‘মনন রেখা’ : বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস সংখ্যা প্রসঙ্গ

উর্দু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবর্গের অন্তর্গত ইন্দো-ইরানীয় উপগোত্রের একটি ভাষা। দিল্লি ও মিরাটের আশেপাশে যে পশ্চিমা হিন্দি ভাষা প্রচলিত ছিল, উর্দু তারই একটি শাখা। ভারতে মুসলিম শাসক ও তাঁদের সহযোগীদের আগমনের ফলে দিল্লি ও তার আশেপাশে প্রচলিত হিন্দি ভাষার সঙ্গে প্রায় দু শতক (১২০০-১৪০০) ধরে ফারসি শব্দের মিশ্রণের ফলে উর্দু ভাষার জন্ম হয়। এ মিশ্রিত বুলিকে ভাষাবিদগণ খাড়িবুলি, রিখতা এবং হিন্দুস্থানি বলেছেন।

 

দিল্লির ফারসি কবি আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) এবং হিন্দি কবি কবির দাসের (১৪৪০-১৫১৮) কবিতায় খাড়িবুলির নমুনা পাওয়া যায়। ‘উর্দু’ একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ সৈন্য। মুগল সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৮-১৬৫৮) সেনানিবাসের নাম ছিল উর্দু-এ-মুআল্লা। এখানে বিভিন্ন এলাকার সৈন্যরা খাড়িবুলি তথা হিন্দুস্থানিতেই কথা বলত। শাহজাহান তাঁর সেনানিবাসের নামে এ ভাষার নামকরণ করেন উর্দু।

 

উর্দু সাহিত্যের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে দিল্লি, লক্ষনৌ ও লাহোরের মতো এক সময় বাংলার কলকাতা ও ঢাকাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উর্দু ভাষার মতো উর্দু সাহিত্যও তার উৎসভূমি দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ক্রমে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। আঠারো শতকের গোড়ার কবি ওলী আওরাঙ্গবাদীর (১৬৬৮-১৭৪৪) সাহচর্যে দিল্লিতে উর্দু কাব্যচর্চার সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে ফায়েজ (মৃত্যু ১৭১৫), মাজমুন (মৃত্যু. ১৭৪৭), আরজু (মৃত্যু. ১৭৪৮) প্রমুখ কবিসাহিত্যিক ফারসির পাশাপাশি উর্দুতেও কাব্যরচনা করেন। এর আনুমানিক এক শতক পরে বাংলাদেশে উর্দু সাহিত্যচর্চা আরম্ভ হয়।

 

মুগল সুবাহদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৩) প্রথম ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী করেন। ১৭১৩ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে এবং ১৭৭২ সালে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯১২ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিল সমগ্র উপমহাদেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী। এ সময়ে (১৭৭২-১৯১২) মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা এ দুটি সদর দফতরে বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা, বসতি স্থাপন ও কবিসাহিত্যিকদের পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে ফারসি ও উর্দু সাহিত্যচর্চা প্রথম আরম্ভ হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদকুলী খান, শুজাউদ্দীন খাঁ ও আলীবর্দী খানের আমলে মুর্শিদাবাদ, আজিমাবাদ, হুগলি ও ঢাকা মুসলিম কৃষ্টি ও ফারসি সাহিত্যচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাষ্ট্রভাষা ফারসির পাশাপাশি উর্দুর চর্চাও ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যায়।

 

নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩৩-১৭৫৭) উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কুদরাতউল্লা কুদরাত ও ফারহাতউল্লা ফারহাত তার সভাকবিরূপে খ্যাতি লাভ করেন। মীর জাফরের (মৃত্যু. ১৭৬৫) সময় মীর মুহম্মদ শরফ উর্দু কবি ছিলেন। নবাব মহলের গ্রন্থাগারে বহু মূল্যবান আরবি, ফারসি ও উর্দুর প্রাচীন পান্ডুলিপি আজও রক্ষিত আছে। আঠারো শতকের শেষদিকে মুর্শিদাবাদে ইনশাল্লাহ খান ইনশা (মৃত্যু ১৮১৮) উর্দু সাহিত্যিক ও কবিরূপে সুনাম অর্জন করেন। তিনি দরিয়া-এ-লতাফত (১৮০৮) নামে ফারসি ভাষায় প্রথম উর্দু ব্যাকরণ রচনা করেন। এ বই উর্দু মহলে বিশেষ পরিচিত।

