‘হারেম’ সংস্কৃতি

প্রথাগত ইতিহাসে রাজা-সম্রাটদের জয়-পরাজয়ের কাহিনি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোনো শাসক যখন কোনো ভূ-খণ্ডের অধিকার আদায় করেন কিংবা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন তাঁদের মনে ভোগ-বিলাসের বাসনা প্রবল থাকে না। কিন্তু যখন শাসনক্ষমতা স্থির অবস্থায় আসে, যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কমে আসে, অপরদিকে সাম্রাজ্যের আর্থনীতিক ভিত্তি দৃঢ় হয়, স্বাভাবিকভাবেই তখন মন যায় ভোগের দিকে: সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ‘হারেম’কে কেন্দ্র করে যা আবর্তিত হয়েছে। সাম্রাজ্যের ভিত্তি যত দৃঢ় হয়েছে, ‘হারেমে’র আকৃতি ততই বেড়েছে।

ইতিহাসগ্রন্থের কালো অক্ষরের ফাঁকে বাদ পড়ে যাওয়া, সাদার আঁধারে অদৃশ্য থাকা এক অধ্যায়ের নাম ‘হারেম’। মনে করা হয়, আরবি ‘হারাম’ শব্দটি থেকে ‘হারেম’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ‘অবৈধ বা নিষিদ্ধ’। ইউরোপীয়রা এটিকে ‘সেরালিয়ো’ নামে জানে। ‘সেরালিয়ো’ মানে ‘বন্য প্রাণীর খাঁচা’। বুঝতে কষ্ট হয়না যে, ‘হারেম’কে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে চেয়েছে। কিন্তু ‘হারেম’ ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছু নয়, এটি রাজপ্রাসাদের একটি অংশ। বলা চলে একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল ‘হারেম’কেন্দ্রিক।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে যাকে অন্তঃপুর বা অন্দরমহল বলে অভিহিত করা হয়, ‘হারেম’ শব্দটিকে তার সমার্থক হিসেবে গ্রহণ করলেই বরং তুলনামূলনভাবে ন্যায়বিচার করা হবে বলে মনে হয়। তুর্কি ভাষায় শব্দটি ‘হারেমলিক’, যার অর্থ ‘প্রাসাদের অন্দর’।

রাজপরিবারগুলোতে মহিলাদের থাকার জন্য নির্ধারিত স্থানকে ‘অন্তঃপুর বা হারেম’ বলা হয়। ‘হারেমে’র বাসিন্দাদের বহির্জগৎ থেকে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হত। বাহিরের খবর পাওয়া তাদের পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব। তেমনি সম্রাটের অনুমতি ব্যতীত ‘হারেমে’ প্রবেশ করাও নিষিদ্ধ ছিল এবং কড়া নিরাপত্তা দিয়ে বিষয়টি রক্ষা করা হত। এখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল।

ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি তাই ‘হারেম’র প্রকৃত স্বরূপ জানতে সমর্থ হয়নি। ‘হারেম’ নিয়ে নানা পর্যটক কিংবা বণিকের যে ভাষ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় সবটাই অন্য কারো মুখে শোনা (হয়তো ‘হারেমে’র কোন সেবাদাসীর স্বীকারোক্তি, কোন খোজার জবানবন্দি, অথবা ‘হারেমে’ সওদা করা কোন বেণিয়ার কথা), কখনো-বা সামান্য বয়ান ও তুচ্ছ কিছু উপাত্তের ভিত্তিতে নেহাৎ কল্পনা।

নিখিল সরকার, যিনি শ্রীপান্থ (১৯৩২-২০০৪) ছদ্মনামেই পরিচিত, হারেম (১৩৭৪ বঙ্গাব্দ) নামে যে গ্রন্থ লিখেছেন, তার কেন্দ্র তুর্কি ‘হারেম’। কিন্তু লেখক দৃষ্টান্তের উছিলায় অন্যান্য ‘হারেমে’ও ঘুরে এসেছেন। শ্রীপান্থ প্রাসাদের মূল ফটক থেকে শুরু করে একজন পর্যটক বা আগন্তুকের দৃষ্টিকোণে তুর্কি ‘হারেমে’র কাঠামোগত অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাসাদের মূল ফটক থেকে তুর্কি ‘হারেমে’ পৌঁছাতে পেড়োতে হত তিনটি তোরণ। তোরণগুলোর আবার আলাদা আলাদা নাম ছিল।

