ধরেই নেয়া হয় যে, পর্নোগ্রাফি বিপুল উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক ব্যাপার; এর ভোক্তা হিসেবে আছে প্রায় সকল ধরনের লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষ। অনেকেই পর্ন দেখেন, কিন্তু স্বীকার করেন না। নারীদের মধ্যে পর্ন দেখার প্রবণতা কম থাকলেও সাম্প্রতিক কালে ইন্টারনেট প্রযুক্তির সহজলভ্য পরিস্থিতিতে নারীরাও পর্নে উৎসাহী। ২০১৫ সালের ইনফোগ্রাফিকের তথ্য অনুসারে ৭০ ভাগ পুরুষ পর্নপণ্য কিনে থাকে, বাকি ৩০ ভাগের ক্রেতা নারী। পেইন্ট বোটল সাইটের তথ্য অনুসারে ইন্টারনেটে রূপান্তরিত ডেটার ৩০ ভাগ তথ্য মূলত পর্ন। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি হলো : পর্ন কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ? শরীর ও মনের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা কতোখানি? শরীর ও মনকে কতোখানি প্রভাবিত করে পর্নোগ্রাফি? এ ধরনের প্রশ্ন সামনে রেখে অসংখ্য গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
এমনকি পর্ন স্টাডিজ নামে গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পর্ন এতোই সহজলভ্য যে, শিশুরাও এসবের দিকে ঝুঁকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী টিনেজারদের শতকরা ৪২ ভাগ অত্যন্ত অল্প বয়সে পর্নছবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তবে উল্লেখ্য যে, গবেষণায় প্রাপ্ত ফল একটি অন্যটির সঙ্গে কখনো কখনো সাংঘর্ষিক। অন্য সব বিদ্যাশাস্ত্রের গবেষণার মতোই এক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। এই সত্য মেনে নিয়েই পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে পাঠ করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্ন মানসিক ও শারীরিক দুই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। কারণ পর্ন দেখার নেশা অন্য সব আসক্তির মতোই ভোক্তাকে কব্জা করে ফেলে। এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে আসক্ত ব্যক্তিরা সাইকোথেরাপিস্টের শরাণাপন্ন হন। সাইকোলজি অফ অ্যাডিক্টিভ বিহেভিয়ার নামের গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, পর্নোগ্রাফি শুধু প্রভাবিত করছে না, ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি কীভাবে ব্যক্তিজীবনে ব্যবহার করছে এবং নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামব্রিজের গবেষকদল দেখিয়েছেন, পর্ন-আসক্তি অন্য সব আসক্তির মতোই কাজ করে এবং মানসিক নির্ভরতা তৈরি করে।
পুরুষের ক্ষেত্রে erectile dysfunction বা উত্থানশৈথিল্য বড় আকারের সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
প্রতিনিয়ত পর্ন দেখার প্রধান সমস্যা হলো যৌনতাকে পর্ন আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে এবং স্বমেহনে উৎসাহিত করে। আর তাই যৌনসঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। পর্নের ছবি, শব্দ, প্রতিক্রিয়া, উপস্থাপনার অডিও-ভিজ্যুায়াল ইমেজ মস্তিষ্কের কার্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ফলে যৌনফ্যান্টাসি বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আরম্ভ করে। পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি সঙ্গীর আচরণ ও শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় একই ধরনের সংবেদনা প্রত্যাশা করতে থাকে। কিন্তু কোনো সঙ্গীর পক্ষেই ফ্যান্টাসির স্তরে থাকা অনুভূতির সর্বোচ্চ জোগান দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি যৌনশিথিলতায় ভুগতে থাকেন।