 

উর্দু গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অবদান উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ কর্মচারীদের উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকায় ওই কলেজের মাধ্যমে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমোন্নতি ঘটতে থাকে। কলেজ থেকে মীর আম্মান, শের আলী আফসোস, হায়দর বখশ হায়দরী (মৃত্যু ১৮২২) প্রমুখকে আরবি ও ফারসি গ্রন্থের সহজ-সরল উর্দু অনুবাদ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মীর আম্মানের বাগ-ও-বাহার (১৮০২) উর্দু গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তাছাড়া আফসোসের আরাইশ-এ-মাহফিল(১৮০৫), বাগ-এ-উর্দু, হায়দর বখশ হায়দরীর তারিখ-এ নাদেরী ইত্যাদি গ্রন্থ উর্দু গদ্যসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। বস্ত্তত উর্দু গদ্যসাহিত্যের প্রথম কেন্দ্রই কলকাতা। ফোর্ট ইউলিয়ম কলেজে উর্দু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কলকাতায় প্রথম উর্দু বই প্রকাশেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৮২২ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা থেকে উপমহাদেশের প্রথম উর্দু পত্রিকা জাম-এ-জাঁহানুমা (সাপ্তাহিক) প্রকাশিত হয়।

কলকাতার পাশাপাশি ঢাকায় আধুনিক ধারায় উর্দু কাব্যচর্চা শুরু হয় আঠারো শতকের শেষ দিকে। নবাব শামসউদ্দৌলার (১৭৭০-১৮৩১) পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় মির্জা জান তাপিশসহ বহু উর্দু কবির সমাগম ঘটে এবং ধীরে ধীরে উর্দু কাব্যের একটি নতুন গতিধারা সৃষ্টি হয়।

 

নবাব আবদুল লতিফের অনুজ আবু মুহাম্মদ আবদুল গফুর নাসসাখ উর্দু-ফারসিতে কবিতা রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকার বনেদি পরিবারের সন্তান মুনশি রহমান আলী তায়েশ (১৮২৩-১৯০৮) উর্দু কবি, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক ছিলেন। তাঁর প্রথম রচনা গুলযার-এ-নাত (১৮৮০) কানপুরের নিযামী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

 

সৈয়দ মুহম্মদ আযাদ (১৮৫০-১৯১৬) ঢাকার অপর জমিদার মীর আশরাফ আলীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। নওয়াব আবদুল লতিফ ছিলেন তার শ্বশুর এবং শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক তাঁর জামাতা। তিনিই প্রথম উর্দুতে নাটক রচনা করেন। স্বতন্ত্র ভঙ্গির প্রবন্ধ রচনা করেও তিনি খ্যাতি লাভ করেন।

 

হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭) উর্দু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ঢাকা মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করে দীর্ঘ এগারো বছর কানপুর, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি ও আগ্রায় চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং ‘শেফাউল মূলক’ (দেশের রোগমুক্তি) খেতাবে ভূষিত হন।

 

বাংলাদেশের উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। খাজা হায়দর জান, খাজা আসাদউদ্দীন কাওকাব, খাজা আবদুর রহিম সাবা (মৃত্যু ১৮৭১), খাজা আহসানউল্লাহ শাহীন, খাজা আতিকউল্লাহ শায়দা, খাজা মুহাম্মদ আফজাল(জন্ম ১৮৭৫), খাজা নাযিমউদ্দীন প্রমুখ উনিশ ও বিশ শতকে উভয় ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। খাজা মুহম্মদ আযম ইসলামী পঞ্চায়েত ঢাকা (১৯১১) নামক উর্দু পুস্তিকা রচনা করেন। তার পুত্র খাজা মুহম্মদ আদেল হাকীম হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন যাদু নামক মাসিক পত্রিকা। খাজা আবদুর রহিম সাবা দাস্তে সাবা (অপ্রকাশিত) নামে উর্দু কাব্য রচনা করেন। এর পান্ডুলিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ শাহীন (১৮৪৫-১৯০১) কুল্লিয়াত-ই-শাহীন নামে উর্দু কাব্য রচনা করেন।

