বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
মাকে বললাম ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছি। কাজ আছে একটা। এক বান্ধবীর মেসে যাবো। দুপুরে ওদের সঙ্গেই খাবো। তামান্নার কথা বললাম। তামান্নাকে মা চেনে। গতরাতেই ফোনে কথা হয়েছে তার সঙ্গে। বলেছি আসতে পারি।
শাহবাগ এরিয়াটাই বিভাস পছন্দ করে। সচরাচর পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসি আমরা। শুক্রবারে মানুষজনও কম থাকে। কাপলরাই এদিকোদিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকে। বেশ রোদ ওঠেছে আজ। বাসের ভেতরেও যা গরম ছিলো! বসেছিলামও জানালার পাশে। আর ঐদিকটাতেই ছিল রোদ। কী বিরক্তিকর। মাথাটা ধরে গেছে। বাসা থেকে খেয়ে দেয়ে বেরোলাম। তবু নামতে না নামতেই ক্ষুধা লেগে গেলো। ছাতাটা খুলে নিলাম। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ছাতাটা এনেছি। এই রোদে ছাতা ছাড়া বেরোলে নির্ঘাত জ¦র।
হলুদ একটা টি-শার্ট পরেছে বিভাস। এই ঝকঝকে রোদে তাকে দারুণ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে খুব স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে তাকে। তার চুলগুলো কেমন পাঁক খাওয়া। প্লেইন না। বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই বোধ হয় কাটে না। তাকে সুন্দর লাগছে। বিভাসের সৌন্দর্যটা যে কোথায়! আমি টের পাই না। সবটা মিলিয়ে সে সুন্দর। আমার মনে হয় ছেলেদের সৌন্দর্য আসলে তাদের পার্সোনালিটিতে। ওর সঙ্গে না-মিশলে ওর ব্যক্তিত্ব টের পাওয়া যাবে না। ও কেমন চুপচাপ। ইন্ট্রোভার্টই বলা যায়।
এখন পর্যন্ত বিভাসকে কিছু কিনে দিইনি। বই ছাড়া আর কিছু সে পছন্দ করে না। আমার আবার কাউকে বইটই দিতে ভালো লাগে না। বই একটা দেওয়ার জিনিস হলো নাকি! তাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবো। আড়ঙ থেকে। একদম হলুদ। হিমুর মত দেখাবে তাকে। ও তো হিমুই। হিমুর মত কোনো কিছুতেই কেমন বিকার নেই।
আমাকে সে দেখেনি। মনে হল পেছন থেকে গিয়ে বলি, হাউ! মাঝে মাঝে শিশুদের মত করতে ভালো লাগে। চোখাচোখি হতেই আমি মুচকি হাসলাম। যাকে বলে সলজ্জ হাসি। বললাম, ‘তোমাকে হিমুর মত লাগছে, বিভাস। খুব সুন্দর লাগছে।’ ও হাসলো। বললো, ‘তাই? হিমুকে তুমি নিশ্চয়ই পছন্দ করো? বললাম, ‘খুব ভালো লাগতো। ইচ্ছা করতো হিমুর মতো হতে। মনে হতো আমিই হিমু। মেয়ে হিমু।’ এবার সে জোরেসোরে হাসলো। বললো, মেয়ে হিমু ছেলে হিমু বলে কিছু নেই। হিমু হলো হিমু। মানুষ তার পছন্দের স্কেল দিয়েই তার প্রিয়জনদের মাপে।
বললাম, ক্ষুধা লেগে গেছে খুব। কী খাওয়া যায় বলো তো? বাসে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে আজ। এত রোদ। অসহ্য অবস্থা। ও জিজ্ঞাসা করলো, আমি আইসক্রিম খেতে চাই কিনা? বললাম, হুঁ খাওয়া যায়।
তোমার চুলগুলো আজ সুন্দর দেখাচ্ছে। চুল বড়ই রেখে দাও। বড় চুলেই ছেলেদের ভালো দেখায়। নিউটনের চুল ছিল মেয়েদের মত বড় বড়। তুমি দেখেছো? আমি টানা কথা বলতে থাকলাম। বিভাসকে দেখেই কেমন ফুরফুরা লাগছে। অনেক কথা এসে মুখে সিরিয়াল দিয়ে বসে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ঐদিনের প্রসঙ্গ নিয়ে তুমি তো কিছু বললে না? প্রশ্নটি করার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা কেমন বিষিয়ে যেতে শুরু করল। অথচ খুব স্বাভাবিক কথার মতই শুরু করলাম। একটা ভয় তৈরি হলো। না-জানি বিভাস কী বলে! আমার কথা যদি তার পছন্দ না হয়!
