একটা চাকরিই তো, গেলে যাক না — এমন একটা ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে কত শতদিন। তারপর বুকের ভেতর ক্ষতগুলো বরফ গলা জলের মতন শিরশির করলে মনে হয়, যে-জীবন গোলামির তার সাথে যেন কারো না হয় দেখা। অথচ কখনওই মনে হয় নাই এই জীবন দিয়া কী করব? কেবল একটা চাকরি মাথার ভেতর গ্যাঞ্জাম পাকালে চরম সুখ সুখ উত্তেজনাগুলো আপনাআপনি স্তিমিত হয়, যেন হাওয়াইমিঠাই মুখে দিতে না দিতেই শ্যাষ। সুখ সুখ উত্তেজনা বলতে ভাইয়ের শালি নাদিরাকে নিয়ে কিছু অলস স্মৃতি। অলস স্মৃতি নাকি অলস কল্পনা কি বলা যায় এইটারে? যেইখানে নাদিরা কোনোদিন হাইহিলপরা ছিপছিপে শরীরটা নিয়ে বলে নাই, চলো মোখলেস ভাই, আজ স্টার কাবাব থেকে কাচ্চি না হয় চিকেন টিকেন গ্রিল খেয়ে আসি। কিংবা আধা আধা আন্ধারে ধানমন্ডির ভ‚ত থেকে খেয়ে আসি। অথচ আমি এইরকম একটা শিরশিরানি ভাবনা মনের ভেতর পুষি, মাঝে মাঝে ভাবনায় হাত বুলিয়ে ঘ্রাণ নিই। তারপর শিরশিরানি ভাবনা ভেগে গেলে নাদিরাকে কেবল ফেসবুকে দেখি আর হোপলেস হই।
চাকরিটা যখন তখন চলে যেতে পারে এমন একটা ভয় মনের ভেতর নিয়ে ছয়টা মাস পার হয়ে গেল তারপরও চাকরিটা থাকল। চাকরি যাওয়ার এই ভাবনাটা একদিকে আর নাদিরার প্রতি গোপন আহ্লাদ আরেকদিকে। এই দুইয়ের টানাটানি ভেতরে ভেতরে কেবল পাক খায়, জল ঘোলা করে ফলে ঘোলা জল আর পান করা হয় না। বলা হয় না নাদিরা চলো ৩০০ ফিট থেকে ঘুরে আসি। ফলে সব কথা আর উত্তেজনা কেবল কোলবালিশ ঘিরে থাকে। অথচ নাদিরাকে বলে দিলে এতদিন কোলবালিশের জায়গায় নাদিরাও থাকতে পারত।
আহা! পেনসিলের মতো সরু হাইহিল পরে টকাসটকাস করে হাঁটা নাদিরা, জিহ্বায় চোৎচোৎ আওয়াজ করে কথা বলা নাদিরা। কী জলি মাইন্ড!
সেদিন হঠাৎ দেখি বান্ধবীদের সাথে ফুচকা খাচ্ছিল ধানমন্ডি লেকে। ঠোঁট গোল করে কী এক কায়দায় ফুচকার প্লেট থেকে তেঁতুলের তরল টক এমন করে খেলোআহা! দেখেই সুখ। তেতুলের টক, ফুচকার বাটি, নাদিরার ঠোঁট। কোনোটাই হওয়া আমার হয় নাই। নাদিরাকে বলা হয় নাইতোমার নাক ঘামে ক্যান? তাকে এই না-বলতে পারার আহাজারিটা বুকের ভেতর গুমোট হয়ে থাকলে কেবল মনে হয় নারী বসকে গুম করে ফেললে শান্তি হতো। নয়টা-পাঁচটা অফিসের সকাল এগারটায় অফিসের প্রায় সব এমপ্লয়ি ক্যান্টিনে যায়, চা, বিড়ি খায়। অথচ আমার যাওয়া হয় না। কয়েকদিন যাওয়ার জন্য এটেম্প্ট নেওয়ার সময় হুট করে নারী বস একটা কাজ ধরায়া দেয়।
এগারটার সময় প্রত্যেকদিন একইরকম ঘটতে থাকলে চাকরির পাছায় লাত্থি মারতে ইচ্ছা করেছিল। আসলে ইচ্ছা করেছিল নারী বসরে পাছায় লাত্থি মারতে। কিন্তু নারী হওয়াতে সেই ইচ্ছাটা জমাট হয় নাই। ফলে চাকরিটার পাছাতেই লাত্থি মারতে ইচ্ছা করে। অফিসে জয়েন করার পর থেকেই কানাকানি এই নারী বসের আন্ডারে কেউ বেশিদিন টেকে না। টেকে না টেকে না করে আমি ছয় মাস পার করলাম। পার না করে উপায়ও ছিল না। ভাই-ভাবীর সংসারে শুয়ে বসে খাওয়ার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। তখন কেবলই মনে হয়, ভাবীর ছোটবোন নাদিরার সাথে যদি তার বিয়ে হতো তাহলে কি ভাবী এমন খাউস খাউস করতে পারতো?