 

নবাব আবদুল গনির দৌহিত্র এবং নবাব খাজা ইউসুফ খান বাহাদুরের পুত্র খাজা মুহাম্মদ আফজালের কাব্যগুরু ছিলেন কবি সৈয়দ মাহমুদ আযাদ। আফজাল উর্দু ও ফারসি উভয় ভাষাতেই গজল লিখেছেন। তিনি ঢাকা শহরে আবজাদ রীতিতে সন-তারিখ (Chronogram) রচনায় পারদর্শী ছিলেন।

 

উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ও ফারসি বিভাগের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল (১৯২১) থেকেই এখানে উর্দু ও ফারসি বিভাগ ছিল এবং প্রথমে ফারসি ও পরে উর্দু শিক্ষাদান আরম্ভ হয়। এ বিভাগটি তখন থেকেই উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিভাগের প্রথম অধ্যক্ষ খান বাহাদুর ফিদা আলী খান বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসের বস কে রোগ নামে উর্দু অনুবাদ প্রকাশ করেন। সৈয়দ ওয়াজাহাদ হোসেন আন্দালীব সাদানী (১৯০৪-১৯৬৯) এ বিভাগে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।উর্দু ভাষায় রচিত তাঁর একাধিক গ্রন্থের মধ্যে নিশাত-ই-রফতা (কাব্যগ্রন্থ), তাহকিক কী রওশনি মেঁ, সাচ্চি কাহানিয়াঁ, নুশ ওয়া নীশ, পায়াম-ই-ইকবাল, ইনশা-ই-আবুল ফযল (অনুবাদ), রুবাইয়াত-ই-বাবা তাহের (অনুবাদ) ইত্যাদি প্রধান।

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে রেজা আলী ওয়াহ্সত (১৮৮১-১৯৫৩) এবং সলিমউল্লাহ্ ফাহমিসহ বেশ কয়েকজন উর্দু কবি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং উর্দু সাহিত্যচর্চার প্রসার ঘটান। তখন নিয়মিত মুশায়রা (কবিতাপাঠের আসর) অনুষ্ঠিত হতো এবং নবীন কবিরা তাঁদের স্বরচিত উর্দু কবিতা পাঠ করতেন। রাহাত আরা বেগম, উম্মে আম্মারা, আহমদ সাদি, আশরাফ মাহ্পুরি, বেগম জয়নব তাসনিন, ইউসুফ আহ্মীর প্রমুখ উর্দুতে অনেক ছোটগল্পও রচনা করেছেন। এসব রচনা প্রকাশিত হতো খাওয়ার (ঢাকা, ১৯৫২), নাযীম (ঢাকা, ১৯৬০), কর্ণফুলি (চট্টগ্রাম, ১৯৬৭) এবং দবিস্তান-ই-মাশরিক (খুলনা) পত্রিকায়। উর্দুভাষী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য কয়েকটি উর্দু পত্রিকাও তখন প্রকাশিত হতো। সেগুলির মধ্যে ওয়াতন (ঢাকা, ১৯৪৭) ও পাসবান (ঢাকা, ১৯৪৭) উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ স্কুল-কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে একটি উর্দু বিভাগ থাকত। রেডিও পাকিস্তান থেকে খবর ছাড়া নাটকও প্রচারিত হতো। এ সময় থেকে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও উর্দুর পঠনপাঠন শুরু হয়।

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উর্দুর চর্চা অনেকটাই কমে যায়। বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে, গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখা সম্পর্কে আমরা আর খোঁজ প্রায় আমরা রাখছিলাম‌ই না, নব্বুই দশকে এসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আসাদ চৌধুরীর উদ্যোগে আমরা ঘরোয়া পরিবেশে আবার উর্দু সাহিত্যের খবর পেতে থাকি। সেইসময় খোঁজ পাই ন‌ওশাদ নূরী, আতাউর রহমান জামিল, জয়নুল আবেদীন, শামীম জামানভি, নাসির‌উদ্দিন ফাহমি, আহমদ ইলিয়াসের। ১৯৫২ সালে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আহমেদ ইলিয়াস; ১৯৭১ সালে তিনি ও তার মতাদর্শে বিশ্বাসীগণ নানাভাবে বাঙালিদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