একটা হাফ লিটারের বক্স কিনে নিলাম। আর দুইটা ওয়ানটাইম চামচ। পোলারের ক্ষীর ফ্লেভারটা চমৎকার। প্লেইন ভ্যানিলাও আমার পছন্দ। সবচেয়ে বিশ্রী হল স্ট্রবেরি। লাইব্রেরির সামনেই বসলাম। আমাদের সিস্টেম হল ঘন্টা দুয়েক এক জায়গায় বসার পরে স্থান পরিবর্তন করা। একই জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে ভালো লাগে না।
বিভাস তার পুরনো কথা দিয়েই শুরু করলো। বললো, কিছু বিষয় নিয়ে তার অবস্থান ভিন্ন। শারীরিক সম্পর্ককে স্পেশালাইজড করার কিছু নেই। বিষয়টা মোটেই এত বিশেষ নয়। বললো, সব সম্পর্কই শারীরিক সম্পর্ক। এই আমরা দুজন একসঙ্গে বসে আছি, শরীর ছাড়া কীভাবে এটা সম্ভব হতো? ভালোবেসে আরেকজনের হাত ধরা আর চুমু খাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্যই আসলে নেই। তেমনি পার্থক্য নেই চুমু খাওয়া আর সঙ্গম করার মধ্যে। ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের মিলন আর যৌনাঙ্গের সঙ্গে যৌনাঙ্গের মিলনে তুমি পার্থক্য করবে কীসে? হ্যাঁ, পার্থক্য আছে। বলে যাচ্ছে বিভাস, পার্থক্য তখনই তৈরি হয় যখন সঙ্গমের উদ্দেশ্য হয় সন্তান জন্ম দেওয়া। এটা প্রাকৃতিক ক্রিয়া। সেই অর্থে সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যতীত প্রতিটি সঙ্গমই এক ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ ক্রিয়া। আমি এভাবেই বুঝি। বিবাহ-পূর্ববর্তী বা বিবাহ-পরবর্তী সঙ্গম-টঙ্গম বলতে আমি আসলে কিছু বুঝি না। প্রকৃতিবিরুদ্ধ সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছো বলে এখন যদি তুমি অনুতপ্ত বোধ করো, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার যা মনে হয়েছে, তোমার সংকট ভিন্ন। যেটাকে আমি কোনো সংকটই মনে করছি না।
গম্ভীরভাবে বলছে বিভাস। তার মুড বুঝতে পারছি না আমি। সে কী বিরক্ত, আমার ওপর বা সমগ্র ঘটনার ওপর? তুমি কী এই ঘটনায় কষ্ট পেয়েছো, বিভাস? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কণ্ঠে এক ধরনের থিতানো বিষাদ। সে হয়তো টের পেল। জোরেসোরে হেসে ওঠলো সে। বললো, এরচেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, দিয়া। কথা বলার। আমরা সেসব বিষয়ে কথা বলতে পারি। এটা তো তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ বিষয়।
বলতে বলতে সে পাশ ফিরলো। তাকালো আমার দিকে। সোজা চোখের দিকে তাকালো। আমি তার ঘন-কালো আর গভীর চোখগুলো আবারও দেখলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পাশাপাশি বসেছিলাম আমরা। আমার বাঁ হাতটি সে তার হাতের তালুতে নিলো। বাঁ হাতের তালুতে রেখে ডান হাত দিয়ে সে আলতোভাবে স্পর্শ করলো। বেশ পুরুষালি শক্ত হাত তার। পরিচ্ছন্ন সাদা। হাতের অন্যান্য অংশের তুলনায় কব্জিটা তার বেশ ফর্সা। প্রথমে সে আমার হাতের তালু ধরে থাকলো কিছুক্ষণ। স্পর্শ করলো। অনেকক্ষণ ধরে পরশ বুলালো সেখানে। তারপর তালুর উল্টাপিঠে। কেন জানি মাথাটা তখন একদম ফাঁকা হয়ে গেলো। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। সমস্ত চরাচরে যেন তখন কেবল আমরা দুজনই। আর কেউ নেই। আর কিছু নেই। কেবল আমরা। শুধু আমরা। পাশের জুটিগুলোও যেন আমরা। তাদের হাতগুলো আমাদেরই হাত। তাদের ঠোঁটগুলো আমাদেরই ঠোঁট। তাই কেবল আমরাই আছি। আর আছে আমাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ হাত।
