১৯৮০ সালে জাপান গিয়েছিলেন দেরিদা। সেখানকার পণ্ডিতদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, গল্প-গুজব করতে। জাপানি পণ্ডিতেরা তাকে মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের আসলে দেরিদার তত্ত্ব দরকার নেই। কেন? কেন? প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ, জাপানের নাকি নিজস্ব ধরনের ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ পদ্ধতি আছে। এবং জেন-চর্চাই নাকি তাদের সেই নিজস্ব ঘরানার ‘ডিকনস্ট্রাকশন’। কেননা, জেন-বৌদ্ধদের তৎপরতা মূলত শূন্যেরই কারবারি। দেরিদা যদিও জাপানি পণ্ডিতদের সঙ্গে একমত হননি। কারণ, তখনও নাকি জাপানের অনেককিছুই ‘ডিকনস্ট্রাকট’ করার বাকি। যাইহোক, এই ঘটনা দিয়ে কথা শুরু করার ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আমাদের এখানে যেকোনো চিন্তা বা তত্ত্ব একরকম বিনা বিচারেই আমদানি ও গৃহীত হয়। যতটা পারি আমরা তাকে অক্ষতভাবেই গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নেই। যদি সাধ্যে না কুলায়, চেষ্টা করি সেই তত্ত্বের আলোকে নিজেদেরই বদলে নিতে। এবং সেই বৈদেশি চিন্তাকে আমরা মানি সর্বজনীন সত্যের প্রতিভূ — যা কেবলমাত্র উদ্ধৃতি প্রদানের জন্যই সদা সংরক্ষিত থাকা চাই। তাকে পর্যালোচনা ও ঝাড়াই-বাছাইয়ের মতো শেরেকি কাজ করার সাহস আমাদের কোনোদিনই হয় না। জাপানিদের মতো করে আমরা বলতে পারি না যে — তোমার তত্ত্ব আমাদের লাগবে না — এক্ষেত্রে আমাদের ভিন্ন কিছু বলার আছে। অবশ্য, এটা বলার জন্য আগে তো গড়ে তোলা চাই চিন্তা-চর্চার নিজস্ব জমিন। থাকতে হবে শক্ত পায়ে সেই মাটিতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। এক্ষেত্রে একটা ‘প্যারাডক্স’ কাজ করে। নিজেকে না জানলে পরকে জানা যায় না। আবার পরকে না জানলেও বাকি থাকে নিজেকে জানা।
সংযোগ
কোনো চিন্তাই পরম্পরা বর্জিত নয়। দেরিদারও নিশ্চয়ই ঠিকুজি আছে। দেরিদা যে পশ্চিমা চিন্তারই প্রবাহ, এ-কথা না মানার কি কোনো উপায় আছে! কথাটা অনেকেই এভাবে বলেন: দেরিদা যদি পশ্চিমা চিন্তার কোনো গতি করেই থাকেন, তবে তিনি তা করেছেন নিটশে, ফ্রয়েড, হাইডেগার ও সস্যিউরের কাঁধে বন্দুক রেখে। তেমনি নিটশের কাছ থেকে দেরিদা যদি কিছু নিয়েই থাকেন তবে সেটা তার সংশয়ী দৃষ্টি। দর্শনকে দেখার সংশয়ী চোখ। বিশেষ করে সত্য বিষয়ক দাবি-টাবি নিয়ে নিটশের মতো তিনিও ছিলেন সন্দেহবাতিক। নিটশের মতো দেরিদাও মনে করতেন, আমরা সবাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দাসানুদাস। তাই অপরের দৃষ্টি পরিবর্তনের কর্মসূচিকে তিনি সন্দেহ না করে পারেননি। জ্ঞানক্ষেত্রে চিন্তার উদ্দাম নৃত্যের প্রদর্শন – নিটশের মতো দেরিদার রচনারও স্টাইল। হাইডেগারের কাছ থেকে দেরিদা ধার করলেন ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ শব্দটি। ‘Deconstruction’ শব্দটি এসেছে হাইডেগারের ‘Destruktion’-এর ধারণা থেকে। ‘ডিস্ট্রাকশন’ শব্দটি হাইডেগার সম্ভবত ব্যবহার করতেন স্বরূপ-সন্ধানের ধারাবাহিক চর্চার ক্ষয় চিহ্নিত করতে। এছাড়া, কোনো একটি শব্দ লিখে, তাকে ক্রস মেরে, শব্দটিকে চলকরূপে হাজির করার স্টাইলটাও দেরিদা হাইডেগারের কাছ থেকে শিখেছেন।
‘ডিকনস্ট্রাকশন’ কী?
