইয়ংনেস বলে কি কিছু আর আছে।’
‘আমার তো মনে হলো বেশ ভালোই…’
‘কী মনে হলো?’
‘মানে ইয়ং…’
‘হুম, বশে ভালোই তো ঝোলাতে পারো বলে মনে হচ্ছে। শোনো তুমি তো বাসায় এসে কিছু খেলে না, কথাও বলললে না। এদিকে জলিও চলে গেল। ওর দেখা আবার কবে পাই তার ঠিক নাই। তুমি কিন্তু বাসায় এসো। আমার খুব লোনলি লাগে। বাচ্চা আর বুড়ো ছাড়া নিজের বয়সী বা কাছাকাছি কাউকে পাই না। তোমাকে কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে বলে রাখি। তুমি এসো, কথা বলো আমার সঙ্গে। আর জানো তো, জলি নতুন একজনের পেছনে ঝুলে পড়েছে। এক্স আর্মি অফিসারের ছেলে। বেশ টাকা-পয়সাওয়ালা। সত্যি কথা বলতে কী, তোমাকে দেখে আমার খারপই লেগেছে। জলির জন্য তুমি অনেক কিছু করেছো, সে বলেছে আমাকে। কিন্তু সে তোমাকে চায় না। কেন চায় না এর কারণটা সে আমাকে বলছে। তবে আমি কারো মুখের কথায় বিশ্বাসী না। আমি মনে করি যে মুখে কিছু একটা বলবে, কাজে বা আচরণে তার একটা প্রকাশ থাকলে তখন মুখের কথায় বিশ্বাস করা চলে। আমি তোমাকে বলব। তুমি কিন্তু যোগাযোগ রাখবা। নইলে আমিই তোমাকে জ্বালাব। জলি বিষয়ে অনেক কিছু বলব। তুমি কী আমাকে চাও না?’
‘আপনাকে চাই না মানে?’
‘আরে তোমার পক্ষে আমাকে চাও কি না, এই ধরো আমরা তো একটু বন্ধু হতেই পারি তাই না? আমাদের বয়স কী যথেষ্ট না, নাকি অন্য কেউ ডিসাইড করে দেবে আমরা কথা বলব কি না? তুমি তো যথেষ্ট আধুনিক। জলি বলেছে তুমি নাকি লেখক স্বভাবের। আমার আবার এসব খুব ভালোলাগে। আমি চাই আমাকে নিয়ে কেউ লেখুক। সে যদি আমাকে নিয়ে লেখে তার মধ্য দিয়ে আমি বেঁচে থাকব, আবার কেউ জানবেও না তোমার লেখার আমিটা কে? এটা খুব মজার না বলো?’
‘জ্বি আমি লেখি না।’
‘আচ্ছা শোনো, কথা হবে, আজ আমার মা আসবে বাসায়। থাকবেন বেশ কিছুদিন। দেখি কী করা যায় তোমার জন্য। বাই।’
আমাদের প্রথম আলাপ এখানে শেষ হলো। আমি ততক্ষণে হলের ক্যান্টিনে বসে আছি। নাশতা করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এই মহিলার কথা আমি যেন একেবারে বিভ্রান্তির বেনো জলে ভেসে গেলাম। ফোনে কথা বলার সময় তিনি কিছুটা চাপা গলায় বলেন। এতে তার ভয়েসটা আরো চিত্তহরী হয়ে ওঠে আমার জন্য। যেন গলাটা শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসছে। কী যেন অভিসন্ধি আছে তার মনে — এমন মনে হয়। সবটা বলতে চান কিন্তু বলছেন না, একটু একটু করে দম ছাড়ছেন। এর বষিয়ে আমি যে আরো খোঁজ নেব সেটার আর উপায় নাই। জলির সঙ্গে যোগযোগ থাকলেও তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না যে ইনি কে। তাহলে জলি সুযোগ পেয়ে যাবে। ভাববে তার ফুফুর সঙ্গে আমি প্রেম করছি, এ উছিলায় সে আবার আমাকে নাকচ করে দেওয়ার লজিক খুঁজে যাবে। তাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না আমার প্রেমে রাজি না হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে। ফলে গোপনই রাখতে হবে লিসার সঙ্গে যাগাযোগ। তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হবে আমার — সেটা আমি বুঝে গেলাম লিসার সঙ্গে আলাপ আগাতে আগাতেই।
