বায়োগ্রাফিক্যাল ফিকশন বা আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য — যখন ফুটিল কমল। লেখার পরিণতি কী দাঁড়াবে লেখক নিজেই তা ভালো বলতে পারবেন। জাহিদুর রহিম চমৎকার গদ্যে উপহার দিয়েছেন জীবন ও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর।
ঘরের নিচে — এক অনেক ঘরের নিচে, অসংখ্য ভাঙা খোলামকুচির মধ্যে
শুয়েছিলাম কালরাতে — কে একটা, কোথাকার বাচ্চা মেয়ে — বরফকুচির
মতো ঠাণ্ডা — হাসতে হাসতে : এই যে শুনছেন, এই যে, আপনি মরে গেছেন :
কোথাও নদী নেই –অথচ কোথায় যে পাড় ভাঙার শব্দ, এত ঠাণ্ডা, এত
ঠাণ্ডা অন্ধকারে –এ কোথায় আমি?
যারা মরে যায় –তারা ঘরের নিচে, এক
অনেক নিচের ঘরে চলে যায়
নীল জামাশুদ্ধু মেয়েটাও হঠাৎ হারিয়ে গেলো –অন্ধকারে, আমার কঠিন মুখ
নীল হয়ে রইলো কিছুক্ষণ –সারি সারি ছায়ার মতো অন্ধকার, সেই অন্ধকারে
অসংখ্য ভাঙা খোলামকুচির মধ্যে শুয়ে শুয়ে –শুয়ে শুয়ে শুয়ে –এ কোথায়
আমি?
যারা মরে যায় — তারা ঘরের নিচে, এক
অনেক নিচের ঘরে চলে যায়
ঘুমের মধ্যে।
— ভাস্কর চক্রবর্তী
অস্বচ্ছ, ধূসর আর খসখসে মোজাইক করা ছবির মতো আমাদের জীবনের ঘটনাগুলো। কিন্তু কাছে থেকে তা দেখার উপায় নেই। ঘটনাগুলোকে ভালোভাবে বুঝে, ছবিটি দেখার জন্যে অবশ্যই দূরে যেতে হবে। শেষ রাতের ঘুমন্ত সময়ের পাখায় করে চলে যেতে হবে মানুষের কোলাহল থেকে দূরে। দাঁড়াতে হবে স্মৃতির ঝুলন্ত সেতুর উপরে। দূর অতীতে নিমজ্জিত এই সংবেদনশীলতা তুলে আনবে একাকিত্ব, নিজস্বতা আর বিষাদ। আমাদের অসৃষ্টিশীল মুহূর্তকে প্রভাবিত করা অদৃষ্ট, মহৎ ও গম্ভীর হয়ে তখন তাকাবে আমাদের দিকে নির্লজ্জ, নিয়ন্ত্রণহীন প্রতাপে। স্পষ্ট বুঝা যাবে সেই ছবি — সুখ, প্রাচুর্য আর ব্যাখ্যাতীত মাহাত্ম্যের এক নতুন দুনিয়া; অভিজ্ঞতা, হতাশা আর আনন্দের মৌতাতের দড়িতে যে ছবি দুলছে ঝড়ো হাওয়ায় সাগরে ভাসা পলকা নৌকার মতো, আমাদের জীবনের মতই।
এই ছবি থেকে বের হয়ে আসবে পাকা পেয়ারার গন্ধের মতো ঝাঁঝালো গন্ধ, যা পরিস্ফুটিত স্মৃতির স্পন্দনে প্রলম্বিত প্রতিধ্বনিতে ভাগ্যের ইশারার এক খেলার পুতুল। পরিপূর্ণ, অকৃত্রিম এবং ভাবাবেগমুক্ত হৃদয়ের দুয়ার খুলে সেই ছবি দেখতে গেলে আজকের ‘এই মানুষ’টিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কোন মানুষের নিজস্বতা যদি তারপরেও জিন্দা থাকে, তবে ভবিষ্যতের আয়নায় হয়ত দেখা যাবে অতীত নিমজ্জিত সেই একাকিত্ব বিশালতা নিয়ে ছড়িয়ে আছে নক্ষত্রদের মাঝে। মানুষের বাস্তবিক চেতনার গড়ন এমন যে উন্নততর অবস্থায় উত্থিত হলে আগের অবস্থায় আর ফিরে আসে না বা তাঁকে ফেরানো সম্ভব হয়না। একটা ‘ওয়ান ওয়ে রোড’।
