প্লেবয়, বাংলায় বলি, খেলারাম, খেলুড়ে – যারা মেয়েদের নিয়ে আমোদপ্রমোদ করতে আর খেলতে ভালোবাসে; এ অর্থে ‘প্লেবয়’ শব্দটির প্রয়োগ বিশ্বজুড়ে পরিচিত। কিন্তু সাংস্কৃতিক ইতিহাসে প্লেবয় অন্য কিছু। আমেরিকার জনপ্রিয় ও প্রভাববিস্তারী সাময়িকী Playboy। শিকাগো থেকে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে এটি প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন হিউগ হেফনার। কেউ কি জানতো কানখাড়া খরগোশের লগোওয়ালা এই পত্রিকা শুধু মার্কিন ভুবন নয়, কাঁপিয়ে দেবে পুরো পৃথিবী। হিউগ হেফনার প্রথম সম্পাদকীয়তেই বলে নিয়েছিলেন, ‘‘আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই, আমরা ‘পারিবারিক পত্রিকা’ নই।’’ তাহলে কাদের পত্রিকা? প্লেবয় মূলত পুরুষদের পত্রিকা; পুরুষরাই এর প্রধান ভোক্তা। আর নারীরা হলো এই প্রকাশনার মূল আধেয় বা কনটেন্ট।
নারীর নগ্ন দেহ ও অভিব্যক্তির চিত্ররূপ প্লেবয়। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয়েছিল ষাটের দশকের যৌনপ্রতিমা হিসেবে খ্যাত অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোকে। ম্যাগাজিনের মধ্যপ্রচ্ছদে ছিল মনরোর আশরীর নগ্নমূর্তি। এক সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল প্লেবয়ের প্রথম সংখ্যার ৫৩৯৯১ কপি। একদিকে মনরো, অন্য দিকে কেবলই পুরুষদের পত্রিকা! অতএব যৌনতার উষ্ণবাজারে উচ্চতম স্থান দখল করে নেয় প্লেবয়। ১৯৫৪ সালে সার্কুলেশন টপকে যায় লাখের ঘর। তৃতীয় বছরে স্পর্শ করে মিলিয়নের ঘর। মজার ব্যাপার হলো প্লেবয়ের প্রথম বারোটি সংখ্যায় কোনো বিজ্ঞাপন ছিল না। তার সোজা অর্থ : পাঠকের ‘ডিজায়ার’ই হয়ে উঠেছিল পত্রিকার মূলধন।
মনস্তত্ত্বে পড়ালেখা করা হেফনার কেন ন্যুডিটিকে বাছাই করলেন? ছাত্রাবস্থায় হেফনার কাজ করতেন দ্যা শ্যাফট নামের ক্যাম্পাস ম্যাগাজিনে। ১৯৪৮ সালে এই পত্রিকার জন্য কিনসে রিপোর্টের ওপর তিনি একটি রিভিউ লিখেছিলেন। ১৯৪৮ সালে আলফ্রেড কিনসে আরও দুই সহলেখকের সঙ্গে লিখেছিলেন Sexual Behavior in the Hman Male। এই বই কিনসে রিপোর্ট নামে পরিচিত। রিপোর্ট দেখিয়েছিল শতকরা ৮৬ভাগ মার্কিন পুরুষের বিবাহপূর্ব যৌন-অভিজ্ঞতা আছে, ৭০ ভাগ পুরুষ যৌনকর্মীদের সঙ্গে যৌনকর্মে অংশ নিয়েছে, ৪০ ভাগ পুরুষ বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। কিনসে রিপোর্টের তথ্য ও বক্তব্য যৌনতার প্রতি মার্কিনিদের অপার আগ্রহকে প্রদর্শন করে, কিন্তু প্রকাশ্য মত দেবার বেলায় মার্কিনিরা ঠিক ততোটাই নীরব। হেফনারের কাছে মনে হয়েছিল এই মনোভঙ্গি নিরেট ভণ্ডামি মাত্র। আর তখন থেকেই হেফনার অ্যাকাডেমিক পড়ালেখার উসিলায় পড়তে থাকেন যৌনতা বিষয়ক চিকিৎসা সাময়িকী, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি।
