বায়োগ্রাফিক্যাল ফিকশন বা আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য — যখন ফুটিল কমল। লেখার পরিণতি কী দাঁড়াবে লেখক নিজেই তা ভালো বলতে পারবেন। জাহিদুর রহিম চমৎকার গদ্যে উপহার দিয়েছেন জীবন ও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর।
The real hero is always a hero by mistake; he dreams of being an honest coward like everybody else.― Umberto Eco, Travels in Hyperreality
জীবনটা যদি প্রথম থেকে শুরু করা যেতো! যদি আবার সুযোগ দেয়া হয় প্রথম থেকে শুরু করার, একটা সেকেন্ড চান্স, প্রথম থেকে হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, চিনতে শেখা, জানতে শেখা। সব স্বাদ, স্পর্শ, গন্ধ আর অনুভব নতুন করে শেখা — তাহলে কি জীবন পালটে যেতো? আজ এখন আমি যা, আমি কি আবার তাই করতাম? সেই আগের ভুল, আগের ভালোবাসা? নাকি এখনকার জীবনটা মিথ্যা হতো, নতুন শুরুর মতো আমার জীবনটাও নতুন হতো। এটা কিন্তু কাল্পনিক মনে করা না, বর্তমানের বাস্তবে দাঁড়িয়ে মানুষ নিয়তই ভাবে, ফেলা আসা জীবনে এমন কিছু মুহূর্তের ঘটনার কথা যা জীবনটাকে বর্তমানের দিকে টেনে এনেছে, সেই বর্তমান যেমনই হোক না কেন।
চিরকালীন সত্য বলে যদি কিছু থাকে সেটা এই জগত আর সৃষ্টির ঊর্ধ্বে কোন মহিমাময় সত্তা। দুঃখ যেমন সুখের মুখোশহীন রূপ, তেমনি ‘সত্য’ মিথ্যার মুখোশহীন রূপ ছাড়া তো আর কিছু না। সত্য আর মিথ্যার মধ্যে কি অন্য কোন তফাৎ আছে? আজ যেটা সত্য, এবং শ্বাশত সত্য বলে মনে হচ্ছে কাল কি সেটা মিথ্যা হয়ে যেতে পারে না? এমনকি চারপাশের সব কিছু? যেমন, প্রতিদিন আমরা পৃথিবীতে সূর্যের রোদ পোহাচ্ছি। এটা সত্য এ পর্যন্ত; চিরকালীন সত্য। কিন্তু এই সত্য একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সত্য। একদিন এমন আসবে সূর্য আর রোদ বিলাবে না। ‘কুল্লু মান আলাইহা ফা’ন। ওয়া ইয়াবকা ওযহু রব্বিকা জুল জ্বালালি ওয়াল ইকরাম’।
সত্য-মিথ্যার ধন্দ লাগা এই জীবনে, ভুল আর শুদ্ধের এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যে মানুষ কি বুঝতে পারে তার সত্যিকার পরিচয়? মাঝে মাঝে ভাবি একজন মানুষের কটা পরিচয় থাকে, এর মধ্যে সত্য কোনটা? ধরুন আপনি একজন শিক্ষিত বাঙালি। পাশ করে কিছুদিন ঘুরে আপনি চাকরি পেলেন, বিয়ে হল,বাচ্চা কাচ্চা হল, বছর বছর ইনক্রিমেন্ট হল, আপনার জীবন চাকরি আর বাজার — এই দুটো পিলারের মাঝে দড়ির সাঁকোর মাঝেই দুলছে। বিনোদন বলতে রোজ খবরের কাগজ পড়া আর রাতে টিভিতে টক শো দেখা। বড় জোর অফিস কলিগদের সাথে মিলে বসের বদনাম করা। মানে আপনি একজন ঘোর সংসারী মানুষ।
কিন্তু ভাবুন আপনার মনের গভীরে একটা ঘোরগ্রস্ত একটা পাগল প্রায় বাউন্ডুলে আছে। সে ভ্রমণ-প্রিয় আড্ডা-প্রিয়, আর অলস। কখনো সে কোন নিভৃত পল্লির দূর পাথারে এক পুকুরের পাশে ছোট কোন কুঁড়ে ঘরে জীবনকে আটকে ধরে বাঁচতে চায়; কখনো আবার সব ছেড়ে ছুঁড়ে পথে বেরিয়ে পড়তে চায় নিখাদ পর্যটকের মতো। এমন কোথাও চলে যেতে চায় যেখানে মানুষের তৈরি কোন কিছুই নেই। যেখানে চাকরি নেই, ব্যবসা নেই, স্বার্থ নেই, রাজনীতি নেই, রোজ সকালে বাস ধরার জন্য অপেক্ষা নেই, চাকরিতে বেতন বাড়ানো নিয়ে চিন্তা নেই, প্রমোশন নেই। যেখানে মাটি আর আকাশ ছাড়া কিছুই নেই।
তাহলে আপনি আসলে কি বলুনতো? আপনি কি সংসারী না বাউন্ডুলে? হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন আপনি এ যাবত নিজেকে যা ভেবে এসেছিলেন আপনি আসলে তা নন। আপনি যদি সত্যিকার শিক্ষিত হন, আপনি এর মাঝে জেনে গেছেন যে, ‘জীবনকে আবিষ্কার করতে হলে মাঝে মাঝে সব ছেড়ে ছুঁড়ে হারিয়ে যেতে হয়।’ আসলে ‘আপনি নিজে কি?’ — সেটা জানার জন্যই আপনাকে পালাতে হবে। কী করবেন আপনি, পালাবেন?