একজন মানুষ যতবেশি একা হবে, তত বেশি সে তার নিজের মতো হবে। নিঃসঙ্গতাকে যে ভালোবাসে না সে আসলে স্বাধীনতাকে ভালোবাসে না। কারণ মানুষ তখনই সত্যিকার স্বাধীন, যখন সে একা।
‘এই একা হতে না পারাটা যে কত বড় দুঃখের!’ — কোথাও বলেছিলেন লা ব্রুইয়ের। তিনি যেন লজ্জা দিতে চান সেই সব লোকদের যারা ভিড়ের মধ্যে দৌড়াচ্ছে নিজেকেই হারাতে, এই ভয়ে যে নয়তো তারা নিজেকে নিজেই সহ্য করতে পারবে না।‘ নিজেদের ঘরে নিজেরা থাকতে জানিনা বলেই আমরা আমাদের প্রায় সমস্ত দুঃখকে ডেকে আনি’- বলেছিলেন, বোধহয় মহাজ্ঞানী পাসকাল।
এই ভাবে তিনি মৌন মন্দিরে ডাক পাঠালেন সেই সব লোকদের যারা, যারা সুখের সন্ধান করে ছটফটানি আর ব্যাভিচারের মধ্যে যাকে আমি বলি ‘ভাতৃ ধর্মী’, যদি আমি আমার কালের সাধু ভাষায় বলি। (‘নিঃসঙ্গতা’ — শার্ল বোদলেয়ার)
অন্যদের মতো হতে গিয়ে আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলি। মহান মানুষেরা ঈগলের মতো। তারা নীড় গড়েন সুউচ্চ নিঃসঙ্গতার ওপর। উচ্চপর্যায়ের বা উন্নততর রুচি ও মেধা মানুষকে অসামাজিক করে তোলে। মানব ইতিহাসের সেরা গল্পকার আন্তভ চেখভ কী সুন্দর করে এক লাইনে বলেছিলেন — ‘আপনার রুচি যত সূক্ষ্ম ও উন্নত হবে, আপনি তত নিঃসঙ্গ ও দুঃখী হবেন।’
রুচি উন্নত আর সূক্ষ্ম হয় কল্পনা দ্বারা। প্রতিভাবান মানুষের এজন্যই কল্পনা দরকার। যাতে তারা বস্তুর মাঝে দেখতে পারে, প্রকৃতি মোটের ওপর কী গঠন করেনি। চিন্তাই একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন, চিন্তার চেহারার সঙ্গে সুন্দর একটি ছবির মিল রয়েছে। যেখানে আলো আর ছায়া দুটোই সঠিক। যেখানে স্বরভঙ্গি সবসময়েই গীতময় আর পরমভাবে রয়েছে রঙের ঐকতান। বস্তুত, এটিই জীবনের সত্যি।
অন্যের দ্বারা অভিব্যক্ত চিন্তাপ্রবাহ অবিরত চিন্তা করতে থাকলে মানুষের নিজের চিন্তা বন্ধ হয়ে যায়, মানে সোজা কথায় ‘চিন্তা মরে যায়’। অবিরাম শেখার মধ্যে থাকলে ব্রেনকে চিন্তার মরা থেকে রক্ষা করা যায়। ফলে যদি কারো নিজের চিন্তাসৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে স্থান করে নেয়, কারো বই থেকে পাওয়া চিন্তা। এ কথাটি শেকসপিয়রকে মনে করিয়ে দেয়। তিনি তার সমসাময়িকদের বলেছিলেন, ‘এরা অন্য দেশ দেখার জন্যে নিজের দেশ বেচে দ্যায়’।
প্রকৃত পরমসত্তা একটি অন্ধ অনুপ্রেরণাদায়ক শক্তি, যা ব্যক্তির ইচ্ছাতে প্রকাশ পায়। অন্ধ ইচ্ছাশক্তি ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকার ইচ্ছা শক্তির দ্বারা চালিত হয়েও সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না মানুষ- সেটাই সেই অসুখ যার কারণে ব্যক্তিকে দুঃখময় জীবন যাপন করতে হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় হলো ইচ্ছাকে দমন করা, কৃষ্ণা কামনা-বাসনার গাছ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