তোমার হাতগুলো কী গরম! তোমার কি জ্বর, বিভাস? না, জ¦র নয়। তাহলে হাতগুলো যে গরম? উষ্ণতা নাকি শরীরের ভাষা। সে বললো। আমার হাতটি সে তার নাকে স্পর্শ করলো। ঘ্রাণ নিলো। গভীরভাবে ঘ্রাণ নিলো। হৃদয়ে একপ্রকার উত্তেজনা বোধ করলাম আমি। মুহূর্তেই এটি ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র শরীরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উত্তেজনা বেড়ে যেতে লাগলো। আমি কি তাকে চিনি? কোথায় এর উৎস স্থল? সে কি দুই উরুর মাঝখানে থেকে সারা দেহে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কম্পন? এমন গভীরভাবে বিভাস আমার ঘ্রাণ নিচ্ছে, যেন সে ঘ্রাণ নিচ্ছে না, মন্থন করছে আমার সমগ্র শরীর। আমার প্রতিটি উত্তেজনাকে সে অভিবাদন জানাচ্ছে। বলছে, হ্যালো। আমার শিরা-উপশিরাগুলোকে সে হ্যালো বলছে। সে ঘ্রাণ নিচ্ছে তাদের প্রতিটি স্পন্দনের। সে ঘ্রাণ নিচ্ছে আমার রক্তের। আমার চিন্তার। আমার ভবিষ্যতের।
আমি আর পারছি না, বিভাস। টান মেরে সরিয়ে নিলাম হাতটা। সে হাসল। খুবই প্রচ্ছন্ন আর সূক্ষ্ম তার হাসি। তার ফেইস ছিল একদম অপরিবর্তিত। যেন চোখ দিয়ে হাসছিলো সে। খুব লজ্জা লাগছিলো আমার।
হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার পর দেখলাম, আগের মতই সব স্বাভাবিক। সুন্দর বাতাস বইছে। পাতার গায়ে শির শির শব্দ হচ্ছে বাতাসের। পাখি ডাকছে। কী পাখি এটা? একটা না দুইটা না, ডাকছে অনেকগুলো পাখি। পাখির কিচিরমিচির শুনছি আমি। আসলেই কি পাখি ডাকছে, নাকি আমিই শুনছি? আমার এত ভালো লাগতে শুরু করলো। আমার নাচতে ইচ্ছে করলো। আমার গাইতে ইচ্ছে করলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুখোমুখি দাঁড়ালাম বিভাসের। আমার ভেতরে কেবল আনন্দ আর আনন্দ। আমার সামনে জনাব বিভাসানন্দ।
বললাম, এই বলো তো কী দিয়ে ভাত খেয়েছি আজ? খুব তো হাত শুঁকলে। কেন শুঁকলে বলো তো? বাচ্চাদের মত সে হাসল। বললো, শুনতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ। বললো, তোমাকে ভালোবাসছিলাম। ফিসফিসিয়ে বললো, আমরা সেক্স করছিলাম, দিয়া। আমি বুঝতে পারলাম না কি এক্সপ্রেশন মুখে ফুটিয়ে তোলা উচিত। আমি দাঁড়িয়ে আছি একদম তার মুখোমুখি। আমার মুখটাকে ভাষাশূন্য দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমার ভালো লাগেনি, দিয়া?’ সমস্ত শরীর দিয়ে সে কথা বলে। ঠোঁট থেকে খুব দ্রুত প্রশ্নটি তার চোখে আশ্রয় নিলো। কোনো জবাব না-দিয়ে বরাবর এগিয়ে গেলাম সামনে। আরও এগিয়ে গিয়ে তার মুখের সামনে আমি দাঁড়ালাম। আরও এগিয়ে গেলাম। একদম চোখমুখ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আমার তলপেট ছিল তার নাকের স্পর্শে। বলতে ইচ্ছা করলো, ঘ্রাণ নাও, যত পারো নাও। বললাম না, সব কথা বলতে হয় না, বলা যায়ও না। আমার শরীরের ভাষা ও ঠিকই বুঝলো।
