অন্যমনস্ক দিনগুলি ।। কিস্তি : ৪

এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এই মুহূর্তের গল্প; যে গল্পের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। চমৎকার ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র। এই গল্প নিশ্চিতভাবে টেনে নেবে আপনাকে। কারণ আপনিও সম্ভবত জড়িয়ে আছেন এই উপন্যাসের সঙ্গে।

 

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল আমার। শরীরে দারুণ অস্বস্তি, মাথাটাও ধরে আছে। লজ্জা আর অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে আছে। অস্বস্তি নিয়েই শুয়ে থাকলাম। মনে হলো, একটা দুষ্টচক্রের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। ওই লোকের সঙ্গে আর যাওয়া যাবে না। বার বার মনে হচ্ছিল রাতে আমি বোধহয় কিছু হারিয়ে ফেলেছি। অথবা রেখার সঙ্গে খারাপ কোনো আচরণ করেছি। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি এসব ভাবতে ভাবতে। এরপর আবার কখনো ঘুম চলে আসছে। পানি খেলাম কয়েকবার। সকাল দশটার দিকে কিছুটা সুস্থ বোধ করলাম। উঠে বাথরুমে গেলাম। আবার শুয়ে পড়লাম।

 

বারটার দিকে ঘুম ভাঙল। রেখা এসে দেখে গেল। উঠে নাশতা খেতে বলল। ধীরে ধীরে নিজেকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকলাম। কোথাও কোনো ভুল করেছি কি না বুঝতে চাইলাম। রেখার দিক থেকে তেমন কোনো আপত্তি আসল না। নাশতা করে আবার শুয়ে থাকলাম। উঠে গোসল করলাম। কারো সঙ্গে কথা বলছি না। শ্যামলী এসে দেখে গেল কয়েকবার। ছি ছি মেয়েটা কী ভাববে, তার দুলাভাই মদ্যপ! রাফাকে একবার দেখে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। রেখা এসে পাশে বসল। শরীর খারাপ কি না জানতে চাইলো। কাল রাতে আমি স্বাভাবিকভাবেই বাসায় এসেছি জানালো। এসে শুয়ে পড়ে আর খেতে উঠিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এসব শুনে আস্বস্ত হলাম। শুয়ে শুয়ে সময় পার করে দিলাম। রোকনের কথা মনে আসলেই গা গুলিয়ে যাচ্ছিল।

 

কী সব যে সে বলল আমাকে। সহ্য করার মতো না। আমি আওয়ামী লীগ করলেও অন্ধ নই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসেই অন্যতম বৈপ্লবিক একটা ঘটনা। সেই ঘটনার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। এসব নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। বেসিক জায়গা যদি ঠিক না থাকে একটা জাতি আগাতে পারে না। এদের কারণে আমাদের বেসিক একটা কনসেপ্ট এখনো তৈরি হলো না। এরা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে। সবসময় আওয়ামী লীগেরই সমালোচনা করবে। দেশটা যে স্বাধীন করল আওয়ামী লীগ, তাদের কথা বলার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার, সব কিছু করার, একটা পরিচয় যে তুল দিল সেসব অস্বীকার করবে আর আওয়ামী লীগেরই সমালোচনা করবে সেটা তো মেনে নেয়া যায় না। তার এসব কথা যত ভাবছিলাম তত যেন অনুশোচনা হচ্ছিল। কেন গেলাম লোকটার কাছে, কেন গেলাম মদ খেতে?

 

তাই আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। যে কোনো ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে মদ খাওয়ার পাপ আর রোকনের কথাগুলো। এভাবে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। উঠে দুপুরের খাবার খেলাম। আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমাব ভাবছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। জলির কথা মনে পড়ছিল। ওর প্রতি আমার একটা চোরা টান ছিল। কিন্তু সে কখনো আমার কাছে ধরা দেয় নাই। আমাকে একান্ত করে চায় নাই। অথচ সে আমাকে সমস্ত রকমভাবে প্রলুব্ধ করে গেছে। আমাকে পাশের রুমে রেখে সে তার প্রেমিককে নিয়ে শুয়েছে। আমি তার অভিসারের পাহারাদার ছিলাম। তার সম্পর্ক ভেঙে গেলে আমার বুকে মাথা দিয়ে কেঁদেছে। কিন্তু আবার তার নতুন সম্পর্ক তৈরি হলে এর গোলাপ ফুলটা আমাকেই কিনে আনতে হয়েছে। এ এক যুক্তি-তর্ক-বিবেচনাবিহীন সম্পর্ক। এত কিছুর পরও আমি জলির দিকে কামনার চোখে তাকিয়েছি। সেও আমাকে ইশারা করেছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছু হয় নাই। জলির কথা ভাবতে ভাবতে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠতাম তখন।