কিন্তু চাইলেই এটা সম্ভব নয়। এর জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হয় অনেক। ভুলে যেতে হয় তার জীবনের ফেলে আসা পথের অনেক স্মৃতি। এটাই সেই গভীর দুঃখ, যা কোনো বন্ধুর মৃত্যুতে আমরা অনুভব করি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এমন কিছু থাকে যা অ-অভিব্যক্ত এবং অদ্ভুতভাবে তার একার, যা কেউ-ই জানে না। এবং তা অপূরণীয়, হারিয়ে গেলে চরমভাবে হারিয়ে গেল। এটাও মানবিক চরিত্রের অনেক রূপের এক রূপ। যেমন জীবনের এক রূপ দেখেছিলেন র্যাঁবো।
জ্যাঁ ককত যেমন বলেছেন, ‘যেন এক দেবদূত, যার চোখ দুটি নীল আকাশেতারা হয়ে গেছে’। র্যাঁবোর ছোটবেলার বন্ধু এরনেস্ত দ্যলায়ে আর শিক্ষক জর্জ ইজাঁবার লিখেছেন, ‘র্যাবো ঠিক ওই রকমই দেখতে ছিল।‘
তিনি কুড়ি বছর বয়সে চিরকালের মতো কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়া এক রুপকথা। ভোরবেলা উঠে দেখি ,কোন এক অচিন দিগন্তের ধারে সেই বিস্ময়-বালক গ্রীষ্মের ঊষাকে চুম্বন করছে। আমারদের মনে পড়ে যাবে অরুণ মিত্রের ‘ভোর’ —
আমি গ্রীষ্মের ঊষাকে আলিঙ্গন করেছি। প্রাসাদের শীর্ষে তখন কিছুই নড়ছিল না। জল ছিল নিথর। ছায়ার শিবির বনপথ ছেড়ে যায় নি। প্রখর উষ্ণ নিঃশ্বাস জাগিয়ে আমি হেঁটেছি; মণিমানিক তাকিয়ে দেখল, ডানা উপরে উঠল নিঃশব্দে। মেটে পথ ইতিমধ্যেই ভরে উঠেছে তাজা অস্ফুট ঝলকে; তার মধ্যে প্রথম উদ্যম হল একটি ফুল, যে তার নাম বলল আমাকে।
১৮৭০ সালের মার্চে ষোলো বছর বয়সে র্যাবো লিখেছিলঃ
নীল গ্রীষ্মরাতেরমধ্য দিয়ে আমি পথ করে নিচ্ছি,
গমের ক্ষত, ছোট ছোট ঘাস মাড়িয়ে :
স্বপ্ন দেখতে দেখতে পায়ের নীচে ঠান্ডা লাগে,
বাতাস ধুয়ে দেয় আমার নগ্ন মাথা
একটি কথাও নয়, কোনও ভাবনা নয়:
অসীম প্রেম আমার বুক ছিড়ে উঠবে,
আর পথভ্রষ্ট আমি চলে যাব দূরে
প্রকৃতির ভেতর — কোনও নারীর মতো সুখী।
(‘অনুভূতি’)
কবিতার ইতিহাসে মিথ যদি কেউ হয়ে গিয়ে থাকে তিনি আর্ত্যুর র্যাঁবো। হা ভগবান, কেন ওই বালক সমুদ্র-লবণের স্বাদ মুখে আনে? কেন সে সীমাহীন ভাবে স্বতন্ত্র? প্রথম প্রকাশিত কবিতায় সে লিখেছিল :
ঘরভর্তি ছায়া; খুব অস্পষ্টভাবে তুমি শুনতে পাচ্ছো
দুটি শিশুর বিষণ্ণ নরম ফিসফিসানি।
ঘুমে তাদের ভারি মাথা নীচু হয়ে আছে
দীর্ঘ শাদা কম্পমান উর্ধচারী পর্দার নীচে…
একে কি বলব অব্যক্তের ওপর আক্রমণ?