হেফনার যোগ দেন Esquire নামক বিখ্যাত পত্রিকায়। এস্কোয়ার ছিল সেকালের বেস্টসেলার পুরুষকেন্দ্রিক সাময়িকী; এর উদ্দিষ্ট পাঠক ছিল মধ্যবিত্ত পুরুষ এবং লক্ষ্য ছিল স্টাইল ও ফ্যাশনকে জনপ্রিয় করা। পৌরুষের উপস্থাপনায় এস্কোয়ার ছিল প্রথম প্রয়াস। এখানকার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে হেফনার গড়ে তোলেন প্লেবয়। শুরু থেকেই হেফনারের পছন্দ ছিল যৌনাবাদী ইমেজ। তার এক প্রাক্তন সহকর্মী বলেছেন হেফনারের মধ্যে যৌনতা বিষয়ক অবসেশন কাজ করত। উল্লেখ্য যে, হেফনার তার বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের গবেষণায় যৌনতাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
প্রথম সংখ্যার প্লেবয়ের প্রচ্ছদে লেখা ছিল : Entertainment for Men. মনরোর হাস্যোজ্জ্বল ছবির ডান পাশে লেখা হয়েছে : FIRST TIME in any magazine FULL COLOR the famous MARILYN MONRO NUDE. তার নিচে লেখা VIP ON SEX. সম্পাদকীয় অংশে হেফনার লিখেছেন, ‘আপনি যদি ১৮ থেকে ৮০ বছরের মধবর্তী কোনো পুরুষ হয়ে থাকেন প্লেবয় তাহলে আপনার জন্যেই। আপনার বিনোদন যদি হয় হাস্যরস, অভিজাত আর ঝাঁজালো তাহলে প্লেবয় আপনার জন্য হয়ে উঠবে বিশেষ পছন্দের।’’ প্লেবয়ে পাওয়া যাবে নিবন্ধ, ফিকশন, ছবিনির্ভর লেখা, কার্টুন, অতীত ও বর্তমান থেকে তৈরি করা বিশেষ ফিচার; কিন্তু ম্যাগাজিনটি হবে ‘মাসকুলিন টেস্ট’ বা পুরুষ-পসন্দ এক প্রাথমিক পুস্তক।
হেফনার বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেছেন, আমরা মূলত অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরেই থাকতে চাই, ককটেলের আয়োজন করতে চাই, সংগীত ছেড়ে দিয়ে পরিচিতি কোনো সুদর্শনাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই, আলাপ করতে চাই পিকাসো, নিটশে, জ্যাজ ও সেক্স নিয়ে। পিকাসো, নিটশে, জ্যাজ শতকরা কতো ভাগ ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেক্স ছিল সুপেরিয়র। প্লেবয়ের অবস্থান ছিল পুরুষের যৌন-নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থান। আর তাই হেফনার বলেছিলেন, ‘আমরা কোনো বিশ্বসমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করি না অথবা প্রমাণ করতে চাই না কোনো মহৎ নৈতিক সত্যকে। আমরা যদি আমেরিকান পুরুষদের জন্য একটু বাড়তি হাসি জোগাতে পারি এবং পারমাণবিক যুগের দুঃশ্চিন্তা থেকে মনকে খানিকটা অন্য দিকে সরাতে পারি, তাহলে আমরা ভাববো আমাদের অস্তিত্ব যৌক্তিক।’
বলা ভালো, সব সময় যে পূর্বানুমতি সাপেক্ষে নারীদের নগ্ন ছবি প্রকাশ করা হতো, তা কিন্তু নয়। উমা থুরমান, মেরিলিন মনরো, ম্যাডোনা, ভানা হোয়াইট, জেসিকা আলবা প্রমুখের ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাদের পূর্বানুমতি ছাড়া।