আইসক্রিমটার অবশিষ্ট কিছু অংশ গলে একদম পানি হয়ে গেছে। চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলাম আমি। ইচ্ছে করেই ঠোঁটের ওপরে মাখিয়ে নিলাম আমি। তারপর তাকালাম তার দিকে। কেমন দেখাচ্ছে?
এখান থেকে ওঠে পড়ার সময় হয়ে গেছে। আজান হচ্ছে জুম্মার। মানে সাড়ে বারোটার মত বাজে। এখন আমরা যাবো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। চা খাবো। চায়ের সঙ্গে কোনো একটা টা খেয়ে নেবো।
বললাম, ‘আমাকে তোমার ভালোবাসতে ইচ্ছা করে না, বিভাস? একদম ঘনিষ্টভাবে। নিজের মত করে। যাচ্ছেতাইভাবে?’ জবাবের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। সে উত্তর দেওয়ার আগেই আমি আরও বললাম, ‘আমার খুব ইচ্ছা করে। খুব খুব খুব। তোমাকে আমার টেনে হিঁচড়ে বালিশের মত সব তুলা বের করে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। তোমাকে আমার অনেক অনেক চুমু দিতে ইচ্ছা করে। কামড়াতে ইচ্ছা করে একদম। গুলি করতে ইচ্ছা করে। চোখের নিচে গুলি করতে ইচ্ছা করে। মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে আমার। হ্যাঁ, মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে।’ যা মনে আসলো, বলে ফেললাম আমি। বলতে খুব ভালো লাগলো। খুব সিরিয়াস হয়ে সে শুনলো। জবাব দিল না। হাসলোও না। একদম চুপ করে গেলো।
আমরা যেখানে বসেছি তার হাত দশেক দূরে বিড়বিড় করে একটা ছ্যাঙ্গা হেঁটে যাচ্ছে। ছ্যাঙ্গা খুবই বিশ্রী একটা পোকা। কোনোভাবে গায়ে লাগলে খবর খারাপ আছে। একদম চাকাচাকা করে ফুলে যায়। ছোটোবেলা একবার গায়ে ছ্যাঙ্গা লাগলো। ঈদে শেরপুরে গিয়েছিলাম তখন। দাদি সরিষার তেল, লবণ আর চুন মেখে দিয়েছিলো। চোখমুখ ফুলে আমার তো অস্থির অবস্থা। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ভুতুম হয়ে।
বিভাস বললো, সেক্সের এই পথটা তার চেনা। এই চেনা পথে অকারণে আর হাঁটতে ইচ্ছা করে না। একদম না। এ কী অদ্ভুত কথা। জীবনে প্রথম শুনলাম। সারাজীবন শুনে এলাম, ছেলেরা এসবের জন্য পাগল থাকে। আর সে কি না বলে উল্টা কথা। আমি বললাম, তোমার কথা আমি বুঝি না। তুমি কী বলো হেঁয়ালি করে তুমিই জানো! বললো, যতটুকু বোঝার আমি নাকি ঠিকই বুঝি। আর যতটুকু বুঝি না, তা বুঝতে হলে নাকি, শুধু আমি না, সবাইকেই সময়ক্ষেপণ করতে হয়।
: বাসায় আমি তোমার কথা বলতে চাই। বলবো, বিভাস নামের একজন আছে, তাকে আমি ভালোবাসি। আমি চাই তোমারামার সম্পর্কটা একটা সিরিয়াস রূপ নিক। তুমি কী বলো? তুমি কেন বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাও না, বিভাস? কথা বলতে বলতে বাসায় কিন্তু কিছুটা হিন্টস দিয়েছিও একদিন।
: তুমি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে চাও, দিয়া? চাইলে কেন চাও, তা কি তুমি জানো? তুমি কি জানো, বিয়ে কী?
