মঈনুল আহসান সাবেরের সাক্ষাৎকার

মঈনুল আহসান সাবের — বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। ১৯৮২-তে বের হয়েছিল তাঁর প্রথম বই পরাস্ত সহিস। চার-পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তাঁর লেখালেখির পৃথিবী। পরাস্ত সহিসের প্রথম প্রকাশনার চল্লিশ বছর উপলক্ষে কথা বলেছি আমরা কথা বলেছি তাঁর সঙ্গে।

 

সহজিয়া : পরাস্ত সহিস আপনার প্রথম বই। অসাধারণ নাম। বেরিয়েছিল ১৯৮২তে। লেখালেখির চল্লিশ বছর হতে চলল। সেই দিনগুলোর কথা বলবেন? গল্প লেখার প্রথম দিককার গল্প… কারা কারা লিখতেন? লেখালেখির ক্ষেত্রে যৌথ কোনো অভিপ্রায় ছিল কিনা? যেমন কবিরা নানা ধরনের আন্দোলন করতেন… ফিকশন রাইটার হিসেবে আপনাদের কোনো যৌথ আয়োজন ছিল?

মঈনুল আহসান সাবের :  আমিও বলি, নাম হিসেবে পরাস্ত সহিস অন্য মাত্রার। কেউ বলেননি, বলা উচিত ছিল, কাব্য বা গল্পগ্রন্থের এমন নাম সে-সময়কে ধরে রাখার জন্য উত্তম মাধ্যম। আমার সূচনার সময়ের গ্রন্থের নাম কতটা কেমন হতো, ভাবুন, বুঝবেন। অবশ্য সূচনায়ই আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন পরাস্ত সহিস নাম হিসেবে অসাধারণ।

হ্যাঁ, লেখালেখির চল্লিশ বছর হতে চলল। এটা ভালো না খারাপ, না-ই বললাম, বলি – চল্লিশ বছর (মূলত ৪৮ বছর, ৭৮-এ লেখালেখির শুরু হিসাবে) ধরে যে লিখছি, এটাকে গ্লোরিফাই করার কিছু নেই। বামুন আর হাফ-বামুন লেখকের এই দেশে অনেক কিছু লেখার ছিল। যতটা আলাদা আমি লিখেছি, যতটা ভিন্ন বিষয়ে, যতবার নিজেকে বদলিয়েছি, আর একটি শ্রেণিকে শনাক্ত করে গেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করার ছিল আমার। হলো কই? ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের সময়ে আপনি ছিলেন না, কিন্তু পড়েন আপনি, জানেনও, বোঝেন, তাই বিস্তারিত বলার প্রয়োজন দেখি না – কেমন ছিল আমাদের সময়। ঐ যে আমার গল্পগ্রন্থের নাম পরাস্ত সহিস – অমন এক সময়ে আমাদের শুরু, অমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা, ঘোড়াটি, অর্থাৎ সময় আমাদের পরাস্ত সহিস হিসেবেই রেখেছিল।

 

আমার প্রথম লেখা বের হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায়, তারপর দৈনিক বাংলায়। ৭৪ সালে। ঐ তখনই, কিংবা আরো দুই-এক বছরের মধ্যে আমার নাম ছড়াল। নাম ছড়ানোর ব্যাপার আছে, লেখা শুরুর আগে জানিনি, কিন্তু এক ধরনের উত্তাপ টের পেলাম। আলাদা থেকেই, আলাদা থেকে এ কারণে যে, আমি আমার বাবার বাইরে কোনো লেখককেই চিনতাম না। নামে জনাকয়েককে চিনলেও, সামনাসামনি কখনো নয়, আড্ডায় আরো দূরের কথা। আমার সমসাময়িক লেখকদের সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। এদের আমি একটু একটু করে চিনতে আরম্ভ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। তবে অধিকাংশই কবি তারা, আর, সাহিত্যের আড্ডা কখনোই আমাকে টানে নি, এখনো টানে না। সাহিত্যের আবার আড্ডা কী! তবে আড্ডায় বসলে, সাহিত্য কিছু না কিছু চলেই আসে, খোশমেজাজে কিংবা আক্রমণ শানিয়ে অস্বীকার করি না।

 

যে কথা বলছিলাম, লেখালেখির শুরুতে যেহেতু কাউকে চিনতাম না, আমার যেহেতু ছিল গোটানো স্বভাব, আছে এখনো, আমি আসলে আপনার প্রশ্নের শেষাংশের জবাব দিতে পারব না।

 

ভার্সিটি লাইফের এক পর্যায়ে আলী রীয়াজ, রুদ্র – এরা মিলে ‘রাখাল’ নামে একটি সংগঠন করেছিল। আমি ছিলাম ওদের সঙ্গে, ঐ রাখাল থেকে আজকের ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’। আবার, ‘রাখাল’ নিয়ে ওদের সঙ্গে আমি ছিলাম না।… কেন?