১৯৫৩ সালের সংখ্যায় খেলা, সংগীত, খাবার ও পানীয়, আধুনিক জীবনযাত্রা বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে; ছিল গল্প, ছবিনির্ভর কৌতুক ও হাস্যরসাত্মক রচনা। স্বল্পবসনা দুই নারীর ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “Jeannie – what’s the past tense of `virgin’?’’ কিন্তু প্লেবয়ের সব চাইতে মনোযোগ ছিল নারীর নগ্নতা ও পুরুষের বাসনায়। এই লক্ষ্যপূরণে ১৯৫৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অগণিত নারীর উন্মুক্ত শরীর প্রদর্শনী করেছে সাময়িকীটি। এর সূচনা ঘটেছিল মেরিলিন মনরোর মাধ্যমে; মনরোও অসংকোচে মেলে ধরেছিলেন নিজেকে। প্লেবয়ের ভাষায় মনরো ছিলেন প্রথম ‘প্লেবয় সুইটহার্ট বা সুইটহার্ট অফ দ্যা মান্থ’। এরপর ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে প্লেবয়’স প্লেমেট অফ দ্যা মান্থ নামে শুরু হয় নারী-শরীরের বিশেষ প্রদর্শনী।
নগ্নতার যৌনইশারা প্লেবয়কে করে তুলেছিল পুরুষদের প্রিয় সাময়িকী। প্রথম সংখ্যা থেকেই অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল প্লেবয়ের কদর। ১৯৭২ সালের নভেম্বর সংখ্যাটি বিক্রি হয়েছিল ৭,১৬১,৫৬১ কপি! বেস্টসেলার পত্রিকায় বিক্রয় ইতিহাসে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই মাইল ফলক। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল বলেই ১৯৭০ সালে প্লেবয় নিয়ে আসে ব্রেইল সংস্করণ।
নিয়মিত সংখ্যা ছাড়াও প্লেবয় প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা : নারীদের অন্তর্বাস বিষয়ক সংখ্যা, কলেজ গার্লস সংখ্যা, সেক্সি কলেজ গার্লস সংখ্যা, ন্যুড কলেজ গার্লস সংখ্যা, কলেজ গার্লস ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ড সংখ্যা, গার্লস অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, সেক্সি গার্লস অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, ন্যুচ সেলিব্রিটিস, ন্যুড, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ন্যুডস, প্লেমেট হান্টস, ন্যুড প্লেমেট ইত্যাদি। বিপুল স্তনী মেয়ে, ভেজা শরীরের মেয়ে, খেলাধুলার যৌনাবেদনময়ী মেয়েদের নিয়েও বিশেষ সংখ্যা করেছে প্লেবয়।
বলা ভালো, সব সময় যে পূর্বানুমতি সাপেক্ষে নারীদের নগ্ন ছবি প্রকাশ করা হতো, তা কিন্তু নয়। উমা থুরমান, মেরিলিন মনরো, ম্যাডোনা, ভানা হোয়াইট, জেসিকা আলবা প্রমুখের ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাদের পূর্বানুমতি ছাড়া। ১৯৮৫ সালে ম্যাডোনা যখন সুনাম কুড়ানো শুরু করেছেন তখনই ছাপা হয় তার ছবি। ১৯৯৬ সালে উমা থুরমানের পাপারাজ্জি ছবি প্রকাশ করে প্লেবয়। ছবিগুলো তারা কিনত ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্ক্যান্ডাল সৃষ্টির জন্য প্রকাশ করত। আকর্ষণীয় করে তোলার বয়ান অনেকটা এরকম : ‘এইসব মেয়েদের বিখ্যাত হওয়ার আগের নগ্ন ছবি!’