 

অনেকে নির্যাতিতও হয়েছেন। বাঙালি মানেই যেমন মুক্তিযোদ্ধা নন, উর্দুভাষী বা বিহারি এমনকি চাকমা মানেই রাজাকার নয়। পাকিস্তানের লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আমরা এখন অনেকের নাম জানি, যাঁরা পাকিস্তান সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বর্তমান সরকার তাঁদের সম্মাননাও দিয়েছে। কাজেই পাকিস্তানের নাগরিক মানেই গণহত্যার সহযোগী নন।

 

এই কবিদের কবিতা বাংলাদেশে ছাপার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এগুলো ছাপা হয় মুম্বাই, দিল্লি ও লাহোরে। তবে এসব লেখার বিষয়বস্তু অবশ্যই বাংলাদেশ, তার সমাজ রাজনীতি জীবন আবহাওয়া ফল ফসল। ‌আহমেদ ইলিয়াসসহ বাংলাদেশের অন্যান্য প্রগতিশীল উর্দু কবি-সাহিত্যিকগণ ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয়দফার পক্ষে উর্দু কাগজ জারিদায় স্লোগান দিয়েছিল:”তেরে নাগাত, মেরে নাজাত ছে নুকতা ছে নুকতা” (তোমার মুক্তি, আমার মুক্তি ছয় দফা, ছয় দফা)।

 

আহমেদ ইলিয়াস সংবেদনশীল হৃদয়বাদী কবি। উর্দু কবিতার ধ্রুপদী ধারার মনোজাগতিক চেতনপ্রবাহী দর্শনের পথেই তিনি তার কবিতায় ভাস্বর। তার কবিতায় লক্ষ্য করা যাক:

…যখন পথ চলা শুরু করি
আমার সাথে ছিল শুধু পথ চলা
ছেড়ে এলাম ঘর যখন
আমার নাম ছিল, ছিল পরিচয়
আমার শব্দ ছিল, ছিল ভাষা
আমার অস্তিত্বের ছিল অংশ এরা, এরা ছিল সব;
এখন কোথায় এসে থেমেছি আমি
আশপাশে কোথাও কিছু নেই
জিভে নেই কোনো ভাষা
ঠোঁটের আড়ালে নেই কোনো শব্দ
এ কীসের খোঁজ আমার?
[তর্জমা: জাভেদ হুসেন]

কিংবা

এই জীবন, প্রতিদিন ভোরে কবর থেকে উঠে
প্রতি সন্ধ্যায় আবার সেই কবরে নেমে যাওয়া
[তর্জমা: জাভেদ হুসেন]

কিংবা:

আয়নার প্রতিবেশী কোনো পাথর ছিলাম না আমি
প্রিয়র রূপ কেন ভয় পায় আমাকে কী করে বলি
প্রেমের পাগলামিকে নিরন্তর দিয়ে গেছি প্রাণের নৈবেদ্য
শহরে যত ছিল বধ্যভূমি তার বেদিতলে
[তর্জমা: জাভেদ হুসেন]

বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্যের অনন্য কবি আহমেদ ইলিয়াস। তাঁকে আবার নতুন করে জানতে পারলাম মনন রেখা সাহিত্য কাগজের মাধ্যমে। আমি বলবো মনন রেখার সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম আহমেদ ইলিয়াসকে নতুন করে আবিষ্কার করে পাঠকের দরবারে তুলে ধরলেন। অসাধারণ একটি কাজ হয়েছে মনন রেখার আহমেদ ইলিয়াস সংখ্যাটিতে।

 