: তোমার কথা শুনে তো মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে করতে হলে কি বিয়ের সংজ্ঞা মুখস্ত করে রাখতে হবে নাকি? আমি জানি কেন তুমি আমাকে বিয়ের ব্যাপারে মত বদলেছো।
বিভাসকে আক্রমণ করলাম আমি। আমার খারাপ লাগছে। আমার অভিযোগটা আসলে মিথ্যা। বিয়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত হ্যাঁ-না সে কিছুই বলেনি। মত বদলানোর অভিযোগ করাটা মোটেই আমার উচিত হয়নি। কিন্তু কেন জানি ও কখনো রাগ করে না। তার কাছে হয়তো মুখের কথার কোনো দামই নেই। একদিন বলেওছিল, সে শুনতে চেষ্টা করে হৃদয়ের কথা। হৃদয় নাকি মিথ্যা বলে না।
: তুমি শুধু শুধু রাগ করছো, দিয়া। জানো, মানুষ আসলে নিজের ওপরই রাগ করে। নিজের ওপরে রাগটাই সে অপরের আশ্রয়ে প্রকাশ করে।
: তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না। কারণ, আরেকজনের সঙ্গে আমার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে। এটা তুমি জানো। মুখে যত কথাই বলো না কেন। যতই সাধু সাজতে চাও না কেন। ছেলেদের কাছে এটা একটা ফ্যাক্ট। আমি জানি।
ও চুপ করে গেলো। একদম চুপ করে গেলো। ও কি কষ্ট পেলো? বিভাসকে খুব কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে আমার। আমার আসলে নিজেকেই খুব কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আশ্রয় করছি তাকে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার চোখে টলমল করছে পানি। মুছতে না মুছতেই অঝোর ধারায় তা বইতে লাগলো। থামার কোনো নাম নেই। পাশ থেকে এক হাত দিয়ে আমাকে সে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো, আমি চাইলে, সে আজকেই, এই এখনই আমাকে বিয়ে করতে পারে। এতো দরদ নিয়ে বললো, আমি আরও কাঁদতে শুরু করলাম।
‘জানো, জগতের প্রতিটা সম্পর্কের অন্তর্নিহিত একটা অর্থ থাকে। তোমার আর আমার সম্পর্কেরও আছে। আমি জানি, কেন তুমি এত সুন্দর! অন্তত আমার চোখে! কেন তুমি তিলোত্তমা! কারণটা হল, আকর্ষণ সৃষ্টি। কিছু ফুল আছে রাতে ফুটে। ধবধবে সাদা হয়। কেন জানো? নির্দিষ্ট কাউকে সে ডাকে। তার ধবধবে সাদা দিয়ে সে ডাকে। এসবের মূল হলো, প্রবল এক আকর্ষণ সৃষ্টি করা। যাতে তোমার কক্ষপথে লেগে থাকি আমি। আমাকে দিয়ে তোমার কোনো একটা পারপাস সার্ভ করানো হবে। হয়তো আমাকে তোমার বাহন করা হয়েছে। তোমাকে কিছুদূর পৌঁছে দেওয়াই যেন আমার কাজ।’ – বিভাস কথা বলছে। এবার তার বলার পালা। এখন শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি তার কথা শুনব। আমার আর কিছু করার নেই। আমার সমস্ত শরীর এখন কর্ণে রূপান্তরিত হয়েছে। – ‘তোমাকে নিয়ে আমি ভেবেছি। অনেক ভেবেছি। অনেকভাবে ভেবেছি। তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। সঙ্গম করেছি তোমার সঙ্গে। একবার নয়, বহুবার। আমাদের সন্তান হয়েছে। আমি তোমার সেই শোভন হয়েছি। আমাকে ঘৃণা করেছো তুমি। আমাকে ভুলে গেছো তুমি। আবার তুমি আমাকে বিয়ে করেছো। দেখেছো আমি বিভাস। বিভাসকে ভালোবেসেছো তুমি। অনেক ভালোবেসেছো তুমি। ভালোবাসতে বাসতে দেখেছো সে আরেক শোভন। আমরা ঝগড়া করেছি। আমরা আলাদা হয়েছি। আবার ভালোবেসেছি আমরা। আবারও সন্তান জন্ম দিয়েছি আমরা।’ নাটকীয়ভাবে সে থামলো – থামার আগেই গতি কমাচ্ছিলো কথার – আস্তে আস্তে বিমান ল্যান্ড করার মত সে থামলো। আবারও বলতে শুরু করলো সে, ‘আমি দেখেছি, তোমার কপালে চুমু খেতেই আমার আনন্দ। তোমাকে ভরসা দিতেই আনন্দ। তোমার পাশে থাকতেই আমার আনন্দ। তোমার সঙ্গে সম্পর্কের রূপ আমি সেদিনই দেখেছি। তোমার হাত আমার মায়ের হাত। তোমার হাত আমার বোনের হাত। প্রথম দিনের কথা তোমার মনে আছে, দিয়া? তোমাকে আমি ভরসা দিয়েছিলাম। আমার হৃদয়ে তখন সেই শব্দটিই, সেই সম্পর্কটিই ধরা দিয়েছিল। আমার হৃদয় সেদিন সঠিক শব্দটিই বেছে নিয়েছিল। এজন্য তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই! জানো, প্রতিটি সম্পর্কই একধরনের বিয়ে। এজন্যই আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিয়ে সম্পর্কে তুমি জানো কিনা!’
গভীর নীরবতা নেমে এলো। নীরবতা এত গভীর হতে পারে! যেন পৃথিবীর ধক ধক হার্টবিট শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। যে পাখিটা একান্তই আনমনে নিজের খড়কুটোর বাসায় গুনগুন করে গান গাচ্ছিলো সেই সুরটুকুও শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। বাতাসে উড়ে উড়ে শাখাচ্যুত শুকনো পাতাটার ধপাস করে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি। অনেকদিন আগে বলা বিভাসের একটা কথা আমার মনে পড়লো। কার যেন বরাত দিয়ে ও বলেছিলো কথাটা। ‘The quiter you become, the more you are able to hear.’ কী প্রসঙ্গে যেন বলেছিলো। আজ মনে নেই। খুব অর্ডিনারি কথাই মনে হয়েছিলো সেদিন। আজকে যেন কিছুটা অর্থ তার বুঝলাম। বাক্যটি জীবন্ত হয়ে উঠলো আমার চিন্তায়। তাকে স্বাগতম!
পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে খুব। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে পোলাও খাওয়ার মজাই আলাদা। বিভাসকে কিছু না-বলেই একটা রিকশা ডাকলাম আমি। সচরাচর আমি ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠি। আজ সরাসরি উঠে পড়লাম। বললাম, মামা, চানখারপুল চলেন। কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না বিভাস। কেন? কোথায়? কীভাবে? চুপচাপ ওঠে বসল। এটাই তার স্বভাব।
রিকশার সিটটা বেশ ছোটো। দুজনের বসতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পেছন দিক থেকে বিভাসকে হাত দিয়ে বেড় দিয়ে বসেছি। ওর হাতটাও আমার পেছনে হেলান দেওয়ার জায়গাটাতে। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। প্রতিটা জায়গা কত চেনা। মনে হচ্ছে এখনো ছাত্রীই আছি। হঠাৎ চমকে ওঠলাম একটা ছেলেকে দেখে। মাথায় টুপি। একদম শোভনের মত দেখাচ্ছে। নামাজ থেকে ফিরছে হয়তো। বিভাসকে বললাম, আমার জন্য তোমার নামাজটা মিস হল। ও তাকালো আমার দিকে। নিচু স্বরে বললো, তোমার সঙ্গে দেখা না-হলেও যাওয়া হত না। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উত্তর দিল না। চুপ করে থাকল।
বললাম, উত্তরার একটা স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছিলাম না! ওটাতে টিকেছি। প্রথম দিকেই আছি। তুমি একটু দোয়া কোরো। তুমি দোয়া করে দিলেই হবে। একশ’বার হবে। আচ্ছা, বলো তো, চাকরিটা আমার হবে কি হবে না? বললো, এটা কীভাবে বলবো? এটা কি বলা যায়? তার জবাবে হতাশ হলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, আগ বাড়িয়ে বিভাস অনেক কিছুই বুঝতে পারে। আমি জেদ করলাম। বললাম, তুমি ঠিকই জানো, আমার হবে কি হবে না! কিন্তু বলবে না। বললে পরে যদি আবার না-মেলে, তখন তো তোমার কেরামতি ফাঁস হয়ে যাবে, এই ভয়ে বলছো না। উচ্চস্বরে হেসে ওঠলো সে। তার হাসি শুনে পাশ থেকে এক পথচারী আমাদের দিকে তাকালো পর্যন্ত। কানের কাছে অনুচ্চ স্বরে বললো, ‘কী বাচ্চা মেয়ে তুমি! বিয়ে বিয়ে যে করো, বিয়ের বয়স হয়েছে তোমার?’ আমি জানি এটা কোনো প্রশ্ন নয়। এটা মন্তব্য। তার মন্তব্য শুনে মনে মনে খুশিই হলাম। তার এই মন্তব্যে টসটস করছে গভীর ভালোবাসা। ভালোবাসা নয় স্নেহ। বিভাসের ভাষায়, স্নেহ আর ভালোবাসা একই। প্রেমিকার কাছে গিয়ে স্নেহের নামই ভালোবাসা হয়। মায়ের কাছে গিয়ে ভালোবাসা নাম নেয় শ্রদ্ধা। একই সে জল মেঘে, নদীতে, সাগরে।
: তুমি কি জানো, ইমরান যে আমাকে পছন্দ করে?
: হুম। জানি।
: বললে না তো কখনো? আচ্ছা, তোমার এই স্বভাব কেন? পেটের মধ্যে সবসময় কথা রেখে দাও!
: তুমি তো জিজ্ঞাসা করো নাই?
জিজ্ঞাসা না করলে, ও কোনোদিন কিছু বলে না। অন্যের কথা তো বলেই না। কারও সমালোচনাও করে না সে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। কিছু কিছু বিষয়ে এজন্য তাকে শ্রদ্ধা না-করে পারা যায় না। জিজ্ঞাসা করলাম, ইমরানকে তোমার কেমন লাগে? সারাক্ষণ তো দেখি পারলে তোমার সঙ্গে ঝগড়াই করে?
: ও খুবই মেধাবী ছেলে। ওকে পছন্দ না করার কিছু নেই। ওকে আসলে আমি খুবই পছন্দ করি। ও আমার একদম বিপরীত। বিপরীত বলেই এতো পছন্দ করি। জগতে বিপরীত জিনিসের মধ্যেই প্রকৃত ভালোবাসা বিরাজ করে।
: তোমার তো আবার সবাইকেই পছন্দ। তুমি তো মাজহার ভাইকেও পছন্দ করো? করো না?
: আরে, মাজহার ভাইকে অপছন্দ করার কি আছে! সহজ-সরল মানুষ। দেখো, অপছন্দ করতে চাইলে দুনিয়ার সবাইকে তুমি অপছন্দ করতে পারবে।
: ইমরান ইদানিং জ্বালাচ্ছে বেশ। ঘন ঘন ফোন করে। বেচারা আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বলো তো, কী করি?