টি এস এলিয়ট যাকে বলেছেন, ‘a raid on the inarticulate’?… ( ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি’, চিন্ময় গুহ) বিষণ্ণ এই ফিসফিসানির নরম শব্দ শুনতে আমাদের যেতে হবে অক্ষরের। কালো কালো শব্দের বর্ণের শরীর যে এতো দ্যুতিময়, লেখকরা না লেখলে কি করে জানতো মানুষ? অন্তর্দৃষ্টি লাভের জন্যে যে বই পড়ে, তার কাছে পড়াশোনা হচ্ছে সেই মইটির ধাপ, যাতে করে সে আরোহন করে জ্ঞানের শিখরে। যখনই তার সামনে একটি ধাপের উদয় ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে সে সেই ধাপকে পেছনে ফেলে উঠে যায় আরও উঁচুতে।
আর যারা স্মৃতিভাণ্ডারকে পূর্ণ করতে বই পড়ে, তারা সে মইয়ের ধাপগুলো ব্যবহার করে না। বরং ধাপগুলোর উদয়কে বন্ধ করে রাখে। নিজেকে বোঝাই করে আর বোঝার ওজন বাড়িয়ে আনন্দ পায়। তারা চিরকাল নিচে থেকে যায়, ছুঁতে পারে না জ্ঞানের শিখর। তাঁদের উদাহারণ অনেকটা বটগাছের বনসাই বানানোর মতন। বটগাছ যে বটগাছ তা কাউকে বিশ্বাস করানোর ব্যাপার থাকে না।
কিন্তু বনসাই যে বটগাছ, এটা বিশ্বাস করানোর ব্যাপার থাকে। যারা প্রজ্ঞাবান তারা ঘরের বনসাইয়ের চেয়ে বনের বটগাছের দিকে তাকিয়ে বেশি মুগ্ধ হয়। তারা ঘরের সাজানো প্রতিবন্ধী গাছের চেয়ে বনের বটের ডালে পাখি ও বাতাসের সঙ্গীতের দিকে বেশি মনোযোগী। প্রজ্ঞা অন্তর্দৃষ্টির ব্যাপার। মনের সেই দৃষ্টি খুলে গেলে মানুষ সত্যকে দেখতে পায় আপন মনে স্বচ্ছতার অনুপাতেই। আসলে প্রজ্ঞাহীন মানুষের বিশ্বাস ও কাজের রীতি তাদের জাগ্রত চেতনার সমানুপাতিক। পবিত্র কুরানে বলা হচ্ছে, “ বলুন, প্রত্যেকেই নিজ রীতি (বুঝ-জ্ঞান) অনুযায়ী কাজ করে। অতঃপর আপনার পালনকর্তা বিশেষ রূপে জানেন, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে (১৭ : ৮৪)।
কিন্তু প্রজ্ঞা আসবে কি করে মানুষের কাছে? প্রজ্ঞা হলো চিন্তা আর অনুভবের একাত্মতায় গণ্ডদেশ ভেজানো অঝোড় অশ্রুর নাম। কত দুর্লভ সেই উদগত অশ্রুর দিন। অশ্রু আলো, অশ্রু হৃদয়ের শুশ্রুষা।চোখে যদি না জাগে নূহের প্লাবন, কিসের সাগরে ভাসবো আমি আলোর আশিক। অশ্রুপাত বা মরিয়া চাওয়া শুরু জ্ঞান জগতের আদব নয়, ‘অশ্রুপাত’ তাওবার মর্মশাঁস।
