বনদ

সেই কোন আমল থেকে প্রচলিত আন্নেস মোল্লার বাড়ির নাম যে এত দ্রুত বদলে যাবে তা ভাবতে পারে নি কেউ। আন্নেস মোল্লা নিজেও হতবাক বিস্ময়কর দ্রুত গতির এ পরিবর্তনে। গ্রামের সীমানা ছেড়ে কলাই, মুগ-মটর ক্ষেতের মধ্য দিয়ে সরু মেঠো পথে এক দৌড়েরও বেশি পথ দূরে মাঠের প্রায় মধ্যভাগে এ বাড়ির পত্তন যে কবে, কার হাতে, তা এ গ্রামের মানুষের অজানা। এ বাড়িতে মানব বসবাসের ইতিহাস দাদা-পরদাদার মুখেও কেউ শোনেনি কোনদিন। সবার এক কথা, “কী জানি বাপু, আমরা এ বাইত্তে বাত্তি দেহি নাই কুনোদিন।”

 

জনমানবের বসবাস না থাকায় বাড়ির আনাচ-কানাচ জুড়ে নানা বৃক্ষলতা জন্মানোর মতই এ বাড়িকে ঘিরে গ্রামবাসীর মনের কল্পনায় জন্মেছে নানা কিংবদন্তি ও গালগল্প। কবে কোন একদিন এদেরই কারো একজনের গল্প-কথাচ্ছলেই হয়তো এ বাড়ির নাম হয়েছে ‘শূন্যবাড়ি’। তারপর তাঁরা পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ভোগের মতই মুখে মুখে বহন করছে এ বাড়ির নাম। সরকারি চাকরিতে হঠাৎ আলাদিনের চেরাগ পাওয়া এমাজ উদ্দিন সাহেব এ পরিত্যক্ত বাড়ি যোগেশ ভৌমিকের কাছ থেকে কিনলে গ্রামের কেউ কেউ বলেছে, “ট্যাহা থুয়ার জাগা নাই তো, তাই। নাইলে এই ‘হুন্যাবাড়ি’ কেউ ট্যাহা দিয়্যা কিনে?” তাঁর মৃত্যুর পর উচ্ছন্নে যাওয়া পুত্রদের কাছ থেকে যখন এ বাড়ি আন্নেস কিনেছে তখনও গ্রামবাসী তাদের বিস্ময় কাটাতে পারে নি। বয়স্কদের নানা নিষেধ ও কিংবদন্তির হরেক ভয় উপেক্ষা করে সেই ভূতুরে ‘শূন্যবাড়ি’তে আন্নেস ঘর তুলেছে। সংসার পেতেছে, এক কন্যার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এ মানব আবাদকে অস্বীকার করেই যেন লোকমুখে বাড়ির নাম ‘শূন্যবাড়ি’ই রয়ে গেছে।

আশপাশের দু’দশ গ্রামের মানুষ ‘হুন্যাবাড়ি’ নামে যে বাড়িকে এক ডাকে চিনতো, রাতারাতি তার নাম পরিবর্তনের কাহিনি এই। বছর চার-পাঁচ আগে গ্রামের কাজি বাড়ির সোরাব কাজি একটি গাভি বর্গা দিয়েছিল আন্নেসের কাছে। কথা ছিল গাভির বাচ্চা হলে বাচ্চাসহ দুধেল গাভি বিক্রির টাকা ভাগাভাগি করে নেবে দু’জন। বছর না ঘুরতেই বাচ্চা দিয়েছে গাভিটা। ঠিক তার কয়েকদিন পরেই সোরাব কাজির স্ত্রী তিন মেয়ের পর পুত্র জন্ম দিলে গাই-বাছুর আর বেচা হয় না ওদের। পুত্র জন্মে বংশের মুখ রক্ষার খুশিতে আত্মহারা সোরাব কাজি বছর জুড়ে ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর শর্তে গাই-বাছুর দুইই দিয়ে দিয়েছে আন্নেসকে।

 