‘হারেমে’র প্রাণভোমরা হলেন সম্রাট বা রাজা নিজে: ‘হারেমে’র একমাত্র পুরুষ। 

বিভিন্ন সাম্রাজ্যের ‘হারেমে’র গঠনকাঠানো অভিন্ন ছিল না। তবে সাম্রাজ্যের চাকচিক্য ও রুচিমর্জি কমবেশি যাই হোক না কেন, ‘হারেমে’র অবস্থান সবক্ষেত্রেই প্রাসাদের ভেতর দিকে হত। নিরাপত্তা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত। নানান কারুকাজ ও সাজসজ্জায় সজ্জিত করা হত ‘হারেম’কে। সেই সাজসজ্জার মধ্যে বিশ্রামালয়ের সাথে সাথে স্নানের ঘর, চিকিৎসালয়, বিদ্যালয়, সংগ্রহশালাও স্থান পেত। যদিও এর সবই বরাদ্দ থাকত অন্তঃপুরের বাসিন্দাদের জন্যই। মাঝে-মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত ‘হারেমে’। কখনো কখনো মেলা বসত সেখানে। তবে সেক্ষেত্রেও কেবল নারীদেরই প্রবেশাধিকার থাকত। একমাত্র সুলতানই সেখানের পুরুষ। আর সেই মেলা থেকে সুলতান তাঁর নতুন শয্যাসঙ্গিনী নির্বাচন করতে পারতেন।

‘হারেমে’র প্রাণভোমরা হলেন সম্রাট বা রাজা নিজে: ‘হারেমে’র একমাত্র পুরুষ। ইতিহাসে ‘হারেম’ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, এই অধিকর্তার সামগ্রিক ভোগবিলাসের লক্ষ্যেই ‘হারেমে’র অস্তিত্ব বর্তমান। কিন্তু বহু অধিকর্তার ভাগ্যবিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে ‘হারেমে’র ভূমিকা প্রমাণ করে যে, এই ভোগবিলাস সহজসাধ্য ছিল না। সেজন্য ‘হারেম’ সুস্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ছিল নিয়মকানুন, সুবিন্যস্ত ছিল দায়িত্ববণ্টন। আইন প্রয়োগে ছিল কড়াকড়ি। সকলের উপরই নজর রাখার জন্য গুপ্তচর নিয়োজিত থাকত। কে যে কার গুপ্তচর, তা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য ছিল। ‘হারেম’ কেবল ভোগের ক্ষেত্র ছিল, এমনটা বলা একদেশদর্শী হয়ে যায়। একই সাথে এটি ছিল জেনানাদের তথা সম্রাটের নিরাপদ আশ্রয়। ‘সুলতান যখন শান্তিতে থাকতে চাইতেন তখন চলে যেতেন ‘হারেমে।’ (সাযযাদ, ২০০৭: ২৬)

‘হারেমে’ বসবাসকারী জনসংখ্যা সুলতানের মর্জির উপরই নির্ভর করত। রকমফের ছিল সুলতান বা সম্রাটের শয্যাসঙ্গিনীর সংখ্যাতেও। এই সংখ্যা দুইশো থেকে দুইহাজার বা তারও বেশি হয়ে থাকত। আবুল ফজলের ভাষ্য মতে, ‘আকবর এক বিশাল প্রাচীরবেষ্টিত ভবন তৈরি করেছিলেন—যেখানে তিনি প্রায়ই বিশ্রাম নিতেন। তাঁর হারেমে পাঁচ হাজারেরও বেশি রমণী ছিল—যাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ছিল আলাদা-আলাদা কক্ষ।’ (সাযযাদ, ২০০৭: ১২) আকবর বিলাসী সম্রাট ছিলেন বলে ইতিহাসে সাক্ষ্য মেলে না। তাহলে বিলাসী সম্রাটদের অন্দরমহলের বহর ও বিলাসের চাকচিক্য আন্দাজ করা কঠিন নয়। অর্থাৎ ‘হারেমে’ রাজার বহুগামিতার প্রমাণ নিশ্চিত। এটিকে তাঁরা অন্যায় মতে করতেন না। ক্ষমতা ও অর্থের কাছে ভোগবিলাস কেন্দ্রীভূত হওয়ার ইতিহাস বহু পুরনো।

