বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
অফিস থেকে ফেরার পথে মাইনর একটা অ্যাকসিডেন্টের কবলে পড়েছিলেন মাজহার ভাই। গতকালের ঘটনা। চোখের কোণায় কেটে গেছে। দাগ হয়ে আছে রক্ত জমে। বেশি না, সামান্য। চশমার ফ্রেম নাকি ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো।
উনাকে মনে হচ্ছে বেশ স্বাভাবিক। যে যখন আসছে নিজেই উদ্যোগী হয়ে ঘটনা বলছেন। একই ঘটনা বারবার শুনতে হচ্ছে। অবশ্য প্রতিবারই বদলাচ্ছে একটু একটু করে।
খুব ছোটো ছোটো করে চুল কাটিয়েছে মোজাম্মেল। এটা কি এখনকার স্টাইল! যদিও মানিয়েছে ওকে। ওকে আসলে সবকিছুতেই মানায়। কেবল এই চাকরিটাতেই মানায় না। সত্যিই ওর পুলিশে হলে খুব ভালো হতো। তাই হয়তো হয় না। যাকে যেখানে মানায়, সে সেখানে থাকবে না। এই দেশে এটাই তো নিয়ম। বিভাস অবশ্য পুরা উল্টা কথাটাই বলে। তার মতে, জগতে সবাই ঠিক সেখানেই আছে, যেখানে তার থাকা উচিত। সবই এক গ্র্যান্ড ডিজাইনের অংশ। আমি মানতে পারি না তার কথা। তাহলে এই যে অরাজকতা চারপাশে — এর ব্যাখ্যা কী? যে মেয়েটাকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ধর্ষণ করার পর খুন করা হচ্ছে। ফেলে দেওয়া হচ্ছে রাস্তায়। তার সঙ্গে যা করা হচ্ছে। তা-ই কী হওয়া উচিত ছিল? বিভাস চুপ করে থাকে। চুপ করে থেকে কী যে ছাতারমাথা উত্তর সে দেয়, আমি বুঝতে পারি না।
আজকে জেসমিন দি’ আমার সঙ্গে ফিরবেন। কথা হলো। নরসিংদী থেকে তার এক পিসাতো ভাই এসেছে। দিদির মা নাকি কিছু জিনিস পাঠিয়েছে। বললো, আজকেই ফিরবে। অথবা পরিস্থিতি বুঝে থেকেও যেতে পারে। ঠিক নেই। তখন হয়তো দেখা যাবে, সকাল দিকে বা বিকালে ফিরছেন। সকাল বা বিকাল দিকে মানে! হ্যাঁ, কাল তো শুক্রবার। অফিস নেই।
উত্তরায় দিদির এক পিসাতো বোন থাকে। জামাইবাবুর চাকরির সুবাদে থাকা। কী একটা বেসরকারি কোম্পানিতে তিনি আছেন। দীর্ঘদিন যাবৎ। দিদিও নাম বলতে পারলো না। জেসমিন দি’র ভাষায়, বোন বলতে বোন বুঝলে হবে না। প্রায় তার সমবয়সী নাকি ভাগনা-ভাগনি আছে। তার এই পিসাতো বোনটি বোনদের মধ্যে সবার বড়। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার হলো, জেসমিন দি’র এই পিসা নাকি বজ্রপাতে মারা গেছেন। আসলেই অদ্ভুত। খবরে দেখি ঠিক আছে। বজ্রপাতে অনেকেই মারা যায়। কিন্তু এমন চেনাজানার মধ্যে কারও আত্মীয় মারা গিয়েছে। এই প্রথম শুনলাম। ব্যবসায়ী ছিলেন। নরসিংদীতে চাল-ডালের বড় ব্যবসা ছিল। হরিপদ সাহা বললে এখনো নাকি এক বাক্যে চেনে।