আন্নেসও শর্ত পালন করেছে পরম নিষ্ঠায়। দুধ দেওয়া বন্ধ হলে গাভি বিক্রি করে ষাঁড় বাছুরটি সে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করেছে কোরবানির হাঁটে চড়া দামে বিক্রির আশায়। ষাঁড়ের গায়ে গতরে বিস্তর মাংস ও টকটকে লাল রঙের সঙ্গে মানানসই দুধসাদা চিৎ কপাল মোহনীয় দেখায়। এক বিঘতেরও বড় কুঁজ নাড়িয়ে ওর রাজকীয় চলার ভঙ্গি আন্নেসের স্বপ্নকে আরো লোভাতুর করে তুলে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি তাঁর। কোরবানির ঈদের কয়দিন আগেই ভারতীয় গরুতে হাট ভর্তি হয়ে গরুর দাম নেমেছে পানির দামে। তার উপর এ অঞলে এত বড় গরুর কাস্টমার না থাকায় এবার আর ষাঁড় বিক্রি করতে পারে নি সে। নিজের অল্প সম্বলের প্রায় সব গরুর পিছনে বিনিয়োগ করে এতবড় স্বপ্নের মৃত্যুতে হিমশিম খায় আন্নেস। এখন দিন মজুরির টাকায় না সংসার চলে, না শোধ হয় তাঁর বাজারের দেনা।

 

এক একদিন সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর গরুর জন্য আর গমের ভূষি কেনা সম্ভব হয় না। তখন ঘরের দাওয়ায় বসে ক্ষুধার্ত ষাঁড়ের দড়ি ছেঁড়ার প্রচেষ্টা ও করুণ হাম্বা ডাকে কলিজা কেঁপে ওঠে ওর। এরই মধ্যে একদিন তেরশ্রী বাজার করে ফেরার পথে খোকা মিয়ার গরুর খামারের রাখাল বাবর আলি ধরে আন্নেসকে। টুকটাক আলাপ শেষে বলে, “মিয়্যা ভাই, তোমারে এট্টা কতা কই, আমাগো খামারের বছর বিয়ানো গাইডা ছয় মাস অইল পাল রাহে না। প্রেত্তেক মাসেই গাইয়ের জোঁয়ার আইলে ফারামে নিয়া বনদ দিছি কিন্তুক একবারও কাম অয় নাই। গাই খালি ঝাঁপ যায়। রতন দাক্তার কইলো হাড় দিয়া গাইরে তাজা বনদ দেওয়াইলে গাই গাভিন অইবো। তোমার হাড়ডা দিয়া আমাগো গাইডারে এট্টু বনদ দিতে দিবা?”

 

একবার গাই গরুর সঙ্গ পেলে ষাঁড় গরম হয়ে যাবে। তখন তাকে লালন-পালন করা কষ্ট হবে। তার উপর বাবর আলিকে বনদের জন্য ষাঁড় দিলে সবাই গাইয়ের বনদ নিতে আসবে ওর কাছে, এসব বলে বাবর আলিকে ফেরাতে চেয়েছে আন্নেস। অবশেষে বাবর আলি কাউকে বলবে না বলে কথা দেওয়ায় ও একবার বনদের বিনিময়ে দশ কেজি গমের ভূষি দিতে রাজি হওয়ায় ওকে বনদের জন্য ষাঁড় দিয়েছে সে। কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই পাঁচকান হয়েছে একথা। গ্রামের সবাই গরু নিয়ে সদরে যাওয়ার পরিশ্রম থেকে মুক্তি ও টাটকা বনদের আশায় গাই ও ভূষি নিয়ে ভীড় করে আন্নেসের বাড়ি। প্রথম প্রথম আন্নেস রাজি না হলেও বাবর আলির উদাহরণে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ষাঁড় দিয়েছে বনদ দিতে। তারপর এক সময় ভূষি ও ভূষির দামের নগদ টাকার লোভ পেয়ে বসে আন্নেসকে। কাউকেই আর গরু নিয়ে বিনা বনদে ফিরতে হয় না ওর বাড়ি থেকে। বরং ভূষির পরিবর্তে সে এখন নগদ টাকা হাঁকে প্রতি বনদের জন্য। ষাঁড়ের আকার ও রঙের গুণে সুন্দর বাছুর দেবার ভরসায় অল্প দিনেই বনদ ব্যবসায় প্রসার পায় সে। আর বাড়ির সুপ্রাচীন ‘হুন্যাবাড়ি’ নাম তাঁর নতুন পেশার খবর রাষ্ট্র হওয়ার চেয়েও অদ্ভূত দ্রুততায় হারিয়ে যায় ‘বনদবাড়ি’র আড়ালে।

 