একদিন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখলেন, আপনার বয়স বেড়ে গেছে। আপনার হৃদপিণ্ড চলছে না আর ঠিকঠাক, মাঝে মাঝে বুকের বাম পাশে হালকা চাপ লাগা অনুভূতি হয়। কখনও অজানা শঙ্কায় গভীর রাতে ঘুম ভাঙে, পিপাসার তীব্র আকুতি বুক জুড়ে। চোখের নিচে কালি, কপালের চামড়ায় ভাঁজ। বাসার বাইরে বের হতে আর ইচ্ছে করে না। অসহ্য লাগে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ, মানুষের মুখ আর চিৎকার। আপনার মনে হবে কত কিছু দেখা হল না জীবনে!
যেই শহরে আপনি বেড়ে উঠেছেন, সেই শহরের কত কত অজানা গলি থেকে গেছে, যেখানে আপনার কোনো দিন যাওয়া হয়নি। আপনার যদি মনে হয় আপনার জন্ম আর বেড়ে ওঠার শহরকে আপনি ভালোবাসেন, কখনো কি মনে হয়েছে সেই শহরটা আর আগের মতো নেই; কখন যেন পাল্টে গেছে হারিয়ে গেছে সব পথের স্মৃতির দাগ, আপনার বয়সের মতই আপনার অজান্তে। আর আপনি না চাইলেও সেই পরিবর্তন আপনি দেখেছেন, মেনেছেন বা মানতে হয়েছে। যেমন মানতে হয়েছে যে আপনি স্বতন্ত্র নন। আপনি রোজ সবার হুকুম আর দাবি মেনে চলা লোক। বউয়ের দাবি, বন্ধুর দাবি, বসের দাবি, পুলিশের দাবি এমনকি যে রাজনৈতিক দলের লোকদের আপনি ভোট দেননি , তাঁদের দাবি। আমি বা আপনি আসলে কি শেষ পর্যন্ত জীবনের এই দাবিগুলো কিছু বুঝে উঠতে পারি? জীবনের দাবি? ভালোবাসার দাবি?যেমন আমি ভালবাসাকে বুঝিনি।
ভালোবাসা বলতে হয়ত শেষপর্যন্ত প্রিয় মানুষের ওপর নিরঙ্কুশ কতৃত্বকে বোঝায় লোকে, মানে প্রেমের মানুষটির ওপর পূর্ণ অধিকার। কিন্তু মানুষের এই ধারণা আমার কাছে স্বৈরতান্ত্রিক, অবিসংবাদিত এক সীমাহীন পীড়ন। ঘূর্ণনরত জীবনের সব আঁকশিতে আর গোপন স্বপ্নের উদ্যানে আমি জেনেছি, ভালোবাসা একটা লড়াই ছাড়া কিছুই না। ঘৃণা দিয়ে এই লড়াইয়ের শুরু আর অমীমাংসিত এক অতৃপ্তিতে এর সমাপ্তি। প্রেমের সমস্ত সঞ্চরণের শরীর জুড়ে আছে নিজেকে নষ্ট করার এক দুর্লভ আনন্দ। মানুষ এই আনন্দের ভিতরেই সত্যিকার জীবনকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আমি কখনো আমার ভালোবাসার মানুষের মনকে বুঝতে চাইনি। আর সেটা স্বেচ্ছায়। এর পেছনে আছে কেবল এক চাপ থেকে মুক্তি।
আমি শুধু এটা ভেবে নিয়েছি, যে আমাকে ভালবাসবে, সে আমার মনের সূক্ষ্মবৃত্তিগুলো আমার হৃদয়ের শ্বাস ফেলা আনন্দের জানালা ছুঁতেই আমার কাছে আসবে। কিন্তু যে ভালবাসবে তার নিজেরও একই রকম ভালোবাসা পাবার যে অধিকার আছে, আর সেই অধিকার আমার ওপর প্রয়োগ করতেই পারে — এই কথা আমার মনে এক বিষম চাপ তৈরি করে। আমি দেখেছি নারীর কাছে ভালোবাসা কেবল সুক্ষ্ম হৃদয় বৃত্তি নয়, বরং এক পরিত্রাণ। জীবনের সকল ধ্বংসের সীমানায় দাঁড়িয়ে নারীরা ভালোবাসার এই পরিত্রাণ খোঁজে।
মানুষ আসলে কম বেশি সবাই জীবন থেকে বিচ্ছিন্নভাবেই বাঁচে। তার মানে হচ্ছে, মানুষ এক একটি খণ্ডিত জীবন নিয়ে বাঁচে। হয়তো পূর্ণ জীবনের বোধ বা বোধের আকুতিও সবার মাঝে থাকে না। ব্যক্তিজীবনে আমরা প্রত্যেকে একটা শুভ, মঙ্গল ও ভালো কোনো বোধের কল্পনা করি। এমনকি আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আছে ‘একটি পূর্ণ মানুষের ছবি’। সেই আমাদের ‘মনের মানুষ’। মুভির দৃশ্যায়ন বা উপন্যাসের পাতার চরিত্র সব আমাদের মনের এই মানুষের সাথে এক হয়ে ধরা দেয় বলেই শিল্পে আমাদের কামনা থাকে আরও পরিশুদ্ধ জীবন। একটা জীবনকে টুকরো টুকরো করলে যেমন পাওয়া যায় জীবনের মুহূর্তগুলো, তেমনি সেই মুহূর্তগুলোর যোগফলের নামই জীবন।
