বিদ্যাসাগর : নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ ॥ দেবোত্তম চক্রবর্তী।। গ্রন্থিক প্রকাশন, ঢাকা, জানুয়ারি ২০২১ ॥ পৃ. ৫৩৬, মূল্য: ৮৫৪ টাকা
১
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুশ বছর পুরা হল করোনাকালে। জরুরি পরিস্থিতি না হলে আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে নতুন আঙ্গিকে বিদ্যাসাগরকে দেখার একটা সুযোগ হিসাবে এই উপলক্ষটাকে আরো বেশি মানুষ নিত বলে অনুমান করি। অনলাইন সভা-সেমিনার অবশ্য কম হয় নাই। লেখালেখিও যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু যে ধরনের পর্যালোচনা ইতিহাস ও জ্ঞানগত নতুন ভিত্তি তৈয়ার করে, তা খুব একটা চোখে পড়ে নাই। নিশ্চয়ই ধীরে-সুস্থে কিছু মূল্যবান আলোচনা হবে। আমার এ ধারণা করার একটা কারণ রামমোহন রায়ের দুশ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত একটা সংকলন। ভি সি জোশির সম্পাদনায় ওই সংকলনটি বেরিয়েছিল ১৯৭৫ সালে, জন্মদ্বিশতবর্ষের বছর তিনেক পরে। ওই সংকলন বাংলাভাষীদের ইতিহাস-সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক অধ্যয়নের জন্য একটা জরুরি ভূমিকা পালন করেছিল বলেই মনে হয়।
বছর পঞ্চাশেক হল কলকাতাকেন্দ্রিক উনিশ শতকের পঠন-পাঠনে, প্রধানত কলকাতার লেখালেখিতে, একটা বড় বদল ঘটেছে। এই বদলকে এভাবে সূত্রায়িত করা যায় : উনিশ শতককে আধুনিকায়ন ও রেনেসাঁর কাল হিসাবে না দেখে, অথবা দেখার পাশাপাশি, উপনিবেশায়ন ও পশ্চিমায়ন হিসাবে পাঠ করা। আরেকটা গুরুতর বৈশিষ্ট্যও এ ধারার লেখালেখিতে পাওয়া যায় : ভালো-মন্দের বৈপরীত্যে না দেখে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার বাস্তবতায় বিচার-বিশ্লেষণ করা। অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক বাস্তবতাই-যে ওই সময়ের প্রধান পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা, সেটা হিসাবের মধ্যে রাখা। গত পঞ্চাশ বছরে বেশ সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি হয়েছে এ ধারায়। আমার হিসাবমতে রামমোহন রায়ের দুশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত জোশি সম্পাদিত রামমোহন রায় এন্ড দ্য প্রসেস অব মডার্নাইজেশন ইন ইন্ডিয়া বইটি এ ধরনের লেখালেখির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নজির।
এ ধরনের প্রভাবশালী কাজের জন্য সময়ের দরকার হয়। ফলে বিদ্যাসাগরকে কেন্দ্রে রেখে অদূর ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি ও প্রকাশনার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। দেবোত্তম চক্রবর্তী অবশ্য বেশি সময় নেন নাই। কাজের ধরন, বিস্তার ও যত্ন-আত্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি কাজ শুরু করেছেন অনেক আগে। এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের সামনে হাজির করেছেন ঢাউস কেতাব বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ। আরো বই বেরোবার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিদ্যাসাগরচর্চার দিক থেকে এবং সামগ্রিকভাবে উনিশ শতকের পর্যালোচনা হিসাবে বইটি গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হবে।