পুরো নভেম্বরে তার সঙ্গে আর দেখা হলো না। কথা হলো কয়েকবার। সামান্য সময়ের জন্যই। আমি বুঝলাম সে সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে কথা বলে আমার সঙ্গে। হয়ত আরো কিছু করতে চায়। তার কিছু কিছু ইঙ্গিত সে আমাকে দিয়েও রেখেছিল ফোনালাপে। আমার পক্ষেও আসলে তার সময়মতো দেখা করা সম্ভব হয় নাই নভেম্বরে। কারণ আমি সেই মামার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হাসনাত আর কমলকেও সঙ্গ দিতে হচ্ছিল। জলির বাইরে তারই এক পরিচিত নারীর সঙ্গে আমার সখ্য তৈরি হয়েছে এটা বুঝাতে দিতে চাইছিলাম না। তখন ফেইসবুক বা ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ ছিল না আমাদের। ফোনে মেসেজ দেওয়া-নেয়া করতে হতো। মাঝে মাঝে লিসা ছবি মেইল করত। সেগুলো দেখার সুযোগ ছিল না আমার পক্ষে সবসময়। মামার বাসায় কখনো একা গেলে তার কম্পিউটার খুলে মেইল দেখে নিতাম। কী সব ছবি যে পাঠাত আমাকে। শরীরে হলকা বয়ে যেত। লিসা ছিল আধুনিক আর রুচিশীল মহিলা। নিজের শরীর বিষয়ে তার যেমন ধারণা ছিল তেমনি পছন্দের মানুষের সামনে নিজেকে এক্সপোজ করতে পারত সে।
তার সঙ্গে শুরুর মাসটা ভার্চ্যুয়ালিই কাটল আমার। জলি আমার বিষয়ে তাকে কী বলছে সেটা শুনার লোভও সামলাতে পারছিলাম না। আবার সে বলে দিয়েছে তাকে যেন আমি ফোন না করি, সে-ই আমাকে ফোন করবে। মেয়েদের এসব সাইকোলজিক্যাল গেম দেখতে দেখতে আমি এমনিতে ফেডআপ। এক জলিকে দিয়েই আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু শিক্ষা হলো না। শিক্ষা হওয়া নিয়ে আমার তেমন ভাবান্তর ছিল না। জীবনে অভিজ্ঞতাই বড় কথা, শিখতে আসা বড় কথা, কী শিখে ফেললাম আর শিখে নিয়ে সেটা ধরে বসে পড়লাম এমন কিছুর নাকি খুব প্রয়োজনীয়তা নাই — এটা সেই মামা আমাকে বলেছিলেন। আমি আশপাশের আর কিছু মানুষের মতো অত ভীতুও ছিলাম। এক্সপেরিমেন্ট আমার দারুণ পছন্দ, লিসারও পছন্দ এক্সপেরিমেন্ট। সে বলত :
‘শোনো লাইফটা হলো এক্সাইটমেন্ট আর একসপেরিমেন্ট ইন অ সার্টেন এস্টেজ। হোয়েন ইউ গ্রোন আপ ফ্লো উইদ দ্য লাইফ বাট হোয়েন ইউ বিকেম ওল্ড, হোল্ড লাইফ অ্যাজ ইউর ওয়ে। আগে থেকে এসব শিখে-টিখে বসে থেকে, ধরে নিয়ে ডাল একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কোনো মানে নাই বুঝলা?’
আমি বলতাম, ‘তাই?’
‘আলবাৎ তাই, তুমি দেখো না জলিকে, সে কেমন উড়ছে। আর এখন যে প্রেমটা করছে সেটা তো তাকে অন্য স্টেজে নিয়ে যাবে। তুমি দেখো জলি কখনো ফেড হয়ে থাবে না তা জীবনে। সে অলওয়েজ আপ করবে, উঠতে থাকবে।’
‘হুম।’
‘তোমাদের ছেলেদের এসব হুম, টুম আমার একদম ভালো লাগে না। যেন তোমরা সবকিছু বুঝে বসে আছো। আর মেয়েদের তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কখন তাকে খেলিয়ে খেলিয়ে তুলবে বাদ দেবে এসব হুম-এর আড়ালে তোমাদের ফন্দি। আমি জানি তুমি মোটেও এমন না, কিন্তু নিজেকে তুমি খুলতে চাও না। তুমি বৃশ্চিক রাশির জাতক না? বৃশ্চিক রাশি হলো তাকে তুমি একটা নোংরা ঘরে নিয়ে বসাও সে মনে বিরক্তি নিয়ে সেখানেই একটা টিকে থাকার নিজস্ব ওয়ে খুঁজে নেবে। কিন্তু সে মনে মনে চাইবে এলিট একটা কিছু। ঘরের কোথাও ময়লা থাকবে না, ঘর হবে গোছাল। কিন্তু সে বসে থাকবে হয়ত দেখা গেল অগোছাল একটা ঘরের মধ্যে। আচ্ছা জলির সঙ্গে তোমার কিছু হয় নাই, বলো তো সত্যি করে, তুমি কিছু করো নাই জলিকে।’
‘কী করব?’