জীবন একটা সফরের নাম। জীবন একটা অভিজ্ঞতার নাম। জ্ঞান আসে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। আর জীবনে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তখন, যখন মানুষ নিজের কাজটুকু সচেতনতার বোধের জাগ্রত সীমানায় করে। সেই কাজের ফল যাই হোক সেই অভিজ্ঞতা মানুষকে পথ দেখায় সামনে। জীবনের সব কার্যকরণে এই অভিজ্ঞতার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়াই প্রজ্ঞা। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি দেখেছি বেশিরভাগ মানুষ এটা জানতেই পারে না জীবন আসলে ঠিক কত বড়, জীবনের পরিচয়ইবা কী! বইয়ের বিদ্যাও অনেক ক্ষেত্রে জীবনকে খোঁজার এই যাত্রায় বাধা। অনেকে চোখের সামনে বই নিয়ে জীবনকে ভুলে থাকতে চায়। বই কেড়ে নিয়ে এসব মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দিন, মানুষ তখন জানবে কোথায় সে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ পড়ে থাকে তার বিভ্রান্তি নিয়ে। মানুষ জানে না কতার পথের শেষ কোথায়। সে কখনো বুঝবে না জীবনে ভালোবাসার আসল দিকগুলো কী ছিল। ব্যক্তির স্বতন্ত্র সত্তা আর তার রক্তের ধারা সর্বদা তাকে নির্যাতন করে ছিঁড়ে ফেলে তার আনমনা ভাবনার খোলস। এই খোলস ছেড়ে বের হলেই মানুষ বুঝবে তার গন্তব্য কোথায়।
অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, ‘যদি তুমি জানো যে তুমি কি হতে চাও তাহলে তুমি শুধু এক মুখী টানেলে ঢুকে গেলে — তুমি এক গন্তব্যেই পথ চলবে। সেটা একটা শাস্তি। আর যদি না জানো তাহলে তুমি যেকোনো কিছুই হতে পারো’।
আমরা যা করতে পারি বা করি—সেটা জানাই জীবনকে জানা নয়। বরং যা করতে পারতাম বা যা করা ঠিক হয়নি সেটা বর্তমানের সাথে মিলিয়ে জানাটাই জীবন। মানুষের নিয়তি এক তৃপ্তিহীন বিরহ, যেই বিরহে সে সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে যায়। মানুষকে ফেলে দিতে হবে সব ভাবনা, হারাতে হবে চিরদিনের অভিজ্ঞান। ফেলে দিতে হবে সব জঞ্জাল, সাবধানের ভার, হতে হবে রিক্ত, যাতে সে পথের বাকে বাকে পুরনোকে চিনতে পারে নতুন করে। কোন একদিন ডিমের খোলসের মতো ফেটে যাবে মানুষের ভাবনার পৃথিবী, বেরিয়ে আসবে এক নতুন জগত। সেই জগতেও পেছন থেকে মানুষকে ধরে ফেলবে তার অতীত। যার প্রতীক্ষা করে মানুষ, যার বিরহে মানুষের এই কান্না। মানুষ ভুলে যায়, তাকে ডুবতে হবেই মৃত্যুর তিমিরে আবার বেচে ওঠার জন্য, তাকে লুপ্ত হতে হবেই পাতালে নাহলে সে কি করে ফিরে আসবে আলোয়?
বরিস পাস্তানাক ডক্টর জিভাগোতে কী সুন্দর করে বলেছিলেন :
For life, too, is only an instant,
Only the dissolving of ourselves
In the selves of all others
As if bestowing a gift –
পড়ুন ।। কিস্তি ৮