গুরুত্বপূর্ণ মনে করার প্রথম ও প্রধান কারণ বইটির উচ্চাভিলাষ। অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলার প্রধানতম ভিত্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিদ্যমান আলোচনাগুলোকে, অন্তত প্রধান ঝোঁক ও প্রবণতাগুলোকে, নিঃশেষে ব্যবহার করতে পারা। এ বইয়ের লেখক এ ব্যাপারে খুব একটা কার্পণ্য করেন নাই। নতুন যে স্কুলের কথা আমরা উপরে বললাম, তার অন্যতম প্রধান একটি কেতাব অশোক সেনের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এন্ড হিজ ইলিউসিভ মাইলস্টোনস। এ বইটি দেবোত্তম চক্রবর্তী ভালোভাবেই ব্যবহার করেছেন; এবং নিজের দিক থেকে নতুন একটি বই লেখার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বাকি বিপুল লেখালেখির অধিকাংশ তিনি ব্যবহার করেছেন মূলত যুক্তিখণ্ডনের জন্য এবং তথ্য-উপাত্তের জন্য। সেদিক থেকে এ বইটি বিদ্যাসাগর বিষয়ক পূর্বতন রচনাবলির এক ধরনের মূল্যায়নমূলক তালিকাও হাজির করে। পাঠকের দিক থেকে আরেকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈয়ার হয়।
মূল জায়গাটা আসলে পুরো বইজুড়ে ব্যাপ্ত একটা প্রকাশ্য ও গোপন তর্ক-বিতর্ক। বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী অসংখ্য ধারণার সাথে জমজমাট এক লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ মজা আছে বইটির পাতায় পাতায়।
২
ভূমিকা ও উপসংহার বাদ দিয়ে বইটি তিন পর্বে ভাগ করা। এর আগে ‘লেখকের কথা’ আছে, আছে ভূমিকাও। এ অংশগুলো সুশৃঙ্খল একটা বইয়ের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির দিকে খুব ভালোভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কী আলোচিত হতে যাচ্ছে, এবং কোন পদ্ধতিতে আলোচনাটা হবে, তার নিখুঁত ফর্দ একদিকে যেমন রচয়িতার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে তেমনি পাঠকের জন্যও এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতির নিরিখ ঠিক করে দেয়। তাকে বাধ্য করে না, কিন্তু সাহায্য করে। আরো আগে, একেবারে শুরুতেই আছে প্রকাশকের কথা। প্রকাশক তাঁর দায়িত্ব ও সীমার খানিকটা বাইরে গিয়ে উনিশ শতক ও ওই শতকের বিখ্যাত ব্যক্তিদের পাঠ-পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যগুলোতে গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিকশিত ইতিহাস-পাঠের যে সিলসিলার কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার প্রতিফলন আছে। পাঠকের জন্য এ অংশও উপকারী প্রতীয়মান হওয়ার কথা।
বইয়ের প্রথম পর্বের নাম ‘শিক্ষাসংস্কারক বিদ্যাসাগর — নতুন দৃষ্টি, নতুন দ্যোতনা’। এগার অধ্যায়ে বিন্যস্ত দুশতাধিক পৃষ্ঠার পর্বটি শুরু হয়েছে অবশ্য বিদ্যাসাগরের ঢের আগে থেকে। ঔপনিবেশিক অবস্থার যে-বিশেষ ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর দিনাতিপাত করেছেন, আর নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে অবস্থার প্রাসঙ্গিক পরিচয় ছাড়া কাজের মূল্যায়ন সম্ভব নয় — এ ধরনের একটা যৌক্তিক অনুমান থেকেই লেখক নতুন জমানার শুরু থেকেই সূত্র টেনেছেন। বলে-কয়েই কাজটা করেছেন। সাধারণত আমাদের আধুনিকতার ইতিহাস শুরু হয় উনিশ শতক থেকে। তাতে আধুনিকতার গালগল্প বেশ রসিয়ে বলা যায়। এর আগেও-যে কলোনির কয়েক দশকের ইতিহাস আছে, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ ন্যারেটিভে সে কথাটা সাধারণত উল্লেখিত হতে চায় না। দেবোত্তম চক্রবর্তী সে আমলনামা হাজির করে যথার্থ কাজ করেছেন। তিনি প্রভাবশালী বয়ানগুলোর পাশাপাশি কলোনির আইনকানুনও দেদার উদ্ধৃত করেছেন। ফলে ওই সময় সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে। আর তার নিরিখে বিদ্যাসাগরকে পড়া সহজ হয়।