 

জলি ছিল মোটামুটি উচ্চতার একটা মেয়ে, তীক্ষ্ণ চিবুকের কারণে তার চেহারাটা ছিল ধারাল। চোখ দিয়ে সে মাঝে মাঝে এমন ইশারা করত, তাতে মনে হতো শরীরের গোপন কোনো অঙ্গ দিয়ে যেন সে আমাকে দেখছে। আমি কেঁপে কেঁপে উঠতাম তাকে ভাবতে ভাবতে। নির্জন দুপুরে হলের বাথরুমে গিয়ে হাত চালাতাম। চোখ বন্ধ করেও আমি জলিকে দেখতে পেতাম না। শুধু ভাবতে থাকতাম তার কথা। জলির সঙ্গম ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে আমার কাছে আসত। এলো চুল পড়ে থাকতো ঘাড় ও বুকের ওপর। আর ওর গায়ে যেন ছিল কাঠগোলাপের গন্ধ। উপচে পড়া বুক। ওহ! আমার ক্ষরণ হয়ে যেত সমস্ত না-পাওয়ার বেদনাকে জয় করে। এসব ভেবে আরো ক্লান্ত হয়ে গেলাম। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমও চলে এল। ঘুম আসার আগে ভাবলাম আমাকে ডায়েরিটা লিখতে হবে।

 

কিন্তু কী লেখব? আমার তো লেখার অভ্যাস নাই। কখনো এক কলম লেখি নাই। লেখতে বসব কখনো ভাবি নাই। এখন ডায়রিটা আমাকে বার বার যেন ডাকছে লেখার জন্য। ডায়রির সাদা পাতাগুলোকে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। আমার সেসব ফেলে আসা দিন, যেগুলো আর ফিরে পাওয়া হবে না। আমরা কয়েকজন ছাড়া যার কথা কেউ জানবে না কত ঘটনা, কত অজস্র ক্ষণ, প্রেম, যৌনতা। লিখে রাখলে অন্তত সেসব ঘটনার একটা ডকুমেন্টারি হবে। না লিখলেই বা কি। কেউ তো জিজ্ঞেস করতে আসবে না — কী ঘটেছিল সেসব দিনে। কারা কারা ছিল আমার সঙ্গে। তাদের কার সঙ্গে কী করেছিলাম আমি। কতটা অধপতনে গিয়েছিলাম, কতটা উচ্ছল ছিলাম তখন! আর এখনকার আমি! আমার এখন জীবনটাই কেমন ম্যারম্যারা। দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকছি। বউকে সন্দেহ করছি। সে ওপর তলার এক পুরুষের সঙ্গে প্রেম করে যাচ্ছে। আমি কী করব?

 

আমি মানুষের সঙ্গে তেমন মিশতে পারি না। কাউকে পটাতে পারি না। আমি দেখতে খারাপ নই। কথাও বলতে পারি ভালো যদি শুরু করি। তারপরও কখনো এমন হয় নাই যে আমি কাউকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করতে পেরেছি। যা বুঝলাম আসলে এ লকডাউনের কয়দিনে, আমার নিজের ভেতরেই আমার দুনিয়াটা সবচেয়ে বড়। সেখানে যত কিছু ঘটে, সংসার জীবনে তত কিছু ঘটাতে পারি না আমি। নিজেকে আমি প্রকাশ করতে পারি না তেমন। কেমন জবুথবু হয়ে থাকি। সেই হিসাবে লিখতে কিন্তু আমি পারিই।

 

জলি বলেছিল, লেখবি মানে তুই নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবি। যেগুলো মুখে কাউকে বলতে তোর লজ্জা করবে সেগুলো লেখবি। বানিয়ে বানিয়ে লেখবি। যা ঘটে নাই তা লেখবি। কাউকে তোর খুন করতে ইচ্ছা হলে খুন করে ফেলবি লিখে লিখে, লাগাতে চাইলে লাগাবি। তুই যদি কমিউনিস্ট হস তাহলে কাজের ছেলে হয়ে কোটিপতির মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবি, যদি প্রগতিশীল হস তাহলে মৌলবাদীর মেয়েকে পটাবি — লেখাই হবে তোর রাজ্য। লেখতে তোরে হবেই বন্ধু।

