আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করেও যৌনকর্ম ও যৌনতার সম্পর্ককে এক করে দেখি। কিন্তু বিংশ শতকের ফরাসি চিন্তক মিশেল ফুকো এই এক করে দেখার প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান। তাঁর মতে যৌনকর্ম ও যৌনতা কখনো এক বিষয় নয়। আমরা আমাদের প্রচল ধারণায় যেভাবে এই দুইয়ের সম্পর্ককে আবিষ্কার করি, সেটি একটি সমস্যাজনক ব্যাপার। ফুকো বলতে চান, ভিক্টোরীয় যুগের পূর্বে মানুষ যৌনক্রিয়াকে খাদ্যগ্রহণ, ঘুম, চলাফেরা ইত্যাদি কাজের মত আর দশটা সাধারণ কাজ হিসেবে মনে করত। কিন্তু ভিক্টোরীয় যুগ ও তার পরবর্তী সময়ে যৌনকর্মের প্রতি সকলের বাড়তি কৌতূহল জন্মাতে থাকে। এই বাড়তি কৌতূহলের কারণটা তলিয়ে দেখা দরকার। ভিক্টোরীয় যুগে পাবলিক প্লেসে মানুষ যৌনকর্ম সংক্রান্ত কোন কথা, আলাপ, গল্প, ইত্যাদি করতে বাধাগ্রস্ত হত। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উপর কড়া সেনসরশিপ আরোপ করা হয়েছিল। মানুষের সহজাত প্রবণতা হল কোন বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সে বিষয়টির প্রতি কৌতূহল ও আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। মানুষ পাবলিক প্লেসে যৌনকর্ম নিয়ে কোন কথা না বললেও ব্যক্তিগত জীবনে যৌনতা নিয়ে তারা অতিমাত্রায় ভাবতে শুরু করে এবং নানা উপায়ে যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করতে থাকে।
ফুকো মনে করেন, বিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ ভিক্টোরীয়দের মতই আচরণ করে থাকে। মিশেল ফুকো যৌনক্রিয়া ও যৌনতার মধ্যকার পার্থক্যকে উপলব্ধি করা জরুরি মনে করেন। এর মানে হচ্ছে, যৌনকর্মের প্রতি বাড়তি কোন রকমের গুরুত্ব আরোপ করা যাবে না। যৌনকর্মের প্রতি আগ্রহের আতিশয্য বা বাড়তি কৌতূহল ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় তৈরি হওয়া একটি বিষয়। ফুকো একথা বলছেন না যে, যৌনকর্ম ভিক্টোরিয়ান যুগের আগে সংঘটিত হত না। ফুকো সবসময়ই কোন ধারণা বা আমাদের চিন্তার কোন বিশেষ প্রবণতা কোত্থেকে বা কবে থেকে শুরু হল, বা ইতিহাসের কোন প্রেক্ষাপটে তা তৈরি হল, সেটি নিয়ে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। কোন ধারণাকে ইতিহাসের কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট বা তৈরি হওয়া বিষয় হিসেবে শনাক্ত করার পদ্ধতিকে তিনি নাম দেন জিনিওলজি। মানুষ সচরাচর যৌনকর্মকে ক্রিয়াপদ ও যৌনতাকে বিশেষ্য হিসেবে বিবেচনা করে। তারা মনে করে, যৌনকর্ম আগে, এবং যৌনতা বা যৌনকর্ম সম্বন্ধে যে কোন ধারণা পরে। কিন্তু ফুকো বলতে চান, যৌনতা ভিক্টোরিয়ান যুগ এবং তার পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা একটি হাইপোথিসিস এবং এই হাইপোথিসিসের সাপেক্ষেই সমসাময়িক কালে যৌনকর্মকে বুঝতে হবে।
অবশ্য যৌনতায় নতুন আগ্রহের পেছনে সেনসরশিপই একমাত্র কারণ নয়। ফুকোর মতে আসলে মানুষের চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদিকে নতুন করে গড়াপেটার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছিল। এই নতুন করে গড়াপেটার কাজটা আসলে ক্ষমতা প্রকৌশলের পরিবর্তনের ফলে ঘটেছিল। এই পরিবর্তনটা হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকৌশল থেকে জৈব রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকৌশলে রূপান্তর। জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের জীবনাকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, স্বপ্ন ইত্যাদিকে নতুন