একটা একটি একটু

‘একটি’ সাধুরীতির শব্দ; আর ‘একটা’ চলিতরীতি বা কথ্যভঙ্গির শব্দ। এমন কথা আমি শুনেছি বাংলা বিষয়ের একাধিক শিক্ষকের মুখে। কথাটা কতটুকু খাঁটি, যাচাই করে দেখিনি। আবার এমনও শুনেছি, ‘একটা’ প্রয়োগ করতে হয় ছেলেদের জন্য; যেমন : একটা ছেলে। আর ‘একটি’ প্রয়োগ করতে হয় মেয়েদের জন্য; যেমন : একটি মেয়ে। কারণ, ‘একটা’ শব্দ একটু রুক্ষ; ছেলেদের জন্য তাই একটা। আর ‘একটি’ শব্দ একটু মিষ্টি; মেয়েদের জন্য তাই একটি!

 

ব্যোমকেশ মুস্তফীর ‘বাঙলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ নামে খুব পুরানো একটি লেখা আছে। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘টা অসম্ভ্রমসূচক এবং টী সম্ভ্রমসূচক’। এরপর লিখেছেন, কোনো সংখ্যাবাচক শব্দ কোনো বস্তু বা প্রাণীর বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হলে সবসময় ‘টা’ প্রত্যয় বা ‘জন’ শব্দ যুক্ত হয়; যেমন : তিনটা গরু, পাঁচটা লোক, সাতজন মানুষ। টি বানান আগে টী ছিল। টী প্রসঙ্গে লিখেছেন, এই প্রত্যয় ছোটো বা অল্পকে সূচিত করে। ব্যোমকেশ অবশ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ‘টি’ কেন অল্পকে নির্দেশ করে। এই টা-টি-টুর ভালো ব্যাখ্যা পেলাম রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখায়।

 

‘ধ্বনি-বিচার’ নামে একটি প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর লিখেছেন: আ, ই, উ — এই তিন স্বরের মধ্যে আ বড়ো বোঝায়; ই তার চেয়ে ছোটো, উ আরও ছোটো বোঝায়। ভেবে দেখলাম, মন্দ বলেননি। যেমন, ১. আমি একটা মিষ্টি খেলাম। এখানে মিষ্টি আয়তনে খানিক বড়ই বোঝাচ্ছে। ২. আমি একটি মিষ্টি খেলাম। এবার মিষ্টির আয়তন আগের চেয়ে ছোটো হয়েছে। ৩. আমি একটু মিষ্টি খেলাম। এবার একেবারেই কম বোঝাচ্ছে। এ রকম মনে হওয়ার কারণ কী? এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন প্রবন্ধকার:

প্রথমে আ ই উ এই স্বরত্রয়ের ভেদ কোথায় দেখা যাউক। ‘আ’ উচ্চারণে আমরা বদন ব্যাদান করি; মুখকোটরের পরিসর ও বিস্তার যথাশক্তি বাড়াইয়া লই। ‘ই’ উচ্চারণে মুখকোটরের বিস্তার ছোট হইয়া পড়ে। ‘উ’ উচ্চারণে আরও ছোট হয়। আমি বলিতে চাহি যে, ঠিক এই জন্যই law of association অনুসারে ‘আ’ ‘ই’ ‘উ’ এই তিন স্বরের মধ্যে আ বড় বুঝায়, ই তার চেয়ে ছোট, উ আরও ছোট বুঝায়।

 

ধ্বনির সঙ্গে অর্থের সম্পর্কের যোগ আছে — এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন এক দল মানুষ। রামেন্দ্রসুন্দর তাঁদের দলে। তিনি টা-টি-টুর আলোচনা ওখানেই শেষ করে দেননি। এগুলো বাংলা ব্যাকরণে পদাশ্রিত নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে সাধারণত নির্দিষ্টতা জ্ঞাপন করে। এর কারণও ধ্বনিগতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর। তিনি প্রবন্ধের আরেক জায়গায় লিখেছেন: কোনো একটা জিনিস নির্দিষ্ট করে বোঝাতে আমরা আঙুল দিয়ে দেখাই। অঙ্গুলি-নির্দেশে সন্দেহ থাকলে একটা যষ্টি বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে দেখালে আর সংশয় থাকে না। লাঠির আঘাতের এই শব্দ বা আওয়াজ ‘টক্’ বা ‘টা’। আঙুল দিয়েও যখন দেখিয়ে বলি ‘এইটা’ বা ‘ওই জিনিসটা’, তখন টা-প্রত্যয়ে লাঠির আঘাতের কাজ করে। এভাবে, বড়ো জিনিসের ক্ষেত্রে টা, আর ছোটো জিনিসের ক্ষেত্রে টি ব্যবহৃত হয়; যেমন : মহিষটা, বাছুরটি। টি-এর মাত্রা আরও কমে গেলে টু বা টুকুতে পরিণত হয়; যেমন : একটু, ওষুধটুকু।

 

টা, টি একটির বদলে অপরটিকে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করুন। কখন টু হবে আমাকে বলে দিতে হবে না।

 

আগের লেখাভারতীয় বিভিন্ন ভাষার কবিতা : ৩
পরের লেখা‘হারেম’ সংস্কৃতি
তারিক মনজুর
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তাঁর আগ্রহের এলাকা ভাষা, ভাষাশিক্ষা, শিক্ষাদান ইত্যাদি। লেখক হিসেবে শিশুকিশোর উপযোগী রচনা লিখেছেন প্রচুর। বেশ কিছু বই বেরিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বাংলা ভাষা বিষয়ে লিখে থাকেন। তিনি পিএইচডি গবেষণা করেছেন বাংলা বানান বিষয়ে। বাংলাদেশে বানান বিষয়ক গবেষণার ইতিহাসে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here