‘ডিকনস্ট্রাকশন’ নিয়ে কেউ সারাদিন কথা বলতে পারে। কিন্তু ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ কী? — এই ধরনের কুফরি প্রশ্ন একবারও করা যাবে না। প্রশ্ন করা হলেও, এই প্রশ্নের কোনো প্রকার জবাব ধার্য করা একদম অনুচিত হবে। কারণ, যে জবাবই ধার্য করা হোক না কেন, সেটি হবে আরেক প্রকার ‘কনস্ট্রাকশন’। যা ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। দেখা যাবে, সেই ‘কনস্ট্রাকটেড’ সংজ্ঞাকেও আবার ‘ডিকনস্ট্রাকট’ করতে হচ্ছে। ফলে, তাত্ত্বিকভাবেও এটা একটা ঝুঁকি। এই বিপদটা সম্পর্কে সচরাচর সতর্ক থাকা হয় না। বিভিন্ন লেখাপত্রে তাই ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ বলতে একপ্রকার ‘রিকনস্ট্রাকশন’-এরই ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই বিষয়ে সচেতন থাকাটা জরুরি। নয়তো দেরিদার চিন্তার মৌল প্রবণতাটাই এক্ষেত্রে গায়েব হয়ে যায়।
‘কনস্ট্রাকশন’-এর যেকোনো প্রকার খবরদারির ব্যাপারেই দেরিদা অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। ফলে, ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ হলো – ‘এই’ অথবা ‘সেই’। তার কাছে এই ধরনের জবাবের কোনো মানে হয় না। কারণ, এ-ধরনের কোনো সংজ্ঞাই ‘ডিকনস্ট্রাকশন’কে উপস্থাপন করতে সক্ষম নয়। ফাঁক রয়েই যায়। এ-কারণেই কারও দিকে তর্জনী তুলে এ-কথা বলাও মুশকিল যে, তিনি ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ বোঝেন নাই। কারণ, এই কথা বলা মানে, মনে মনে ঠিকই একটি সংজ্ঞা দাঁড় করানো। এই সুবাদে আবার ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর নামে সূচের ভেতর দিয়ে সমানে পাচার হচ্ছে হাতি-ঘোড়া। কে হাতি, কে ঘোড়া এই বিচারের চেয়ে বরং এভাবে বলাই ভালো, ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ একটি জানাবোঝার প্রক্রিয়া। কোনো কিছু (টেক্সট) পাঠ-টাঠ করার পদ্ধতি। যেখানে ‘কেন্দ্র’-এর মাস্তানির ব্যাপারে পাঠকের পক্ষ থেকে খুবই সচেতন থাকা হয়। ‘কেন্দ্র’কে বুড়ো আঙুল দেখানো বা তার বিভিন্ন ভড়ংকে প্রকাশ্যে ন্যাংটা করার বিষয়টি এই পঠন-প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব পেয়ে থাকে। পঠন-পাঠনের এই প্রক্রিয়াটি কেন্দ্রের আধিপত্য নস্যাৎ করে করেই এগিয়ে যায়।
কেন্দ্র কী? কেন্দ্রের সমস্যা কোথায়?