দ্যা আউটলাইন পত্রিকায় লরা জুন বলেন, নারীবাদ সম্পর্কে হেফনারের নিজস্ব ও ব্যক্তিগত সংজ্ঞার্থ আছে, ‘এটা হচ্ছে সেই অধিকার যার ফলে একজন নারী নিজের জীবনের জন্য কী চায় তা স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে পারা।’ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করার সুযোগই যদি থাকে, তাহলে প্লেবয়ে কারো নগ্ন ছবি প্রকাশিত হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হলো না কেন? লরা জুনের মন্তব্য, ‘নিশ্চিত কারণ : প্লেবয়কে সেক্স বিক্রি করতে হবে।’
প্লেবয়ের জনপ্রিয়তা মার্কিন মুলুক পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, ওসেনিয়ার অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে। পরবর্তীকালে বাজারে এসেছে প্লেবয় লিথুয়ানিয়া, প্লেবয় ইজরায়েল ইত্যাদি। সব কিছু জোড়া দিয়ে বলা যায়, প্লেবয়ের মূল লক্ষ্য নগ্নতা ও যৌন উপস্থাপন; তবে তা পুরুষের নয়, পুরুষের জন্য নারীর উপস্থাপন। আর এ কারণেই প্লেবয় বিষয়ক বিতর্ক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়। আয়ারল্যান্ডে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ছিল ৩৬ বছর। মূল চিনে নিষিদ্ধ হলেও হংকঙে বিক্রি হতো প্লেবয়। জাপানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ছাপা হত, যেখানে নারীর যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখানো হতো না।
কিন্তু প্রভাব কী এই পত্রিকার? বৈষয়িক দিক থেকে দেখলে বলা যায়, প্লেবয় দেখিয়ে দিয়েছে পুঁজি হিসেবে শরীর কী করে মুনাফা উৎপাদন করতে পারে। অবশ্য ষাটের দশকে প্লেবয়ের ভূমিকাকে ভাবা হতো যৌনতার বিপ্লব। কিন্তু গবেষক ও নারীবাদী অ্যাকটিভিস্টরা দেখিয়েছেন সাময়িকীটি তৈরি করেছে পুরুষবাদী যৌন ভাবাদর্শ; নারীর শরীর, সৌন্দর্য ও নগ্নতাকে দেখানো হয়েছে পুরুষের কাম্য, উপভোগ্য ও আরাধ্য হিসেবে। নারীর শরীরী সৌন্দর্যের এক ধরনের আইডল বা মানও তৈরি করতে চেয়েছে প্লেবয়। পত্রিকাটির অধিকাংশ মডেল পাতলা গড়নের, অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ওজনেরও কম। অর্থাৎ কোনো নারীকে সুন্দর বা পুরুষ-উপভোগ্য হতে হলে তাকে কমাতে হবে ওজন, কোমর, পশ্চাদ্দেশ, স্তন হতে হবে নিটোল ও নিভাঁজ।
নন্দিত ও নিন্দিত প্লেবয় জায়গা পেয়েছে অ্যাকাডেমিক আলোচনায়ও। সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন, মনস্তত্ত্ব, ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল বিষয়ক গবেষকবৃন্দ নেমেছেন প্লেবয়ের গবেষকসুলভ বিশ্লেষণে। পণ্ডিতি সমালোচকদের একজন গেইল ডাইনসের ভাষায় সাময়িকীটি হলো, ‘ভোক্তাবাদের যৌনতামুখীকরণ।’ ডাইনস আরও কিছু শব্দ প্রয়োগ করেছেন, ‘সফট পর্ন’, ‘পুরুষের এন্টারটেইনমেন্ট’; এসবের সমষ্টি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে, ম্যাগাজিনের মধ্যবর্তী পৃষ্ঠায় অবস্থিত আকর্ষণীয়, তরুণ ও বিপুল স্তনী নারী হস্তমৈথুনের প্রণোদনা জোগায়।