বাংলাদেশের উর্দুভাষী কবিদের পরিচয়ের মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক জাভেদ হুসেন কবি আহমেদ ইলিয়াসকে তুলে এনেছেন। আসাদ চৌধুরী সমকালীন সাহিত্যের খোঁজ নিবিড়ভাবে রাখেন, সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি বাংলাদেশের উর্দু কবি ও কবিতার অনুরক্ত। কবি আহমেদ ইলিয়াস তার পুরনো বন্ধু, বন্ধুর সংবর্ধনাতে তিনি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন বন্ধুকে নিয়ে, সে ভাষণটি এ-সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। মফিদুল হক “আহমেদ ইলিয়াস ও পার্টিশন সাহিত্য” নিয়ে লিখেছেন। দেশভাগের বেদনার ভারে কবি ও কবিতার মধ্য কীভাবে আহমেদ ইলিয়াস উঠে এলেন সেই নির্যাস রূপায়ন করেছেন মফিদুল হক তার এই রচনায়। অধ্যাপক খালিকুজ্জামান তার নিবিড় পর্যবেক্ষণে আহমেদ ইলিয়াসের প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছেন “আহমেদ ইলিয়াস: একজন সৎ বুদ্ধিজীবীর প্রতিকৃতি” নিবন্ধে।

 

এছাড়া আহমেদ ইলিয়াসে জীবন ও কবিতা নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন মননকুমার মণ্ডল, সিন মিম সাজিদ, এ. টি. এম. মোস্তফা কামাল, আলতাফ পারভেজ, মো. মেহেদী হাসান,রুখসানা কাজল, জহির হাসান, ফারুখ ওয়াসিফ, সামিউল ইসলাম, জাহিদুর রহিম, তসলিম হাসান, আসিফ আসলাম ফাররুখি, আব্দুল লতিফ, আতাউর রহমান জামিল। আহমেদ ইলিয়াসের গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেছেন মিজানুর রহমান নাসিম, পিয়াস মজিদ। আহমেদ ইলিয়াস উপর লিখিত প্রবন্ধ;একটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন গৌরাঙ্গ হালদার;‌ এছাড়া একাধিক উর্দু প্রবন্ধ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সালাম হামিদী, জাভেদ হুসেন, মাজদার হোসাইন।

 

কবি আহমেদ ইলিয়াস বিভিন্ন সময় প্রবন্ধ লিখেছেন, সেই প্রবন্ধ থেকে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপর রচিত দুটো লেখা এই সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছে। আহমেদ ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে এই সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ পারভেজ ও মাজহার জীবন। এ সাক্ষাৎকারে আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা লেখা, জীবন ও ব্যক্তিত্ব প্রগাঢ় শক্তি নিয়ে উপস্থিত। এছাড়া এ সংখ্যায় বাংলাদেশের অন্যতম উর্দু কবি শামীম জামানভি কবি আহমেদ ইলিয়াস প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ পারভেজ, মাজহার জীবন ও জাভেদ হুসেন। এ সাক্ষাৎকারেও আহমেদ ইলিয়াসের মানস স্পষ্ট।

 

আহমেদ ইলিয়াসের ইংরেজিতে লেখা আত্মজীবনী The World I Saw : Memories of A Commoner একটি অসাধারণ স্মৃতিকথা। তাঁর শিল্পমানস অনুধাবনে অসাধারণ একটি জীবনী। মনন রেখার জন্য অনুবাদ করেছেন আশানুর রহমান। এ-সংখ্যায় আরেকটি চমৎকার সংযোজন জাভেদ হুসেনের ভাষান্তরে আহমেদ ইলিয়াসের নির্বাচিত কবিতা। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি আয়োজন মনন রেখার এই আহমেদ ইলিয়াস সংখ্যাটি।

 

আমরা মনি করি ভাষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক‌ই ভাষাবর্গের শাখাগুলোর পাশাপাশি অবস্থানের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক ভাষার‌ই পরিপুষ্ট ঘটে, ঘটে বিবর্তন, বিকাশ ও সাহিত্য সৃজনের অনন্য সংবেদন। তাই বাংলাদেশের মূল ধারার সাহিত্য তথা বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের তুলনামূলক সৃজনী অব্যাহত এবং এই ভাষা ও সাহিত্যের চেতনার সহযোগী বোধ ও বোধির বিকাশে আঞ্চলিক, আদিবাসী ও সহযোগী ভাষাসমূহের বিকাশের পথ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে উর্দু ভাষার সাহিত্য চর্চা ও পরিসরের প্রতি আমাদের সহমর্মি আচরণে সে ভাষার বিকাশে আমাদের পাশে থাকা উচিত। আমি মনে করি মনন রেখা সে দায়িত্ব পালন করেছে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here