 

জলি আমাকে বন্ধু ডাকত বা ফুয়াদ বন্ধু বলত। আহ্লাদ করত আমার সঙ্গে। কিছু চাইতে দ্বিধা করত না। এমনকি টাকাও না। আমি তেমন খরচ করার মতো লোক ছিলাম না, টাকার অভাবও ছিল না। মোটামুটি জমা করার একটা অভ্যাস আমার ছিল সবসময়। জলি আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার প্রেমিকদের দিত। আর কখনো সেসব টাকা আমি ফেরত পাই নাই। টাকা পাওয়ার কথা আমি ভাবিও নাই। ভাবছিলাম জলিকে পাব। ওকে পাব বলে টাকা ধার দিতাম, সময় দিতাম। কিছুই আর ফেরত পাওয়া হলো না আমার। শুধু সেই সূবর্ণ সময়গুলোই পাওনা। সেগুলো ডায়রিতে বাঁধাই করে রাখার একটা অবসর তো আমার আছেই এখন অফুরান।

 

জলি আমাকে লেখতে বলত কারণ হয়তো সে বই পড়ত প্রচুর। আমি কলেজ লাইফ পর্যন্ত অনেক বই পড়েছি। আমার কাছে উপন্যাস পড়তে ভালো লাগত খুব। কাহিনীগুলোর মধ্যে ঢুকে যেতাম একেবারে। মনে হতো আরেক জীবনের গল্প। তারপর আর পড়া হয় নাই। হাসনাত যেমন অনেক বই পড়ত। ওর পড়া বই নিয়ে আমি শুনতাম। ওর কাছ থেকে বুঝার চেষ্টা করতাম। সে বিভিন্ন দার্শনিকের বই পড়ত আর মুভি দেখত। ওদের কথা আমাকে লেখতে হবে আসলে। নইলে কেমন শান্তি পাচ্ছি না। আর আমি তো কোনো গল্প-উপন্যাস লেখতে যাচ্ছি না। আমি যা যা ঘটেছে, ওরা যা যা বলেছে সেসব শুধু তুলে রাখব, স্মৃতি ঘেঁটে ঘেঁটে যা যা মনে আসবে লেখব।

 

লেখব বললেই তো লেখা হয় না। প্রথমে দেখলাম কলম নাই। বাসায় খুঁজতে খুঁজতে বুক শেলফে কলম পেলাম। রেখার রাখা কলম বলে বুঝতে পারলাম। মাঝে মাঝে বাজারের কেনাকাটার এটা-সেটার জন্য লিখে দিতে হয়তো কলমটা রেখেছে সে। আমি কলমটা নিয়ে নিজের রুমে গেলাম। কীসে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল আমাকে লেখার জন্য। তারপর লেখতে বসে অনেকক্ষণ চুপ হয়ে গেলাম। কার কার কথা লেখব ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে সিগারেট খেলাম বেশ কয়েকটা। কিছুই না লেখে শুয়ে পড়লাম। মনে পড়ল মাসুদের কথা। আমার রুমমেট ছিল সে — অত্যাশ্চর্য এক চরিত্র। সে অনেকটা এখনকার আমার সম্পর্কহীন প্রতিবেশীদের মতো। যে সারাক্ষণ পাশেই থাকে কিন্তু কথা হয় না, জানাজানি হয় না নিজেদের বিষয়ে নিজেদের — তেমন।

 

মাসুদ আসলে আমার সিনিয়র ছিল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই দুই হাজার এক সালে। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আমরা গাদাগাদি করে কমন রুমে থাকছিলাম। তখন এক দিন সাইফুল ভাই আমাকে ডাক দিলেন। আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ, একই এলাকার সাইফুল ভাই। ঘনিষ্ঠ বলতে শুধু একই হাড়িতে ভাত খাই না এমন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। এলাকায়ও তার পরিবার বিএনপি বলে পরিচিত। পাস করে বের হওয়ার আগে সেই সাইফুল ভাই তার রুমের বেডটা আমাকে ছেড়ে যান। যে কারণে কেউ আর ঝামেলা করতে আসে নাই। সেই রুমে উঠে আমি মাসুদ ভাইকে দেখতে পাই।