প্রণোদনায় প্রভাবিত করে। সবচেয়ে ভালভাবে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, সবচেয়ে ভালভাবে বাঁচা কাকেই বা বলে—এসব প্রশ্নের উত্তরপত্র সরবরাহ করে মানুষকে কীভাবে এজেন্সি অর্জন করতে হবে—সে সম্পর্কে পথ বাতলে দেয় জৈব রাজনৈতিক ক্ষমতা। তুমুল যৌনানন্দ লাভ করা সুখী জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়—এরকম ধারণাকে উসকে দিয়েছে জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা। ভালবাসাকে আগে যেভাবে অত্যন্ত উঁচুমানের এবং আদর্শ কিছু বলে ভাবা হতো, এখন যেন যৌনক্রিয়া সেরকমই পরম প্রত্যাশিত একটি বিষয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তো মানুষের জীবনে ভালবাসার গুরুত্বের যে স্থান সেটাই যেন দখল করে নিয়েছে যৌনতা।
ফুকো মনে করেন, যৌনতা একটি বয়ান। যেকোন বয়ানের কাজ হচ্ছে অর্থ সৃষ্টির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি করা—যে কাজটি কার্যত একদিকে নতুন ধারণার প্রণোদনা যোগায়, অন্যদিকে নতুন আচরণকে প্রতিষ্ঠা করে। এ দুটি কাজ আবার ক্ষমতা প্রকৌশলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে।
ফুকোর মতে যৌনকর্ম ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো ধারণার মধ্যে কৃত্রিম ঐক্যসাধনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়গুলো হল, দৈহিক সংবেদনা, যৌনাঙ্গ, স্পর্শানুভূতি, অন্যের দেহ স্পর্শ করে আনন্দ পাওয়া ইত্যাদি। ফুকো মনে করেন, যৌনতা একটি বয়ান। যেকোন বয়ানের কাজ হচ্ছে অর্থ সৃষ্টির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি করা—যে কাজটি কার্যত একদিকে নতুন ধারণার প্রণোদনা যোগায়, অন্যদিকে নতুন আচরণকে প্রতিষ্ঠা করে। এ দুটি কাজ আবার ক্ষমতা প্রকৌশলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে। যৌনতা বয়ানটি আসলে জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকৌশলের প্রভাবে বিকাশ লাভ করেছে। জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে এবং সুখী-সমৃদ্ধ জীবনযাপন করাকে একটি সর্বাঙ্গীণ কল্যাণময় এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এর আনুষঙ্গিক একটি পন্থা হচ্ছে আনন্দপূর্ণ যৌনজীবন। যৌনকর্মে সম্পৃক্ত হতে পারা বা না পারার উপরে যেন জীবনের মূল্য বা গুরুত্ব নির্ভর করছে। কোন এক সময়ে হয়ত মানুষ ভালোবাসাকে সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করত, কিন্তু যৌনতা বয়ানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই “ভালবাসার” স্থানটি দখল করে নেয় যৌনকর্ম।
যৌনতা বয়ান এবং যৌনকর্মের প্রতি নতুন আগ্রহ
বয়ান হচ্ছে পরস্পর আন্তঃসম্পর্কযুক্ত একগুচ্ছ ধারণার পরিবেশনা। এই ধারণাগুলো একদিকে নতুন অর্থের বা তাৎপর্যের ক্ষেত্র/ প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করে, অপরদিকে ধারণাগুলো মানুষের শুধু চিন্তাচেতনা নয়, বরং তাদের আচার-আচরণ গড়ে তোলা বা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। জেন্ডারকে বয়ানের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। নারী পুরুষের শারীরিক পার্থক্য, বিশেষ করে যৌনাঙ্গের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে নারী (female) এবং পুরুষ (male) হিসেবে আলাদা করা হয়। একজন নর তার শরীরের সকল শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি ধরে শৈশব থেকেই কী কী আচরণ করা উচিত এবং কীভাবে সেগুলো করা উচিত, কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে বসতে হবে, কীভাবে দাঁড়াতে হবে, কীভাবে দৌড়াতে হবে—এসব সম্পর্কে সমাজের প্রচল ধারণাগুলোকে তার শরীর দিয়ে সম্পন্ন করতে থাকে। কাজগুলো একটি বিশেষভাবে বারবার করতে করতে সে করার এই কায়দাগুলোকে তার ব্যক্তিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ভাবতে শুরু করে। একদিকে ভাবনা এবং অন্যদিকে আচরণের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সে নিজেকে নিজের কাছে এবং অন্যের কাছে পুরুষ হিসেবে প্রকাশ করে থাকে।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে নারীদের ক্ষেত্রে। তারাও কথাবলা, বসা, দাঁড়ানো, হাটা, দৌড়ানো, ইত্যাদি কাজগুলো সম্পন্ন করার অন্য একটি প্যাটার্ন আয়ত্ত করে এবং তা অনবরত চর্চা করতে থাকে। এর ফল হিসেবে তারা নিজেদেরকে নিজের কাছে এবং সমাজের কাছে “মহিলা” হিসেবে প্রকাশ করে থাকে। এই উদাহরণের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লৈঙ্গিক পরিচিতির কিছু বয়ান বা গুচ্ছবদ্ধ ধারণা সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত থাকে। নর এবং নারী সেই গুচ্ছবদ্ধ ধারণার বাইরে গিয়ে নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলতে পারে না। কেন পারে না সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, বয়ান বা গুচ্ছ ধারণাগুলো নিজেরাই অনেক শক্তিশালী। এই শক্তির উৎস আর কিছু নয়, বরং এই শক্তির উৎস হচ্ছে ক্ষমতা প্রকৌশল যা বয়ানগুলিকে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নর এবং নারীর শারীরিক পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে আলাদা আলাদা করে পরিচয় এবং নাম দেওয়ার বিষয়টি অনিবার্য ব্যাপার হিসেবে প্রচার করে। এতক্ষণ আমরা বোঝার চেষ্টা করলাম বয়ান কীভাবে জেন্ডার এর ধারণাকে প্রচল, স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত একটি ঘটনা হিসেবে প্রচার করে।
একই রকম ভাবে, যৌনতাকে খুবই সহজ, স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মনে হলেও এরও বয়ানপ্রসূত ইতিহাস রয়েছে। যৌনতা যে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারণার কৃত্রিম সমবায়, সেটা আমরা ইতোপূর্বেই ব্যাখ্যা করেছি। ফুকো মনে করেন, যৌনতা বয়ানের ছত্রছায়ায় যৌনকর্মের প্রতি মানুষের বিশেষ আগ্রহকে ভিক্টোরীয় এবং এর পরবর্তী সময়ে গড়ে তোলা হয়েছে।
জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা ও যৌনকর্মের প্রতি নতুন আগ্রহের সম্পর্ক
ক্ষমতা প্রকৌশলের চেহারা, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য যুগে যুগে পাল্টায়। এই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে নতুন নতুন বয়ানের উদ্ভব ঘটে। আগে বয়ান না আগে ক্ষমতা — এভাবে কালানুক্রমিক পরম্পরা নয়, বরং ভাবতে হবে বয়ানে রূপান্তর এবং ক্ষমতা প্রকৌশলে রূপান্তর একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এখানে জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের আচরণকে “নিয়ন্ত্রণ” করে — এ কথা বলার পরিবর্তে তাদের আচরণকে “গড়ে তোলে” : এভাবে বলতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। কারণ, জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা বাইরে থেকে নয় বরং ভেতর থেকেই কার্যকর হয়ে ওঠে ।
জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতা সুখি জীবনের বয়ানের মধ্যে আনন্দপূর্ণ যৌনাচরণকে একটি অপরিহার্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। বয়ানের বিশেষ প্রভাবের জন্যে যৌনতার প্রতি নতুন আগ্রহকে মানুষ তার নিজেরই ব্যক্তিগত আগ্রহ হিসেবে নিজের চিন্তায় এবং কাজে শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু এটি যে বয়ানের এবং ক্ষমতা প্রকৌশলের রূপান্তরের ইতিহাসসৃষ্ট বিষয়, সেটি হুট করে ভাবতে পারে না। আসলে বয়ান এভাবেই কাজ করে। একজন ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছায় সকল কাজ করছে, কিন্তু সে যে সেগুলো একটি বিশেষ তরিকায় করছে এবং অন্যভাবে করলেও করা যেত — সে বিষয়টি একেবারেই তার চিন্তায় বা আচরণে স্থান দিতে পারে না। এখানে ব্যক্তি বলতে ফুকো কী বোঝান সেটি ভেবে নেয়া জরুরি।
“ব্যক্তি”, “দেহ”, প্রতিষ্ঠানের ধারণা
“ব্যক্তি” বলতে ফুকো একটি অভিনব ধারণাকে তুলে ধরেন। সময়ের বিবর্তনে একেক যুগে একেক রকম বয়ানের অধীনে কিছু কিছু প্রবণতা, ভঙ্গিমা, চিন্তার ধরন-ধারণ বিশেষ বিশেষ আকার লাভ করে, বা চেহারা নেয়। এই বিশেষ আকার বা চেহারাকে ফুকো ব্যক্তি বলে শনাক্ত করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি কোন এসেনশিয়ালিস্ট বর্গ নয়। বরং ব্যক্তি ক্ষমতা প্রকৌশলের প্রভাব মাত্র। ব্যক্তিকে জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতার সাপেক্ষে বিবেচনা করলে, আমরা বিশেষ কিছু জীবনাচরণ, প্রবণতা, ভঙ্গিমা, চিন্তাভাবনার ধরনকে শনাক্ত করতে পারব যেগুলো ব্যক্তির যৌনকর্মে নতুন আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বুঝে নেওয়া যায়। ইচ্ছা করলেই এই ধরনের প্রবণতা ও চিন্তাভাবনাকে ব্যক্তি এড়াতে পারবেনা বা অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
কেন অগ্রাহ্য করতে পারবে না — সেটি আরো স্পষ্ট করে বোঝার জন্যে ফুকোর “দেহ” (বডি) ধারণাকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। “দেহ” বলতে ফুকো দুটো জিনিসকে একসাথে বোঝাতে চান। একটা হল ব্যক্তিক-দেহ, অন্যটি হল সামাজিক-দেহ। ফুকো মনে করেন, সামাজিক-দেহ ব্যক্তিক-দেহকে তৈরি করে। আমরা সামাজিক দেহে পুনঃপুন অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তিক-দেহ অর্জন করি। ফুকোর কাছে দেহ আসলে একটি স্পেস যা আগে থেকেই আছে এমন নয়, বরং তৈরি হবার বা গড়ে ওঠবার বিষয়।
কিন্তু কীভাবে দেহ গড়ে ওঠে? দেহ গড়ে ওঠে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক নানা উপাদান ও অনুষঙ্গের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে। ইতিহাসের সমস্ত চিন্তার বাঁক-পরিবর্তন, ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি সকল কিছুই বডি নামক এবস্ট্রাক্ট বর্গটি ধারণ করে। এই এবস্ট্রাক্ট বর্গটি আবার ব্যক্তিক-দেহে হরহামেশাই প্রতিভাত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন ভদ্রমহিলা কোন ভঙ্গিতে পাবলিক প্লেসে বসবেন? হয়ত তিনি দু’পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসবেন। অনেকরকম বসার সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি বিশেষ উপায় বেছে নেওয়ার একটি সহজাত প্রবণতার কারণ হিসেবে ফুকো বলবেন, এই ভদ্রমহিলার শৈশব থেকে নানা ধরনের বয়ান, প্রথা, ধারণা ইত্যাদির বলয় থেকে বড় হবার অভিজ্ঞতা এর জন্যে দায়ী। এই একই উদাহরণে হয়ত আমরা ব্যক্তিক-দেহ ও সামাজিক-দেহকে একইসঙ্গে খুঁজে পাব। এরা আসলে একসঙ্গেই থাকে। প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সুস্থিত কিছু আন্তঃসম্পর্কের সমবায়। এই আন্তঃসম্পর্ক বিভিন্ন মানুষের মধ্যে, বিভিন্ন মানুষ এবং বস্তুর মধ্যে। যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে ক্লাসরুম, বিল্ডিং, ব্ল্যাকবোর্ড, চক-ডাস্টার, খাতা-কলম, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক — এদের সবার সাথে সবার সম্পর্ককে বোঝানো যেতে পারে।
