পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।
বিকালের দিকে বাহলুল মামা আর হারিস মামা মিলে এক গোছা খেজুর কাঁটা দিয়ে গেল নানুর হাতে। আজ গভীর রাত পর্যন্ত পিঠা বানানোর অছিলায় বাড়ির সবগুলো মেয়ে গালগল্প আর হাসা হাসি করে নিজেদের ব্যস্ত রাখবে। এমন আগেও হয়েছে। আজ অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই রাতের খাবার দেয়া হলো। ছেলেরা খাবার পরে যার যার মতো গল্প করতে বা ঘুমাতে চলে যায়। মেয়ে মহলের এসব কাজে তাদের কোন ভূমিকা নাই। বিকাল থেকেই প্রয়োজনীয় সবকিছু জমা করা হলো রান্নাঘরে। আজ রাতে বানানো হবে মচমইচ্চা ও মেরা পিঠা। এই পিঠা বানানোর কারণ এগুলো বানিয়ে বহুদিন ঘরে রাখা যায়। মেরা পিঠা তাজা রাখার জন্য রাখা হয় চালের মটকায়। আর মচমইচ্চা একবার তেলে ভেজে তুলে রাখার পর খাবার সময় দ্বিতীয় বার তেলে ভেজে জিলাপির মতো সিরায় ডুবিয়ে তোলা হয়।
কাল বিকালে আমরা নান্দাইল যাবো নানুর খালাতো বোনের বাড়ি। ওখানে একদিন থেকে রওনা হবো জাঙ্গালিয়ার উদ্দেশ্যে। আজ সন্ধ্যার খাবার পালা শেষ হলে আমরা মেয়েরা সবাই জুটে যাই রান্নাঘরে। তখন দিনের বেলায় ভেজানো চাল ঢেঁকিতে কোটা শেষ হলে আমার নানুর কাজ শুরু হয়। নানু চেলে নেয়া আধভেজা চালের গুঁড়ো দুই হাতে চেপে চেপে বল বানিয়ে সাবধানে ফুটন্ত পানিতে আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। বড়নানু পাশের চুলায় বড় কড়াইয়ে লম্বা হাতা নেড়ে মেরা পিঠা বানানোর কাঁই তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দুই চুলায় দুই রকম পিঠার প্রস্তুতি চলে। আমরা ঘরজোড়া পাটিতে বসে পেছনের ঢেঁকিতে হেলান দিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাদের অভিজ্ঞ হাতের নিপুণ ও ত্বরিত কাজের ধারা দেখি। বড়নানুর কাঁই তৈরি হলে জমিলার মা একটা বড় হাতায় করে তা গরম গরম আমাদের সকলের সামনে থাকা কাঠের খঞ্চায় ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেয়। আমরা ছ্যাঁকালাগা হাতে ফুঁ দিতে দিতে আর হাসাহাসি করতে করতে সেগুলোকে ইচ্ছামতো ডলাইমলাই করতে থাকি। শুধু তিন নানু মিলে মচমইচ্চার গোলা ডলে ডলে পিঠার যোগ্য করতে থাকে। এটা করতে নাকি অভিজ্ঞতার দরকার।
এই নক্সার নাম হৈলো গিয়া হতিন মুচুরা। বুজলি? দুই সতীন একজন আরেক জনেরে ঘিন্না করে। কুনুদিন মুখোমুখি বইয়া গালগল্প করে না। দুইজনেই দুইজনের জানের দুশমন। পারলে কাঁচা চাবাইয়া খাইতো চায়।
একসময় সবাই মিলে হাতাহাতি করে মেরা পিঠা বানানো শেষ করি। জমিলার মা দুই চুলায় ফুটন্ত পানির মস্ত দুই হাঁড়ির উপরে রাখা গর্তঅলা চালুনিতে পিঠাগুলো ঢেলে ঢাকনা দিয়ে দেয়। এবার আমারা মনোযোগ দেই তিন নানুর কাজে। জমিলার মা দ্রুত হাতে মোটা কিন্তু ছোট ছোট রুটি বানিয়ে তিন নানুর পিঁড়িতে চালান দেয়। আর নানুরা রুটি বানানোর পিঁড়িতে তেল মাখিয়ে ধোয়া খেজুর পাতার কাঁটা নিয়ে তখন তৈরি থাকে। ঐ কাঁটা দিয়ে কেটে কেটে সেই মোটা ছোট রুটির উপর অসম্ভব সুন্দর সব নক্সা বানাতে শুরু করে নানুরা। লতা, ফুল, পাতা, পাখি, কল্কা থেকে শুরু করে এমনকি বড়নানার তামাক খাবার কল্কি পর্যন্ত বানানো হয়। একজনের নক্সার সঙ্গে আরেক জনের কোন মিল নাই। ওখানে আছে যার যার মনের মাধুরী। আমার নানুর হাতে তৈরি হয় পিঠাপিঠি জোড় লাগা দুইটা কল্কা।
নানু আমার দিকে তাকিয়ে বলে, এই নক্সার নাম হৈলো গিয়া হতিন মুচুরা। বুজলি? দুই সতীন একজন আরেক জনেরে ঘিন্না করে। কুনুদিন মুখোমুখি বইয়া গালগল্প করে না। দুইজনেই দুইজনের জানের দুশমন। পারলে কাঁচা চাবাইয়া খাইতো চায়। একজনেরে দেখলেই আরেকজন এইরকম দুইদিকে মুখ ফিরাইয়া জীবন কাটায়। — তখন মাহিনানু জোড়া লাগা দুইটা ফুল দেখিয়ে বলে : এর নাম মালঞ্চ। বড়নানু কিছু একটা বলতে বলতেই পেয়ারা খালা ঘুমে ঢুলে পড়ে উপুড় হয়ে পড়ে যায় পাটির উপর। তখন তিন নানুই একত্রে হৈ চৈ করে ওঠে : যা যা ঘুমাতে যা তোরা। রাইত নিশি হৈলো। আমাদের আরো অনেক কাজ বাকি।
আমরা তিনজনই ঝটিতি উঠে দাঁড়াই। যেন আমারা এই কথাটার অপেক্ষায় ছিলাম এতোক্ষণ। রান্না ঘর থেকে একটুখানি উঠান পার হলেই বড় ঘর। আমার আরেকটু ক্ষণ থাকার ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারলাম না। ওরা দুইজন বেরিয়ে গেলে সবশেষে আমি বড়ঘরের পিঁড়ায় পা রাখতে না রাখতেই ঘরের পিছনে একসঙ্গে তিন চারটা শিয়াল একসঙ্গে হুল্লোড় করে ওঠে : কেয়া কেয়া কেয়া হুয়া …হুক্কা হুয়া??
কেয়া হুক্কা?? হুক্কা কি কি!
পড়ুন ।। কিস্তি : ৮