প্লেবয় ম্যাগাজিনের এবং যৌন-সহিংসতার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করেছেন অনেকে। ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে প্লেবয়, পেন্টহাউজ ও হুস্টলার প্রভৃতি পত্রিকার অ্যাডাল্ট কটেন্টকে দায়ী করা হয়েছে। সত্তর ও আশির দশকের অনেক গবেষণাই যৌন-সহিংসতার উপাদান খুঁজে পেয়েছে প্লেবয়ের লেখা ও ছবিতে। আবার অনেকে উল্টো দিক থেকেও ভেবেছেন; কেউ কেউ ভেবেছেন প্লেবয় এক ‘যৌন বিপ্লব’। তাদের যুক্তি এই যে, ষাটের দশকের আমেরিকায় যৌনতা, বিশেষ করে নারীর যৌনতা ও শরীরকে প্রকাশ্য করে তোলা ছিল অত্যন্ত অগ্রসর কাজ।
অবশ্য এও মানতে হবে যে, প্লেবয়ের শরীর ও যৌনতাকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ একটি বিশেষ কাঠামোতে আবদ্ধ থাকে নি। কিছু নারীবাদী কনটেন্টও তারা প্রকাশ করেছে। আবার নাগরিক অধিকার ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো বিষয়কে গ্রহণ করায় প্লেবয়কে প্রগতিশীল ম্যাগাজিন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। যদিও ষাট ও সত্তরের দশকের নারীবাদী আন্দোলনকে উপেক্ষা করেছে। অন্যদিকে আবার জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জার্নাল অফ দ্যা হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটির এক প্রবন্ধে ক্যারি পিটজুলু লিখেছেন, ‘হেফনার চেয়েছেন মেয়েরা দেখতে হোক তার প্লেমেটদের মতো, আর পুরুষরা জারি রাখুক প্রথাগত টানটান যৌন-লড়াই।’
কারো কারো মতে প্লেবয় সামাজিকীকরণের মাধ্যম। টরোন্টোভিত্তিক দুই গবেষকের মতে, সাময়িকীটির প্রধান কাজ হলো সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া; তবে সব প্লেবয় পাঠক এ উদ্দেশ্যে পত্রিকাটি পড়বেন, তা নয়। কিন্তু পত্রিকাটির আধার ও আধেয়র নিয়মিত ও সুস্থির উপস্থাপন অন্য ম্যাগাজিনগুলোর তুলনায় প্লেবয়কে আলাদা করেছে; যা আমেরিকায় ‘প্লেবয় স্টেরিওটাইপ’ তৈরি করেছে। সমাজতত্ত্বের দুই অধ্যাপক ওয়াল্টার গারসন ও স্যান্ডার লুন্ডের কথা মতে, ‘‘পাঠকদের শেখানো হয় কীভাবে একজন ‘প্লেবয়’ হয়ে উঠতে হয়।’’ তাঁরা আরও বলেছেন, প্লেবয় কাজ করেছে একটি অপারেটিং ম্যানুয়াল হিসেবে, তারা শিখিয়েছে কীভাবে ‘প্লেবয় স্টেরিওটাইপ’ অর্জন করতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে প্লেবয় পুরুষের মনস্তত্ত্বে ফ্যাশন, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভ্রমণ, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটি স্টেরিওটাইপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। জনপ্রিয় সংস্কৃতির উৎপাদন ও বিস্তারে এর ভূমিকা খুবই প্রভাবশালী।
পুরুষের অবয়ব কেমন হবে? অথবা কেমন হবে তার লাইফস্টাইল? এধরনের প্রশ্নের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কেউ কেউ; জনপ্রিয়তা ও যৌনপ্রিয়তার সম্পর্ক প্রতিপাদন করেছেন কেউ কেউ। গবেষক বেকে কোনেকিন বলেছেন, প্লেবয়ের অনেক বহুগামী পাঠক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা কোরিয় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন; যারা প্রবেশ করেছেন করেছেন গার্হস্থ্য জীবনে। প্লেবয়ের এই পাঠকরা প্রস্তুত ছিলেন সেনাবাহিনির পোশাক খুলে নিজস্ব পছন্দের পোশাক পরতে। তাছাড়া মার্কিন সমাজে এমন শ্রেণি ছিল যাদের নিজের গাড়ি, নৌকা, অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, যারা ‘ক্লাসিকস’ পড়ত, যারা জানত কী রাঁধতে হয়, কোন ওয়াইন বা পানীয় নির্বাচন করতে হয়; তাদের কাছে প্লেবয়ের আবেদন ছিল।