 

চুপচাপ, চশমা পরা হ্যাংলা শরীরের একটা লোক। আমার সঙ্গে তার কোনো কিছুতেই মিলত না। একই রুমে পাশাপাশি আছি, কিন্তু কোনো বন্ধন তৈরি হয় নাই তার সঙ্গে আমার কখনো। আমি দুপুরে রুমে ঢুকে দেখতাম তিনি পড়ছেন। গভীর রাতে তাকে রুমে পাওয়া যেত না। পরে শুনেছি তিনি নোটের ব্যবসা করতেন। বিভিন্ন ইয়ারের ছেলেমেয়েদের কাছে গোপনে নোট বিক্রি করতেন। রাত হলে নীলক্ষেতে গিয়ে গাইড বইয়ের কাজ করতেন। তার পরিবার চালাতেন, নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেন। ছাত্রদল করতেন সময়ে সময়ে। তার আগে নাকি ছাত্রলীগও করেছেন। তার কোনো রাগ নাই, উষ¥া নাই। তিনি নিরেট একটা লোক। তিনি ছিলেন বকের মতো ধীর ও নিমগ্ন কিন্তু ধূর্ত। ধূর্ত বললাম এই অর্থে যে, তিনি নিজেকে গোপন রাখতে পারতেন। একটা ক্যামোফ্লেজের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন। মাসুদ এখন একটা সরকারি বড় পোস্টে চাকরি করে। আমাকে মাঝে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই। আমি এতে আশ্চর্যই হয়েছিলাম। তার বিষয়ে আমার কিছুই লেখার নাই।

 

আর জলির সঙ্গে আমার পরিচয় ভর্তি হওয়ার অনেক পরে। শেষের কয়েক বছরে। যদিও আমি তাকে খেয়াল করি ফার্স্ট ইয়ারেই। ফার্স্ট ইয়ারে যেটা হয়, একসঙ্গে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা মিলে আড্ডা দেয়, সেখানে জলিকে দেখি। হাকিম চত্বরে হতে পারে বা ডাসে, টিএসসিতে। আমি দেখতাম একটা মসৃন রঙের মেয়ে খুব উচ্ছ্বল। সে হাসছে, হাতের আঙুলে চুল পাকাচ্ছে, অন্যদের মাঝখানে বসে কী যেন ভাবছে। ওর অঙ্গভঙ্গিগুলো আমাকে আকৃষ্ট করত। দেখতেও বেশ ছিল জলি। ধারালো চেহারা, চিকন নাক, বড় চোখ, মুখটা কেমন যেন তার ঝলমল করত। পোশাক-আশাকে তার একটা নিজস্ব ঢঙ ছিল। যেমন সে শাড়ি পরত বা সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, টপস — ওর সঙ্গে মানিয়ে যেত। পরে দেখতাম সে একা একা কোথাও বসে বসে আছে অনেক্ষণ। আমি ভাবতাম মেয়েটা বুঝি বাম বা কালচারাল কোনো সংগঠন করে। পরে সে বলেছিল তেমন কিছু না। আসলে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগে তার একটা প্রেম ছিল। সেই ছেলের সঙ্গে ব্রেকআপ হওয়ার পর অনেকদিন সে একা একা ছিল। তারপর তার প্রেম হতে বেশ সময় লেগেছিল।

 

জলি আসলে কেমন ছেলে পছন্দ করত আমি কখনো বুঝতে পারি নাই। মনে হতো ও হয়ত শরীরী প্রেমে বিশ্বাস করে। এখনো এই রহস্যের কিনারা আমি করতে পারি নাই। আমার সঙ্গে যোগযোগ শুরু হওয়ার পর জলি অন্তত দুইটা প্রেম করেছে। তার আগে আমি দূর থেকে তাকে দেখেছি আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করতে। সেটা ভাঙার পর নতুন প্রেমটা হব হব সময়ে আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আর সেটা হাসনাতের মাধ্যমে।

 

হাসনাত আর জলির পরিচয় বোধহয় কোনো স্টাডি সার্কেল বা অ্যাক্টিভিস্ট ঘরানার সূত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে আসলে ছাত্রছাত্রীদের একটা না একটা দাবি-দাওয়া, ফিল্ম সোসাইটি, লিটারারি সোসাইটি — এসব থাকবে। এরই কিছু একটায় তাদের পরিচয়। হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় কীভাবে মনে নাই।