বনদ বিক্রিকে আন্নেসের পেশা হিসেবে গ্রহণ করাটা গ্রামের অনেকেই পছন্দ করে নি। এমনকি সর্বজন শ্রদ্ধেয় নুরু মিয়া পর্যন্ত বলেছে, “তুই তো দেহি মান-সম্মান আর রাখলি না। এত কাম দ্যাশে থাকতে এই কাম নিলি?” তাঁকে মুখের ওপর উপর শুনিয়ে দিয়েছে সে, “আমি তো আর চুরি কইরে খাইতেছি ন্যা, তো আপনেগো এত টাটায় ক্যাঁ, অ্যাঁ? বইয়্যা থাকলে আপনেরা তো আর ভাত দিবেন না।” তারপর থেকে কেউ আর ঘাটায় নি ওকে। তাঁর স্ত্রী কমলার আপত্তির বেলায় অবশ্য চোখ রাঙানি ও সময় মত দু’এক ধাতানিতেই কাজ হচ্ছিল। মাঝে দু’একবার ওর কন্যা বড় হওয়া, বিয়ে-শাদিতে জটিলতা প্রভৃতি প্রসঙ্গ তুললেও আন্নেস স্পষ্ট বলেছে, “মেয়া আমার চিন্তাও আমার। তর এত বিষ করে ক্যান? ভাত ফালাইলে কাইয়্যার অভাব অইবো না। জামাইও আইসবো দেহিস সময়মতো। দুনিয়ায় ট্যাহাই অইল আসল কতা। ফির‌্যা ক্যাট ক্যাট মারাবি তো বাপের বাইত্তে থিকা সংসারের ট্যাহা আনবি কইল্যাম।”

 

এরপর আর কথা বাড়াতে সাহস করে নি কমলা। স্বামীর জেদ সম্পর্কে ধারণা আছে তাঁর। আন্নেসের ব্যবসায় আর কোন বাধা আসে নি। নগদ টাকা রোজগার হওয়াতে দিন মজুরিও ছেড়েছে সে। ষাঁড়ের যত্ন ও বনদের জন্য আসা কাস্টমারের অপেক্ষাতেই সময় কাটে ওর। ইদানিং বনদের জন্য আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে গাভি নিয়ে আসে কৃষকেরা। এক ষাঁড় দিয়ে এত গাভিকে বনদ দিতে হিমশিম খায় সে। কয়েক মাস বনদ বিক্রির টাকা জমিয়ে আন্নেস যখন আর একটি ষাঁড় কিনে। তখন টনক নড়ে গ্রামের অনেকের। আন্নেসের দেখাদেখি আরো কয়েকজন তাগড়া ষাঁড় সংগ্রহ করে নাম লেখায় বনদ বৃত্তিতে। ফলে পুরো বড়বিলা গ্রামটিই বনদ বিক্রির জন্য লাভ করে ব্যাপক পরিচিতি আশেপাশের অঞ্চল জুড়ে। তবে এ পেশার প্রাচীনতা, অভিজ্ঞতা ও ষাঁড়ের সৌন্দর্যে ‘বনদবাড়ি’র আন্নেস সবার উপরে।

 

দুই

বুধবার সাপ্তাহিক হাট বসে কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্তী ঘিওরে। হাট থেকে পুরো সপ্তাহের জন্য বাজার-সদাই করে আন্নেস। এখন সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় তেল, নুন, চাল, আটার সাথে যোগ হয়েছে এক বস্তা ভূষি, খৈল ও চিটাগুড়। ফলে এত কিছু আর মাথায় করে আনা সম্ভব হয় না তাঁর। অগত্যা ভ্যান-রিকসায় এসব মাল চাপিয়ে হাওয়া খেতে খেতে আরামে বাড়ি ফিরে সে। একমাত্র মেয়েকে চমকে দিতে মেয়ের পছন্দের চকচকে সাদা রঙের একটা পাঙ্গাস মাছ সে কিনে এনেছে আজ। মেয়ের খুশিতে মনটা আত্মহারা হওয়ার আগেই খারাপ হয়েছে তাঁর স্ত্রী কমলা’র কথায়, “বাবর আলি ভাই আইছিল গাই নিয়্যা, তুমি বাইত্তে নাই দেইখ্যা ফিরত গেছে।” বউ আরো বলে, “হে আমারে কইছিল ‘ভাবি আপনে হাড় ছাইড়্যা দেন, পাল দ্যাহান অইলে আমি বাইন্ধ্যা দিমু নি।’ কিন্তুক আমি দেই ন্যাই। হ্যাষে মিজানের বাইত্তে গ্যাছে গাই নিয়্যা।”

