আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি। ফারসি গদ্যসাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয় তেরো শতকে রচিত এই গদ্য। বইটি ইংরেজিতে Discourse of Rumi নামে পরিচিত। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন সায়মন আলী।
রুমি বলেন, ‘মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.) একবার বলেছিলেন, জ্ঞানীদের মধ্যে নিকৃষ্ট হচ্ছে তাঁরা যাঁরা রাজার অনুগামী আর রাজাদের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যাঁরা জ্ঞানীদের অনুগামী। সেই রাজাই প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী যিনি গরীবের কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর গরিবদের মধ্যে সেই নীচ যে রাজার দরবারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।’ এখন রাসুল (স.) এর এই বাক্যকে ভালোভাবে উপলব্ধি না করেই লোকে ভাবে যে, জ্ঞানীদের কখনই রাজার কাছে যাওয়া উচিত না কারণ, তাহলে তারা নিকৃষ্টতম জ্ঞানীতে পরিণত হতে পারেন। রাসূল (স.)-এর ভাষ্য অনুযায়ী যা কোনভাবেই সঠিক নয়। বরং নিকৃষ্টতম জ্ঞানী তারাই যারা সর্বদা রাজার উপর নির্ভরশীল এবং রাজার অনুগ্রহে থাকার জন্য নিজেদের জীবনটাকে তৈরি করে। রাজা পুরস্কৃত করবেন, উচ্চাসনে আসীন করবেন, রাজ দরবারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেবেন — এসমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করেই এই শ্রেণির জ্ঞানীগণ অধ্যয়নে রত থাকেন।
বলাবাহুল্য যে এ ধরনের জ্ঞানীগণ নিজেদেরকে ‘জ্ঞানী’ হিসেবে তৈরি করে শুধু রাজার জন্য। রাজার প্রতি ভয় থেকেই তারা শিক্ষিত হয়ে ওঠে। রাজার ইচ্ছাধীন থেকে নিজেদের আনুগত্য স্বীকার করে। রাজা যেভাবে চান তারা সেভাবেই পরিচালিত হয়। সুতরাং, যখন তারা রাজার কাছে যান কিংবা রাজা তাদের কাছে যান — উভয় ক্ষেত্রেই রাজাই গন্তব্য আর সেই জ্ঞানীগণ রাজার অনুগামী। কিন্তু যে জ্ঞানীগণ রাজাকে খুশি করার জন্য জ্ঞানান্বেষণ করেন না বরং আদ্যন্ত চেষ্টা করেন সত্যের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকতে, যাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপে সত্যের আভা প্রকাশ পায়, সত্যপ্রকাশই যাদের জীবনের একমাত্র পন্থা হয়ে দাঁড়ায়, সত্য প্রকাশে যারা এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেন তা করতে না পারলে ডাঙায় তুলে আনা মাছের মতো তাদের অবস্থা হয় — এমন জ্ঞানীগণ একমাত্র আল্লাহর অধীনে থাকেন এবং আল্লাহর বিধিমোতাবেক নিজেদের পরিচালিত করেন। এ শ্রেণির জ্ঞানী ব্যক্তি নবীগণের অভিভাবকত্বে থাকার সৌভাগ্যলাভ করতেন। নবীগণের সময়ে লোকে তাঁদের সান্নিধ্যলাভ করার এবং তাঁদের দেয়া দৃষ্টান্ত থেকে উৎসাহ লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। আর নবীগণের প্রতি লোকেদের এতটাই বিশ্বাস ছিল যে তারা সেসব দৃষ্টান্তগুলোর সত্যতা যাচাই করতে যেতো না। এমন জ্ঞানীগণের কি রাজার অনুগামী হওয়াটা সাজে? প্রকৃতপক্ষে এমন জ্ঞানীরাই গন্তব্য আর রাজা তাদের কাছে গমনকারী। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজা তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকেন। এমন জ্ঞানীগণ রাজার আজ্ঞাধীন থাকেন না। তাঁরা সূর্যের মতো আলোর দিশারী। যাঁদের সমস্ত কার্যক্রম দুনিয়ার বিলিয়ে দেবার মধ্যে নিহিত। তাঁরাই পারেন প্রস্তরখণ্ডকে হীরকখণ্ডে পরিণত করতে; পাহাড়কে পরিণত করতে পারেন তামা, সোনা, রূপা এবং লোহার মতো মূল্যবান ধাতব খনিতে। পৃথিবীকে সবুজ ও সতেজ করে তুলতে তাঁরাই পারেন। পারেন গাছে ফুল,ফল আনতে; হিমের মধ্যে উষ্ণতা আনতে। দানেই তাঁদের সার্থকতা, গ্রহণে নয়। একটি আরবি প্রবাদে আছে, ‘আমরা দানের উদ্দেশ্যেই শিখেছি, গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়।’ আর এ কারণে সর্বত্রই তাঁরাই হয় অনুসরণীয় আর রাজা তাঁদের অনুসারী।
পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত আমাকে আরেকটি চিন্তার খোরাক জোগালো। যদিও এটা আমাদের এই আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তবুও চিন্তাটা যখন এসেই গেল তো এটি আমি ব্যক্ত করে এই আলোচনায় লিপিবদ্ধ রাখতে চাই।
হে মুহম্মদ! তোমার হাতে বন্দীদেরকে বল, “আল্লাহ যদি তোমার হৃদয়ে ভালো কিছু দেখে থাকেন তাহলে জেনে রাখেন তিনি তোমাদেরকে কাছ থেকে যা নিয়েছেন তার বেশি ফিরিয়ে দিবেন এবং তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অসীম করুণাময় এবং ক্ষমাশীল।
এই আয়াতটি তখনই প্রকাশ পায় যখন মুহম্মদ (স.)-এর অনুসারীগণ অবিশ্বাসীদের হত্যা করছিল, তাঁদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিচ্ছিল এবং তাঁদেরকে শেকলে বেঁধে বন্দি করছিল। এসকল বন্দীদের মধ্যে মুহম্মদ (স.)’র চাচা আব্বাসও ছিলেন। শেকলবন্দি লোকগুলো নিজেদের অসহায়ত্ব সইতে না পেরে সারারাত ধরে কাঁদছিল। তারা মুক্তির কোন আশাই দেখতে পাচ্ছিল না। বরং তারা ধরেই নিয়েছিল যে তাদের শেষ গন্তব্য হচ্ছে মুহম্মদ (স.)’র তরবারির নিচে। মুহম্মদ (স.) এসব দেখে হেসে উঠলেন। বন্দিরা তা দেখে বলল, ‘দেখ দেখ, তিনি আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি মহাপুরুষ নন; কারণ, আমাদেরকে এই শেকলবন্দি অবস্থায় দেখে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে হাসছেন। তিনি আর সকলের মতোই নিজের আবেগের বশবর্তী। যখন কেউ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে এবং প্রতিপক্ষকে এমন বন্দিদশায় দেখে তখন তারা আত্মহারা হয়ে পড়ে। মুহম্মদ ও তাই করছেন।’
“ভুল” মুহম্মদ (স.) তাদের অভিব্যক্তি দেখে বললেন, “আমার হাতে আমার শত্রুরা পরাজিত দেখেও আমি হাসছি না, কিংবা তোমাদেরকে শেকলবন্দি অবস্থায় দেখেও হাসছি না।
“ভুল” মুহম্মদ (স.) তাদের অভিব্যক্তি দেখে বললেন, “আমার হাতে আমার শত্রুরা পরাজিত দেখেও আমি হাসছি না, কিংবা তোমাদেরকে শেকলবন্দি অবস্থায় দেখেও হাসছি না। তবে আমি সত্যিই আনন্দিত আর আমার হাসবার কারণ আমি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছি যে, আমি জাহান্নামের বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে কতগুলো লোককে শেকলে বেঁধে জান্নাতের দিকে টেনে আনছি। সে লোকগুলো তখন আমায় কেঁদে কেঁদে আমায় জিজ্ঞেস করছে, ‘কেন তুমি আমাদেরকে আত্মবিধ্বংসী জায়গা থেকে নিরাপদ বাগানে নিয়ে যাচ্ছো?’ এজন্যই আমার হাসি পাচ্ছে। তোমাদেরকে এটা বলতে আল্লাহ আমাকে আদেশ দিয়েছেন, ‘প্রথমে তোমরা তোমাদের যাবতীয় ক্ষমতার সমাবেশ ঘটিয়েছিলে। তোমাদের নীতিগত আদর্শ ও শৌর্যবীর্যের প্রতি তোমরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলে যে তোমরা জানতে মুসলিমদের তোমরা পরাজিত করে তাদের উপর তোমাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। তোমাদের সকল ক্ষমতার চেয়ে অধিকতর ক্ষমতাধর কিছু আছে যার কথা তোমরা কল্পনাও করতে পারো নি। তোমরা জানতেই না যে, তোমাদের যাবতীয় শক্তির চেয়েও শক্তিশালী কোন কিছু থাকতে পারে। আর এজন্যই তোমরা যা পরিকল্পনা করেছিলে তার উল্টোটা ঘটেছে। এমনকি তোমাদের এই সঙ্গীন অবস্থাতেও তোমরা তোমাদের নীতিতেই অবিচল আছো পাশাপাশি সেই নীতির মোহে অন্ধ থাকায় তোমরা এই রূঢ় বাস্তবতাটাকে দেখতেই পাচ্ছো না। তোমরা বরং সে ক্ষমতার মুখোমুখি হবার চেয়ে আমাকেই দেখ। কেননা, সে ক্ষমতার মুখোমুখি হবার চেয়ে নিজেদেরকে আমার হাতে শাসিত দেখা তোমাদের জন্য শ্রেয়তর। কিন্তু তোমাদের এমন দশাতেও আমি বলব, তোমরা যদি আমার ক্ষমতা উপলব্ধি করে থাকো এবং সর্ববাস্থায় নিজেদেরকে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সঁপে দাও, তাহলে তোমাদেরকে এ দুর্দশা থেকে মুক্তি দিবো। তিনিই একমাত্র ক্ষমতাশালী যিনি একটি সাদা ষাঁড়কে একটি কারো ষাঁড়ে পরিণত করতে পারেন, আবার তাঁর ক্ষমতাবলেই একটি কালো ষাঁড় থেকে একটি সাদা ষাঁড়ের জন্ম হয়। তোমরা যদি তোমাদের পূর্বতম নীতি থেকে সরে আসো তাহলে তোমাদের থেকে যা কিছু কেড়ে নেয়া হয়েছে তার বহুগুণ আমি ফিরিয়ে দিবো। আমি তোমাদের সকল দোষত্রুটি ভুলে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিবো পাশাপাশি তোমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি সফল জীবনাদর্শের সন্ধান দিবো।’
‘আমি অনুতপ্ত!’ আব্বাস বলতে থাকল, “আমি আমার পূর্ব অনুসৃত পন্থা থেকে সরে এলাম।”
মুহম্মদ (স.) বললেন, ‘তুমি যা বললে তার প্রমাণ কী? মুখে বলা যত সহজ, করে দেখানো তার চেয়ে অনেক কঠিন। তোমাকে প্রমাণ দিতে হবে।’
‘আল্লাহর শপথ, তুমি কী প্রমাণ চাও?’ আব্বাসের প্রশ্ন।
মুহম্মদ (স.) বললেন, ‘তোমার সম্পত্তির যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা ইসলামের জন্য দান করে দাও। তাহলে ইসলামের অনুসারীদের শক্তিবৃদ্ধি পাবে। আর এভাবেই তুমি সত্যিকার অর্থে মুসলমান হিসেবে পরিচিতি পাবে। পাশাপাশি ইসলাম ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি তোমার সহমর্মিতা আছে বলে প্রমাণিত হবে।’
আব্বাস প্রত্যুত্তরে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী, দান করার মতো আর কীইবা অবশিষ্ট আছে? এক টুকরো পুরাতন ছেঁড়াফাটা মাদুর ছাড়া আমার তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’
মুহম্মদ (স.) বললেন, ‘দেখলে তো? তুমি এখনো তোমার পূর্বতম পন্থা পরিত্যাগ করতে পারো নি। তুমি এখনো সত্যের আলোককে দেখতে পাও নি। তাহলে আমিই বলে দিচ্ছি যে, তোমার কাছে এখনো কী পরিমাণ ধন সম্পদ আছে? কোথায় কোথায় তা তুমি লুকিয়ে রেখেছো? কার কাছে তুমি সেগুলো গচ্ছিত রেখেছো? কিংবা কোথায় সেগুলো পুঁতে রেখেছো?’