‘উহ, ন্যাকা, ভাজা মাছ দিলে কীভাবে খাব বুঝতে পার না না? শোনো এসব বেড়ালগিরি করবা না আমার সঙ্গে। আমি খুব খোলামেলা। জলি যে টাইপের মেয়ে তোমাকে দিয়ে কিছু না করিয়ে সে ছেড়ে দিয়েছে আমি বিশ্বাস করি না’।
বেশিরভাগ সময় আমার কিছু বলার থাকত না। আমি আড় ভাঙতে পারতাম না তার সঙ্গে।
কোনো কোনো দিন হয়ত ফোন করে রাজনীতির কথাও বলে। ‘শোনো এই জাতিটা হলো অসভ্য, এদের ভালো করে ঠ্যাঙানি না দিলে কিন্তু এরা সোজা হবে না। তুমি দেখ না যেখানে-সেখানে থু থু ফেলে, নাক ঝাড়ে — এরা না জানে কোনো ম্যানার, না জানে কিছু। এদের হাতে তুমি যা দিবে সব নষ্ট করে দেবে। এমন আনসিভিলাইজড একটা জাতির জন্য দরকার কড়া শাসন। দ্যাখো না কী হয়।’
এরপর আবার কখনো রোমান্টিক মুডে আমার সঙ্গে তার বাসার বারান্দায় বসে কথা বলবে। সেই বাসার বারান্দা থেকে নাকি অনেক গাছ দেখা যায়। আর সবুজের ঢেউয়ের সামনে বসে সে কড়া করে চা খায়। তখন নাকি তার সিগারেট খেতেও খুব ইচছা করে। আর হালকা কিছু ড্রিংকস। মাঝে মাঝে কী পরে সেসবও বলত আমাকে লিসা। শাড়ি, টপস, লেগিংস, প্লাজো, ফতুয়া, টিপ। আর বলত, ‘আচ্ছা তোমার কি স্লিভলেস ভালোলাগে? তুমি কি কবিতা লিখতে পারো, পারো না? আমার পাশে তুমি যদি থাকতা, এখন কী করতা বলো তো?’
‘কী?’
‘উহ, ভাজা মাছটা উল্টায়া খাইতে জানো না তাই না? জলির সঙ্গে তো ঠিকই উল্টায়া-পাল্টায়া সব করছ।’
আমি হাসতাম। আমার শ্বাসের শব্দ বেশি হতো তখন। বাহিত হতাম তার কথায়। জলির সঙ্গে আমার কিছু হয় নাই এ কথাটাও তাকে আর বলতে পারতাম না। আমার মনে হতো জলির সঙ্গে যা যা হওয়ার ইঙ্গিত লিসা আমাকে দিচ্ছে, সে আসলে জানে তার কিছুই আমাদের মধ্যে হয় নাই। না হওয়াকে সে হওয়াতে চাইত। জলিকে নিয়ে আমার আক্ষেপ নিজেকে দিয়ে পূরণ করতে চাইত। কিছু না হওয়ার হাহাকার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার ভেতর থেকে বের করতে চাইত। আমি অবশ্যই কিছু না হওয়ার শূণ্যতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম। মনে হতো কোথাও আমি যাই, ডুবে যাই কারো শরীরে, নিজেকে সঁপে দেই উষ্ণতায়।
মাঝে মাঝে নিজেকে পারভার্ট ভাবতে শুরু করলাম। আমি সারাক্ষণ লিসাকে নিয়ে ভাবতাম। ওর ছবিগুলো সুযোগ পেলেই দেখতাম। খুব খোলামেলা ছবি সেসব ছিল না। কিন্তু ওর শরীর দেখতাম আমি সত্যি কথা এটা। মনে হতো খুব ভরাট আর পরিপূর্ণ একটা শরীর। এভাবে কাউকে দেখা লজ্জার মনে হতো আমার কাছে। আবার এড়াতেও পারতাম না।