 

স্ত্রীর কথা শুনে আজ বাড়ি না থাকার কারণে সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতির চিন্তায় আন্নেস আফসোস করে মনে মনে। ‘একটা গাভির পাল দেওয়ার টাকা হাতছাড়া হওয়ার চাইতে পাল না দিয়ে গাই নিয়ে বাবর আলির ফিরে যাওয়া তাঁর জন্য অনেক লসের ব্যপার হতে পারে। কারণ খোকা মিয়ার খামারের বড় রাখাল বাবর আলি। তাঁর হাতে খামারের সব দায়িত্ব দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে থাকে খোকা মিয়া। সুতরাং বাবর আলির মর্জির উপর নির্ভর করছে খামারের বিশ-বাইশটি গাভির কাছে পাল বেচা। তাছাড়া সম্পর্কের দিক থেকে তারা এখন প্রায় বন্ধু। বিনা বনদে গাই নিয়ে সে ফেরত যাওয়া মানে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে এতগুলো গাই হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।’ এসব ভাবতে ভাবতে আন্নেস স্ত্রীকে বলে, “এ্যারপর আমি বাইত্তে না থাকলে বাবর আলি আইলে কইস, ‘ও য্যান হাড় ছাইড়্যা নিয়্যা গাইয়ের বনদ দ্যায়।’ তারবাদে কাম অইলে আবার বাইন্ধ্যা রাখবো। আমার দোস্ত মানুষ, অরে কষ্ট দেওয়া ঠিক অইবো না।” “আর যুদি আইনক্যা মানুষ দেইক্যা তুমার হাড় ফালাফালি পারে?” প্রশ্ন করে কমলা। নির্বিকার উত্তর দেয় আন্নেস, “তাইলে না অয় তুই এট্টু কাছে যাইয়্যা খারাইস।” শুনেই মুখ ঝামটা দিয়েছে কমলা, “হ, এহন আমি ব্যাটা মাইনষের হাতে যাইয়্যা গাইয়ের বনদ দিমু? কুন আক্কেলে তুমি এই কতা কও আমারে, অ্যাঁ?” তারপর আর কথা বাড়ায় নি আন্নেস। বড় গামলাটা নিয়ে ষাড় দু’টোকে জাবনা দিতে গোয়ালের দিকে হাঁটা দেয় সে।

 

তারপর বনদ বৃত্তিতে বছর পূর্ণ হয়েছে আন্নেসের। ব্যপারটা নিয়ে এখন আর আপত্তি করে না গ্রামের কেউ। এমনকি কমলাও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এ পেশার সাথে। এখন আন্নেসের অনুপস্থিতিতে কেবল বাবর আলিই নয়, কাউকেই আর বিনা বনদে গাই নিয়ে ফেরত যেতে হয় না। আন্নেসের অনুপস্থিতিতে গাভির বনদ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে কমলা বলে, “ক্যান, আমাগো পছন্দ অয় না? খালি ভাইরে তালাশ করেন। গাই নিয়্যা খোঁয়াড়ে বান্ধেন। আমি আইতাছি।”

 

দু’একটা অশান্ত গাভি মাঝে মাঝে লাফালাফি করে ঝামেলা বাঁধায়। তাদের নির্বিঘ্নে বনদ দিতে বাঁশ দিয়ে বাড়ির কোল ঘেঁষা পালানে খোঁয়ার বানিয়েছে আন্নেস। গোয়াল থেকে একটানে ষাঁড়ের দড়ি খুলে বাড়ির পালানে নিয়ে খোঁয়াড়ে বাঁধা গাইকে পাল দিয়ে আবার ষাড় এনে গোয়ালে বাঁধে কমলা। তারপর কড়ায়-গণ্ডায় বনদের টাকা আদায়ে কমলার দক্ষতায় মনে হয় আন্নেস নয় এ ব্যবসা তাঁর, জন্ম-জন্মান্তরের। আর আন্নেসরও সুবিধা হয়েছে এতে। এখন সময় অসময়ে বাজারের চা-দোকানে আড্ডা সিনেমায় মশগুল হয় সে। গাইয়ের সাথে আসা দু’একজন জোয়ান পুরুষ কালেভদ্রে বনদ বিষয়ক আদি রসাত্মক কথা আরে-ঠারে শোনায় কমলাকে। প্রথম প্রথম ও লজ্জায় রাঙা হলেও এখন সেও মেতে ওঠে রসিকতায়। কখনো কখনো বনদ দিতে আনার সময় ষাঁড়গুলো অশান্ত হয়ে ছুট দিলে পিছনে ছুটে ওদের ধরতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে সে। তখন ঘন নিঃশ্বাসের সাথে তাঁর বুকের ওঠানামার দিকে তাকিয়ে থাকা পুরুষগুলোকে দেখে হাসি পায় ওর।