 

আমার ভালো লাগত না।… আমার ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল।

আমার ভালো লাগা গল্প। কারো বলতে হবে না, আমি নিজে জানি, আমি ভুল জানি না – বিশ্বমানের কিছু গল্প আমি লিখেছি।

 

সহজিয়া : কয়েক দশক গল্প-উপন্যাস লিখলেন। কোনটি লিখে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি? গল্প ও উপন্যাস – এ দুটিকে আলাদা করেন কীভাবে?

মঈনুল আহসান সাবের : আমার শুরু গল্প দিয়ে। আমার ভালো লাগা গল্প। কারো বলতে হবে না, আমি নিজে জানি, আমি ভুল জানি না – বিশ্বমানের কিছু গল্প আমি লিখেছি। বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকেই বলছেন, গল্প অনেকেই লিখেছেন, যা লিখেছেন, তা-ই টিকিয়ে রাখবে, আর একটিও না লিখলেও। এখন কিছু বড় উপন্যাস লিখুন। বড় উপন্যাস মানে, বড় পরিসরের উপন্যাস, আমি নিজেও কতবার ভেবেছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আমাদের মধ্যবিত্তের বিকাশ নিয়ে, রেমিটেন্স গার্মেন্টস, আদমের কারবার কীভাবে কাড়ি কাড়ি কাঁচা টাকা আনল আর বদলে দিল অপরিণত, অপ্রস্তুত সমাজ ও মানুষকে – এসব নিয়ে ৩/৪টা উপন্যাস লিখব। অথচ শুরুই করা হয় না, শুধু সময় ফুরোয় হুহু করে। তবে একদিন শুরু করে দেব।

 

আলাদা করি না তো। গল্প লেখার সময় গল্প লিখি, উপন্যাস লেখার সময় উপন্যাস লিখি। এমনিতেই দুটো একসঙ্গে থাকে। সুমন, এ নিয়ে হাজার জন বলেছেন। আমি না হয় ক্লাসরুম টাইপ এই প্রশ্নের উত্তর না-ই দিলাম।

 

 

সহজিয়া : আমার মনে হয়, প্রতিটি গল্পের পেছনে কোনো-না-কোনো গল্প থাকে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো প্রণোদনা থাকে। পরাস্ত সহিসের সাতটি গল্পের পেছনে হয়তো সাত রকম গল্প আছে। ‘হন্তারক’ গল্পটির পেছনের গল্প কী?

মঈনুল আহসান সাবের : হুমম, গল্পের পেছনে গল্প, সে থাকেই। কাছের, কিংবা দূরের, খুব দূরের, কখনো এতটাই দূরের লেখকেরও সেটা মনে থাকে না, কিংবা তার মনেও পড়ে না, ওটা থেকে তৈরি হলো।

 

একটা গল্প এলো। কোত্থেকে এলো। কোনো ঘটনার এক লাইন কিংবা কোনো পাঠের দেড় লাইন থেকে। এক এক আর দেড় লাইনকে গল্প করে তুলতে তুলতে, তার যে সূতিকাঘর, আমার ধারণা, তার কোনো অস্তিত্ব বা মূল্যই আর থাকে না। লেখক যে ভাবে, মানুষের কোনো ভাবনাই তার সময়, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি অর্থাৎ তার চার পাশ ও তার অদ্ভুততম কল্পনারও বাইরে নয়। কারো পক্ষে এমন কল্পনা করা সম্ভব না, যা কোনো-না-কোনোভাবে নেই বা হতে পারেনা। লেখকের এই ভাবনা থেকেই বেরিয়ে আসে গল্প, ভাবনা থেকে মানে তার চারপাশের অবস্থান থেকে।

 