 

আর হাসনাত হলো এমন ছেলে যে জীবনটাকে উপভোগ করতে পারে তার নিজস্ব উপায়ে। যেমন সে মদ খেতে পারত না। কিন্তু না করত না। আমাদের সঙ্গে বসে অল্প একটু মদে অনেক পানি মিশিয়ে ধীরে ধীরে খেত। আর গুন গুন করে গান ধরত। ওর গলাটা খারাপ ছিল না। যেন আমাদের আগেই তার নেশা হয়ে গেছে এরকম ভাব করত। তারপর খাওয়া-দাওয়া বিষয়েও তার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিছু একটা খেলেই হতো। সেই হাসনতাই আবার তার পরিবারের বিষয়ে খুব দায়িত্বশীল ছিল। লিখলে এদের নিয়ে লেখা যায়। যাদের সঙ্গে আমার একটা মিথষ্ক্রিয়া হয়েছিল।

 

এসব ভাবতে ভাবতে আবার লেখার উত্তেজনায় পেয়ে বসল। উঠে আলো জ্বেলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর ডায়রিটা মেলে ধরলাম। টিভি দেখার রুম থেকে একটা টুল আগেই জোগাড় করেছিলাম। সেটা হাতে নিয়ে প্রথম কী লিখব ভাবলাম। আবার ব্যর্থ হলাম লিখতে। পরে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত করলাম।

 

শুয়ে শুয়ে আধো জাগরণে মনে পড়ছে বিভিন্ন ঘটনা। ডায়েরিতে কী কী লিখব তার একটা ছক আঁকতে থাকলাম বিকাল থেকে রাতে খেতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। কোন ঘটনা থেকে শুরু করব, তারপর কী লেখব, শেষ হবে কোথায় গিয়ে সেসব ভাবনা মাথায় কিলবিল করতে থাকল। অনেক গম্ভীর হয়ে পড়লাম আমি। মনে হলো কথা বললেই মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে ঘটনাগুলো, আর লিখতে পারব না। রেখা কী বুঝল কে জানে? সে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলল। আমি সেসবের উত্তর দিলাম আবার দিলাম না। আমার মনে তখন শুধু রাত হওয়ার অপেক্ষা।
আমার অপেক্ষা ফুরাল। রাতে খেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখার পর সবাই ঘুমানোর উদ্যোগ নিল। রেখার তাগাদাই বেশি ছিল। আমার কিছু সন্দেহও হলো। এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর মতো কিছু তো নাই। তাহলে? সে কি ফোনে আবার হাসবে? কিন্তু না, সন্দেহ নিয়ে লেখা যাবে না। সন্দেহমুক্ত থাকতে হবে। অনেকটা অজু করার মতো মনে হলো আমার কাছে। নিজেকে কতভাবে আমার প্রস্তুত করতে হচ্ছে! অদ্ভূত এ অবস্থায় নিজের প্রতি হাসিও পেল। আমারও তাড়া ছিল মনে মনে রাত হওয়ার। রাত হয়েছে, সবাই শুয়েও পড়েছে। আমি শুরু করলাম ডায়েরি লেখা :

 

২০০৪ সালের ৪ জুন রাত। আমি কুমিল্লা থেকে ফিরছি। সায়েদাবাদ থেকে একটা বাসে উঠে পরে প্রেসক্লাবে নেমে গেলাম সেটা শাহবাগ যাবে না বলে। সামনে একটা লাল দোতলা বিআরটিসি বাস দেখতে পেলাম। আমি সেটায় খুব উঠতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। অফিসফেরত মানুষের চাপ প্রেসক্লাবে আসা বাসগুলাকে ঘিরে। বাসটায় উঠতে না পেরে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম দোয়েল চত্বর দিয়েই বরং ক্যাম্পাসে ফিরি। হাঁটতে হাঁটতে শিক্ষা ভবনের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হলাম। রিকশায় উঠলাম। বেশ গরম পড়েছে। নিয়ন আলোয় আর ধুলা মিলিয়ে মোটেও স্বস্তিকর কোনো পরিবেশ না। আমার সামনে একটা রিকশা যাচ্ছে হুড তুলে এই গরমের মধ্যেও। হুডের পেছনের মাঝখানে কিছুটা ফাঁক রয়েছে। বাম পাশের জন যে মেয়ে তা তার পোশাক দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তার শাড়ির কিছুটা রিকশার বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। ডান পাশের জন ছেলে। সে পাঞ্চাবি পরেছে। রিকশা খুব আস্তে আস্তে চলছে। ছেলেটার হাত মেয়েটার কোমরের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে আবার কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। হাতটা নড়ছে — বেশ বুঝতে পারছিলাম আমি। আর মেয়েটা ছেলেটার ঘাড়ের কাছে মুখ এলিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ছেলেটার কানে বোধহয় কামড় দিচ্ছে। আমার রিকশাওয়ালাও বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল। সে দ্রুত রিকশা তাদের সামনে নিয়ে আবার ধীর করে ফেলল। যেন আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পাই।