ইমরানের সঙ্গে খুব একটা কথা হচ্ছে না। গতদিন ফেরার পথে একটু যা কথা হলো। ওর চোখেমুখে স্থায়ী বিষাদ দেখতে পাচ্ছি। মুখে সে যতই বলুক। প্রেম বলে কিছু নেই। প্রেম একটা বুর্জোয়া ফিলিংস। গরিবরা প্রেমে পড়ে না। তারা যৌনক্ষুধা অনুভব করে। হেন তেন। বেচারা আমার ঠিকই প্রেমে পড়েছে। একদম হাবুডুবু খাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ভাবতে কেমন ভালোই লাগে। নিজেকে মূল্যবান কেউ মনে হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে খুবই সুন্দর মনে হয়। কখনো আবার একদম বিশ্রী লাগে। আমি কি সত্যিই তিলোত্তমার মত সুন্দরী? তিলোত্তমা কে তা-ও জানি না। বিভাস কেন একথা বলে! আমি বুঝতে পারি না। সে কি আমাকে খুশি করার জন্য বলে? তা তো ওর বলার কথা না।
খেতে গিয়ে চোখাচোখি হলো ইমরানের সঙ্গে। কোনো এক ফাঁকে বলেই ফেললো বেচারা। আমাকে খুব মিস করছে। কবে নাকি ফোন করেছিলো। বিজি পেয়েছে। কয়েকবার নাকি ফোন করেছিলো। দেখে বিজি। মন খারাপ করে আছে। কিন্তু ও আমাকে মিস করলে তো সমস্যা! এখানে আমার কি করার আছে?
বিভাসকে একদম অপরিচিতের মত লাগছে। একেবারে প্রথম দিকে যেমন লাগতো। খুবই সাদামাটা। যেন ও হলো দেখতে শুনতে কালো মতন আমাদের একজন সহকর্মী মাত্র। দুজনের মধ্যে কোনো কথাই হয়নি আজ। হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। সেই রাতের পর থেকেই দুজনের মধ্যে খুব বেশি কথা হচ্ছে না। রাতে হায়-হ্যালো বলার পর আর কোনো কথা অবশিষ্ট থাকে না। নিমিষেই সব কথা শেষ হয়ে যায়। আমিও বলার মত কিছু খুঁজে পাই না। বিভাস ফোন রেখে দিতে চায়। আমিও আটকাই না। কী বলবো?
শান্তা আপুকে কেমন বয়স্ক দেখাচ্ছে। শরীরটা হয়ত ভালো নেই। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। বাজে মেয়েদের মত দেখাচ্ছে তাকে। সুন্দর একটা সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে। খুব বেশি মানায়নি। এমনও হতে পারে, আমারই পছন্দ হচ্ছে না। জামার উপর দিয়ে দেহের ভাঁজটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। তার পশ্চাৎ ভাগটাও বেশ দৃশ্যমান। খুব সচেতনভাবে যে সে তার শরীর প্রদর্শন করে তা নয়। কখনো মনেও হয়নি। সে খুবই গড়পড়তা ধরনের মেয়ে। মন-মানসিকতার দিক থেকেও। খুব সার্ফেস লেভেলের বিষয় নিয়ে মশগুল থাকে। আমিও অনেকটা তার মতই। আমিও বুঝতে পারি না, জীবনে সবচেয়ে জরুরি জিনিস কী? কী নিয়ে মশগুল থাকতে হয়। এখন অবশ্য আমার বিভাস আছে। তাকে নিয়ে মশগুল থাকি আমি। এটা অন্তত আমি বুঝতে পারি, ও খুবই দামি। আর খুবই দামি আমাদের এই সম্পর্ক। আমি কি বিভাসকে কেড়ে নিয়েছি তার কাছ থেকে? এটা কি করে সম্ভব? বিভাস কি তার ছিল?