‘হন্তারক’ গল্পটি আমার ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছিল,পরিণতি পাচ্ছিল না, আমি একটা কাঠামো তৈরি করেছিলাম সম্ভবত, কিন্তু কোথাও একটা অসমাপ্তি থেকে যাচ্ছিল। এসময় পত্রিকায় আহসান হাবীবের ‘হত্যাই উদ্দেশ্য যদি’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। আমার গল্পটিও শেষ হয়।

 

সহজিয়া : ‘হন্তারক’ দারুণ শ্বাসরুদ্ধকর একটি গল্প। শেষ দিকে এসে মনে হয়, শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। খুবই চমৎকারভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘নৈঃশব্দ্য’। কেন ওই শব্দহীনতার বোধ বেছে নিলেন সেকান্দরের জন্য?

মঈনুল আহসান সাবের : সেকেন্দার, সে তো শব্দের বা শব্দময় মানুষ। তার জীবনযাপন, তার পেশা সবই উচ্চ কণ্ঠের। তার ধারণাও নেই ‘নৈঃশব্দ্য’ সম্পর্কে। সুতরাং শেষে এসে পরাস্ত সে অপরিচিত নৈঃশব্দ্যের কাছেই হয়। ওটা তার অপরিচিত, অজানা পরিবেশ।

 

সহজিয়া : ‘গ্রাস’ গল্পে দেখতে পাচ্ছি, মানুষ ও যন্ত্রের এক ধরনের বৈপরীত্যমূলক উপস্থিতি হাজির করেছেন। কিন্তু ১৯৮২-তে আজকের অর্থে যান্ত্রিকতা ছিল না, যেমন, ধরা যাক, রোবট দিয়ে চিকিৎসা, ড্রোন দিয়ে কাজ করানো, বিমানবিক সম্পর্ক… তো সেই বাস্তবতায় ‘গ্রাস’ লিখলেন কেন?

মঈনুল আহসান সাবের : হ্যাঁ, আমাদের এখনকার যান্ত্রিক অনেক কিছুই সেই ৪০-৪২ বছর আগে ছিল না। কিন্তু মানুষ ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, এ মিথ্যা ছিল না। তার পরিণতি, রূপক, কী হতে পারে – ‘গ্রাস’ গল্প তো এমনই না? এটা একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবোধ বা বাদেরও গল্প। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছিল আমাদের আচরণে, আমাদের রোজকার জীবনে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ তৈরি হচ্ছিল আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতির চারপাশ থেকে। আমরা টের পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মানুষ কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল, কোনঠাসা মানুষ সংবেদনাহীন হয়ে পড়ছিল। এই এখন কী দেখি আমরা? একটি বাড়ি ছিল, পাশে আরেকটি, আরো একটি, সামনেও তেমন। এসব বাড়ির সবাই সবাইকে চিনত। তারপর একদিন সবগুলো বাড়ি ভেঙে বিশাল বহুতল বাড়ি তৈরি হলো। তার বাসিন্দারা কেউ কাউকে চেনে না।

 

এখন মোবাইল ফোন আমার বন্ধুর চেয়ে কাছের ও বিশ্বস্ত। কিছু চাপিয়ে দেওয়া ও কিছু অনিবার্য সংকট মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলবে, এটা ধরতে না পারলে আমার লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না।

সে এক অস্থির সময়, সে এক অনিশ্চিত সময়, সে এক স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সময়। কী, কেন, কীভাবে – এরকম নানা প্রশ্ন আমাদের এলোমেলো করে রেখেছিল। পুরো দেশটাই তখন এলোমেলো। কিছুই অখণ্ড নয়, কিছুই স্বচ্ছ নয়, কিছুই নিশ্চিত নয়।

 

সহজিয়া : পরাস্ত সহিস বইতে ‘পরাস্ত সহিস’ আসলে কে? বইয়ের জন্য এই নামটি আপনি পছন্দ করলেন কেন?