 

একদিন বাবর আলি হাসতে হাসতে বলেছিল, “দ্যাখছেন ভাবিসাব, হাড় গরুডাই আরামে আছে। বনদের নিগ্যা গাই আসে তার কাছে। আবার ট্যাহাও পায়। আমাগো পুষ্যা মাইনষের কত কষ্ট; ট্যাহা দিয়্যাও মিলে না।” কমলা হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছে, “তয় য্যানে মিলে আপনে হ্যানে গেলেই পারেন। না করছে ক্যাড়া।” তখন উদাস ভঙ্গিতে বলেছে সে, “এই গেরাম ছাইড়্যা কই আর যামু? কামাই দিলেই তো মিয়াসাব মাইনা কাটবো। এহনে পাইলে না অইতো।” “হ, আপনের নিগ্যা আমি এহন বনদের ব্যবসায় নামি!” — কপট রাগ দেখিয়ে কমলা বলে,“এত কতায় কাম নাই, ছুটি নিয়্যা বাইত্তে বউয়ের কাছে যান গা।”

 

মাটির দিকে তাকিয়ে কোন রকমে বলে, “ট্যাহা নাইক্যা। আপনে রাইতে আইসেন।”

 

তিন

কচুরিপানায় ঢাকা দানেজ বুড়ার ডোবার একপাশ পরিষ্কার করে গরু গোসল করায় গ্রামের সবাই। সেদিন দুপুরে ষাঁড় দুটোকে জোড় বেঁধে গোসলে নামিয়েছে আন্নেস। খড়ের মাজুনি দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে ষাড়ের গায়ের গোবরের দাগ উঠিয়ে ঝাঁপানো শেষে গরু নিয়ে বাড়ির পথ ধরে সে। ফিঙেপাখির তাড়া খেয়ে প্রাণপনে ছোটা একটি দাঁড়কাক হঠাৎ ষাঁড়ের সামনে গোত্তা দিলে আচমকাই দৌড় দেয় ষাঁড় দুটো। মাটিতে গড়ানো দড়িতে পা বেঁধে ধপাস করে পরে যায় আন্নেস। শক্তিশালী গরু দুটো দৌড়ে ওকে টেনে নিয়েছে অনেক দূর। চিৎকার শুনে অন্যরা আসতে আসতে ওর আর নড়ার শক্তি নেই। সবাই মিলে ধরাধরি করে প্রথমে বাড়ি তারপর ঘরের কাঠের কপাট খুলে চাঙাড়ি বানিয়ে তারউপর শুয়ায়ে সদর হাসপাতালে নিয়েছে। বড় ডাক্তার দেখেই বলেছে, “পা ও মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙছে, দ্রুত ঢাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।” এতবড় দুর্ঘটনার খবরে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলেও শক্ত থেকেছে কমলা। প্রথমে নিজের জমানো টাকা, তারপর এর ওর কাছে ধার; অবশেষে নিজেদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ষাঁড় দুটোও বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছে সে। ডাক্তার-হাসপাতাল বদল, অপারেশন, ওষুধ, পথ্য, ছোটাছুটি ইত্যাদিতে নিঃস্ব হলেও আন্নেস আর দাঁড়াতে পারে নি নিজের পায়ে।

 

চার

গত কয় মাস গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ফসল ঝাড়াই-মাড়াইয়ের কাজ করে কায়ক্লেশে সংসার সামলিয়েছে কমলা। তাদের ফসলের বতর শেষ তো কমলার কাজও শেষ। বাধ্য হয়েই হাঁস-মুরগি, এমনকি বাড়িতে থাকা বিক্রয় উপযোগি সব গাছ বিক্রি করতে হয়েছে সংসার চালাতে। তবুও জীবন চলে না। পঙ্গু আন্নেসের ওষুধ জুটেছে তো খাবার নেই, খাবার জুটলে ওষুধ নেই; এ যেন নিত্যদিনের চিত্র। আবার কখনো দুটোর কোনটাই জোটে নি। প্রথম প্রথম পরের বতরে কাজ করার আশ্বাসে পরিচিত গৃহস্থ বাড়ি থেকে ধার-দেনা করা গেলেও দেনার পরিমাণ মাত্রা ছাড়ানোয় ও পূর্বের দেনা শোধ না দেওয়ায় এখন আর কেউ ধার দেয় না ওকে।