খ্রিস্টপূর্ব যুগে বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজাদের বহুগামিতার প্রমাণ মেলে। সেক্ষেত্রে তাঁরা পর্যায়ক্রমিকভাবে এক এক রানীর সাথে মিলিত হতেন। পরবর্তীকালে তা সম্রাটের রুচিমর্জির উপরই নির্ভর করত। অর্থাৎ কোন রাতে সুলতান কোন নারীর সাথে মিলিত হবেন, এটা নির্ধারণ করতেন সুলতান নিজে। তবে এই মিলিত হওয়ার ব্যাপারটি গোপনীয়তা মান্য করে করা হত। সুলতানের নির্ধারিত দাসী ও প্রত্যেক নারীর জন্য নির্ধারিত দাসীর মাধ্যমে বিষয়টি সম্পন্ন করা হত। অন্য কোনো নারী জানতে পারতেন না, সেদিন রাজা কোন রানীর সাথে মিলিত হবেন।

রাজার মনোনীত নারীকে বিশেষ আচারের মাধ্যমে প্রস্তুত করে পাঠানো হত তার শয়নকক্ষে। শরীরের লোম অপসারণ, স্নান, নানা উপাচারে সুসজ্জিত অঙ্গসৌষ্ঠব, সুগন্ধীর ব্যবহার সবই মান্য করা হত। রাত ভোর হওয়ার পূর্বেই দাসীর সহায়তায় আবার তাকে তার নিজ ঘরে পৌঁছে দেয়া হত। এইসব আচরণ অনেকটা প্রথার মত পালন করা হত। যাকে বলা যেতে পারে ‘হারেম’ সংস্কৃতি। অবধারিত ভাবে ‘হারেমে’র চিকিৎসালয়ে যৌনসঞ্জীবনী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে কোনো কোনো সুলতানের আগ্রহের সীমা ছিল না। ব্যভিচারের দৃষ্টান্তও যে কম ছিল, তা নয়। কোনো কোনো রাজা অমাত্য পত্নী-কন্যা, নিকটাত্মীয়, এমনকি পতিতার প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ে থাকতেন। এসব বিষয়ে সম্রাট শাহজাহানকে কম নিন্দনীয় বলা হয়নি ইতিহাসে।

মমতাজ মহলের কথা তো ইতিহাসে সুবিদিত। কথিত আছে, মমতাজ মহলের ভাই শায়েস্তা খানের পত্নীকে ভোগের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন শাহজাহান। কিন্তু কোনো উপায় করতে সমর্থ না হয়ে শেষে কন্যা জাহান আরার সাহায্যে রীতিমতো বলাৎকার করেন। এবং এই ঘটনার দিন কয়েক পরই মারা যান সেই নারী। জাহান আরা আর রোশন আরা এই বিষয়ের সাক্ষ্য দেয় যে, ‘হারেমে’ কেবল রাজাই বহুগামিতায় লিপ্ত ছিলেন না, ‘হারেমে’র নারীরাও কোনো অংশে কম নয়। নয় জন সুদর্শন তরুণকে আটকে রেখে নিজের চাহিদা মেটানোকে কেন্দ্র করে জাহান আরার ষড়যন্ত্রে রোশন আরা মারা যায়। দোষ তার এই যে, ঐ নয় জনের একজনও সে জাহান আরাকে ধার দিতে রাজি হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব কমাতে আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) শাহজাদীদের বিয়ে দেয়া নিষিদ্ধ ছিল।

‘হারেমে’র সমস্ত জেনানাদের মধ্যে কয়েকটি বিভাজন থাকত। সুলতান, রাজা বা সম্রাটের বিয়ে করা স্ত্রী থাকত, তাঁদের মধ্যে একজন থাকতেন প্রধানা। তাঁর অধিকার ও মর্যাদা ছিল সুলতানের সকল শয্যাসঙ্গিনীর মধ্যে সেরা। থাকত নানা সময়ে সংগৃহীত অবিবাহিত রাজার শয্যাসঙ্গিনী। থাকত সেবাদাসী। দাসীদের মধ্যেও কর্মভেদে শ্রেণিবিভাগ করা ছিল। তাদের প্রত্যেক বিভাগে একজন প্রধান থাকত। তার মর্যাদা ও বেতন অন্যদের তুলনায় বেশি থাকত। এছাড়া থাকতেন সম্রাটের মাতা। মর্যাদায় সুলতানের মাতা জেনানামহলে সর্বোচ্চ থাকতেন। তারপর থাকতেন সম্রাটের প্রধান রানী। কখনো কখনো সম্রাটের উপরও প্রভুত্ব খাটাতেন এই দুইজনের কোনো একজন। কখনো-বা এই দুই পক্ষের ক্ষমতার লড়াই মসনদের পতনেরও কারণ হয়ে উঠত। এছাড়া বৃদ্ধা বা বয়সী নারীরাও ‘হারেমে’রই অংশ ছিল।