মঈনুল আহসান সাবের : আপনি প্রথম প্রশ্নের একাংশে বলেছেন, ‘পরাস্ত সহিস’ অসাধারণ নাম। এ দিকটি বিবেচনা করলে বোঝা যায়, আপনি জানেন পরাস্ত সহিস কে বা কারা। হ্যাঁ, আমি নিজেই পরাস্ত সহিস, আমার বাবাও, আমাদের পাশেরবাড়ির লোকটি, কিংবা বইটির কম্পোজ, ছাপা, বাঁধাইয়ে যারা ছিলেন, যারা ক্রেতা হিসেবে ছিলেন, প্রশংসা করে যারা বইটির আলোচনা লিখেছিলেন, তারা।

 

সে এক অস্থির সময়, সে এক অনিশ্চিত সময়, সে এক স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সময়। কী, কেন, কীভাবে – এরকম নানা প্রশ্ন আমাদের এলোমেলো করে রেখেছিল। পুরো দেশটাই তখন এলোমেলো। কিছুই অখণ্ড নয়, কিছুই স্বচ্ছ নয়, কিছুই নিশ্চিত নয়। সব আমার, তার, এর-ওর আয়ত্তের বাইরে। রোজকার জীবন কখনো থেমে থাকে না, তবে থমকে থমকে চলেছে। কেন এই বিড়ম্বনা, কেন এই অবস্থা? আমি বলতে চাই না। এখনো আস্থা রাখি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাসটা লিখতে পারব। তখন হয়তো অনেক ব্যাখ্যা আমি দেব।

 

তো ওরকম যখন ছিল সময় কারো ঘোড়া তার নিজের ছিল না, কারো ঘোড়া তার বাধ্য ছিল না, সময়কে ধরা যাচ্ছিল না, তখনকার সময়ে প্রকাশিত গল্প বা গল্পগ্রন্থের নাম পরাস্ত সহিস ছাড়া আর কী হবে?

 

জানানো দরকার, ৭টি গল্পের গল্পগ্রন্থে পরাস্ত সহিস নামে কোনো গল্প নেই। থাকলে সামগ্রিক অবস্থাটা ধরার যে চেষ্টা, ব্যর্থ হয়ে যেত।

 

সহজিয়া : পরাস্ত সহিসের গল্পগুলো লেখার সময় গল্পের গঠনশৈলীগত দিক থেকে আপনার কী ধরনের ভাবনা ছিল?

মঈনুল আহসান সাবের : কোনো ধরনের ভাবনাই ছিল না। গল্পগুলো আমার ১৯-২২ বছর বয়সে লেখা। এ সময়ে আমি আরও কিছু গল্প লিখেছিলাম। কিন্তু একটি চরিত্র বজায় রাখতে গিয়ে সেসব বা সেসবের একটি দুটি এই গ্রন্থে আমি রাখি নি। এই, এ পর্যন্তই। তখন এ পর্যন্তই আমি বুঝতাম। আপনি যে বলছেন গঠনশৈলিগত দিক, বুঝতাম না। জানতাম না। জানতাম আমি একটি গল্প লিখছি। আরও একটি ব্যাপার বুঝতাম, গল্পের তৈরি হওয়ার ব্যাপারটি। এটাই গঠনশৈলি?

 

আপনি খেয়াল করুন, গ্রন্থভুক্ত ৭টি গল্পের বলার ভঙ্গি আলাদা, একেকটি গল্পের ভাষা আলাদা, কোন চরিত্র কী আচরণ করতে পারে (তার প্রেক্ষাপটে) তা আমার জানা, কোথাও কিছু আরোপ করা হয় নি। ১৯-২২-এ এই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।

 

সহজিয়া : পরাস্ত সহিস বইটি পাঠকদের দ্বারা কীভাবে গৃহীত হয়েছিল? আমার হাতে বইটির যে কপি আছে, তাতে দেখতে পাচ্ছি ১৯৮২ সালের এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বইটি পুরস্কার হিসেবে একজনকে দেয়া হয়েছে। বইটির প্রকাশকালও ১৯৮২। তার মানে, সৃষ্টিশীল বই তখন দ্রুতই মফস্বলে পৌঁছুত, গাইড বইয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে নি সম্ভবত। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও জানতে চাই, সমালোচকরা কীভাবে দেখেছিলেন বইটিকে? রিভিউ হয়েছিল কোনো? একালে তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রিভিউ করা হয় এবং করা হয় না। তখন কেমন ছিল ব্যাপারটি?