একই ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় পর্বেও। ‘সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগর — নতুন তথ্য, নতুন আলো’ নামের ওই অধ্যায়ে একদিকে হেস্টিংসের আমলের আইন-প্রণয়ন, এবং অন্যদিকে প্রাচ্যবাদী চর্চার মধ্য দিয়ে হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদির মধ্যে বিশেষ বিশেষ শ্রাস্ত্রগ্রন্থের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার ইতিহাসটা বেশ কতকটা খোলাসা হয়। তাতে করে বিদ্যাসাগর কেন কয়েকটি সংস্কারের ক্ষেত্রে সাহেবদের বেজায় সহযোগিতা পান, আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন পান না, তার খানিকটা দিশা পাওয়া যায়। আবার, তিনি কোন উপলক্ষে কোন শাস্ত্রটিকে মান্য বলে ফতোয়া দেবেন, অথবা কোনটির ফতোয়া ব্যবহার করবেন, তার পর্যালোচনাও একটা নতুন তাৎপর্যে সামনে আসে। ‘সাহিত্যসংস্কারক বিদ্যাসাগর — নতুন চিন্তা, নতুন চেতনা’ নামের তৃতীয় পর্বেও লেখক বিদ্যাসাগরের ভাষাপ্রশ্নে কয়েক দশক ধরে চলা সংস্কৃতায়ন প্রসঙ্গ সামনে আনেন। বলার কথাটা হল, দেবোত্তম চক্রবর্তী বইটিতে আলোচনার ধরন হিসাবে একটা উত্তম কাজ করেছেন। আবহ তৈরি করে তার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।
কিন্তু ওটাই এ বইয়ের প্রধান আকর্ষণ নয়। মূল জায়গাটা আসলে পুরো বইজুড়ে ব্যাপ্ত একটা প্রকাশ্য ও গোপন তর্ক-বিতর্ক। বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী অসংখ্য ধারণার সাথে জমজমাট এক লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ মজা আছে বইটির পাতায় পাতায়। লেখক চেয়েছেন বিদ্যাসাগর বিষয়ক প্রধান মিথগুলো ভেঙে দিতে। কিন্তু বিদ্যাসাগরকেন্দ্রিক মিথগুলার গোড়া তো আছে উনিশ শতক বিষয়ক বিচিত্র অতিশয়োক্তিতে। ফলে লেখককে আগে লড়াই করতে হয়েছে সেগুলার সাথে। তিনি তৈরি হয়েই মাঠে নেমেছেন। তিন ধরনের সূত্র দেদার ব্যবহার করেছেন। এরমধ্যে আইনি সূত্র আর শাস্ত্রীয় সূত্রের কথা আগেই বলেছি। এগুলো বেশিরভাগ সময় প্রাথমিক সূত্র থেকে উদ্ধৃত হয় নাই। এ বইয়ের জন্য সেটা জরুরিও নয়। কিন্তু তৃতীয় যে সূত্রের কথা বলতে চাইছি, সেটা খুবই জরুরি আর কার্যকর ঘটনা। দেবোত্তম চক্রবর্তী বইটিতে বিদ্যাসাগর বিষয়ক পূর্ববর্তী প্রায় যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ রচনার পর্যালোচনা করেছেন। ফলে বইটি বিদ্যাসাগর বিষয়ক টেক্সটগুলোর আংশিক সালতামামি হয়ে উঠেছে। এই তিন সূত্রকে লেখক ব্যবহার করতে পেরেছেন পরিচ্ছন্ন ভাষা ও যুক্তিক্রমে, যার ফলে অতিকথনে ভর্তি উনিশ শতক ও বিদ্যাসাগরের অনেক এলাকা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
৩