পুরুষের ক্ষেত্রে erectile dysfunction বা উত্থানশৈথিল্য বড় আকারের সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। পর্নোছবির নারীর মতো সক্রিয়তা পুরুষ রক্ত-মাংসের নারীশরীরে পায় না; নারী পায় না পুরুষের মধ্যে। একইভাবে নারীর মধ্যে ফিজিডিটি বা যৌনশিথিলতা। পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্য ও যৌনস্থায়িত্ব নিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে অতিরিক্ত আগ্রহ তৈরি হয়। যৌনতার আনন্দই লোপ পেয়ে যায়।
এমনও গবেষণা আছে যেখানে গবেষক দেখাচ্ছেন, পর্ন দেখতে অভ্যস্ত দম্পতি পর্ন ছবি ছাড়া স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন; যৌনদৃশ্য ব্যতিরেকে পুরুষের উত্থান ঘটে না। অবশ্য এমন অনেক দম্পতি আছেন যারা মনে করেন, পর্নছবি তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে বিশেষ উদ্দীপনা জুগিয়েছে। অনেক দম্পতি আবার শক্তভাবে এর বিরুদ্ধে বলেছেন।
পর্ন দেখার সঙ্গে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতারও সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। যারা ডিপ্রেশনে ভোগেন, তারা যৌনানন্দের মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে করে ডিপ্রেশনের মাত্রা বাড়তেই থাকে। এক দিকে বিষণ্ণতার ধকল, অন্যদিকে যৌনসঙ্গী না থাকা বা থেকেও পরিতৃপ্ত না হবার অসন্তুষ্টি — দুইয়ের অভিঘাতে ব্যক্তি বিষণ্ণতার প্রকোপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পর্ন দেখার কারণে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিক সম্পর্ক থেকে। নৈঃসঙ্গ্যের যন্ত্রণা ব্যক্তিকে আরও বেশি নৈঃসঙ্গ্যের দিকে নিয়ে যায়। কারণ পর্ন সাধারণত একাই একাই ব্যক্তি দেখে থাকে এবং উপভোগ করে থাকে। এই একক আনন্দ যৌথ যৌনতার আনন্দকে বিনষ্ট করে দেয়। পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি বা যুগল ভাবেন না যে, যৌনতা কি আনন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত? নাকি দীর্ঘস্থায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত?
অনলাইন পর্নোগ্রাফি দর্শন সম্পর্কে গবেষকদের মত এই যে, পর্ন ডিপ্রেশন, রাগ ও দুঃশ্চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যর্থতা নিজেই ডিপ্রেশন, রাগ ও দুঃশ্চিন্তার জন্ম দেয় — যা মানসিকভাবে চাপে ফেলে। গবেষকদের মতে, হঠাৎ দেখা পর্নছবিও কারো কারো মনে স্থায়ী দাগ কেটে দেয়। বাইপোলার ডিজ-অর্ডার সৃষ্টিতেও পর্ন ভূমিকা রাখে বলে গবেষকরা মত প্রকাশ করেছেন।
পর্নোগ্রাফির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার এক ধরনের সহনশীলতার বোধ তৈরি করে; এ কারণে আরও বেশি অস্বাভাবিক, অবাস্তব, অবিশ্বাস্য, মারাত্মক পর্যায়ের যৌন-সম্পর্ক বিষয়ে সহনশীলতার মানসিকতা তৈরি হয়। যে হয়তো কোনোদিন পায়ুকাম বিষয়টি ভাবতেই পারে নি, সে উৎসাহিত হচ্ছে পায়ুকামে। আত্মীয়তা সম্পর্কের সূত্র ধরে যেখানে যৌনসম্পর্ক নিষিদ্ধ বা অজাচার হিসেবে বিবেচিত হয়, সে ধরনের সম্পর্ক বিষয়ক পর্ন দেখতে দেখতে ওই ধরনের সম্পর্ককে যৌনসম্পর্কের মোড়কে ভাবার মানসিকতা তৈরি হয়। সেক্সটয় সম্পর্কে যার ঘেন্না আছে, সে-ই হয়তো পর্ন দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হতে হতে উৎসাহিত হচ্ছে সেক্সটয় ব্যবহারে।