মঈনুল আহসান সাবের : আমি এখন পরিচিত, সূচনাপর্বে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলাম, প্রথম দুতিন বছরেই বোদ্ধা পাঠক বুঝে ফেলেন, একজন কথাসাহিত্যিক এসেছেন। খ্যাতিটাও সেই মাত্রায় ছড়ায়। ফলে বইয়ের বিক্রি, আমি যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়। হ্যাঁ, এর মধ্যে বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনরা আছেন, আবার, বাইরের পাঠকও কম নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত বই, বিপণনের ব্যবস্থা নেই, প্রোডাকশন মান অনুন্নত – তবু প্রায় ৫০০ বই এক মেলায় ফুরিয়ে গেলো। প্রেসে কথা ছিল ১০০০ ছাপার, ৫০০ ফুরিয়ে যেতে বসলে আমি বাইন্ডারের কাছে গেলাম। বাইন্ডার বললেন, বই তো পাঁচশই। ফাজলামোটা কে করল প্রেস, বাইন্ডার, না জড়িত থাকা এক কবি-টাউট, জানা হয় নি।

 

বইটি আলোচিত হয়েছিল। অধিকাংশই প্রশংসা। পত্রিকায় সমালোচনা বেরিয়েছিল বেশ কয়েকটি। মৌখিকভাবেও (দায় নিতে হচ্ছে না) অনেক সিনিয়র খুব ভালো খুব ভালো বলেছিলেন।

 

সহজিয়া : কবি ও কবিতার বেলায় একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, ত্রিশের দশকের কবিদের জন্য বাধা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের কবিদের জন্য বাধা ছিলেন ত্রিশের দশকের কবিরা। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে এ-ধরনের কথা খুব কম উচ্চারিত হয়। কেন? আপনারা যখন তরুণ বয়সে লিখতে এলেন, তখন কাউকে কি বাধা মনে করতেন? কোনো বিশেষ কথাসাহিত্যিককে নিজের গল্প বা উপন্যাসের ভাব ও ভাষার জন্য সংকট মনে হয়েছিল?

মঈনুল আহসান সাবের :  প্রচুর পড়তাম। পড়তাম, বাসায় বই ছিল প্রচুর। আব্বা ওসব বই আগেই আমাদের জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। আবার যারা বন্ধু, তাদের মধ্যে যারা পড়ুয়, বই তাদের মাধ্যমেও আসত-যেত। বগুড়ায় নানাবাড়ির কাছে ছিল বড় এক লাইব্রেরি। বাহরাম, বনহুর, কুয়াশাও যেমন পড়া হয়েছে, পড়া হয়েছে আবু রুশদ, হুমায়ুন কাদির, রশীদ করিম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল কর বা রমাপদ চৌধুরী। আবার ও হেনরি, মোপাসাঁ, মমও ছিলেন। এদের অনেককে বেশি পছন্দ করতাম, পক্ষপাত ছিল, ভালোবাসা ছিল। যেমন ধরুন, প্রেমেন্দ মিত্র, তবে এঁরা কেউই আমাকে লেখালেখিতে প্রভাবিত করেননি আমার লেখায়। সেই প্রথম থেকেই কারো প্রভাব খেয়াল করবেন না বলেই আমার ধারণা। এই বড় বড় লেখাকরা বাধাও ছিলেন না। আমার ব্যাপারটা খুব সাদামাটা। পড়তে-পড়তে একদিন মনে হলো, আচ্ছা, এই যে এঁরা লিখছেন, আমি কি এদের মতো লিখতে পারি? বিবেচনা ছাড়া শুরু। এই এভাবেই।

 

সহজিয়া : গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনো আদর্শ লেখক আছেন? কার গল্পশৈলী বা বয়ানভঙ্গি আপনার ভালো লাগে? বাংলা ভাষা বা বাংলা ভাষার বাইরের লেখক – দুই দিক সম্পর্কেই বলুন।

মঈনুল আহসান সাবের : আদর্শ লেখক নেই। এই টার্মেই আমি বিশ্বাসী নই। অনেক লেখককে প্রচণ্ড শক্তিশালী মনে হয়, অনেকের লেখা পড়ে বিমূঢ় হই, অনেকে চিন্তিত ও ক্ষীণ হলেও অস্থির করে তোলেন। কিন্তু আদর্শ তারা কেউ নন। স্ট্যান্ডার্ড ধরা যায় না শিল্পের ক্ষেত্রে। আমরা বলি, ‘শ্রেষ্ঠ’, বাঙালির আবেগ, আসলে ওটা হবে ‘প্রিয়’।

 

তবে আদর্শ লেখক না থাকলেও, আদর্শ লেখক হওয়া সম্ভব না, এমন বহু লেখকই আছেন, যারা প্রয়োজনীয় (আমার কাছে), যাদের পাঠ করলে শেখার থাকে, ধরার থাকে কিছু-না-কিছু।

 

সহজিয়া : গল্পকার হিসেবে আপনি গল্পের কোন ধরনের বিশ্লেষণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, নাকি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ?