কিন্তু এ মিথ ভাঙার প্রকল্পই বইটির সামগ্রিক ভারসাম্য বেশ খানিকটা নষ্ট করেছে বলে মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই লেখকের বিবরণী থেকে এরকম মনে হওয়া খুবই সম্ভব যে, তিনি বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত মূর্তি ভাঙার কাজে নেমেছেন। তাতেও খুব একটা ক্ষতি হত না। কিন্তু এ ঝোঁক বেশি হওয়ায় মূর্তি-বিরোধী পর্যালোচনা বেশ কয়েক জায়গায় রীতিমতো নিন্দার রূপ নিয়েছে। ব্যাপারটা শুধু গবেষণাকাজের রীতি-বিরোধী নয়, যে ধরনের ইতিহাসচর্চা গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিকশিত হচ্ছে বলে বলেছি, তার জন্যও ক্ষতিকর। কথাটা একটু খুলে বলা যাক।
বিদ্যাসাগর বড় গাছ। তাতে বাতাস লাগবেই। সমস্যা হল, অন্য অনেক গাছের ফল ওই বড় গাছের নামে চলে যায়।
বিদ্যাসাগর বড় গাছ। তাতে বাতাস লাগবেই। সমস্যা হল, অন্য অনেক গাছের ফল ওই বড় গাছের নামে চলে যায়। গাছ যতটা বড়, লোকে তারচেয়ে বড় বলা শুরু করে। তাতে ইতিহাসপাঠে ও সামগ্রিক বোধ নির্মাণে সংকট তৈরি হয়। তাই পর্যালোচনা জরুরি। যেমনটা করেছেন দেবোত্তম চক্রবর্তী। তিনি যথার্থই দেখিয়েছেন, উপনিবেশায়নের ইঙ্গবাদিতার কালে শাসকপক্ষের মনোভাবের পক্ষে সর্বোত্তম উদ্যোগ-আয়োজন করতে পেরেছিলেন বলেই বিদ্যাসাগর আর সবাইকে ছাড়িয়ে অধিকতর দৃশ্যমান হয়েছিলেন। আসলে দেবোত্তম চক্রবর্তী হুবহু এভাবে বলেন নাই। কিন্তু তাঁর বিবরণী পড়লে যে কেউ এরকম ধারণা করতে পারবে। অথচ তিনি মুখ ফুটে বহু জায়গায় কথাটা যখন বলেছেন, তখন তাঁর বয়ানে অন্যরকম ব্যক্তিগত স্বর ও সুরই বড় হয়ে উঠেছে। সে স্বরে-সুরে ক্ষোভ গোপন থাকে নাই।
কমলকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জবানে তিনি জানিয়েছেন, সাহেবদের সাথে ভালো খায়খাতির থাকার কারণেই দেশের মানুষ বিদ্যাসাগরকে অত পাত্তা দিয়েছে, অতটা মহিমান্বিত করেছে। এ কথাটাকে বর্তমান বইয়ের লেখক খুব উঁচু মূল্য দিয়েছেন। মূল্য দেবার কারণে পুরা আলোচনার ধরনটাই গেছে বদলে। যে কারো মনে হতে পারে, ওইকালের অন্য বিখ্যাত বা বিশিষ্ট মানুষদের বুঝি অন্য কোনো কারণে সুনাম হয়েছিল। কাভি নাহি। উনিশ শতকের সবাই এক গোয়ালের গরু। কেউ বড়, কেউ ছোট, কেউ মাঝারি। শতাব্দীর প্রথমার্ধে তুলনামূলক ছোট প্রশাসনে তুলনামূলক অন্তরঙ্গতার মধ্যে সাহেবদের সাথে উপনিবেশিত বাঙালি এলিট কাজ করতে পেরেছে। শতাব্দীর শেষভাগে একদিকে জাতীয়তাবাদী আবেগের জোর, আর অন্যদিকে বৃহৎ ভারতের প্রেক্ষাপটে আগের অন্তরঙ্গতার ধরন গেছে পালটে। এখানে বিদ্যাসাগরকে বিশেষভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা খুব কাজের কথা নয়। বরং বৃহৎ প্রকল্পের জন্য ক্ষতিকর।
সংস্কার-আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্র-ব্যবহারজনিত মূল্যায়নেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। প্রসঙ্গটি বিস্তারিত তুলে এনে দেবোত্তম চক্রবর্তী আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তিনি-যে পুরো ব্যাপারটাকে প্রাচ্যবিদ্যা নামক বিষবৃক্ষের সিলসিলা হিসাবে দেখাতে পেরেছেন, তাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু শাস্ত্রগ্রন্থ হিসাবে বিদ্যাসাগর কেন আগে অমুকটি বাছাই করেছেন, আর পরেই বা কেন অন্যটিতে ফিরেছেন — এ আলাপের মীমাংসা করতে গিয়ে লেখক বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে এতটা বড় করে তুলেছেন যে, গোড়ার আলাপ বেশ কতকটা মার খেয়ে