চুপ করে থাকল বিভাস।
: তুমি কি রাগ করলে?
: রাগ করবো কেন?
‘মামা, বোরহানি দিয়ে যাবেন। তিন গ্লাস।’ বোরহানি আমার খুব পছন্দ। অবশ্য সব দোকানে ভালো বানাতে পারে না। কেউ চিনি দিয়ে ফেলে বেশি। কারও লিকুয়িডটা আবার বেশি ঘন হয়ে যায়। বিরক্তিকর। আজকেরটা ভালো হয়েছে। বেশ! হুম,পারফেক্ট।
: যত কাহিনিই তুমি আমাকে শোনাও না কেন। ভাই-বোন সমাচার। আমি তোমাকেই বিয়ে করবো। তোমাকে এই দুই নম্বর মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হবে, বুঝেছো? আমি আজকেই বাসায় গিয়ে তোমার কথা বলবো। বলবো মানে বলবো।
জবাব দিচ্ছে না বিভাস। হাসছেও না। মাইন্ডও করে না সে। অথবা করলেও প্রকাশ করে না। আমি কি বেশি পাগলামি করে ফেলছি! ওর সঙ্গেই তো আমার যত পাগলামি। আর কারও কাছে কি আমার পাগলামির কানাকড়ি মূল্য আছে? নেই। কেবল আমার প্রিয় বিভাসের কাছেই তার মূল্য আছে। তাহলে কেন করবো না? আরও করবো। বেশি করে পাগলামি করবো।
: চুপ করে থাকলে হবে না। এটা তোমার ভং আমি জানি। যখন তুমি হেরে যাও তখন চুপ করে থাকো। এমন ভাব করো যে চুপ করে থাকাটাই একটা জবাব। সোজা জবাব দাও। বলো, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে কি হবে না? কোনো ভংচং জবাব নট গ্রান্টেড।
সে হাসল। বললো, দিয়া, আমি যদি ‘হ্যাঁ’ বলি। এই ‘হ্যাঁ’র কাছে তোমাকেই পৌঁছতে হবে। পৌঁছার পরেই কেবল ‘হ্যাঁ’র অর্থ তৈরি হবে। অর্থ উপলব্ধ হবে তোমার। একইভাবে, ‘না’ বললেও ‘না’র কাছে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তার অর্থ তুমি বুঝবে না। তাই বর্তমানের অবস্থান থেকে ভবিষ্যতের হ্যাঁ অথবা না দুইটাই সমান।
বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ না-মারলে বিভাসের পেটের ভাত হজম হবে না। এখন সে বই-টই দেখবে। একসঙ্গে কফি খাবো। তারপর আমাকে সে বিদায় দেবে। না, বিদায় আমি নেবো না। ওকে সঙ্গে করে উত্তরায় নিয়ে যাবো। উফ! বিভাসের সঙ্গে বইয়ের দোকানে দোকানে ঘোরার চেয়ে বিশ্রী অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নেই। একদম দুনিয়া ভুলে যায় সে। এত তন্ময় হয়ে বই খোঁজার কি আছে রে বাবা। যাবি পটাপট কিনে নিয়ে চলে আসবি। ও যে কী খোঁজে আল্লাই জানে। অনেক খুঁজে খুঁজে অনেক সময় নিয়ে কী কী বই বের করে। আবার কী মনে করে সেখান থেকে দুয়েকটা কমায়। আবার খোঁজে। তার পিছে পিছে আমি যাই না। আমি আলাদা ঘুরি। কখনো যদি চোখাচোখি হলো এমনভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় যেন চেনেই না। মাঝে মাঝে এতো বিরক্ত লাগে। বই কিনে বের হওয়ার পরেও রেহাই নেই। সারাক্ষণ ঐ বই নিয়েই কথা বলতে থাকবে। খুব ভাল বই কিনেছে। অনেকদিন থেকে খুঁজছে। ভাগ্যিস আজকে এসেছিলো। ভালো প্রকাশনী। আগের এডিশন। কমেই পাওয়া গেছে।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১১