‘তওবা’ ইসলামের এক আশ্চর্য কনসেপ্ট যেখানে আছে স্রষ্টার পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি। কারণ প্রত্যেক ‘পাপীর একটা আগামী থাকে, যেমন থাকে প্রত্যেক সাধুর একটা অতীত’। তওবা মানে প্রত্যাবর্তন : নিজেরই সহিসত্তা বা পুণ্যময় ফিতরাতে ফিরে আসা। কলুষিত ,অপরাধী হৃদয় প্রজ্ঞার পথে বাধা। তাই নিজের ভুলের স্বত:স্ফুর্ত স্বীকৃতি ও অনুতপ্ত হৃদয়ের আকুল নিবেদনের কারণে আদম(আঃ)কে শেখানো হয়েছিল এক আশ্চর্য প্রার্থনাবাক্য : “আমি নিশ্চয় অত্যধিক জুলুম করেছি আমার নফসের উপর”। আদম (আঃ) ক্ষমা পেয়েছিলেন। আর তাকে প্রথম মানব ও নবি হিশেবে ‘নামানো’হয়েছিল পৃথিবীতে যাতে সে ‘খিলাফত’ ও ‘রবুবিয়াতের’ দায়িত্ব পালন করে ফিরে যেতে পারে। তার আদি বাসস্থানে, স্বর্গে।
প্রজ্ঞা মানে গায়েবের নিশ্চিত উপলব্ধি, খোদার নুরে জগত দেখবার সক্ষমতা। বুঝি, প্রজ্ঞার কোন শর্টকাট ওয়ে নাই; দরকার কেবল প্রেমিকের হৃদয়ে ‘অশ্রুময় রাত্রি জাগরণ’। মানুষ ‘ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে — বলে গান তৈরি করে। ভালোবাসা দিতে চাইলে অশ্রুর পরীক্ষা লাগে। সেখানে প্রজ্ঞা তো আরও উন্নত্তর বিষয়। ‘কতটা চোখের জল ফেলেছি যে প্রজ্ঞা নাজিল হবে? শুধু কিতাব নয় ,দরকার সহবতও; দরকার মুহাব্বাতে খালক (মানবপ্রেম), দরকার সতেজ, সাড়াময়, জীবন্ত, দরাজ ও দরদি দিল’।
প্রজ্ঞা হচ্ছে মানুষের সেই সম্পদ যা তার নিজের, নিজের কালের এমনকি মৃত্যুর পরেও উপকার দিতে থাকে। যেমন দিয়েছিল দান্তেকে।
দান্তে মারা গিয়েছিলেন ১৩২১ সালে। কিংবদন্তি রয়েছে যে তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল ‘ডিভাইন কমেডি’র শেষ অংশ কেউ যেন সরিয়ে নিয়েছে পান্ডুলিপি থেকে! ফলে তাঁর দুই ছেলে জ্যাকোপো ও পিয়েত্রে মাসের পর মাস তন্নতন্ন করে খুঁজে চললেন সেই হারানো পাণ্ডুলিপি। পিতার কাগজপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে পিয়েত্রে আর জ্যাকোপো রীতিমতো হয়রান। শত চেষ্টা করেও পাণ্ডুলিপির শেষ অংশটুকু খুঁজে পেলেন না। অবশেষে সব আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজে মন দিলেন তাঁরা।
এভাবে কেটে গেল কিছুদিন। এক রাতে পিয়েত্রে স্বপ্নে দেখতে পেলেন তাঁর পিতাকে। সাদা পোশাক পরিহিত পিতা যেন নরম আলোতে ডুবে এসে দাঁড়ালেন পিয়েত্রের সামনে। পিয়েত্রে তখন পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ ডিভাইন কমেডির শেষ অংশটুকুর কথা। বললেন, ‘পিতা! আপনি কি এ মহাকাব্য অসম্পূর্ণ রেখেই মারা গিয়েছিলেন, না অন্য কেউ তা চুরি করে নিয়ে গেছে?’
