কৃষক দিমিয়ান
রূপকথা ছোটদের গল্প নয়, রূপকথা সবার গল্প। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির রূপকথাগুলো ধারণ করে সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস। সুদেষ্ণা ঘোষের অনুবাদে পড়ুন রুশ রূপকথা।
খুব বেশিকাল আগের কথা না, আবার হতেও পারে বহুকাল আগেকার কথা — সময়কাল সম্পর্কে আমার ঠিক ভাবে মনে নেই। সেই সময়ে রাশিয়ার কোনো একটা গ্রামে দিমিয়ান নামে একজন রাশিয়ান কৃষক বসবাস করতো। সে ছিল প্রচণ্ড একগুঁয়ে এবং উগ্র স্বভাবের লোক। প্রকৃতির সবকিছুকেই দিমিয়ান তার হাতের মুঠোয় রাখতে পছন্দ করতো। ফলে প্রকৃতি তার জন্য কঠোর হয়ে উঠেছিল।
কেউ তার বিপক্ষে কথা বললে, সঙ্গে সঙ্গে সে মুষ্টিবদ্ধ করে সেই লোকের ওপর আঘাত হেনে তাকে উত্তর দিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করত না। আবার যেমন ধরো, সে কোনো একজন প্রতিবেশীকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালো। বাড়িতে অতিথি প্রবেশ করা মাত্রই দিমিয়ান তার সামনে ভালোমন্দ খাবার এবং সুস্বাদু পানীয় পরিবেশন করে সেই অতিথিকে স্বাগত জানাতো। পুরানো প্রথা মেনে অতিথিটি খাবার গ্রহণে রাজি না হলে দিমিয়ান রুষ্ট হয়ে বলতো ‘নিমন্ত্রণকর্তাকে তোমার মান্য করা উচিত!’
‘আমার প্রিয় সবকিছুর ওপরই আমি তোমার অধিকারকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
একবার এইরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দিমিয়ান তার আরেক প্রতিবেশীকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালো। এবারের লোকটি ছিল খুব বুদ্ধিমান। এদিকে আমাদের কৃষক অর্থাৎ দিমিয়ানের বাড়িতে যা যা ছিলো তার সমস্ত কিছু দিয়ে সে খুব সুন্দর করে চারপায়া বিশিষ্ট চৌকিটিকে সাজালো। বাড়িতে অতিথির আগমনে দিমিয়ান ভেবেছিল সে আগের মতোই আনন্দ করবে। এবারের আগন্তুকটি নিমেষের মধ্যেই সব খাবার খেয়ে নিলো।
দিমিয়ান বেশ হতভম্ব হলো, তবুও সে তার ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি সেই অতিথির কাছে সমর্পণ করলো। দিমিয়ান তার অতিথিকে বললো ‘ভেড়ার পশমের তৈরি এই বস্ত্রটিকে খুলে ফেলে তুমি আমার এই নতুন ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি পরো।’ একথা বলার পর সে মনে মনে ভাবলো ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আমার এই প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার মতো দুঃসাহস সে কখনওই দেখাবে না, সুতরাং আমি ওকে উচিৎ শিক্ষা দেবো।’ কিন্তু আগন্তুকটি তাড়াতাড়ি সেই নতুন ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি পরে নিয়ে বেল্ট দিয়ে তা দৃঢ়ভাবে আটকাতে আটকাতে তার কোঁকড়া চুল ভর্তি মাথাটা নাড়িয়ে উত্তর দিলো, ‘প্রভু, এমন সুন্দর উপহার দেওয়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার উপহারকে প্রত্যাখ্যান করার দুঃসাহস আমি কীভাবেই-বা দেখাই? প্রত্যেকেরই তার আমন্ত্রণকর্তার ইচ্ছাকে মান্য করা উচিৎ।
একথা শুনে তো দিমিয়ানের রাগ চড়চড় করে বাড়তে থাকলো। এই পরিস্থিতিকে নিজের হাতের মুঠোয় আনবার জন্যে সে যে কোনো মূল্য চোকাতে প্রাস্তুত ছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে কী করণীয় তা ভেবে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে দিমিয়ান আগন্তুকটিকে তার আস্তাবলে নিয়ে গেলো। সেখানে সবচেয়ে সুন্দর, বলিষ্ঠ, সুকেশী শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটিকে দিমিয়ান তার অতিথির সামনে দেখিয়ে বললো, ‘আমার প্রিয় সবকিছুর ওপরই আমি তোমার অধিকারকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
একথা বলার পর সে মনে মনে ভাবলো, ‘এবারে নিশ্চয়ই সে এই প্রস্তাবটিকে প্রত্যাখ্যান করবে আর তারপরেই আসবে আমার পালা।’ কিন্তু অতিথি লোকটি দিমিয়ানের দেওয়া প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান না করে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো, ‘আপনার বাড়িতে তো আপনিই শাসক।’ আর তারপর সে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে উচ্চস্বরে কৃষক দিমিয়ানকে বললো, ‘বিদায়, প্রভু! আজ পর্যন্ত কেউ-ই আপনাকে জব্দ করতে পারেনি, কিন্তু আজ আপনি নিজেই নিজের ফাঁদে বন্দি হলেন।’ একথা বলে সে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো। আর দিমিয়ান বাড়ির প্রস্থান পথের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর সে মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘এবার স্পষ্টভাবে আমি বুঝতে পারছি, আমার কৃতকর্মের জন্যই আমি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
* রাশিয়ার প্রচলিত রূপকথা এবং লোকগল্পগুলোকে সংগ্রহ করে জেনোফোতোভনা কালামাতিনো দে
ব্লুমেন্তাল ফোক টেলস্ ফ্রম দ্য রাশিয়ান গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। মূল গল্পটির নাম ‘দিমিয়ান দ্য
পীজ্যান্ট’