প্রতিটি ‘কনস্ট্রাকশন’-এরই একটি কেন্দ্র থাকে। বৃত্তের যেমন কেন্দ্র থাকে, তেমন। এটি মূলত ভাবকেন্দ্র। খালি চোখে দেখা যায় না। অন্তরচক্ষু দিয়ে ঠাহর করতে হয়। উদাহরণ দিলে অবশ্য ঠাহর করা সহজ। নিজেদের সংস্কৃতি বাদে অন্যান্য ধর্মীয় আচার-সংস্কৃতি সম্পর্কে ছোটোবেলা থেকেই আমরা নানান মন্তব্য করে করে অভ্যস্থ। এই যেমন: ‘হিন্দুরা মাটির ভুইত্যার পুজা করে/ খ্রিস্টান ধর্ম এখন বাতিল/ তোমাদের নবি কেন এতোগুলো বিয়ে করেছেন/ গারোরা সাপ-ব্যাঙ খায়।’ এই রকম উদাহরণের আসলে অভাব নাই। আমি মূলত ধোয়ামোছা উদাহরণগুলোকেই সামনে আনলাম। কে হায় কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপকে জাগাতে ভালোবাসে! তো ওপরের মন্তব্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক কোথায়? আছে। ‘হিন্দুরা মাটির ভুইত্যার পুজা করে।’ এই মন্তব্যটি এমন কেউ কখনো করবেন না, যিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বা হিন্দু ধর্মকে সত্য জ্ঞান করেন। অর্থাৎ, যার চিন্তার কেন্দ্রে বিরাজ করে হিন্দুধর্মীয় জ্ঞান। তেমনি অপর মন্তব্যগুলোও সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো ব্যক্তির পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে যারা ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত নয়, যাদের চিন্তার কেন্দ্রে ইসলামী-জ্ঞান নেই, ইসলাম সম্পর্কে তারা সুযোগ পেলেই কটূক্তি করে। এইসব মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যসমূহ আর কিছু নয় – কেন্দ্র ও পরিধির খেলা।
যেকোনো বৃত্তের একটিই কেন্দ্র থাকে। বৃত্ত যেমন একটি কাঠামো। তেমনি যেকোনো চিন্তারই একটা কাঠামো থাকে। ধরে নিলাম তা বৃত্তাকার। তো, ধর্ম নিয়েই যদি কথা হয়, তবে কোনো একটি ধর্মকে কেন্দ্রে জায়গা দিলে, বাকিদেরকে তা পরিধিতে পাঠাবেই। কারণ, কেন্দ্রের পর পরিধিই বিকল্প জায়গা। আমাদের চিন্তার কাঠামোতেও দুইটিই জায়গা। কেন্দ্র আর প্রান্ত। ফলে, ইসলামকে কেন্দ্রে বসালে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যন্যের স্থান হবে পরিধিতে। দেখা যাবে, ইসলামী চিন্তাই তখন অন্যান্যের সম্পর্কে জ্ঞান উৎপাদন করবে। জ্ঞানোৎপাদনকে প্রভাবিত করবে। কেন্দ্রের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলে কি পরিধি গড়া যায়! যায় না। পরিধি কেন্দ্রের ওপর নির্ভশীল। শুধু ইসলাম নয়, এটা বাদবাকি ধর্মগুলোরও ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি খ্রিস্টান ধর্মকে কেন্দ্রে বসানো হয়, তবে পরিধিতে চলে যাবে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মসমূহ। তখন সেইভাবেই উৎপাদিত হবে সত্য। কেন্দ্রে যা অধিষ্ঠিত হয়, তা-ই মূলত অর্থ উৎপাদন করে। প্রভাবিত করে অর্থ তৈরির প্রক্রিয়াকে। জোর প্রয়োগে তাকে নিজের অধিকারে রাখে। এই সুবাদে কেন্দ্রীয় ভাব নিজেকে হাজির করে একমাত্র সত্য রূপে। আবার কেন্দ্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় উপস্থাপিত সেই একমাত্র-সত্যের চেহারা। আগে যা কেন্দ্রে ছিলো, পরে তা-ই আবার পরিধিতে গড়াগড়ি খায়। এভাবে কেন্দ্রকে বদল করতে করতে সত্যের পরিবর্তনশীল রূপটাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। তখন বিদ্যমান সত্যের শরীরে ঘাপটি মারা আধিপত্যবাদকে কান ধরে টেনে বের করা যায়। ধরা পড়ে কেন্দ্রের জালিয়াতি। এই জালিয়াতি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খসে যায় বিদ্যমান সত্যের মুখে আঁটা পবিত্রতার চিরন্তন মুখোশ।
এই আলাপটাকে দেরিদা এতো সহজভাবে করেননি। একটি ‘আইকন’কে কেন্দ্র থেকে অপসারণ করে আরেকটি ‘আইকন’কে সেখানে বসানোই তার মূল কর্মসূচি নয়। যিশু/ গৌতম, গৌতম/ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ/ যিশু এই ধরনের বিরুদ্ধ জোড়ই কেবল নয় – দেরিদা দেখলেন – পুরো বাস্তবতাটাই এভাবে গাঁথা হয়েছে বিরুদ্ধ ফোঁড়ের (বাইনারি অপোজিশন) বুননে। এবং এই প্রতিপক্ষ জোড়ের কাঠামোতে কোনো একটি ফোঁড় আবার সুবিধাভোগী। ফলে, প্রভাবশালী। একটি প্রভাবশালী বলে বাকিটা আবার প্রান্তিক। ফলে, স্তিমিত ও অনুচ্চারিত হয় তার স্বর। তার সত্য। অর্থাৎ, মাঠ এখানে সমতল নয়। খেলা এখানে ‘ফিক্সড’। জয় এখানে নির্ধারিত। দেরিদা দেখলেন, জোড়ের আধিপত্যবাদী অংশটিই পুরো গঠনটাকে নিয়ন্ত্রণ ও চালিত করে। তাছাড়া ইতিহাসের কোনো বিশেষ পর্বের অসামঞ্জস্য এটি নয়। গোটা পশ্চিমা চিন্তার কাঠামোতেই তিনি এই প্রবণতা সনাক্ত করলেন। দেরিদাকে উদ্ধৃত করা যাক:
It would be easy enough to show that the concept of structure and even the word ‘‘structure’’ itself are as old as the episteme – that is to say, as old as Western science and Western philosophy – and that their root thrust deep into the soil of ordinary language, into whose deepest recesses the episteme plunges in order to gather them up and to make them part of itself in a metaphorical displacement.(Derrida, 2001: 352)
এই ধরনের গঠনবাদী চিন্তার ছাপ ভাষার মধ্যেও একদম গেঁথে গেছে। ফলে, চিন্তার সমগ্র পরিসরেই এর প্রভাব বিদ্যমান। এমনকি আমাদের চারপাশের গঠিত বাস্তবতার গভীরেও এর বীজ। নারী/পুরুষ, ভালো/মন্দ, সত্য/মিথ্যা, সাদা/কালো, হিন্দু/মুসলমান, আস্তিক/নাস্তিক, সভ্য/বর্বর এইসব বিরুদ্ধ ফোঁড়ে গাঁথা আমাদের বাস্তবতা। উদাহরণ দিয়ে পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলা যাবে। দেরিদা বুঝলেন, এই প্রকার ভাবাদর্শিক জোড়াজুড়ি না মানলে বাস্তবতার গণ্ডিতেই জায়গা হয় না। তার ভাষায়:
The function of this center was not only to orient, balance, and organize the structure – one can not in fact conceive of an unorganized structure – but above all to make sure that the organizing principle of the structure would limit what we might call the play of the structure. By orienting and organizing the coherence of the system, the center of a structure permits the play of its elements inside the total form. And even today the notion of a structure lacking any center represents the unthinkable itself. (Derrida, 2001: 352)
এভাবে প্রতিটি মন্তব্যই, প্রতিটি সত্যই কেন্দ্র ও পরিধির সূত্রে গাঁথা। এভাবে আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি বক্তব্যই মেনে নেয় বিরুদ্ধ জোড়ের গঠন। ফলে, ধ্বংস হয় অর্থের লীলাময় গুণ। অর্থ হয়ে পড়ে স্থির। নির্দিষ্ট অর্থের এই স্থিরতা প্রণয়ন করে এক ধরনের আধিপত্যবাদী সমাজ। সত্য হয়ে ওঠে একরোখা। গড়ে তোলে ফ্যাসিবাদী সমাজ। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। সত্য মাত্রই তখন উন্মোচন করে তার ফ্যাসিবাদী চেহারা। যেমন, সামাজিক নীতি-নির্ধারণের কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত পুরুষ গড়ে তোলে পুরুষবাদী সত্য। সেই সত্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পুরুষবাদী সমাজ। সেই সমাজে অনুচ্চারিত থাকে নারীর স্বর। নারী সেখানে প্রান্তীয়। নারীর বাস সেখানে পরিধিতে। নারী সেখানে নির্মিত হয় পুরুষের মানদণ্ডে। নারী হয়ে ওঠে শরীর-সর্বস্ব। শরীর হয়ে ওঠে নারীর বিদ্যমান অস্তিত্ব।
‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে একধরনের সমতলীয় ক্ষেত্র, যেখানে খেলা করে অর্থের বহুমাত্রিকতা। দেরিদা একে ‘খেলা’ বলেই চিহ্নিত করেন।
চিন্তার গাঠনিক সমস্যা এখানেই। এটিই ‘কেন্দ্র’-এর সমস্যা। কেন্দ্র আর পরিধির কাঠামোতে এটিই কেন্দ্রের সন্ত্রাস। একইভাবে কেন্দ্রে যদি অবস্থান করে বাঙালি-বাংলাদেশ তাহলে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সত্য বোঝা কষ্টসাধ্য হবেই। কারণ, তারা তখন প্রান্তিক। তারা তখন ‘নগরের বাহিরের ডোম্বী’। ফলে, তার সত্যও তখন নগরের বাইরের সত্য। নগর হলো কেন্দ্র, গ্রাম হলো পরিধি। ‘গ্রামের চেয়ে নগর ভালো।’ পরিধির ভাষা সর্বদাই অবদমিত। অবদমিত তার আকাঙ্ক্ষার ভাষা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আসলে এই একই কথা খাটে। ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ায় সামাজিক এই ঠাসবুননটিই আলগা হয়ে পড়ে। দুই ফোঁড়ের মাঝখানের সুতা ধরে এটি এমন টান দেয়, পলকেই আলগা হয়ে আসে বাঁধন। প্রকাশ্য দিবালোকে স্পষ্ট ধরা পড়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী রূপ।
‘ডিকনস্ট্রাকশন’ কোথায় পৌঁছে দেবে?