এইসব অবদমন, চোরা চাহনির দিনগুলিতে একবার লিসার বাসায় আমার দাওয়াত পড়ল। লিসার বাবা নাকি এসেছেন, সেই উপলক্ষে দাওয়াত। লিসার বাবা বেশ রাশভারি লোক। লম্বা-চওড়া কেতাদুরস্ত। আমি তার সামনে নিতান্তই ছোট, বয়সেও শরীরেও। তবে বেশ অপ্যায়ন করলেন তিনি আমাকে। তার মেয়ের সঙ্গে একটা তরুণ ছেলের যোগাযোগ নিয়ে ওই বাসায় কোনো উষ্মা, বিরক্তি দেখলাম না। লিসার পক্ষ থেকে আমি ভেবেছিলাম ফোনে বা মেইলে যেসব চালাচালি হয়, সেসব হিসাবে আমি তার গোপনই। কিন্তু না। আমি তার গোপন যেমন প্রকাশ্যও তেমন। সে আমার কিছু গোপন করার জন্য আমাকে প্রকাশ্যও রাখে। সে জন্য ওই দাওয়াত দেওয়া।
তখনো ওয়ান-ইলেভেন আসে নাই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাচ্ছে খালি চোখে এটা সবাই জানে। আওয়ামী লীগ তখন খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি করেছে। লিসা বলেছে কি না, না তার বাবা নিজেই ধরে নিয়েছেন আমি পলিটিক্যাল বুদ্ধিজীবী কে জানে। তিনি আমাকে এসব নিয়েই নানা বয়ান দিলেন। দুপুর থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সেদিন ছিলাম। মোটামুটি তার আলাপ একই। তিনি এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। মতিয়া গ্রুপ করতেন। আওয়ামী লীগের একজন কড়া সমালোচক। তিনি বললেন, ‘শোনো যত যাই বলো ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। পরে পাকিস্তানের অত্যাচারের মুখে আমরা যতই ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলি না কেন, ধর্ম ব্যাপারটাকে কখনো ইগনোর করা যাবে না। আওয়ামী লীগ সেই পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন করেছে, সোভিয়েত হেজিমনির সময়ে সে ক্ষমতায় এসেছে, ছিল, তারপরও তার পক্ষে ধর্মের বিষয়টা বুঝে ওঠা জরুরি ছিল। যে কারণে শেখ মুজিব ইসলাম ধর্মের পক্ষে অনেক কাজ করেছেন। নাইন-ইলেভেনের পরে ধরতে পারো এই চাপ আরো বেড়েছে। বিগ ব্যাং বোঝো তো? ইউনিভার্সিটেতে পড়ো, বুঝার তো কথাই। বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের ঝনঝনানি বা কম্পন মহাকাশের সবকিছুতেই আছে। আদি অস্তিত্ব সবসময়ই থাকে, বুঝছো। আওয়ামী লীগও তার আদি কম্পন এড়াতে পারে না।’
আরো কী কী সব বললেন তিনি, আফিফ সাহেব। ভদ্রলোককে আমার পছন্দই হয়েছে। তিনি রিটায়ার্ড করেছেন, আমলা ছিলেন বিএনপির সময়ে। তার কাছে আওয়ামী লীগের সমালোচনা শুনতে হবে- এটা স্বাভাবিক। তবে ভরসার কথা ছিল তিনি আমার সামনে নিরপেক্ষই থাকতে চেয়েছেন।
সেদিনের পর লিসার সঙ্গে আমার দেখা ডিসেম্বরের শেষে। চিলিস রেস্টুরেন্ট দিয়ে শুরু আমাদের দেখা হওয়া। সেদিন লিসা এসেছিল শাড়ি পরে। সে বলেছিল শাড়ি হলো প্রস্তাবনা। মানে আমাদের বন্ধুত্বের প্রস্তাবনা। সালোয়ার-কামিজ হলো প্রাত্যহিকতা। দ্বিতীয় দিনে সে সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছিল। এরপর টপস, ফতুয়া, জিনস এসব পরেছিল।
লিসা বলত জিন্স হলো সেক্সি।
আরও পড়ুন ।। কিস্তি : ৬