 

সেই অনিশ্চিত অন্ধকার, ফেরার ক্লান্তি, চিটচিটে ঘামের অস্বস্তিকর দিনটায় আমি রিকশায় জলিকে দেখেছিলাম। তখন সে আমাকে চিনত না। ওকে ভাবতে ভাবতে ততদিনে আমি তাকে ভুলেই গেছি। মাঝখানের দিনগুলোতে আর তাকে দেখতাম না। ফলে মনেও পড়ত না তেমন। অনেকদিন পর জলিকে রিকশায় এভাবে দেখার পর আমার মধ্যে অস্থিরতা শুরু হলো। তাদের বেপরোয়া সেক্স করা দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। রিকশাওয়ালাটা বলল, দেখছেন মামা কেমনু মজা নিতেছে?

 

আমি তাকে ধমক দিলাম। জোরে রিকশা চালিয়ে যেতে বললাম। চানখারপুল গেলাম সিদ্ধান্ত বদল করে। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে শুনলাম বিআরটিসি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। যে বাসটায় আমি উঠতে চেয়েছিলাম মনে হয় সেই বাস, একই রকম লাল। এগারজন মারা গেছে। খবরে খালি এসব দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের আন্দোলন চলছে তখন। তারা হরতাল, অবরোধ এসব দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বেশ কিছু লজিক্যাল দাবিও আছে। আমি অতটা পলিটিক্স সচেতন ছিলাম না, আগ্রহও জাগত না। কী হচ্ছিল, কী হলে কী হতে পারে, কোন দিকে যাওয়াটা ঠিক হবেÑ এসব ভাবতাম না। মাঝে মাঝে এরকম বড় ঘটনা ঘটলে তখন খবর পেতাম বা নিজেই জানতে চাইতাম। পরে অবশ্য রাজনীতি ব্যাপারটার অনেকটাই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন না, এগারজন মানুষ পুড়ে মরার পরেও না। আমার মাথায় তখন ভোঁ ভোঁ করছে ঘুরছে রিকশায় জলির আলুথালু বেশ।

 

ওইদিনের পর জলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল কয়েকবার। তাকে ঠিক ক্যাম্পাসে পাওয়া যেত না। কাউকে তার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা যেত না, জানতে চাইলে হাসাহাসি হবে বা সন্দেহ করবে এই ভয়ে। কিন্তু আমার হারিয়ে যাওয়া মনের চোখটা আবার ফিরে আসল। আমি চোরাচোখে জলিকে খুঁজতাম। পেতাম অথবা পেতাম না। পেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। জলিও আমাকে দেখত, কিন্তু খেয়াল করত না। সে তখন বেখেয়াল প্রেমে মগ্ন। কখনো রিকশায়, কখনো সিএনজিতে, তারপর সেই প্রেমিকের বন্ধুর মেসে — এসব জলি পরে বলেছিল আমাকে। রিকশায় দেখা সেই ছেলের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণ অদ্ভূত। ছেলেটা আইইএলটিএস করছিল। খুব মেধাবী নাকি সেই ছেলে। দেখতেও ব্রাইট। কোকড়া চুল, ফর্সা চেহারায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা — কিন্তু আইইএলটিএস দেওয়ার কারণে তাদের প্রেম টিকল না। ছেলেটা জলির সঙ্গে ডেটিংয়ের সময় আইইএলটিএস এর ক্লাস করত যেন। ইংরেজিতে কথা বলতে বলত। এটা-সেটার অর্থ জিজ্ঞেস ও জানতে চাইত। এসব কারণে ফেডআপ হয়ে জলি যা করল স্রেফ তাকে তার এক বন্ধু মারফত একটা খব পাঠিয়ে আর যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দিল। এরপর জলি আবার ক্যাম্পাসে অনিয়মিত হয়ে পড়ল। ওর যখন প্রেম হতো তখন সে হলে থাকত। প্রেম ছুটে গেলে বাসায়। তারপর প্রেম হলো যার সঙ্গে কেন এবং কীভাবে হলো তার কিছুই আমি জানতে পারি নাই। জলি বলে নাই। শুধু তার আইইএলটিস প্রেমের ঘটনাটা বলেছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে সে আসলে কী আলাপ পছন্দ করে ডেটিংয়ে। জলি বলল, জানি না। এটা আগে থেকে বলা যায় না।