‘কোথা থেকে আসত ওরা? আসত নানা পথে, দশ দিক থেকে। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, মাৎসন্যায়,—সেদিনের পৃথিবী করুণাহীন, অস্থির। সেখানে পেটের জ্বালায় মা কোলের মেয়ে বেচে দেয়, দস্যু মোহরের লোভে মানুষ লুঠ করে, দরবারী চরেরা এখানে ওখানে ওত পাতে, জাল ফেলে শিকার ধরে। উপহার হিসেবেও আসত অনেক। আবার কেউ কেউ আসত স্বেচ্ছায়।’(শ্রীপান্থ, ১৩৭৪: ৩২) স্বেচ্ছায় আসা নারীদের মধ্যে ইংরেজ রমণী ইসাবেলা ডানের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর মেয়ে মুসা হাইদর সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তাঁর মা ‘হারেমে’ প্রকৃতপক্ষেই সুখী হয়েছিলেন। তবে সুখী হওয়া নারীদের সংখ্যা অল্পই ছিল।

নিরাপদ আশ্রয়ে সতত অনিরাপদ ভবিষ্যৎ ‘হারেমে’র নারীদের তাড়া করত। ক্রীতদাসী হয়েও লুৎফা সিরাজদ্দৌল্লার বেগম হতে পেরেছিলেন, এমন ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি রোশন আরা, জাহার আরার মৃত্যুর ঘটনা, আকবরের নির্দেশে পুত্র সেলিমের প্রেমিকাকে জীবন্ত কবর দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ‘হারেমে’ জাতপাতের কোন বালাই ছিল না। সাম্প্রতিক কালে সাম্প্রদায়িতা যেভাবে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে, ‘হারেমে’ তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। যদিও উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছুটা সচেতনতার পরিচয় অনেক ‘হারেমে’ই পাওয়া যায়।

নিরাপত্তার বিষয়ে ‘হারেমে’ পুরুষের উপর ভরসা করা হত না। অথচ, যাবতীয় নিরাপত্তায় শক্ত-সামর্থ্য ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই হয়তো ‘হারেমে’ খোজার আধিক্য নজরে পড়ে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নারী দাসী নিযুক্ত থাকলেও সকল ‘হারেমে’ই খোজার উপস্থিতি ছিল। খোজা সম্পূর্ণ মানুষ নয়, মানুষের আশ্চর্য-অদ্ভুত-বিকৃত অস্তিত্ব মাত্র।

‘হারেম’ কেবল মুসলমানী ব্যাপার নয়। ঐশ্বর্য, ক্ষমতা আর লালসার সাথে এর যোগ। হিন্দু রাজায় আর মুসলমান নবাবে এক্ষেত্রে কোনো বড় পার্থক্য ছিল না।

ইতিহাসে প্রথম খোজা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৮১১ থেকে ৮০৮ অব্দে মেসোপটেমিয়ার আসিরিয়ার রাণীমাতা সামুরামাত। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এ খোজার ‍উল্লেখ আছে। ধর্মীয় কারণে কামনাবাসনাশূন্য থাকতে ঈশ্বরের উপাসকদলের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় খোজা হতেন। কিন্তু ‘হারেমের খোজারা ঈশ্বরের নামে রিক্ত-পুরুষ নয়, তারা লোভাতুর, উদ্বিগ্ন, অক্ষম রাজাবাদশাহদের মনোবিকারের ফল মাত্র।’ (শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৫৫) আরবের ছোট্ট শহর ‘দিউয়াউসেস’। শব্দটির অর্থ ‘খোজাগিরি’। এই শহর খোজা সরবরাহের জন্য খ্যাত ছিল। ‘বছরে প্রায় তিন হাজার খোজা রপ্তানী হত সেখান থেকে, তার জন্য নাকি বিসর্জন দিতে হত তিরিশ হাজার বালকের প্রাণ।’(শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৫৮)। ‘হারেমে’ ভোগবিলাসকে যদি গোলাপ কল্পনা করা যায়, খোজা তাহলে সেই গোলাপের কাঁটার মতো।