হলবারস্ট্যাম লিখেছেন, প্লেবয় তৈরি করেছিল উন্নত জীবনের অভিলাষী এক তরুণ প্রজন্ম; পত্রিকাটি শিখিয়েছিল কীভাবে একটি স্পোর্টস কার কেনা যায়, কোন ধরনের হাই-ফাই সেট কেনা যায়, কীভাবে রেস্তোরাঁয় অর্ডার করতে হয়, কোন ধরনের খাবরের সঙ্গে কোন ধরনের ওয়াইন খেতে হয়। যাদের বাবা-মারা কলেজের দৌড়গোড়ায় যেতে পারে নি, তাদের জন্য প্লেবয় মূল্যবান উৎস রূপে কাজ করেছে। সাময়িকীটি তাদের জন্য দিয়েছিল নতুন আমেরিকান লাইফস্টাইল সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান। অর্থাৎ ভোক্তার লাইফস্টাইলের জন্য এক প্রকার ‘সার্ভিস’ দিয়েছে প্লেবয়। নৈতিকত যার অবস্থান ‘ফান মোরালিটি’, মজা করার নৈতিকতা।
এই নৈতিকতা উৎসাহিত করেছে একক, বহুগামী মানুষকে ‘সিঙ্গেল’ ও ‘সেক্সুয়াল’ থাকার ব্যাপারে। আর তাই বেকে কোনেকিন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, প্লেবয়ের পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত নতুন পণ্য, খাবার, পানীয় ও ভ্রমণের বিবরণ ‘নব্য পৌরুষ ও অবিবাহিত’দের মনে আনন্দ ক্রয়ের অনুভূতি দিয়েছে; এই আনন্দ পোশাক ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি কেনার — যৌনতার আনন্দ ক্রয় তো ছিল অনিবার্যাই। কোনেকিন প্লেবয়ের নীতিকে বলেছেন ‘ভোগের মাধ্যমে মজা করা’।
প্রকৃতপক্ষে প্লেবয় পুরুষের মনস্তত্ত্বে ফ্যাশন, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভ্রমণ, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটি স্টেরিওটাইপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। জনপ্রিয় সংস্কৃতির উৎপাদন ও বিস্তারে এর ভূমিকা খুবই প্রভাবশালী। তা না হলে এটি কখনোই একটি বাণিজ্যিক ট্রেডমার্ক ও ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারত না। রাজনৈতিক-অর্থনীতির আলোকে প্লেবয়কে বলা যায়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের পর্বে ভোগবাদী মতাদর্শ প্রকাশের মুদ্রিত মাধ্যম; এক্ষেত্রে অন্য পণ্যগুলোর পাশাপাশি যৌনতা ও নারী একইসঙ্গে পুঁজি ও পণ্য।
সাম্প্রতিক কালের সত্য এই যে, ন্যুডিটির বিরাট ব্যবসাসমেত ধসে পড়েছে প্লেবয়ের যৌনসাম্রাজ্য। প্লেবয় আর মুদ্রিত রূপে প্রকাশিত হয় না। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বন্ধ হয়ে যায় এর মুদ্রিত প্রকাশনা। সিবিসনিউজ ডটকম লিখেছে, ‘Coronavirus kills 66-years old Playboy’. মূলত করোনা ভাইরাসের প্রকোপজনিত অর্থনৈতিক ধস নয়, বরং ইন্টারনেট প্রযুক্তির খোলামেলা যৌনতা ও নগ্নতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েক দশক ধরেই পারছিল না প্লেবয়। ধীরে ধীরে পত্রিকাটির সার্কুলেশন কমে আসছিল। সহজলভ্য বহুমাত্রিক ইন্টানেট প্রযুক্তির সক্রিয় নগ্নতার পাশে প্লেবয়ের টপলেস ন্যুডিটি মারাত্মকভাবে মার খেয়ে গেছে। কিন্তু পুরুষের জনরুচি ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বড় একটি অবস্থানও তৈরি করেছে প্লেবয়।
প্লেবয় শিরোনাম দেখে কৌতূহলী হলাম। আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। একুশ শতকে প্লেবয়ের শেষ ২০বছর কেমন আবেদন তৈরি করছিল সে কৌতূহল মিটল না। তবে অনেক কিছু জানলাম নিমেষে। ধন্যবাদ প্রাবন্ধিক।