‘আল্লাহ না করুন।’ আব্বাসের কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ল।
মুহম্মদ (স.) বলতে থাকলেন, ‘তুমি কি তোমার অধিকাংশ সম্পত্তি কারো কাছে, বিশেষত তোমার মায়ের কাছে গচ্ছিত রাখো নি? মায়ের মতো একটি দেয়ালের আড়ালে কি তোমার কোন সম্পত্তি লুকিয়ে নেই? তোমার মাকে কি তুমি বল নি যে, তুমি যদি কখনও তার কাছে ফিরে আসতে পারো তখন তোমার মায়ের কাছ থেকে গচ্ছিত সম্পদগুলোকে আবার ফেরত নেবে? তুমি তো তাকে এটাও বলেছ যে, তুমি যদি নিরাপদে ফিরে আসতে না পারো তাহলে সেই সম্পদগুলো তিনি তার ইচ্ছানুযায়ী খরচ করতে পারেন, বিলিয়ে দিতে পারেন অথবা নিজের জন্য রেখে দিতে পারেন। বল নি তাকে?’
নবীজীর কাছ থেকে এসব শুনে আব্বাস নতি স্বীকার করল এবং বলল, ‘হে আল্লাহর নবী, আমি ভাবতাম তুমি নিশ্চয়ই হামান, সাদ্দাদ, নমরূদ ও অন্যান্য পুরাতন রাজাদের মতো সাধারণ ভাগ্য বয়ে চলেছো। কিন্তু এইমাত্র তুমি যা যা বললে তাতে আমার মনে হল কথাগুলো জাগতিক কারো দ্বারা ব্যক্ত হওয়া তো সম্ভব নয়ই বরং নিশচয়ই এগুলো বলার পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তির যোগসাজশ আছে এবং নিঃসন্দেহে তিনিই আল্লাহ।’
মুহম্মদ (স.) বললেন, ‘এবার তুমি একটি খাঁটি কথা বললে। মনে হল আমি যেন সংশয়ের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা একটি আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ শুনছি। এতক্ষণ যেন তোমার ভেতর একটি সংশয় ছিল। আমার অন্তরাত্মার মাঝে একটি গোপন কান আছে। যার দ্বারা আমি কারো কণ্ঠ শোনামাত্রই বুঝতে পারি যে, লোকটি সংশয় নিয়ে কথা বলছে, না আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে। আর এ সত্যটিই তোমার বিশ্বাসের কারণ।’
আমি একজন আমিরকে এই ঘটনাটি বলেছি। সাথে আরো বলেছি — শুরুতে তোমরা মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে সম্মুখ সারিতে এসেছিলে। তোমরা প্রত্যেকে বলেছিলে, ‘আমি প্রায়শ্চিত্ত করছি। আমি আমার সকল কামনা-বাসনা, বিচার-বিবেচনা ইসলামের জন্য উৎসর্গ করলাম যাতে ইসলাম আরো নিরাপদ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।’ কিন্তু তোমরা এখন তোমাদের নিজেদের পরিকল্পনায় বিশ্বাস রাখছো। আল্লাহর আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছো এবং আল্লাহর দেয়া সকল বিধিনিষেধ ভুলতে বসেছো। সেকারণে তোমাদের সকল কার্যক্রমে তোমাদের পরিকল্পনার উল্টোটি ঘটেছে। তাতারদের সাথে চুক্তি করে তোমরা তাদের সহযোগিতা করেছো কিন্তু এর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের অজ্ঞাতে সিরীয় ও মিশরীয়দের জন্য বিপদ ডেকে আনছো যা পরবর্তী কালে ইসলামের শান-শওকতকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সুতরাং তোমাদের যে পরিকল্পনার ফলাফল ইসলামকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছিল, দিন শেষে মহান আল্লাহ সেই পরিকল্পনাটিই নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