মঈনুল আহসান সাবের : আমরা নন্দনতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বকে আলাদা করে ফেলেছি, না? এই দুই মিশিয়ে লিখলে কী হবে? তবে স্থূল বিচারে যদি যাই, আমি সমাজতাত্ত্বিক গল্প বেশি লিখেছি। তাই বলে নন্দনতাত্ত্বিক কম? না। মানুষের জীবনে বহু বহু ঘটনা, লেখকের জীবনে বহু বহু অবলোকন। এখন, লেখার সময় গল্পটি যেভাবে দাঁড়ালে ভালো হয়, সেভাবেই দাঁড়াবে। তারপর তাত্ত্বিকরা বলবেন।

 

সহজিয়া : অনেক আগে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ একই প্রশ্ন যদি এই সময়ে আপনাকে করি আপনি কী বলবেন?

মঈনুল আহসান সাবের : আমি যখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাকরি করি, শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে পরামর্শ করে এবিভাগটি চালু করি। অনেকেই জানেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এ লেখাটি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন বটে, তবে সেটা ছিল অ্যাসাইন্ড লেখা। তার লেখাটি আলোচিত হওয়ার কারণ, তাঁর লেখাটি ছিল দীর্ঘ ও গভীর পর্যবেক্ষণমূলক।

 

না, বাংলা ছোটগল্প মারা যাচ্ছে না। তবে এ কথা উল্লেখ করার মতো ছোট গল্পকার এখন প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং দুর্দশা যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি না রাজনীতি ও অর্থনীতি এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি করে নি, সাহিত্যের এই অংশটি মারা যাবে। দুদর্শা, অনুবর্বতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু টেনে নেয়ার লোক সবসময়ই থাকেন।

 

সহজিয়া : নবীন গল্পলেখকের প্রস্তুতিটা কেমন হতে পারে? আপনার তারুণ্য ও গল্প লেখার প্রস্তুতিকালের সাপেক্ষে যদি এ বিষয়ে বলতেন… যেমন : ধরা যাক, একটি গল্প লিখতে গিয়েও লেখা হচ্ছে না, মাঝ পথে আটকে থাকছে গল্প, সমাপ্তি সুন্দর হচ্ছে না, খুব নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে… সম্ভবত গল্পকারকে এই লড়াইগুলো মোকাবিলা করতে হয়… তরুণদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

মঈনুল আহসান সাবের : খুব নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে – এই সম্যা ছাড়া গল্প লিখতে গিয়ে আমাকে এখনও অন্যান্য সমস্যায় পড়তে হয়। লেখক যদি নিজে পার হতে পারেন, হাজার পরামর্শ বা উপদেশে লাভ হবে না। আমি পরামর্শ, উপদেশে বিশ্বাস করি না। তরুণদের কিছু বলার নেই। তারা লিখতে পারেন – এটা জেনেই এসেছেন। না পারলে, লেখা বন্ধ করে দেবেন।

 

সহজিয়া : অনুগল্প ইদানিং বেশ ছাপা হচ্ছে। আপনার কোনো অনুগল্প পড়ি নি। লিখেছেন কি? অনুগল্প কেন হঠাৎ জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যপাতায়?

মঈনুল আহসান সাবের : একেক সময় একেক বাতিক ওঠে। চলেও যায়। আমি অনুগল্প নিয়ে ভাবিনি। আপনার প্রশ্নে পর মনে হচ্ছে, গোগল বেঁচে থাকলে তাঁকে এই প্রস্তাব দিতাম।

 

সহজিয়া : গল্পে আপনি জীবন সম্পর্কে কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করতে চান? সোজাসাপ্টায়, গল্পকার হিসেবে আপনি জীবনকে কীভাবে দেখেন?

মঈনুল আহসান সাবের : জীবন পছন্দমতো উড়িয়ে পুড়িয়ে ফুরিয়ে ফেলার।

 

ডিসেম্বর ২০২০

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here