স্বপ্নের ভেতরই দান্তে তাঁর স্নেহময় পুত্রকে জানালেন, ‘মৃত্যুর পর মূল্যবান এই মহাকাব্য বেহাত হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে তিনি পাণ্ডুলিপির শেষাংশটুকু লুকিয়ে রেখেছেন পাশের ঘরের ভেন্টিলেটরের ভেতরে।’ সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়েত্রে রাতের স্বপ্নের কথা জানালেন সবাইকে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না তাঁর কথা। যেমন আপনাদের অনেকেই এই কথা আজও বিশ্বাস করবেন না, কারণ আধুনিকতার মাত্রা মানা জ্ঞান আপনাদের অন্ধ বানিয়ে রেখেছে।
যারা বিশ্বাস করল তারাও তেমন একটা প্রয়োজন মনে করল না পাণ্ডুলিপিটি আবার খুঁজে দেখার ব্যাপারে। পিয়েত্রে তখন তাঁর এক আইনজীবী বন্ধুকে নিয়ে খুলে ফেললেন পিতার নির্দেশিত সেই ভেন্টিলেটর। খুলে তো তিনি অবাক! দেখতে পেলেন, একটি মোটা কাপড়ে জড়ানো রয়েছে অনেক অগোছালো কাগজ এবং সেগুলো ডিভাইন কমেডির শেষাংশ ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
সেদিন যদি দান্তে স্বপ্নে দেখা দিয়ে পিয়েত্রেকে পাণ্ডুলিপির জায়গাটি না দেখিয়ে দিতেন, তবে হয়তো চিরতরেই তা লুকানো থেকে যেত। তাতে ডিভাইন কমেডি পরিচিত হতো একটি অসফল ও অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি হিসেবে।
এই যে সাত শতকের পুরাতন এক ঘটনা, সেটার রহস্য আধুনিক মানুষের কাছে বেশ জটিল। কিন্তু দেহ ও আত্মাকে আলাদা করতে পারে যে প্রজ্ঞা তার কাছে এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ দুনিয়ার সব কিছু ঘুরছে যে নিরবতার চারপাশে, সেখানে রহস্য বলে কিছুই নেই। কেবল উপলব্ধি বলে এক ব্যাপার আছে। এই উপলব্ধি ছাড়া মাটির মানুষ সহ্য করতে পারে না শরীরী ভাষার বাইরের কিছু।
যদি হারানো কথাগুলো হারিয়ে যায়,
যদি ব্যয়িত শব্দগুলো ব্যয় হয়ে যায়,
যদি না বলা হয় কথা , না শোনা হয় শব্দ,
তবু এখনো পৃথিবীতে না বলা কথা আছে,
না শোনা শব্দ আছে,
শব্দহীন একটি শব্দ আছে,
শব্দের ভিতরে শব্দ আছে,
গভীর অন্ধকারে আলোর প্রজ্বলন আছে, আর
এই অস্থির পৃথিবী ঘুরছে সেই শব্দের বিপরীতে,
সেই নীরব নীরব শব্দের কেন্দ্রে” ( টি এস এলিয়ট/ অনুবাদ-জাহিদুর রহিম )
ঈসায়ী প্রথম শতাব্দীর স্টয়িক দার্শনিক এপিক্টেটাস বলছেন, ‘কেউ যদি আমাকে হুমকি দেয় আমাকে শেকল পড়াবে বলে, তাহলে আমি বলি এটা তো কেবল আমার হাত পায়ের জন্য হুমকি। যদি আমাকে বলে আমার মাথা কেটে নেয়া হবে, আমি জবাবে বলি, এটা তো কেবল আমার গলার প্রতি এক হুমকি। যদি আমি আমার হাত-পা-মাথা এগুলোর ভয়কে নিজের ভয় বলে মনে করি, তাহলে হুমকি গুলো আমার জন্য। কিন্তু যা আমার নিজের অধীন তাঁকে দুনিয়ার সবাই মিলেও তো হুমকি দিতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, যেমন যদি আমি আমার হাত-পা- দেহ- মাথাকে পাত্তা না দিই, তাহলে সব কিছুই, সব হুমকি হাস্যকর হয়ে পড়ে’।