এক বিকৃত জীবনযাপন মেনে নিতে বাধ্য হওয়া খোজাদের চিন্তা-আচরণ-আহার-অনুভূতির স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হত। ‘হারেমে’র রক্ষী ও প্রহরী হিসেবেই মূলত এদের ব্যবহার করা হত। যৌনজীবনে অক্ষম এই খোজাদের ভিন্ন গল্পও শোনা যায়। কোন বিকৃত উপায়ে তারা তাদের কামনা ‍নিভৃত করত বলে জানা যায়। কোনো কোনো খোজা পুরোপুরি অক্ষম হয়ে যায় না। তাদের নিয়ে ‘হারেমে’র নারীদের যৌনাচারের ঘটনাও জানা যায়। কখনো কখনো কোন সন্দহপ্রবণ নবাব ‘হারেমে’র কোনো কোনো নারীকেও খোজা করে দিতেন: কেবল সন্তানধারণে অক্ষম নয়, সর্ব কামনাবাসনামুক্ত করে।

সমস্ত ভোগ-বিলাসের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুলতানের জীবন ‘হারেমে’ সর্বদা সুখকর ছিল না। ‘আপন হাতে রচিত হারেমের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে সুখের পথটি ভুলে গিয়েছিলেন অনেকেই।’ (শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৭৩)। নাদির শাহ অসংখ্য নারীসহ ‘হারেম’ পেলেও শেষকালে নূর বাঈ নামের এক গণিকার ঘরেই সুখ খুঁজেছিলেন। কুতুবুদ্দীন মুবারকও নাকি গণিকালয়ে পড়ে থাকতেন। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ ফৈজবাজারের কোন এক গলির ঘরের ফারখান্দা জামানি বেগম নামের রমণীর কাছে যেতেন রোজ সন্ধ্যায়। কেবল পরকীয়া প্রেমেই নাকি শাজাহানের তৃপ্তি ছিল। ‘প্রাসাদে নৈশ্যভোজের আয়োজনে ঘাটতি ছিল না। তারপরেও নাকি অধিকাংশ নবাব বাদশাহ অতৃপ্ত পুরুষ। উচ্ছিষ্টের লোভে তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন হারেমেরই আনাচে-কানাচে, কিংবা দেওয়ালের বাইরে— অন্যত্র। নানা বিকৃতি তাঁদের আচারে আচরণে, যৌন জীবনে।’(শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৭৫)। অযোদ্ধার নবাব ওয়াজেদ আলি বিকৃত যৌনাচারী ছিলেন। তুরস্কের সুলতান ইব্রাহিমও তাই। এমনকি তিনি ‘ক্লীব’ ছিলেন বলেও শোনা যায়। ‘তাই লোকে বলে, হারেমে সবচেয়ে দীন মানুষ তার অধীশ্বর স্বয়ং। তিনি সবচেয়ে দরিদ্র, সবচেয়ে বঞ্চিত।’ (শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৭৭)

‘হারেম’ কেবল মুসলমানী ব্যাপার নয়। ঐশ্বর্য, ক্ষমতা আর লালসার সাথে এর যোগ। হিন্দু রাজায় আর মুসলমান নবাবে এক্ষেত্রে কোনো বড় পার্থক্য ছিল না। ‘এখানে সব কিছুই ছিল। আবার অনেক কিছুই ছিল না। সুখ ছিল। দুঃখ ছিল। আনন্দ ছিল। ছিল বেদনাও। কিন্তু ছিল না স্বাধীনতা। নিঃশর্ত স্বাধীনতা পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু হারেমে কেবলই শর্ত, স্বাধীনতা এখানে স্বপ্ন হিসেবেও নিষিদ্ধ যেন।’(শ্রীপান্থ, ১৯৮৬: ৯৫)। ‘হারেম’ ভালো না মন্দ ছিল, এই বিষয়টির চেয়ে বড় বিষয় হলো, ‘হারেম’ একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে ‘হারেম’ বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু বিত্তবানদের ‘হারেমে’র অনুরূপ ভোগবিলাস বিলুপ্ত হয়নি। স্বরূপ বদলেছে মাত্র। নারী-স্বাধীনতার নামে নারী পুঁজির কবলে পড়েছে কেবল। সামন্তীয় শোষণ থেকে পুঁজিবাদী শোষণে তার উত্তরণ ঘটেছে।

 

সহায়ক গ্রন্থ

শ্রীপান্থ (দে’শ সংস্করণ ১৯৮৬)। হারেম । দে’জ পাবলিশিং। কলকাতা।

সাযযাদ কাদির (২০০৭)। হারেমের কাহিনী : জীবন ও যৌনতা । ‍দিব্য প্রকাশ। ঢাকা।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here