 

ঘরে একদানা খাবার নেই। কাজের জন্য কমলাকে ডাকতে আজ আসে নি কেউ। তবুও সকাল বেলাতেই সে একবার বেড়িয়েছিল গ্রামে। বড়বাড়ি, মিয়াবাড়ি, কাজিবাড়ি, সব বাড়িতেই গিয়েছে সে। কিন্তু কেউ কোন কাজের কথা বলে নি তাঁকে। গ্রামের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত হেঁটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। নিজের এ দুর্ভাগা জীবনকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে চৌকাঠে এসে বসতেই ক্ষুধায় কাতর মেয়েটা বায়না ধরে খাওয়ার। কমলা যতই বলে, “এহন গিয়্যা খেল গা, ভাত অইলে ডাক দিবানি।” মেয়েটা কোন বুঝই মানে না। ভাত ওর এখনই চাই। এদিকে আন্নেসের ওষুধও প্রায় শেষ। দু’চোখে অন্ধকার দেখে কমলা। এরমধ্যে মেয়েটা ভাতের জন্য কান্না শুরু করলে দুম করে ওর পিঠে এক কিল বসিয়ে দিয়ে কেঁদে ফেলে সে। তারপর বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পায় দূরের রাস্তা দিয়ে মাথায় কলসি বোঝাই দুধ নিয়ে তেরশ্রী বাজারে যাচ্ছে বাবর আলি। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে কমলা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ভাই, আমার নিগ্যা দুইসের চাইল আর একসের আলু আইনেন।” “আইচ্ছ্যা, আনুম নি” বলে বাবর আলি পড়নের লুঙ্গির নিচের অংশ উল্টিয়ে হাঁটুর উপরে এনে কোমরে গিঁট দেয়। তারপর বলে, “ট্যাহা দিবেন না?” মুখ থেকে আর কথা সরে না কমলার। একবার এদিক ওদিক তাকায়, তারপর বাবর আলির দিকে একবার তাকিয়েই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। মাটির দিকে তাকিয়ে কোন রকমে বলে, “ট্যাহা নাইক্যা। আপনে রাইতে আইসেন।”

 

কমলার সারা উঠান জুড়ে এখন আবার হাঁস-মুরগি টই টই করে বেড়ায়। দুটো ছাগলের বাচ্চাও কিনেছে সে। তাঁর মেয়েটা এখন আর ক্ষুধার জন্য কাঁদে না। গত ঈদে দেওয়া লাল জামাটা গায়ে দিয়ে ছাগলের বাচ্চার পিছে ছোটে। গাছ থেকে ঝরা কাঁঠাল পাতা এনে বাচ্চা দুটোকে খেতে দেয়। দুপুরে বারান্দায় ঘুমানো আন্নেসের পাশে বসে মাটিতে দাগ দিয়ে বাঘ-বকরি খেলে। দুইবেলা খাবারের সাথে সাথে আন্নেস ওষুধও পায় নিয়মিত। রাতের আঁধার না নামতেই এখন খাবার-দাবারের পর্ব সারে ওরা। কন্যা ঘুমাতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে ঘরের দরজা টেনে চাপিয়ে রাখে কমলা। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে সর্ন্তপনে ঢোকে গোয়াল ঘরে। ষাড় দুটো নেই তবুও রোজ লেপে-মুছে ঘরটাকে ধবধবে করে রাখে সে। কমলা ঝুপ করে গোয়াল ঘরের ঝাঁপ ফেলতেই বিছানায় উঠে বসে আন্নেস। কিছুতেই ঘুম আসে না তাঁর। চৌকিতে বসে ঘুমন্ত কন্যার দিকে তাকিয়ে ছাড়া দীর্ঘশ্বাসও মিইয়ে যায় — বনদের জন্য কমলার কাছে আসা পুরুষদের ফিসফাস ও চাপা হাসির আড়ালে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here