গেছে। ব্যক্তিকে পারিপার্শ্বিকের আবহে দেখার মধ্যে একটা বিপদ এই, ব্যক্তির কর্তাসত্তা তাতে চাপা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে দিকে কড়া নজর রাখলে একটা আনুপাতিক মীমাংসা হয়ত সম্ভব। কিন্তু দেবোত্তম পারিপার্শ্বিককে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যাসাগর-বিবেচনার যে প্রস্তাব গোড়ায় করেছিলেন, বহু জায়গায় সে প্রস্তাব ক্ষুণ্ন করে রীতিমতো ব্যক্তির কর্তাসত্তাকে সময় ও প্রতিবেশের চেয়ে শক্তিমান করে তুলেছেন। পদ্ধতিগতভাবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বইটির তৃতীয় পর্বে তিনি হ্যালহেড ও কেরির সাথে বিদ্যাসাগরকে ত্রয়ীভুক্ত করেছেন। তাতে রামমোহন থেকে শুরু করে তত্ত্ববোধিনী পর্যন্ত বিপুল কর্মযজ্ঞ, ব্যাকরণ-অভিধান, পত্রপত্রিকা, গদ্য-বিষয়ক প্রভাবশালী ডিসকোর্স ইত্যাদি এড়িয়ে দ্রুত হাজির হতে হয়েছে বিদ্যাসাগরের দরবারে। এ অধ্যায়ে লেখক গত দু-তিন দশকে প্রকাশিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যবহার করেন নাই। সেটা গলদের একটা কারণ হতে পারে। তবে তিনি যে-উপাদানগুলো ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর বরাতেই বিদ্যাসাগরকে একটা প্রসেসের মধ্যে বড় ভূমিকা পালনকারী হিসাবে দেখাতে পারতেন। ব্যক্তি-লেখক হিসাবে অতটা গুরুতর করে তোলার দরকার ছিল না। বলার যথেষ্ট কারণ আছে, উপনিবেশিত গদ্যের দায়টা বিদ্যাসাগরের ভাগে একটু বেশি পরিমাণে ফেলার একটা চেতন-অচেতন তাগিদ তাঁকে দিয়ে এই অনৈতিহাসিক দোষারোপ করিয়ে নিয়েছে। আমরা মোটেই এদিক থেকে বিদ্যাসাগরকে রেয়াত দেয়ার কথা বলছি না। কিন্তু তিনি প্রভাবশালী ডিসকোর্সের নিষ্ঠাবান খাদেম হিসাবেই বিবেচিত হওয়ার যোগ্য, মত-পথের স্রষ্টা হিসাবে নয়। আইরনি এই, দেবোত্তম চক্রবর্তী অন্তত কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে সমালোচনার উপলক্ষ করতে গিয়ে অন্যায্যভাবে সময়ের কর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। হয়ত নিজের অজান্তেই।
৪
বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ বইটি মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরকে ঘিরে যে-বিপুল মিথ ও মিথ্যাচার জ্ঞানের নামে বা আলোর নামে জ্ঞানীরা জড়ো করেছেন, সেগুলো ভাঙার ব্রত নিয়ে অগ্রসর হওয়ায় দেবোত্তম চক্রবর্তী পূর্বোক্ত ফাঁদ এড়াতে পারেন নাই। আমাদের বিবেচনায়, তিনি যদি মিথ বা মূর্তিভাঙার কাজটা আলাদা করে আগে সেরে নিয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় নামতেন, তাহলে এ পদ্ধতিগত ত্রুটি অনেকটাই এড়ানো যেত। পুরনো জীবনীগুলোর পর্যালোচনা দেবোত্তম ভালোভাবেই করেছেন। কিন্তু তার সাথে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা একাকার হয়ে যাওয়ায় আমাদের শনাক্তকৃত গোলমালটা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ দিলে কথাটা ভালো বোঝা যাবে। অন্তত বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক পাঠের তুলনায় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পাঠ অনেক বেশি প্রভাবশালী। ফলে অনেককেই, খুব সঙ্গত কারণে, ওই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের মোকাবেলা করতে হয়। এটা করতে গিয়ে সাহিত্যিক বা চিন্তক বা সংস্কৃতি-নির্মাতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথের যে-অতুলনীয় ভূমিকা, তার প্রতি সুবিচার করা প্রায়ই সম্ভবপর হয় না। ঠিক একই রকম একটা ভেজালে দেবোত্তম চক্রবর্তী পড়েছেন বলেই মনে হয়।