ফুকোর প্রতিরোধের ধারণা
ব্যক্তির এরকম অভিনব ধারণাটা প্রচলিত সমাজ পরিবর্তন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ধারণাকে মৌলিকভাবে ভিন্নতর করে উপস্থাপন করে। প্রচলিত প্রতিরোধের ধারণার কথা বুঝতে গিয়ে মার্ক্সিস্ট মডেলকে ভেবে নেওয়া যাক। সেখানে ব্যক্তিকে একটি এসেনশিয়ালিস্ট বর্গ হিসেবে ভাবা হয়। এও ভাবা হয়, ব্যক্তি এজেন্সি অর্জন করতে সক্ষম। ব্যক্তি শ্রেণি, সর্বার্থ এবং শ্রেণি-সংঘাতের সূত্র ধরে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন, বিপ্লব, যুদ্ধ ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত হতে পারেন এমনটি ভাবা হয়ে থাকে। কিন্তু ফুকো প্রতিবাদ প্রতিরোধের এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মডেলকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বরং বলতে চান যে, প্রচল কোনো ধারণার ইচ্ছে করে ছোট ছোট বিরুদ্ধাচরণ করা উচিত। এই ছোট ছোট বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, বরং প্রচল বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং প্রচল বয়ানের প্রতিক্রিয়ামূলক বয়ান, ভিন্ন বয়ান ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে প্রচল ক্ষমতা প্রকৌশলের প্রতি বিরোধার্থক চিন্তা ও আচরণের বিস্তারণ ঘটানোর চেষ্টা করা। এভাবে ভাবলে বোঝাই যাচ্ছে, ফুকো প্রতিরোধকে তাৎক্ষণিক কিংবা স্বল্পসময়ে ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় হিসেবে মানতে রাজি নন। পরিবর্তন সবসময়ই সময় সাপেক্ষ। চিন্তার প্যারাডাইমের বদল, ক্ষমতা প্রকৌশলের বদল, শক্তিশালী বয়ানের বদল — এসবের উপরেই পরিবর্তন নির্ভর করে।
জৈবরাজনৈতিক ক্ষমতার সাপেক্ষে যৌনকর্মের প্রতি বিশেষ আগ্রহের মাধ্যমে কোনো একক ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে—এভাবে ভাবলে অনেকে মনে করবে এখানে প্রতিবাদ হচ্ছে যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকা। ফুকো মনে করেন, যৌনকর্মের প্রতি বিশেষ কোন পছন্দ বা তরিকাকে প্রাধান্য না দিয়ে, এক্ষেত্রে নানা রকম বৈচিত্র্য সাধনের চেষ্টা করা। কারণ, “পছন্দ” একটি ইতিহাসসৃষ্ট বিষয়। আর এখানে ইতিহাস মানে বয়ান, বয়ানে রূপান্তর, ক্ষমতা প্রকৌশলের রূপান্তর, বিশেষ বিশেষ বডি, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির উদ্ভব ইত্যাদি। এখানে বিশেষ পছন্দের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে এই পছন্দের পেছনে থাকা সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধাচরণ করা, এই হচ্ছে ফুকোর প্রতিরোধ।
ফুকোর সমালোচনা
১. ক্ষমতা-প্রকৌশল, জ্ঞান, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রুপান্তর কিংবা যৌনতার ইতিহাস — সব ক্ষেত্রেই ফুকোর তত্ত্ব বিকাশিত হবার প্রয়াস পেয়েছে ইউরোপকে প্রেক্ষাপটে রেখে। ফুকোর এই ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তায়নের ধরনটা এমন যে প্রাচ্যের অভিজ্ঞতার বিবরণ সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
প্রাচ্যে কী ঘটেছে, কীভাবে ক্ষমতার ধারণাকে এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রূপান্তর, গতি-প্রকৃতি এখানে কীভাবে তত্ত্ব দিয়ে অনুধাবন করা যাবে, যৌনতার ইতিহাসের ক্ষেত্রেই বা প্রাচ্যের অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান কী — এসব বিষয়ে ফুকোর কাছ থেকে সরাসরি কোন সাহায্য পাওয়া যায় না।
এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন পাশ্চাত্য কীভাবে প্রাচ্যকে নিন্মস্তর, অধস্তন, পশ্চাদপদ প্রতিপন্ন করতে ওরিয়েন্টালিজমকে নিজেদের মগজে-মননে গেঁথে নিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন জাগে যে কলোনিয়ালিজমের মত যে অনাচারটি প্রাচ্যের দেশে দেশে কয়েকশো বছর ধরে চলেছে তাকে কি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের তত্ত্ব দিয়ে বুঝতে হবে?
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যদি ইউরোপে ক্ষমতা-প্রকৌশল সার্বভৌম থেকে জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলে বাঁক নিয়ে থাকে, ঠিক এই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার নানা ভূখণ্ডে যে উপনিবেশ কায়েম করা হয়েছিল, সেসব ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের চিন্তা-চেতনার গড়াপেটার ধরন-ধারণ কী ছিলো — সে বিষয়ে ফুকো নীরব।
জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলের কোথাও এ কথা বলা নেই যে, অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে উপনিবেশ বানাতে হবে। তবে অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে আক্রমণের ধারণাটি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলে অবশ্য উপস্থিত। তাহলে কি ধরে নিতে হবে উপনিবেশায়িত রাষ্ট্রগুলোতে দ্বিস্তরের ক্ষমতা-প্রকৌশল কার্যকর ছিলো? বাইরের, বা আন্তর-রাষ্ট্রের স্তরটি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের বলয় আর ভেতরের, জনগণকে গড়া-পেটার ক্ষেত্রটি জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়?
ফুকোর চিন্তাসূত্র ধরে এগুলে এইরকম, বা এর কাছাকাছি কিছু ভাষ্য তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এই ভাষ্যগুলো উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত অবস্থা, তাদের যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতার কতটা কাছাকাছি? ফুকোর তত্ত্বের আভাসের বাইরে গিয়ে জোরেশোরে যদি এই কথা বলি যে, কলোনিয়ালিজম একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন এই অর্থে যে, উপনিবেশিত বিশাল জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে তাদের নিজেদেরকে অনেকটাই উন্মূল করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হেজেমোনির বলয়ে এমনভাবে গড়া-পেটা করা হয়েছে যে, উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিমানসে পাশ্চাত্যের নানারকম প্রভাব দুর্লঙ্ঘভাবে বিরাজমান— যার প্রকৃত ভাষ্য ফুকোর চিন্তা-প্রকল্পে অনুপস্থিত।
ইউরোপ বা আমেরিকার জনগণের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা আর উপনিবেশিত মানুষের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা এক নয়। উপনিবেশিত মানুষের মগজে-চেতনায় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব এমনভাবে কাজ করে যে ঢাকার নাগরিক জীবনের সূর্যোদয়, সুর্যাস্ত ঘটে ওয়াশিংটন ডিসি, প্যারিস, লন্ডনে। অন্য কথায় ঢাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তার ‘সময়’ বা ‘কাল’ এবং তার মনো-ভৌগলিক ‘স্থান’ থেকে উচ্ছেদকৃত হয়েছেন বা বাস্তুহারা হয়েছেন। একথা ঔপনিবেশিকতার নিগড়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন সকল জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্যও সত্য। এই মানুষেরা শুধু জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে গড়া-পেটা নয়, বরং ঔপনিবেশিকতাজনিত বিস্মৃতিপরায়ণতা এবং পাশ্চাত্যের হেজিমোনির বলয়ে এক ভিন্ন এবং বিশিষ্ট গড়া-পেটার অভিজ্ঞতাকে সামষ্টিক ও সামগ্রিকভাবে ধারণ করছে। এ কারণেই পোস্ট-কলোনিয়াল চিন্তকদের অনেকেই বিউপনিবেশয়ানের ধারণাকে সামনে আনেন—একদা উপনিবেশ ছিলো কিন্তু পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এমন জাতিরাষ্ট্রগুলোরর প্রকৃত মুক্তি বিউপনিবেশায়ন ছাড়া সম্ভব নয়।
২. যৌনতার ইতিহাস বিষয়ে ফুকোর ভাষ্য ইউরোপকেন্দ্রিক। এই ভাষ্যকে আবার দৃঢ় করেছে তাঁর বয়ান, ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা-প্রকৌশল, জিনিওলোজি ইত্যাদির ধারণা। এভাবে দেখলে ফুকোর যৌনতা বিষয়ক চিন্তা-প্রকল্পটিতে ইনফিনিটি রিগ্রেস (Infinity Regress) ফ্যালাসির উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। তবে ফুকোর ধারণাগুলোর শক্তি হচ্ছে—এগুলোকে সন-তারিখ, কিংবা অকাট্য প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসের নানা পরিবর্তন, রূপান্তরকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাখ্যা করা চলে। প্রাচ্যের ইতিহাস, এর সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বিকাশ ব্যাখা করার প্রশ্নে ফুকোর ধারণাগুলো সরাসরি সাহায্য করে না।
৩. “ব্যক্তি”কে নিছক প্রভাব (উপরের মূল আলোচনা থেকে দেখে নিন) হিসেবে দেখিয়ে ফুকো ব্যক্তির এজেন্সিকে ‘নাই’ করে দিলেন, প্রতিরোধের ধারণাকে নাকচ করলেন বলে এক ধরনের হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড হরহামেশা দেখতে পাওয়া যায়। নতুন করে তাতে যোগ দেবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি মনে করি ব্যক্তির এজেন্সির ক্ষেত্রগুলো বা এজেন্সির প্রকৃতি, সামর্থ্য, প্রতিরোধের ধারণা ইত্যাদি মার্ক্সিস্ট মডেলে একরকম; ফুকোর মডেলে সেগুলো অন্যরকম। ভিন্ন ভিন্ন গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্যারাডাইম শিফট ঘটতে ব্যাপক প্রস্তুতির এবং সেজন্যই সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এতে ব্যক্তির ভূমিকা থাকলেও ফুকো বলতে চান মূল নিয়ন্তা এক্ষেত্রে ব্যক্তি-পর্যায়ের বাইরে — বয়ানের পরিবর্তন, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রূপান্তর ইত্যাদি।
৪. জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশল সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ-ধারণাকে মুলো হিসেবে ঝুলিয়ে কাজ করলেও বিগত দু-তিন দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলতে হয় সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ-ধারণা নয় বরং ভীতি, ত্রাস, যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র দ্বারা নিজ রাষ্ট্রের ও অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তোলা—এসবই এখন কাজ করছে ক্ষমতা-প্রকৌশলের ‘লাঠি’ হিসেবে। একিলি বেম্বে তাই জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলের রূপান্তর ঘটেছে বলে দাবী করেন এবং এই নতুন ক্ষমতা- প্রকৌশলকে বলতে চান মারণ-ক্ষমতা।
গ্রন্থপঞ্জি
Foucault, M. (1990). The history of sexuality, volume 1: An introduction. New York: Vintage Books.
Foucault, M. (1995). Discipline and punish: The birth of the prison. New York: Vintage Books.
অসাধারণ একটি প্রবন্ধ।