‘ডিকনস্ট্রাকশন’ আমাদের কোথায় পৌঁছে দেবে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চিন্তার কেন্দ্র থেকে বাঙালিকে সরিয়ে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীকে বসালেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো? না, সমস্যার সমাধান হলো না। যেমন, পাকিস্তানিদের সরিয়ে কেন্দ্রে বাঙালিরা অবস্থান নেওয়ার পরেও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান হয়নি। তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বদলে নারীকেন্দ্রিক সমাজ কোনো সমাধান নয়। তবে ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয় – অবদমিত সত্যগুলো তাদের কণ্ঠে ভাষা ফিরে পায়। এবং এটি নির্দেশ করে অর্থের লীলাময় চরিত্র – তার পরিবর্তনশীলতা, তার ক্ষণস্থায়ীত্ব। এর ফলে, যাবতীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সামাজিক শর্ত গড়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় প্রান্তিক গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে কাতারে কাতার মেলানোর যৌক্তিক পটভূমি। সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বহুদলীয় সংলাপের পরিসর প্রস্তুত হয়।
‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে একধরনের সমতলীয় ক্ষেত্র, যেখানে খেলা করে অর্থের বহুমাত্রিকতা। দেরিদা একে ‘খেলা’ বলেই চিহ্নিত করেন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তার সেই বিখ্যাত বক্তৃতাটির নাম ছিলো, ‘‘Structure, Sign and Play in the Discourse of the Human Sciences’’। এই খেলা, ভাবের অর্থময়তার খেলা। অবাধ খেলা। যেখানে কোনো প্রকার কর্তৃত্বই আর ক্রিয়াশীল নয়। একে ‘লীলা’ ধারণাটি দিয়ে বুঝলেই বরং বোঝার গভীরতা বৃদ্ধি পায়। ফলে, ‘টেক্সট’জুড়ে কেবল বিরাজ করে অর্থময়তার এক অপার লীলা। একজন ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’ প্রথমেই টেক্সটের অভ্যন্তরে নিহিত বিরুদ্ধ ফোঁড়ের বুননটি চিহ্নিত করেন। তারপর দেখান যে, টেক্সটে তারা পরস্পর কীভাবে সম্পর্কিত রয়েছে। অর্থাৎ, তাদের একটি অংশ কীভাবে কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে বাকি অংশটিকে করে তুলেছে প্রান্তীয়। কীভাবে প্রভাবশালী অংশটি জারি রেখেছে আপন কর্তৃত্ব। এরপর ক্ষণস্থায়ীভাবে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে তিনি নস্যাৎ করে দেন। ফলে, প্রান্তীয় অংশটি আবির্ভূত হয় তার প্রকৃত চেহারায়। এভাবেই প্রকাশ পায় অর্থময়তার লীলা।
‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর ঘাটতি কোথায়?
‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’রা কোনো একটি তত্ত্ব পর্যালোচনার সময় সেই তত্ত্বে বিদ্যমান কেন্দ্রাভিমুখীনতা সনাক্ত করেন। ভাঁজ খুলে দেখান যে, সেই তত্ত্বের গঠনকাঠামোয় কীভাবে একটি কেন্দ্রীয় টান ক্রিয়াশীল রয়েছে। এবং তা নির্দেশিত হয় সেই তত্ত্বের খামতি হিসেবে। সেই হিসেবে একজন ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’ চিন্তার দিক থেকে থাকবেন একদম শূন্য। অবাধ ও নিরপেক্ষ ‘ব্ল্যাঙ্ক ডিস্ক’। ভালো মন্দ কিছুই যেখানে আগে থেকে ‘আপলোড’ করা নাই। তাই হওয়ার কথা। ফলে, তার কাজ হবে নৈর্ব্যক্তিক। তিনি কাজ করবেন বিষয়গত ‘ডিফারেন্স’-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, শেষাবধি যে কেন্দ্রীয় টানটি সনাক্ত হবে তা মূলত টেক্সটেই নিহিত থাকবে, ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’-এর মাথায় অন্তত নয়। কিন্তু রবার্ট উইকস এতে বাদ সাধছেন। তিনি খোলাসা করে জানিয়ে দিলেন তার আপত্তির কথা। তার কথা হলো:
If we consider examples of Derrida’s own deconstructions, for instance, we notice that they are impressively imaginative, and are unlikely to have been duplicated by anyone who might have been independently deconstructing the same text. This is due, significantly, to Derrida’s own wealth of knowledge… The deconstructor is thus very far from acting as the objective force of difference when approaching a text. The deconstructor always operates with a wealth of background presuppositions, and unavoidably brings these to bear on the activity of discerning the text’s tensions and internal conflicts. Any particular deconstruction, then, will carry the mark of the deconstructor. (Wicks, 2003: 215)
রবার্ট উইকসের আপত্তি – ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’রা যেকোনো প্রকার পূর্বানুমান থেকে নিজেদের দূরে রাখতে অপারগ। এমনকি এটা হতে পারে তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতার মতো ব্যাপার। নয়তো একই টেক্সট ‘ডিকনস্ট্রাকট’ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এতো গরমিল কেন! এছাড়া তিনি ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ারও ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ তত্ত্বের কথা তুললেন। তার কথা হলো, কমনসেন্সের খাতিরে হলেও একজন ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’কে চিন্তার কোনো একটি গড়পড়তা সেটের প্রতি আস্থাশীল হতেই হয়। তার ভাষায়:
The deconstructor may be aware of the metaphorical resonance of language, but this does not imply that the finite consciousness of the deconstructor operates within the world without a determinate perspective. This perspective constitutes a background theory, as the deconstructionist understands the term, if only in the rudimentary sense of containing basic distinctions and priorities – distinctions and priorities such as that between physical objects and hallucinations, mirages, afterimages, etc. The deconstructor’s consciousness (and everyone’s consciousness) is thus constituted by a theory in fusion with the metaphorical resonance that attends the term of that theory. (Wicks, 2003: 215)
রবার্ট উইকসের প্রস্তাবণাসমূহ বিনা সন্দেহে পর্যালোচনার দাবিদার। এছাড়া, মার্কসবাদীরাও ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর সমালোচনা করেন। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় কোনো পজিশন তৈরি হয় না দাঁড়াবার। এই বৈশিষ্ট্যকে তারা ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর একরকম অক্ষমতা হিসেবেই দেখিয়ে থাকেন।
নিজে থেকে চিন্তা করতে শুরু করলেও ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর কিছু ফাঁক টের পাওয়া যায়। কিন্তু ভাষা দিয়ে তাকে দাঁড় করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সম্ভব না হওয়ার ক্ষেত্রে পারিভাষিক অদক্ষতার পাশাপাশি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গরিবিও কম দায়ী নয়। দেরিদার মতো এতো বড়ো পণ্ডিতকে ছেদ করতে আমাদের সাহসে কুলায় না। এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সচরাচর আমরা কোনো চিন্তাকে (দেশি বা বিদেশি) তার প্রবাহ থেকে বিচ্ছিনভাবেই বুঝে থাকি। ফলে, তাকে জুৎ মতো ঠেসে ধরার কৌশলটা আমাদের অজানাই রয়ে যায়। এর ফলেও আমরা কোনো চিন্তাকে – ঐ অর্থে – পর্যালোচনা করতে শিখিনি। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে ‘শেষ কথা’ বলে কিছু থাকতে নেই। তাকে পর্যালোচনার ওপরেই রাখতে হয়।
বইপত্র
১. Jacques Derrida, Writing and Difference, trans. Alan Bass, Routledge, 2001.
২. Robert Wicks, Modern French Philosophy From Existentialism to Postmodernism, Oneworld, 2003.
৩. Jim Powell, Derrida For Beginners, Orient Longman, 2003.
৪. Jim Powell, Deconstruction For Beginners, 2007.