বিপদাপন্ন হলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। এমনকি, তোমার চলমান পরিস্থিতিতে কখনও আশাহত হয়ো না বন্ধু। আল্লাহর কাছে চাও এবং তাঁর ইচ্ছার অধীনে নিজেকে সঁপে দাও। তুমি ভেবেছিলে তোমার সামর্থ্য ও স্পৃহা দিয়েই তুমি সবকিছু জয় করে ফেলবে। আব্বাস ও তার সঙ্গীসাথী এরকমটাই ভেবেছিল। আর এখানেই তোমার দুর্বলতা। কিন্তু কখনও আশা হারিয়ো না। কারণ তিনিই একমাত্র, যিনি পারেন শক্তির প্রাচুর্যের মধ্যেও মাঝে দুর্বলতাকে প্রকট করতে পাশাপাশি দুর্বলতার চরম পর্যায়ের মধ্যেও শক্তি ও সামর্থ্যের উদগীরণ ঘটাতে। বন্দিদের দুর্দশা দেখে মুহম্মদ যেকারণে আনন্দিত হয়েছিলেন ঠিক একই কারণে আমিও তোমার বিব্রতকর পরিস্থিতি দেখে আনন্দিত। কেননা, মুহম্মদের বাণী অনুযায়ী এই দুর্বলতা ও দুর্ভোগের ফলে তুমি যা কিছু হারিয়েছো তার থেকে আরো বেশি কিছু ফিরে পেতে পারো। অতএব আশা ছেড়ো না। কারণ,
একমাত্র আল্লাহই পারেন অবিশ্বাসী ছাড়া আর সকলকে হতাশা থেকে মুক্তি দিতে।
আমি সেই আমিরকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম কারণ, তিনি উচ্চ মর্যাদা থেকে নিম্ন মর্যাদায় অবনমিত হয়েছিলেন। তবে চাইলে তিনি এখনও এ অবস্থা থেকেও উন্নতি করতে পারেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেন ব্যাপারটাকে সূক্ষ্মভাবে দেখেন এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে সাদরে গ্রহণ করেন। জীবন কখনও কখনও সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয়কে আমাদের কাছে এমনভাবে তুলে ধরে যা আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়। কিন্তু এর আড়ালে একটি সূক্ষ্ম কারচুপি লুকিয়ে থাকে যার কারণে আমরা বিস্মিত হই কিন্তু বিস্ময়ের উৎস সম্পর্কে কোন ধারনা আমাদের থাকে না। মহান আল্লাহ এভাবেই তাঁর পরিকল্পনা সাজিয়েছেন যাতে আমরা একগুঁয়েমি ও দম্ভের বশবর্তী হয়ে অন্যায় কিছু দাবি করতে না শিখি। বরং যাতে এটা ভাবতে শিখি যে, আল্লাহর পরিকল্পনাগুলো একমাত্র আমাদের নিজেদের জন্যই।
খোলা চোখে যা কিছু দেখা যায় তার সবই যদি সত্যি হতো তাহলে এর অন্তর্দৃষ্টি আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মুহম্মদ কখনো কেঁদে কেঁদে বলতেন না —
হে আল্লাহ, আমাকে প্রত্যেকটি জিনিসের প্রকৃত রূপ দেখান। আপনার কুদরতে যা আমাদের চোখে সুন্দর হিসেবে ধরা দিল তো বাস্তবে দেখা গেল তা কুৎসিত। আবার আপনার দয়ায় যা কুৎসিত আকারে আমাদের চোখে ধরা দেয়, প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল তা অনিন্দ্য সুন্দর। আমাদেরকে প্রত্যেকটি বস্তুর প্রকৃত রূপ প্রদর্শন করুন। যাতে আমরা কখনও লোভের বশবর্তী না হই ।
এখন আপনাদের বিচার বিবেচনা যতই ভালো, স্পষ্ট এবং সূক্ষ্ম হোক তা নিশ্চয়ই নবীজীর বিচারের চেয়ে শ্রেয়তর না। সুতরাং প্রতিটি জাগতিক চিন্তা ও কল্পনার উপর বিশ্বাস স্থাপন করো না। যদি বিশ্বাস স্থাপন করতেই হয় তো একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর বিচক্ষণতার উপর করো।