টিকিটিকিটারও বয়স বাড়ছে। কে জানে কতদিন থেকে এখানে আছে। বছরখানেক হতে চললো আমার। সেই প্রথমদিন থেকেই তো দেখছি। প্রথমদিন থেকেই কি দেখছি? মনে পড়ছে না। হ্যাঁ তাই তো, ঠিক কবে থেকে তাকে দেখছি? এ-ও এক জরুরি প্রশ্ন। টিকটিকিটাকে সবারই দেখার কথা। অন্তত আমাদের মেয়েদের সবার। কোনোদিন কেউ কিছু বলেনি তার ব্যাপারে। অবশ্য আমিও কাউকে বলিনি। কেবল বিভাসকে বলেছি।
উত্তরায় যে স্কুলটাতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ঐটার রিটেনে টিকেছি। প্রথমদিকেই ছিলাম। বিশ-বাইশজনের মত টিকিয়েছে। চারজন নেবে। সামনের বুধবারে ভাইভা। বিভাসকে বলা হয়নি। বলতে ঠিক ভুলেও যাইনি। দুপুর বারোটার দিকে মেসেজটা এসেছে। কেন জানি বলার কোনো তাড়া বোধ করলাম না।
আমাদের বাসা সাত নম্বরে। জেসমিন দি’ নামবে জসীম উদ্দীন রোড। হেল্পাররা ডাকতে থাকে জসীমুদ্দিন জসীমুদ্দিন। জেসমিন দি’ তার সঙ্গে আমাকেও যেতে বলে। আমি বললাম, আমি না-যাই দিদি। ভাবলাম, দিদি হয়তো জায়গাটা চেনে না ভালো করে। বললাম, ঢাকা শহরে কিছু চিনতে হয় না। তুমি ফোন করে ঠিকানাটা ডিটেইল জেনে নাও। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি কী কী করতে হবে। বললো, সেজন্য না। সে চেনে সব। আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। এজন্যই যেতে বলছে।
জেসমিন দি’র গা থেকে সুঘ্রাণ আসছে। অন্যের পারফিউমের গন্ধ সবসময়ই আমার পছন্দ। আমি পারফিউম কিনতে পারি না। একবার বেশি দাম দিয়ে একটা পারফিউম কিনলাম। কেমন অ্যারোসলের মত গন্ধ। কতগুলোর আবার গন্ধই টের পাই না। রিয়া বলে, নিজের পারফিউমের ঘ্রাণ নাকি নিজের কাছে স্পষ্ট হয় না। আমার সেই অ্যারোসলটা রিয়া আরামসে ব্যবহার করে ফেলেছে। ধন্যবাদও দিয়েছিল। দিদির পারফিউমের ব্র্যান্ডটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করাটা একটু কেমন হয়ে যায়। আমি বললাম, তুমি চাইলে তোমার সঙ্গে আমি জসীমুদ্দিন নামতে পারি।
জেসমিন দি’কে আমি বিভাসের কথা বললাম। জানালাম তার সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডশিপের কথা। বললাম, ভয়ে আছি কবে না আবার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে যাই। বিভাসের সঙ্গে প্রেম হলে কেমন হবে? ও তো খুবই ভদ্র একটা ছেলে। কেমন মাই ডিয়ার টাইপ। তোমার সঙ্গে তো ভালো খাতির। তুমি কী বলো? আমি কৌশলে জিজ্ঞাসা করলাম। জেসমিন দি’ কেমন স্নেহময় হাসি হাসলো। আমি যেন খুব বাচ্চা একটা মেয়ে। না-বুঝে প্রেমে পড়ে গেছি টাইপ। বাচ্চাদের প্রেম। বললো, ‘তোর আর কথা’! আমাকে নাকি সবসময়ই তার খুব বাচ্চা একটা মেয়ে মনে হয়। কিউট কিউট। এখন দেখছে আমি আসলেই বাচ্চা। জেসমিন দি’ বলাতে নিজেকে কেমন বাচ্চাদের মতই লাগছে। আমি কি বাচ্চাদের সুরেই কথা বলছি?