অথচ, বিদ্যাসাগরকে যেভাবে মিথিকেল করে তোলা হয়েছে, আর সেই মিথের বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের পঠন-পাঠনে যে-বিভ্রান্তি তৈরি করছে, তার মোকাবেলা জরুরিই বটে। উনিশ শতককে এতটা মিথিকেল করে তুলতে হয়েছে কেন? উত্তরটা খুবই সহজ। এটা নিশ্ছিদ্র ঔপনিবেশিক আমল। রেনেসাঁ, আলো, বা উন্নতির গালগল্প অল্প কিছু মানুষের। বাকি শতকরা নব্বইভাগ জমাট অন্ধকার। কাজেই আলোওয়ালারা তাদের মিটিমিটি আলোকে এতটা বাড়িয়ে তুলেছেন, তুলতে বাধ্য হয়েছেন, যেন আলোর মায়ায় চোখ ধাঁধিয়ে অন্ধকারের কথাটা ভুলিয়ে দেয়া যায়। ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা বর্ণবাদ। সেই বর্ণবাদকে আরো পাকাপোক্ত হতে দিয়ে যে-সমাজ কায়েম করেছে উনিশ শতকের আলো, তার ফাঁকিটা আড়াল করতে গিয়েই আলোটাকে বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। সতীদাহ, বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ ইত্যাদির সাথে বিপুল নিম্নবর্ণের ও বর্গের আদৌ-যে কোনো সম্পর্ক ছিল না, বিপুল মুসলমান জনগোষ্ঠীর বা অন্য নৃগোষ্ঠীর-যে কোনো যোগ ছিল না, সে কথাটা আড়াল করতেই একে চালাতে হয়েছে রেনেসাঁ বা আধুনিকতা নামে। ঔপনিবেশিক শাসনের পুরুষতন্ত্র আর ব্রাহ্মণ্যবাদের পুরুষতন্ত্র মিলে নিরেট পুরুষতন্ত্রের মধ্যে ভদ্রনারীকুল উৎপাদনের আয়োজনকে দাবি করতে হয়েছে নারীমুক্তির আন্দোলন।
আরো একটা বড় ঝামেলায় পড়তে হয়েছে ওই আলোর বয়ান-নির্মাতাদের। বয়ানগুলো তৈরি হয়েছে মুখ্যত বিশ শতকে। তদ্দিনে জাতীয়তাবাদী জোশ বেশ চাঙ্গা। অথচ উনিশ শতকের যেসব আলো তার ভরসা, সেখানে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে কিলবিল করছে বিজাতীয় শাসকদের প্রাচ্যবাদী-ইঙ্গবাদী হাত। কাজেই বয়ানগুলোতে ওইদিকটা জুতমতো আড়াল করতে হয়েছে। বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমের ব্রিটিশ-বিরোধিতার গালগল্প সে তাঁবেই রচিত। দেবোত্তম চক্রবর্তী এই মূল জায়গাগুলোকে এক্বেবারে ঠিকঠাকমতো পাকড়াও করেছেন। বর্ণ-বিদ্বেষ, মুসলমান-বিদ্বেষ, ইংরেজপ্রীতি ও সক্রিয়তা, নারীবিরোধী পুরুষতন্ত্র ইত্যাদিকে প্রধান ডিসকোর্স হিসাবে ঠাহর করতে পারা তাঁর গভীর ইতিহাসচেতনার প্রমাণ। বিদ্যাসাগরকে আলাদা করে এ ব্যাপারগুলোর কারবারি হিসাবে সাব্যস্ত করাটাই শুধু অনেক ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করেছে।
সে এতটাই যে, তাঁকে বহু বিষয়ে সাক্ষ্য মানতে হয়েছে ইয়ং বেঙ্গলদের। কাজটা ঠিক হয় নাই। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ধারণাগুলো শিরোদেশে স্থাপন করে বিদ্যাসাগরকে তার বিপরীতে পড়ার চেষ্টাও পদ্ধতির দিক থেকে ক্ষতিকর হয়েছে মনে করি। আমরা জানি, বিদ্যাসাগরের নামে জমে ওঠা মিথগুলোর একাংশ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের রচনা বা তাঁর প্রশ্রয়প্রাপ্ত। এর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কাউন্টার ডিসকোর্স হিসাবে ব্যবহার যুক্তিসহ হয় নাই। বোঝা