আহমেদ ইলিয়াস ও তাঁর দুটো কবিতা

সূত্র : বার্তা ২৪ ডট কম

আহমেদ ইলিয়াস বাংলাদেশের উর্দু ভাষার কবি। প্রবীণ এই কবির দুটি কবিতার অনুবাদ করেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক খুরশীদ আলম বাবু। জুড়ে দিয়েছেন একটি ভূমিকা — যা আহমদ ইলিয়াসকে চিনিয়ে দেবে স্বল্প পরিসরে।

 

বেশ কিছুদিন আগে একজন সমালোচক ও অনুবাদক আহমেদ ইলিয়াসকে ‘‘নীড়হারা বাংলাদেশের উর্দু কবিতার বুলবুল’’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন ― সেই উপাধি আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিলো। বাংলাদেশে অবস্থান করেই উর্দু কবিতা লেখা সত্যিই এখন একটি দুরূহু সাধনার কাজ। অথচ আহমেদ ইলিয়াস সেই কাজটি দ্বিধাহীন চিত্তে করে গেছেন। প্রথমে স্বীকার করি ― বাঙালি মুসলমান হিসেবে উর্দু কবিতার বিষয় আশয় নিয়ে কোনদিন গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করিনি। আমার দুর্ভাগ্য যে মানুষটি পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল কবিতার পেছনে নিজেকে লিপ্ত রেখেছেন, তার সম্পর্কে আমরা জানার আগ্রহ বোধ করিনি।

 

এর পেছনে অপরাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে, সেটা স্বীকার করতে এখন আর দ্বিধা করিনা। তবে এই না চেনা-না জানার জন্য দুই পক্ষই দায়ী। অনেক দিন আগে প্রয়াত কবি সমালোচক হুমায়ুন আজাদ একসময় খুব দারুণ মন্তব্য করেছিলেন এই বলে ― উর্দু আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে গেল যখন আমরা উর্দু শুনতাম জেনারেলদের মুখে। আহমেদ ইলিয়াসকে বুঝতে হলে তার লেখা দুটি আত্মজীবনী A Long Walk I ও The World I Saw মনোযোগ দিয়ে পড়া জরুরি হয়ে পড়বে। কারণ আহমদ ইলিয়াস মনেপ্রাণে একজন কবি বলেই দেশ হারানোর বেদনার বিধুরতা তার অনেক কবিতার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে।

 

তবে আমরা খুশি এই কারণে, সেই বেদনাবোধকে কখনো স্লোগানে রপান্তরিত করেন নি। আর এই জন্য তিনি জীবনের প্রথম পাঠ থেকেই প্রখ্যাত উর্দু বামবাদী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে অনুসরণ করেছেন। ফলে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য গজলে দেখা যায় আহমেদ ইলিয়াস অনেক বেশি রোমান্টিক। তবে রোমান্টিকতার মাত্রাজ্ঞান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। আবার তাঁর কবিতা শেষাবধি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকেও এড়িয়ে গিয়েছে, আর এটি উপার্জিত হয়েছে তার দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে।

 

আসলে তিনি মুষড়ে পড়েন যখন তিনি ভাবেন ― তাঁর কোন নাগরিকত্ব নেই। এত বড় বেদনার কথা বাংলাদেশের আর কোন উর্দু কবি বলতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই, যখন তিনি বলে ওঠেন আমি “নিজের ঘরে সেই আমি/ সব আমন্ত্রণকারীরা ভুলে গেছে” (অনুবাদ : জাভেদ হুসেন)। তবে একজন কবি সব সময় দুঃখের দাসত্ব করবেন সেই রকম ভাবনা করা ঠিক হবে না। তিনিও একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (“আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভূবন ভরা” গানটির কথা স্মরণ রেখে) মত বলে ওঠেন — “রওশনী তেরে লিয়ে মেরে লিয়ে/ রওশনী দিন কে লিয়ে, শব কে লিয়ে/ বন্দ আখোঁ কে লিয়ে, খুলতে হুয়ে লব কে লিয়ে/ রওশনী সব কে লিয়ে।”

 