বিভাস খুব ভালো ছেলে। পড়াশোনা করে বেশ। সবকিছুতে কেমন ভাবলেশহীন। তার মধ্যে একটা সাধু সাধু ভাব আছে। জেসমিন দি’ কখনো ইয়ার্কি করে ডাকে বিভাসানন্দ। সাধুদের নাম নাকি এমন হয়। তার কথা আমি অবশ্য মেলাতে পারছি না। বিভাসকে আমার কখনোই তেমন মনে হয়নি। কত প্রাণবন্ত আর প্রণোদনায় ভরপুর তার মন। সে কিনা হতে যাবে সাধু। সাধুদের আমার কেমন বিরক্ত লাগে। তাদের সব কথাই আধ্যাত্মিক। অথচ অন্যের দান ছাড়া তাদের চলেই না। বেশি ধার্মিকদের কখনোই আমার পছন্দ নয়। আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। ধর্মকূলশিরোমণি। সবসময় বাবার পেছনে লেগে থাকে টাকার জন্য। তার ধারণা, বাবার অনেক টাকা। তার মুখে যত ধর্মের কথা। আমার কেন জানি সবসময় মনে হয়েছে, তার ধর্মকথা কেবল টাকা খসানোর জন্য। তার কথা হল, ‘দুনিয়া কয়দিনের! ’ অথচ দুনিয়ার চিন্তাতেই বেটা বেশি অস্থির থাকে।
‘আজকে থেকে যাবো, বুঝলি?’ জেসমিন দি’ বললো। আমি কি বুঝে সায় দিলাম তার কথায়। বললাম, থেকে যাও। বললো, শুভ আর সুনির্মল ওখানেই আছে। ওরাই বাইরে কোথাও থাকতে চায় না। আজকে আর আমার দৌঁড়ঝাঁপ করতে ইচ্ছা করছে না।
‘সেক্স নিয়ে তোমার ধারণা কি, দিদি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। এতো স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা করলাম। আমাদের আলোচনার বিষয়ই যেন ছিলো সেক্স। এটা অবশ্য আমি জানি যে, প্রশ্ন শুনে সে ঘাবড়ে যাবে কি-না। এজন্যই প্রশ্ন করা।
সুনির্মল তার হাজব্যান্ডের নাম। নামটা বেশ সুন্দর। শুভ হল কিউট শুভ। ফেসবুকে দেখেছি। জেসমিন দি’র ছেলে। একদম বাপের মত হয়েছে। বাচ্চারা সবসময়ই কেমন কিউট হয়। হয়তো দুনিয়ার পঙ্কিলতা তখনো তাদের স্পর্শ করে না বলেই তারা কিউট। আমার মনে হয়, কিউট শব্দটাকে জীবন দিলে সে একটা টুনটুনি পাখি হবে। ‘টুনটুনি গো পাখি/ নাচো তো দেখি/ না বাবা নাচবো না/ পড়ে গেলে বাঁচবো না।’
তোমার সঙ্গে গল্প করতে আমারও ভালো লাগছে, আমি বললাম। উত্তরায় তো দিদি আসতোই। আমার সঙ্গে সময় কাটানো মানে একের ভেতর দুই। বললাম, আড়ঙে ঢুঁ মারবা নাকি? বললো, হ্যাঁ, যাওয়া যায়।
আমি আর জেসমিন দি’ একটা রেস্টুরেন্টে বসেছি। জোর করে ধরেছে খাওয়াবে। আমি বললাম, তাহলে চলো স্যুপ-ট্যুপ কিছু একটা খাওয়া যেতে পারে। এই রেস্টুরেন্টটাতে শোভনের সঙ্গে একবার এসেছিলাম আমি। মনে হয় এই দিকটাতেই বসেছিলাম। খুব ভালো লাগছে জেসমিন দি’র সঙ্গে। তার মত চমৎকার একজনের সঙ্গে সময় কাটানোটা নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যাপার। প্রথমদিকে কিছু ফিল করতে পারছিলাম না। বিরক্ত হচ্ছিলাম না ঠিক। কিন্তু এই সময়টা আমার বিভাস আর ইমরানের সঙ্গে কাটতো। তাদের বদলে দিয়ে জেসমিন দি’কে বসানোয় প্রথমে ভরসা পাচ্ছিলাম না। এখন দেখি আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করছে। জেসমিন দি’ একটু মহিলা টাইপ। আক্ষরিক অর্থেই বড় আপু। নিজেকে তাই বাচ্চা-বাচ্চা লাগা স্বাভাবিক।