মানসিক ঝুঁকির সব চাইতে মারাত্মক দিক হলো : পর্ন ছবি থেকে ব্যক্তি যৌনতা এবং যৌন-সম্পর্ক বিষয়ে ভুল ধারণা গ্রহণ করে।
আবার এমনও হয় যে, পুরুষ বা নারী তাঁর শরীরের কাঠামো, যৌনাঙ্গ, স্তন, কোমর, ঠোঁট, পেশী প্রভৃতি নিয়ে অসন্তুষ্টিতে ভুগতে থাকেন; নিজের শরীর ও যৌনতা বিষয়ে অনিরাপদ বোধ করতে থাকেন। শরীর সম্পর্কে তৈরি হয় হীনম্মন্যবোধ।
অনেকে জড়িয়ে পড়েন সাইবার যৌনতায়; ছবি-ভিডিও আদান-প্রদানের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক ও ধর্মীয় ট্যাবু অপরাধবোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার প্রভাব হিসেবে গড়ে ওঠে একাকিত্বের বোধ এবং উদ্বিগ্ন আচরণ। মূলত আচরণিক মনস্তত্ত্বে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
মানসিক ঝুঁকির সব চাইতে মারাত্মক দিক হলো : পর্ন ছবি থেকে ব্যক্তি যৌনতা এবং যৌন-সম্পর্ক বিষয়ে ভুল ধারণা গ্রহণ করে। ব্যক্তির মনে যৌনতা বিষয়ক বিভিন্ন মিথ গড়ে ওঠে। যেকোনো ঘনিষ্ঠতাকে যৌন-সম্পর্কের দিকে ধাবিত করার প্রবণতা তৈরি হয়। নারীর বিভিন্ন অভিব্যক্তিকে যৌন অভিব্যক্তি হিসেবে ভাবার মানসিকতা তৈরি হয় পুরুষের মধ্যে। পুরুষ তাই ধর্ষণ করে নারীর অভিব্যক্তির দোহাই দিতে আরম্ভ করে।
বেশির ভাগ পর্নদৃশ্যে নারীকে দেখানো হয় যৌনপ্রতীক রূপে। নারীর শরীরকে পুরুষের উপভোগ্য বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য অনেকে বলেন, নারীকেন্দ্রিক ছবিও আছে, যেগুলো নারীর যৌনক্ষমতায়ন ও যৌনসক্রিয়তাকে উজ্জীবিত করেছে। কিন্তু পুরুষ সেখানে যৌনদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ কারণে ক্ষমতায়নের পরিপ্রেক্ষিতেও পর্নকে ভাবতে চান না অনেক গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক। ক্যামব্রিজের অ্যাংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক জুলিয়া লং — যিনি একজন নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট — বলেছেন, ‘পর্নোগ্রাফি যৌনফ্যান্টাসিরও অধিক। এটা এক ধরনের সাংস্কৃতিক সহিংসতা।’ তিনি পর্নোগ্রাফিকে ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার একটি ধরন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ভার্জিনিয়ায় আইন প্রণেতারা পর্নোগ্রাফিকে ‘আসক্তিযোগ্য’ বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, এগুলো ধর্ষণকে স্বাভাবিক করে তোলে, বিয়ের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলবে, সহিংসতা ও যৌনতাকে সমান ভাবতে সহায়তা করে, সংঘবদ্ধ যৌনতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে প্রলুব্ধ করবে। গবেষকদের এসব অভিমত ও বক্তব্য পর্নকে ইতিবাচকভাবে ভাবতে মোটেও সহায়তা করে না। কারণ অধিকাংশ গবেষণায় পর্নের নেতিবাচক প্রভাবই প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য প্রাপ্তবয়স্কের বিনোদন হিসেবে লিঙ্গনিরপেক্ষ-ক্ষমতাসম্পর্কের আধিপত্যহীন বিকল্প যৌন-উপকরণ আছে কিনা, ভাববার বিষয়। আর বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে যৌনতা বিষয়ে কানাকানি ও ফিসফাস সেখানে পর্নোগ্রাফি ভুল বার্তা দেবে এটাই স্বাভাবিক বলে অনুমিত হয়।
আরও পড়ুন