যায়, লেখক বিদ্যাসাগরকে সচেতনভাবে অথবা অচেতনে খানিকটা আলাদা করে ফেলেছেন। সে কারণেই পর্যালোচনার জায়গায় কোথাও কোথাও মন্তব্য, সিদ্ধান্ত বা ঝোঁকগুলো নিন্দার রূপ নিয়েছে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বিধবাবিবাহ দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এ তথ্য স্বীকার করে দেবোত্তম লিখেছেন, তিনি নিজেই এ পথ প্রস্তুত করেছিলেন। খুবই খারাপ ব্যাখ্যা। মনে-মননে ব্যাপারটাকে নারী ও সমাজমুক্তির উপায় হিসাবে গণ্য না করলে বিদ্যাসাগর এ কাজ কখনোই করতেন না। তাহলে এ ঘটনার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় উৎপন্ন প্রগতির ধারণায় বিদ্যাসাগর এবং অন্যরা খাঁটি ইমানদার ছিলেন, এবং ইমানের পক্ষেই আমল করেছিলেন। এর বাইরে অসততা, ষড়যন্ত্র, চালাকি, ইংরেজপ্রেম, উচ্চবর্ণপ্রেম ইত্যাদি শব্দ বা পদ্ধতির ব্যবহার বিশ্লেষণকে মাঠে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। ঠিক এদিক থেকেই চাকরি জোটানো বা জুটিয়ে দেয়া, ধুমায়া স্কুল তৈরি করা ও বাজেট পাশের আগেই খরচ করা, কিংবা নিজের বেশুমার বই ছাত্রপাঠ্য হিসাবে অনুমোদন নিয়ে নেয়া ইত্যাদি কোনো পর্বেই দেবোত্তম চক্রবর্তীর অনুমান ও মূল্যায়নকে সন্তোষজনক বলা যাবে না।
৫
আমাদের বিবেচনা মোতাবেক কিছু পদ্ধতিগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকট সত্ত্বেও দেবোত্তম চক্রবর্তীর বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ সন্দেহাতীতভাবে একটা জরুরি বই। উনিশ শতক সম্পর্কে আগ্রহী যে কোনো পাঠকের জন্য এ বই বিস্তর প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের আকর। এমনকি কেউ যদি স্রেফ বিদ্যাসাগর বিষয়ে পড়তে চান, এবং ভালো কথাই কেবল শুনতে চান, তার জন্যও বইটি উপকারী। কারণ, খানিকটা সন্দিহান দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণিত হলেও বিদ্যাসাগরের কাজের বিপুলতা ও প্রভাব এর মধ্য দিয়ে নির্ভুলভাবে টের পাওয়া যায়।
প্রকল্পটি লেখকের গভীর যত্ন ও মনোযোগের সাক্ষ্য বহন করছে। উদ্ধৃতি-কণ্টকিত বিবরণী এত মসৃণভাবে রচিত হয়েছে যে, ক্লান্তিহীনভাবে পড়ে ফেলা যায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বইটির প্রকাশকও নগদ ধন্যবাদ প্রাপ্য। লাইন ও প্যারার বিন্যাসে এবং লিপির নির্বাচনে বিশিষ্টতা আছে বলেই অতটা আরামে পড়া যায়। পাঠকের জন্য বইয়ের পর্ব-বিভাজনটা হয়ত অভাবনীয় নয়, কিন্তু অধ্যায়-বিভাজন আর শিরোনামগুলো নিঃসন্দেহে আমোদজনক। ‘এক অনন্ত লুঠের কাহিনি’, ‘সংস্কৃতের আবাহন, সংস্কৃতির বিসর্জন’, ‘আহা ইংরেজি, বাহা ইংরেজি’, ‘দেশি ধান বনাম বিলিতি ওক’, ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’, ‘উচ্চবর্ণের পৌষমাস, নিম্নবর্ণের সর্বনাশ’, ‘শাস্ত্র! শাস্ত্র! তোমার মানবতা নাই বিদ্যাসাগর?’ ইত্যাদি শিরোনাম আমার কাছে ঈর্ষণীয় মনে হয়েছে। লেখকের অভিনিবেশের ব্যাপারে আমাকে আরো নিশ্চিত করেছে।
বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ আগামী দিনগুলোতে কিভাবে পঠিতে হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে, উনিশ শতক এবং বিদ্যাসাগর পাঠের বিপুলতায় এ বই নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে বলেই ধারণা করি।