আপনারা আমার সাথে এমন করেন ক্যান — নারী বস্ কিংবা ভাবী কাউরেই এটা বলার অনেক চেষ্টা করেও মুখ ফুটে যখন বলা হল না তখন মনে মনে অসংখ্যবার এটা বলা হয়ে গেছে। মনে মনে বলা এই ব্যাপারটা নিয়ে তখন ভাবনা চিন্তা শুরু হয় এবং মনে হয় এটা মন্দ না। তখন আরও মনে হয় কোনো এককালে মানুষের তো মুখের ভাষা ছিল না। ভাষা ছিল না আমার মুখেও ওইসব দিনে যখন ক্লাশে স্যার জিজ্ঞাসা করতো, এটা কে পারবে। আমি কোনদিন হাত তুলি নাই, কিংবা পড়া বলি নাই। অথচ কোনো কোনো দিন পড়াটা আমার জানা ছিল। আমার কেবলই মনে হতো পারলেই কি বলতে হবে? কিংবা একটা ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করতো। তো সেই কালটা যদি আবার নেমে আসে। ধরা যাক হুট করে একদিন মানুষের মুখ থেকে ভাষা উধাও হয়ে গেল। এই ভাবনাটার ভেতরেও নারী বস এসে উঁকি মারে আর তখন মনে মনে কথা চলে, ভাগেন, আমার সামনে থেকে ভাগেন।
এটা বলার পর অনেকটা রিলিফ বোধ হয়। আর তখন মনে হয় পুরো পৃথিবী থেকে ভাষা উধাও না হলেও আমার পৃথিবী থেকে উধাও হতে পারে।আর তখন আবার নারী বস উঁকি দিলে মনে মনে কথা চলে, আপনি এমন চুন্নি ক্যান? পারমশিন ছাড়া আরেকজনের রুমে ঊঁকি মারেন, আপনি একটা চুন্নি মাগী।
এটা বলার পর সিদ্ধান্তটা নিতে আর কোনো প্রবলেম হয় না। তখন থেকে আমি নারী বসের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। নারী বসের সাথে কথা বন্ধ কাজটা খুব সহজ ছিল না। কথা বন্ধের দিনগুলোতে নারী বস আমার সাথে খাউস খাউস করা বাড়িয়ে দেয়। নারী বস যতই খাউস খাউস করে আমি ততই তাকে মনে মনে গাইল দিতে থাকি। আর ওইসব দিনে আমি চ্যাপলিনের নির্বাক সিনেমা দেখা শুরু করি। এমনি করে কয়েকদিন চলার পর নারী বস আমাকে তার রুমে তলব করে। সময় তখন এগারটা মানে যে-সময় চা, বিড়ির জন্য সবাই ক্যান্টিনে যায়।।
বস : আপনার সমস্যাটা কী?
আমি মনে মনে বলি, তুই।
বস : কী ব্যাপার চুপ করে আছেন কেন?
আমি মনে মনে বলি, আমি তো ঠিকই কথা বলতেছি, তুই শুনতে পাবি না।
বস : আপনার নামে আমি কমপ্লিন করব?