হয়ত এটাও শেষ মিমাংসা নয়। কারণ মানুষের মধ্যে আছে একাধিক স্বত্বা। সেই আলাদা স্বত্ত্বার প্রকাশ ও সহ্যের ধরণ আলাদা। পাত্তা না দিলেও অনেক কিছুই মানুষের জন্য হুমকি হতে পারে যদি মানুষ নিজের স্বত্তার খন্ডিত অংশের সবটার সক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না রাখে। যে ছিল না মনসুর হাল্লাজের। প্রজ্ঞার জগতের খবর একান্ত আস্থাশীল ছাড়া কারো কাছেই কোন মতেই রহস্য প্রকাশ করা যায় না। মনসুর হাল্লাজ যদি প্রাজ্ঞতায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হতেন তবে কখনও তিনি ‘তাঁর বন্ধুর রহস্য’ লোক সমাজে প্রকাশ করতেন না।
হযরত হাল্লাজের বোন ছিলেন উঁচু স্তরের একজন ওলী। অর্ধেক রাত অতিবাহিত হবার পর তিনি ঘর ছেড়ে বাগদাদের উন্মুক্ত মরুভূমিতে চলে যেতেন এবং একাগ্র চিত্তে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন। বাড়ি ফিরার সময় হলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের হলতেন, আমার প্রেম মদিরার এক পেয়ালা বেহেশতী সুরা তাকে পান করতে দাও। ফেরেশতাগণ পানপাত্র তাঁর হাতে তুলে দিতেন। তিনি তা পান করে ঘরে ফিরে আসতেন মনসুর বোনের ঘর থেকে বের হয়ে যাবার বিষয় জানতে পারলেন। বোন কোথায় যায় জানার জন্য এক রাতে ঘর থেকে তাঁর পেছনে পেছনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নিয়ম মতই বাড়ি ফিরবার পূর্বে ফেরেশতাগণ তাঁর সামনে পানপাত্র ধরলেন। তিনি প্রেম সুধার সামান্য পরিমাণ পান করতেই মনসুর পিছন থেকে ডাকলেন, ‘বোন! তুমি একা পান করো না, আমাকেও একটু দাও।‘
পেছন ফিরে ভাইকে দেখে তিনি তো অবাক! তিনি বললেন, ‘হায় অদৃষ্ট! আমার এতদিনের রহস্য আজ প্রকাশ পেয়ে গেল!’ তারপর ভাইকে বললেন, ‘তুমি এটা পান করো না। আমার বিশ্বাস তুমি এটা সহ্য করতে পারবে না’। ভাই তাঁর কথায় কান দিলেন না। সেই সুধা পান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে পড়ল, ‘আনাল হক। আমিই সত্য। ‘ভাইয়ের অবস্থা দেখে বোন দুঃখে কেঁদে কেঁদে ফেললেন।
এরপরে নানান কিছু হলো। লোকে বলাবলি করতে লাগল, মনসুর এমন পৌরুষের অধিকারী ছিলেন যে বন্ধুর প্রেমে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন। কিন্তু বোন লোকের কথা শুনে বললেন, ‘মনসুর ছিল একজন কাপুরুষ। সে পৌরুষের অধিকারী হলে সামান্য পরিমাণ প্রেমের মদিরা পান করে এমনভাবে বিপথগামী হত না। আমি আজ বিশ বৎসর যাবৎ এই মদিরা পান করে আসছি, অথচ আমি তো কোন বিপথে চলিনি। বরং বলেছি, আরও দাও’।
প্রজ্ঞা আসে জ্ঞান থেকে, জ্ঞান আসে শিক্ষা থেকে, শিক্ষা আসে অভিজ্ঞতা থেকে। আর অভিজ্ঞতা আসে জীবনের আয়ু পুড়িয়ে। এবং প্রজ্ঞাও প্রেমের মতো —
প্রেম হৃদয়ে থাকলে বদনাম হয়
ঠোঁটে এলে গোপন কথা হয়ে যায়”
‘ইশক দিল মে হ্যায় তো রুসওয়া হো
লব পর আয়েঁ তো রায হো জায়ে’
( মূল : মির্জা গালিব/ অনুবাদ : জাভেদ হুসেন)