খুব শুনশান চমৎকার পরিবেশ। এজন্যই লোকে রেস্টুরেন্টে আসে। নিরিবিলি পরিবেশে ঘণ্টাখানেক আড্ডা মেরে যায়। অবশ্য কয়েকজন মিলে বাইরে একটু দাঁড়ানোর জায়গাই বা কই? এমন নিরিবিলি পরিবেশে শোভনের আলাপের বিষয় হতো সেক্স। কথা তার যা দিয়েই শুরু হোক, শেষ হবে তা সেক্সে গিয়ে। গলার স্বরটা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলতো শোভন। শুনে কেমন নেশা নেশা লাগতো। খুব উত্তেজনা বোধ করতাম তখন।
‘সেক্স নিয়ে তোমার ধারণা কি, দিদি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। এতো স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা করলাম। আমাদের আলোচনার বিষয়ই যেন ছিলো সেক্স। এটা অবশ্য আমি জানি যে, প্রশ্ন শুনে সে ঘাবড়ে যাবে কি-না। এজন্যই প্রশ্ন করা।
তার জবাব হলো, আসলে সেক্স বলে আলাদা কিছু থাকে না রে! বিয়েটা কর, তারপর বুঝবি। একটা সময় থাকে যখন সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু থাকে সেক্স। পরে সেটা সামান্য একটা অনুষঙ্গ হয়ে পড়ে মাত্র। শিক্ষকদের মত ভাবলেশহীনভাবে সে বলে যাচ্ছে। অথচ সে শিক্ষক নয়। শিক্ষক হলো তার হাজব্যান্ড। জনাব সুনির্মল কর্মকার। পরিবেশ হালকা করার জন্য মুখে একটু হাসিও নেই তার। তবে স্বরটা একটু নামিয়েছে। যেন আমিই শুধু শুনতে পারি। বলে, বলতে পারিস ভাত-মাছ খাওয়ার মত। অভ্যাসবসত একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। কখনো কখনো ক্ষুধা লাগে না খুব? তখন খেতে কেমন লাগে? এই-ই হলো বিষয়।
ভেতরে ভেতরে কেমন একটা উত্তেজনা বোধ করছি। দুই উরুর মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত একটা আকাঙ্ক্ষা ঘনীভূত হতে হতে মাংসল জিজ্ঞাসা হয়ে বেরিয়ে আসছে ভাষারূপে। আমি বললাম, ‘পর্নোগ্রাফি দেখো তুমি?’ এবার জেসমিন দি’ হেসে ফেললো। বললো, ‘তোর প্রশ্ন শুনে হাসিও আসছে, আবার মজাও পাচ্ছি।’ আমি খুব সিরিয়াস ভাব নিয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী সাজার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘আসলে সেক্স নিয়ে আমি স্টাডি করছি। অনেকটা গবেষণার মত। এই সুযোগে তোমার অবজারভেশনটা জেনে নিচ্ছি, এই আরকি! তুমি আবার কিছু মনে করছো না তো?’ নিজের মন্তব্যে নিজেই খুশি হয়ে গেলাম। বাহ্, কী সুন্দর পালিশ করতে পারি আমি। ‘আরে না, না। তোর উদ্দেশ্য আমি ঠিকই বুঝেছি।’, দিদি বললো।