আমি মনে মনে বলি, তুই যা খুশি কর।
বস : আপনি কি চান আপনার চাকরি খাই?
আমি মনে মনে বলি, দুনিয়ায় তো তোর খাওয়ার জিনিস একটাই।
তখন নারী বস্ আমার মুখ থেকে কোন কথা ঝরাতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে বলে, আই উইল সি ইউ…
আমি ড্যাবড্যাব করে চিড়িয়া দেখার ভান করে বসকে দেখতে থাকি। তখন বস উকুশফুকুশ করতে করতে — গেট লস্ট ইংরেজি মারে।
আমি নারী বসের রুম থেকে বের হয়ে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে নতুনভাবে আবিস্কার করি। তখন মনে হতে থাকে আমার অসুখী হওয়ার দিন শেষ।
পরদিন নারী বস আবার আমাকে তার রুমে ডাকে আগের দিনের কথাগুলো বলে আর আমি চুপচাপ মনে মনে তাকে ভ্যাংচাই তারপর সে — গেট লস্ট বললে রুম থেকে সুখ নিয়ে বের হয়ে যাই।
এভাবে টানা বেশ কয়েকদিন দিন নারী বস আমাকে ডাকে আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। তারপর একদিন হঠাৎ করে নারী বস আর ডাকে না। প্রতিদিন এগারটায় আমি নারী বসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু নারী বস্ আর ডাকে না। এভাবে বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেলে বস যখন আর তার রুমে ডাকে না তখন নারী বসের জন্য আমার মনে এক ধরনের চিনচিনে দুখ দুখ ভাব জাগে। কিন্তু আমি যেহেতু ঠিক করেছি যে, নারী বসের সাথে কথা বলব না তাই তাকে জিজ্ঞাসাও করতে পারি না।
আর তখন ব্যাপারটা আমাকে আবার অসুখী করতে থাকে। এমনই একরাতে আমি যখন নারী বসের প্রবলেম কী হতে পারে এমনটা ভাবছি তখন আমার মনে একটা কথা বারবার ঘুরপাক খায় যে, নারী বস কাল এগারটায় আবার আমাকে ডাকবে।
পরদিন বেলা এগারটা বাজার জন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকি। বস আমাকে ডাকবে এটা যেমন একটা ব্যাপার ঠিক তেমনি আমার ভাবনাটা সঠিক কিনা সেটা যাচাই করা আরেকটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সময় যতই এগারটার দিকে গড়াতে থাকে আমার বুকের ডিবাডিবানি ওই দিনগুলোর মতো আবার বাড়তে থাকে, যে-দিনগুলোতে চাকরি যাওয়ার ভয়ে থাকতাম। এমন ডিবডিবানি ভরা মন নিয়ে আমি যখন কাঁপছি তখন সময় এগারটা আর নারী বস আমাকে তার রুমে ডাকে। আমার ডিবডিবানিটা আরও বাড়ে এবং আমি বুঝতে পারি যে, নারী বস যে-কথাগুলো বলবে তা আমার মনে উথালপাথাল করতে থাকে। এবং সেটাই ঘটে যখন নারী বস আমাকে সত্যি বলে। ভেতরের ডিবডিবানিটা আরও বাড়ে যখন নারী বসের কথাগুলো আমার ভাবনার জগতের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