তখন স্বভাবত আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা কেন পড়বো? পড়বে এই কারণে, বলছি সূত্রাকারে ― ১. আহমেদ ইলিয়াস হলো সেই জাতের কবি যাঁরা কবিতায় সরাসরি কথা বলাকে পছন্দ করেন না। পৃথিবীর প্রত্যেক বড় বড় কবিদের মধ্যে এই দীপ্র চেতনা লক্ষ্য করা যায়। ইলিয়াস মনে করেন তিনি অচেনা পথের কথিক, তার কোনো পথ ছিলোনা। সেই বেদনা বোধকে সহজ ভাষায় কবিতায় রূপায়ণ করেছেন। তবে আশাবাদ যে নেই সেটা বলা যায় না। ২. ইলিয়াসকে বলা হয় বামধারার কবি, কারণ তিনি কর্মসূত্রে পাকিস্তানের ইকবাল-পরবর্তী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবুও শ্লোগানের পরিবর্তে কাজকে আশ্রয় দিয়েছেন প্রতীকের ভেতরদেশে। সেই অর্থে তিনি একজন সফল প্রতীকবাদী কবি।

 

সেই জন্য তাঁর কবিতা পাঠ কালে পাঠককে হতে হয় খানিকটা জ্ঞানী ও সেই সাথে ঐতিহ্যের অনুসারী। এই সময়কার একজন সমালোচক যথার্থই বলেছেন, “আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা উর্দু সাহিত্যের পরম্পরায় শক্ত করে শিকড় গেড়ে আছে। কিন্তু তাতে সুরা, সাকি বা শরাবখানা আসে কদাচিৎ। কিন্তু বিপরীত ওয়ায়িজ, মোহতাসিব, মরু, তৃষ্ণা, ক্ষত পায়ে বিরানভূমিতে পথ খুঁজে ফেরা আসে বারবার। এই সবই প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের মজমুন বা বিষয় রূপান্তরের ধারাবহিকতা।”

 

অনূদিত দুটি কবিতা সম্পর্কে এইটুকু বলা যায় ― একজন উর্দু ভাষার অধ্যাপকের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। তবে অনুবাদ কেমন হয়েছে সেটা বলা আমার কাজ নয়, পাঠকরাই বলবেন। তবে এটা বলতে পারি যে, চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি।

 

ধূসরিত পদযুগল

আমরা এমন বৃক্ষ ছিলাম

রৌদ্র ছিলো বটে
মাথার উপর ছিলো না তার ছায়া
কঠোর কঠিন নীল সুরুজের কায়া
দৃষ্টি শূন্যাহত
পুড়লো গাছের সবুজ পাতা
জমলো বুকে ক্ষতের খাতা
সইলো আঘাত ক্রমাগত।
জমলো মনে তীক্ষ্ণ তাপের রেখা
খুঁজেই তারা হলো সারা
পেল না হায়! সেই পথিকের দেখা।

 

আমরা কেমন বৃক্ষ ছিলাম
সেই চিন্তাই হইনি চিন্তাময়
সেটাই আমার ভয় —
পথিক যখন তাপের জ্বালায়
ছায়া পাবার দীপ্র আশায়
আসবে যখন ছায়ার তলে —

 

আবার যখন যাবে চলে —
আমরা এখন কোথায় যাবো? আমরা তো হায়!
সেই বৃক্ষ ছিলোনা তার ঠাঁই।

 

ঝড়

তাহলে কি সেই থামলো দীপ্র ঝড়?
যার ভয়ে এই চক্ষুযুগল হয়েছিলো
থরোথর —
তামসী করুন মন —
খুলেনি ঘরের বন্ধ দুয়ার।
খুলেছে কি বাতায়ন?
ভিড়েছে কি সেই মাল্লার সারি মেঘনার বুকে —
যারা চলেছিলো উর্মীমালার মুখে।

 

ফিরেছে কি সেই পৌঢ় মাল্লা বিক্ষত মুসাফির?
যারা ছিলো ধাবমান —
সেই রাস্তার পরে
তারাও ফিরেছে ঘরে
বুকের ভেতরে ভেসেছে আবার নতুন আশার গান।
শান্ত এখন মেঘনার সব তীর —

 

তাহলে আমার চক্ষুযুগল বন্ধ রাখার নেই কোন প্রয়োজন
খুলবে এবার বন্ধ দুয়ার
অবারিত বাতায়ন
থেমেছে যখন শেষ নির্মম ঝড় —
বইছে এবার মৃদ-মন্দ হাওয়া —
নতুন আশার পাল খুলে আজ আমার এগিয়ে যাওয়া।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here