এবার সে একটু সিরিয়াস হয়ে গেল। বললো, ‘আমার খুব একটা দেখতে ইচ্ছা করে না। তোর দাদাই কখনো দেখায়।’ তখন দেখতে তার ভালোই লাগে। পরিচিত একজন মডেলকে নিয়ে একবার কি এক কেলেঙ্কারি হয়। নিজে থেকে শুধু সে সেই মডেলের ভিডিওটাই দেখেছিলো। একটু হাসলো। দাদার প্রসঙ্গ চলে আসায় মনে হলো লজ্জা পেয়েছে। আর আমি স্বাদ নিচ্ছিলাম আমার অন্তর্গত উত্তেজনার। চকলেটের মত গলে গলে একদম তা ছড়িয়ে পড়ছিল আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। আমি বললাম, ‘আমিও দেখেছি সেটা।’
দেখতে পাচ্ছিলাম ওয়েটার আসছে। তার হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম স্যুপের বাটি। আলাদা একটা প্লেটে অন্থন। বললাম, ‘জেসমিন দি’, তুমি কি আমাদের অফিসের বাথরুমের টিকটিকিটা দেখেছো? ঐ যে ভেন্টিলেটরের ফোঁকরটাতে সারাদিন বসে থাকে? কেমন বড় বড় চোখ করে তাকায়?’ ফোন আসলো জেসমিন দি’র। ভ্যানিটি ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলো সেই ফোন। ধরতে ধরতেই কেটে গেলো। হাতের ইশারায় আমার কাছে সময় চেয়ে নিলো দিদি। খুব নিস্পৃহভাবে ওয়েটারটা টেবিলটা সাজিয়ে দিয়ে গেলো। অপেক্ষা করছে, দিদির কথা কখন শেষ হয়। আমি বললাম, ‘ওকে। দুইটা কোল্ড ড্রিঙ্কস দিয়ে যাবেন। কাচের বোতল। ডিউ অথবা কোক।’ সে চলে গেলো।
চাচা এসেছিলো চাল দিতে। পরদিনই চলে গেছে। চাচার ইনকাম খারাপ না। এখন বেশ ভালোই চলছে তার। দাদিকে নিয়ে গেছে। সপ্তাহ খানেক পরে আবার এসে দিয়ে যাবে। বাবা রাজি হয়েছে। দাদিরও একটু হাওয়া পরিবর্তনের দরকার আছে। বাবাকে বললাম, বাসার কাছেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রিটেনে টিকেছি। বললাম, স্কেলও খারাপ না। থার্টি প্লাসের মত আসবে। কথাবার্তা শুনে বাবাকে বেশ আশাবাদী মনে হলো। বুধবারে ভাইভা। বললাম, দোয়া কোরো। যাতে চাকরিটা হয়। বাসে-টাসে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করাটা মুশকিল। বললাম মাজহার ভাইয়ের দুর্ঘটনার কথা।
মাকেও ঘটনার অন্তর্ভুক্ত করলাম। ডেকে বললাম, ‘মা, দুআ কইরো যাতে হয়। বাসার একদম কাছেই। হাঁইটাই যাওয়া যাবো।’
মা আজ ছোটো মাছ রান্না করেছে। চিকন করে কেটে বেগুন-আলু-কাঁচা মরিচ দিয়ে। ঝাল হয়েছে খুব। একদম বোঝা যায় না – কোনটা বেগুন, কোনটা মরিচ। বললাম, ‘ঝাল হইছে খুব। কী দিছ?’ কাঁচা মরিচ বেছে বেছে ফেলে দিতে বলে। ততক্ষণে বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেলেছি। আমের মিষ্টি আচারের বয়ামটা মা টেবিলে এনে রাখল। তাকে বেশ খুশিখুশি দেখাচ্ছে। বাসার কাছে চাকরির কথা শুনেই কিনা। ইচ্ছা করলো, মাকে বলি, আগেই যেন সে বেশি খুশি না-হয়ে যায়। পরে হতাশ হতে হবে। বললাম না। হোক খুশি। পরে দুঃখ পেলে, পাবে। এখনকার খুশি আর পরের দুঃখ দুইটা মিলে সমান সমান হয়ে যাবে।
পড়ুন ।। কিস্তি ১০