এই ঘটনাটার পর আমি অনেকের সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দেই। তখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, মোবাইল ফোনটার আর কোনো দরকার পড়ে না। এভাবে যখন দিন পার হচ্ছিল, পৃথিবী তার নিয়ম মতোই ঘুরছিল তখন আমার মুখ থেকে কথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং আশেপাশের যে-মানুষগুলোর আমার সাথে টুকটাক কথা বলার প্রয়োজন পড়ে তাদের কথা মনে মনে ভাবি যেন তারা আমাকে যা বলবে কিংবা বলতে চায় সেটা আমি আগেই করে ফেলতে পারি। কিংবা তাদের মনের ভাবনা ধরার চেষ্টা করি। তখন নারী বসের কথা ভাবতে থাকি যে, হঠাৎ কেন তার আচরণ পাল্টে গেল। আর তখন নারী বস তার সমস্ত ভাবনা নিয়ে আমার মনে হাজির হলে দেখি, নারী বসের সাথে যে-ছেলেটার ফেসবুকে গোপন কাহিনি চলছিল সেটা তার স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যায়। এটা নিয়ে নারী বস আর তার স্বামীর মধ্যে একটা ক্যাওমেও চলছিল। এই ক্যাওমেওচলা দিনগুলোতে নারী বসের হম্বিতম্বি হাওয়া হয়ে যায়। নারী বসের জন্য তখন আমার দুখ দুখ লাগে আর তার কাহিনিটা তখন ভাবতে ভালো লাগে না। এরপর নারী বস আমাকে আর ডাকে না এবং আমিও নারী বসে রুমে যাওয়া বন্ধ করে দেই। তারচেয়ে বরং আমার নাদিরাকে নিয়ে ভাবতে ভালোলাগে।
নাদিরা, চলো আজ তোমারে ধানমন্ডি লেকে তেঁতুলের টক দিয়ে ফুচকা খাওয়াবো। আহা! নাকের বিন্দুবৎ ঘাম থাকুক না নাদিরা! নাদিরার নাকের বিন্দু বিন্দু ঘামও কি তেঁতুলের মতো টক! এমন আবোলতাবোল অনেককিছু ভাবতে ভাবতে মনে হয় নাদিরার মনে একটু ঢোকা যাক। কিন্তু তখন আমার ভয় ভয় লাগে। ওইসব দিনের মতো ভয় যখন ক্লাশে পড়া মুখস্ত থাকার পরও কোনদিন হাত তুলি নাই। ভয় লাগে যদি দেখি নাদিরা অন্যকারো সাথে প্রেম করে। তখন আবার নিজেরে বুঝ দেই, এমন সুন্দরী একটা মেয়ে তা করুক না প্রেম তাতে কী আসে যায়!
অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও নাদিরার মনে ঢুঁ মারা যাচ্ছিল না। তখন মনে মনে ভাবি,নাদিরার মনে ঢোকা এত সহজ না। তখন আরও মনে হয় নাদিরার সাথে বেশ কিছুদিন হলো দেখা হয় না। তার মনের ভেতর যাওয়ার জন্য তাকে নিয়ে আরও গভীর ভাবনায় যাওয়া দরকার। কিংবা এমন পার্টটাইম ভাবে নাদিরার মনে ঢোকা সম্ভব না। তখন আমি ভাবির মনে ঢোকার চেষ্টা করি। এবং খুব সহজে ভাবীর মনের খবর পাই। ভাবি অসুখী মানুষ। তার স্বামীকে নিয়ে সবসময় একটা সন্দেহের মধ্যে থাকে। তার এই নারীবিষয়ক সন্দেহ করার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না ফলে ভাবীর ভাবনা থেকে বের হয়ে যাই।
আর তখন ইচ্ছে করে ভাইয়ের ভেতর যেতে। ভাইয়ের মনে ভাবির থলথলে চর্বিঅলা পেটটা বড়ই ঘৃণার বস্তু। ভাবির খাউস খাউস স্বভাবের জন্য ভাবনাটার এই পর্যন্ত মজা পাচ্ছিলাম। তারপর ভাইয়ের মনের আরেকটু অতলে ঢু মারলে আমি তব্দা খাই। মানুষের সাথে অনেক আগেই কথা প্রায় বন্ধ করেছিলাম। সেদিনের পর থেকে আমি আর কখনওই কথা বলি নাই যখন আমার ভাইয়ের মনে নাদিরাকে নিয়ে কামনার জগত দেখি। এটা সত্য নয় কিংবা অন্যকিছু এমন একটা ব্যাখ্যা জোর করে আমার মনের ভেতর আনার চেষ্টা করতে করতে একদিন আমি নাদিরার মনে ঢুকে পড়ি। তারপর থেকে আমি আর কোনোদিন নাদিরাকে নিয়ে ভাবি নাই এমনকি কারো সাথে কথাও বলি নাই। আমার মতো কতো মানুষ কথা বলে না তাতে কার কী আসে যায়!