বিশ্বখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক ডিএইচ লরেন্স আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আহমেদ বাসার।
ডিএইচ লরেন্সেরর জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ সালে। যুক্তরাজ্যের ইস্টউডের একটি ছোট শহর নটিংহ্যামশায়ারের ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে জন্ম নেন এ অনন্য কবি, কথাকার , নাট্যকার ও চিত্রকর। তাঁর পিতা ছিলেন কয়লাখনির শ্রমিক। মাতা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। লরেন্স পিতামাতার চতুর্থ সন্তান। লরেন্স তাঁর প্রাথমিক রচনাবলির উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন ছোটবেলার এ শ্রমজীবী পরিমণ্ডল ও পিতামাতার সম্পর্কের টানাপড়েন থেকে। এ অঞ্চলটিকে তিনি তাই ‘হৃদয়ভূমি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর রচনায় আধুনিকায়ন ও শিল্পায়নপ্রসূত মানবিক অবক্ষয়ের চিত্র নিপুণভাবে ফুটে ওঠে। ডি এইচ লরেন্স বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৪ বছর। এই স্বল্প সময়েই তিনি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়ে গেছেন এক অনিঃশেষ সাহিত্যসম্ভার। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্যসমালোচনা — সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তিনি স্বকীয়তায় ভাস্বর। কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তিনি বিশ্বসাহিত্যে সমধিক পরিচিত। কিন্তু কবি হিসেবেও তাঁর স্থান প্রথম সারিতে। অনেকে মনে করেন তাঁর উপন্যাসও অনেক বেশি কবিতার লক্ষণাক্রান্ত। দস্তয়ভস্কির মতো তাঁর উপন্যাসের বর্ণনাও যেন নেশাগ্রস্ত মনের নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত।
লরেন্সের উল্লেখযোগ্য কিছু উপন্যাস লেডি চ্যাটর্লিজ লাভার, সন্স অ্যান্ড লাভারস প্রভৃতি। লরেন্সের কিছু উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো — নিউ পোয়েমস (১৯১৮), লুক! উই হ্যাভ কাম থ্রো (১৯১৭), বে: অ্যা বুক অব পোয়েমস (১৯১৯), লাস্ট পোয়েমস (১৯৩২), ফায়ার অ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৪০), দ্য হোয়াইট হরস্ (১৯৬৪) প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থ: দ্য ভার্জিন অ্যান্ড দ্য জিপসি (১৯৩০), দ্য রকিং-হর্স উইনার (১৯২৬)। তাঁর স্মরণীয় কিছু নাটক: দ্য ডটার ইন ল( ১৯১২), টাচ অ্যান্ড গো ( ১৯২০), ডেভিড ( ১৯২৬), দ্য ফাইট ফর বারবারা (১৯৩০)।
একজন মায়ের স্বগতোক্তি
এবারই শেষ — এরপর আর নয়
আমি আমার হাতের কবজি ভাঁজ করবো এবং আগুনে রাখবো মুখ
আর দেখবো আমার মৃত দিনগুলো জ্বলে উঠছে ভাগাড় থেকে
অতীত একের পর এক আকৃতি নিচ্ছে, বদলাচ্ছে দৃশ্যের পর দৃশ্য
গলন্ত আগুন মৃতের স্তুপের ওপর সেলাই করছে জীবনের জামা
যেখানে গাঢ় শ্যাওলার মতো খুব ধীরে বাড়ছে কয়লাপোড়া ছাই
হায়! আমি আমার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি প্রেয়সীর মতো
এ এক বিস্ময়, যেন আমি পরদেশে বন্দিনী
সীমাবদ্ধ, মনোযোগের অতীত — এমনকি মুক্ত হাওয়ার বিপরীতে
ধূসর সতৃষ্ণ চোখে ভাসছি কেবল
অপ্রতিরোধ্য এক দূরত্বে যেন তার আত্মা অন্তহীন বিষাদ বয়ে
কেবলই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়
একটা ক্ষীণ সাদা পাখির পালকের মতো উত্তরের সমুদ্রে উড়ে যায়
দূর উত্তর হতে আবার উড়ে চলে ভাঙা ডানায়
আমাদের কৃষ্ণবর্ণ বাগানের বেড়া ভেদ করে সে ততক্ষণ পর্যন্ত চেঁচায়
যতক্ষণ না আমার বাহু থেকে ভালোবাসা থেকে এমনকি প্রয়োজন থেকে
দূরে সরে যায়
আমি ম্লান চোখ নিয়ে অবশ্যই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবো
অবনমিত কুকুরের গোড়ালির মতো এখন সে অভিযুক্ত
দাঁতহীন শিকারি কুকুরের মতো আমার ইচ্ছেরা তার অনুগামী
যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার জেদ তাকে উত্তেজিত করছে এবং আগুনের
ফুলকির মতো জ্বলে উঠছে
ততক্ষণ আমার হৃদয় অপেক্ষা করবে তার ভ্রূযুগলের আকস্মিক কিংবা
পরাজিত ভঙ্গিতে পলায়নের দৃশ্য দেখার লোভে
এটাই শেষ আর পুনরাবৃত্তি হবে না
একজীবন নিজেকেই করে তুলেছি দুর্বহ বোঝা
স্বামীগৃহে অনন্তকাল স্থবির হয়ে থাকা
কখনো নিজেকে বলিনি বন্ধ করো দ্বার
কিন্তু এখন আমি পরাজিত
ওহ আত্মা! তুমি নির্মমভাবে পরাজিত
ভীত ইঁদুরের মতো তুমি আনন্দকে ভয় পাও
হে হৃদয় আমার
তিনবার নিজেকে প্রস্তাব করেছি তিনবারই প্রত্যাখ্যাত
আর নয়, আর নয় হে সন্তান আমার
আনুগত্যের আনন্দ তুমি কখনোই উপলব্ধি করবে না
শৈশবের পরীরা আমাকে চুম্বন করে চলে যাচ্ছে
হে সন্তান আমার
শেষবার তোমাকে প্রত্যাশা করছিÑ এবং এখুনি
আমি অবশ্যই একাকী অপেক্ষায় থাকবো
কখনো জানবে না আমার ফুরিয়ে যাওয়ার দাহ
অপেক্ষা করো যাবো মৃত্যু অবধি
তুমি না এলেও সে নিশ্চিত আসবে অনুরাগে
মৃত্যু — মহত্ত্বের অতীত — নিয়ে যাও আমায়
ঈশ্বরের ঠোঁট ও চোখ জ্বলছে আড়ালে
আর পিতার অশরীরী কণ্ঠস্বর আমাকে নাড়িয়ে তুলছে
আমার অন্তরাত্মাকে ভরে তুলছে আকাঙ্ক্ষা ও অশ্রুতে
আমার হৃদয় বিষাদের সঙ্গে দ্ব›দ্বময়
যেভাবে রাত ভোরের নিকটবর্তী হয়…
মিরিয়মের প্রতি শেষ উক্তি
তুমি গোমড়ামুখে দুঃখিত ভঙ্গিতে বসে আছো
এ অপমান আমাকে বিদ্ধ করছে
তোমার ভালোবাসা ছিল তীব্র ও নিখুঁত
আমার ভালোবাসা সূর্যোদয়ে
জেগে ওঠা ফুলের মতো
জানি, আমাকে জাগিয়ে তোলার মতো ক্ষমতাময় তুমি
বহুবৃন্তে আমাকে ফোটাও তবে
তুমি আমার আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছো
দিয়েছো নতুন জন্মের অভিধা
যখন আমি আত্মদ্বন্দ্বে রক্তাক্ত
তখন দিয়েছো সচেতন ও সতর্ক সঙ্গ
শরীরে শরীর ঘঁষে ভালোবাসতে পারিনি জানি
যদিও অসম্ভব ছিল না
আমরা চুম্বন করেছি, হয়তো অনুচিত ছিল
তুমি আবিষ্কার করেছো, আমরা ভেঙেছি আদল
যা শুভ হয়নি মোটেও
তুমি শুধু সহ্য করেছো এবং ভেঙেছ
আমার ধ্যানমগ্ন মন
তোমার আঘাতে সাড়া দেয়নি সত্তা আমার
তাই যতটা প্রত্যাঘাত তোমার প্রাপ্য ছিল
তা তোমাকে দিতে পারিনি
তুমি সুগঠিত, সুশোভিতও বটে
কিন্তু শরীরী ডাকে দাওনি সাড়া
যে আমি শরবিদ্ধ বার বার
বিষণœভাবে বিদ্ধ ভালোবাসার
প্রলুব্ধ জালে
একটি চিত্রিত জানালার মতো, তোমার শরীরে
প্রবাহিত হচ্ছে আগুনের হল্কা
তাকে পঙ্কহীন সজাগ অনুভবের নতুন
আবহাওয়ায় মুক্তি দাও
কিন্তু এখন কে তোমাকে নতুন করে জাগাবে
তোমার শরীরী মৃত্যু ও পঙ্কিলতা হতে ?
কে তোমাকে নতুন করে পুড়িয়ে মুক্তি দেবে?
যখন আমার ভেতরের আগুনই ব্যর্থ
তখন কে তোমার কামনার আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে
চষবে লাঙল?
একটা মুক বধির মাধুর্য তোমার মুখদর্পণে নৃত্যমান
যা আমাকে লজ্জিত করে
এ অনুভূতিরা বাড়ছে ক্রমশ…
তোমার ভেতরের আগুনকে উস্কে দিতে
আমার আরও নির্দয় হওয়া উচিত ছিল।
অভিযাত্রী
তারা মৃত নয় — তারা নয় মৃত
ক্লান্ত সিংহের মতো সূর্য যখন লেহন করছে পা
ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পর্বতের গা ঘেঁষে
যখন স্মরণের জোছনায় জেগে উঠছে বাঁক চাঁদ
অস্তিত্বের গভীরে জ্বালছে আলো
তখন পর্বতের চূড়ায় একটু দাঁড়াও, ধীরে চলো
যেভাবে একজন কুমারী পুনরায় সিংহের দিকে তাকায়
এখন সমুদ্রকে বলা যায় অভিযাত্রিক দরিয়া
ভোরের সৈকতে অডিসাসের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে
দাঁড়াও, দাঁড়াও এখনই কফি নয় — নয় বেদনাদায়ক প্রস্থান
এখনো ভোরের ঘুম ভাঙেনি সমুদ্র বিছানায়
আর অডিসাসের জাহাজও হয়নি দ্বিপান্তরিত
আমাকে এসব দেখতে দাও…