 

আমাদের সঙ্গের আড্ডায় জলি খুব প্রাণবন্ত থাকত। খোঁচাখুঁচি করত। রাজনীতি নিয়ে আলাপ করত। তার আর হাসনাতের রাজনৈতিক লাইন বেশ মিলে যেত। আমি বরাবরই ইন্যাকটিভ আওয়ামী লীগ ছিলাম। জলি বা হাসনাতও কখনো বিএনপি ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের ক্রিটিক ছিল। কোনো কিছু তারা সহজে গ্রহণ করত না আসলে। সব কিছুর একটা ক্রিটিক তৈরি করত।

 

সেই জলির সঙ্গে আমার খাতির হয় বাস পোড়ানোর বছর দুয়েক পরে। উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে। সময়টা দুই হাজার ছয় সাল। ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে দেশজুড়ে। বিএনপি ক্ষমতা শেষ করতে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। আমার অবশ্য তখন ব্যস্ততা জলিকে নিয়ে। এর আগে হাসনাতের প্রলোভনে জলির সঙ্গে পরিচিত হই। আমার একটা কনফিডেন্ট ছিল জলিকে পাব। আমি দেখতে ভালো, ভদ্র। হাত খরচের টাকা সব সময় হাতে থাকে। উপরন্তু আড্ডাবাজি। আমি জানি মেয়েরা এমন ছেলেই পছন্দ করে। হাসনাতের সঙ্গে প্ল্যান ছিল জলির প্রেমটা ছুটে গেলে আমি তার সঙ্গে লেপ্টে যাব। যদিও তখনও তার প্রেম ভাঙেনি। কিন্তু সেই প্রেম ভাঙবেই বলে হাসনাত জানিয়েছিল। সে জানত যে ছেলের সঙ্গে জলির প্রেম ওই ছেলের অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম আছে। এটা সে ঘটনাচক্রে একদিন দেখে ফেলেছিল। জলিকে যদিও বলে নাই। কিন্তু তাদের প্রেম যে টিকবে না সেটা নাকি জানাই ছিল হাসনাতের। সে আমাকে আগাম জানিয়ে রেখেছিল। আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। তখন থেকে জলির প্রতি আমি কিছুটা কেয়ারিং হতে শুরু করি। দেখা গেল জালি নিউ মার্কেট এলিফ্যান্ট রোড, রমনা পার্ক, শাহবাগ যাবে- আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

 

আজিমপুরে প্রেমিকের সঙ্গে অভিসারের পরিকল্পনা — আমি তাকে বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে আসছি। কোনো কারণে ধানমন্ডি লেকে যাবে জলি, আমাকে বললেই সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছে। কখনো কোনো রাতে পল্টনের কোনো বাসা থেকে বিধ্বস্ত জলি নেমে আসলে আমি কোনো দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই তাকে রিকশা করে হলে নিয়ে এসেছি। তাকে আকৃষ্ট করার জন্য নতুন স্টাইল, একটু দাড়ি-গোঁফ, লম্বা চুল পছন্দ করত — সেসবও রেখেছিলাম। তারপর গানের সিডি, কিছু একটা গিফট কিনে দিয়েছি। ওর হাসি চোখ টান টান শরীরটা আমার খুব ভালো লাগত। মাঝে মাঝে মনে হতো ওর শরীর থেকে কাচা সবুজ কোনো গন্ধ আসত।

 

এ সমস্ত বেগার খেটে গিয়েও কোনো লাভ হচ্ছিল না। ওই ছেলেটা ছিল লম্পট, নেশাখোর এসব আমি জানতাম। ভাবতাম জলি বোধহয় উদাস ছেলে পছন্দ করে। তাই আমিও উদাস হওয়ার ভান করতাম। ও ডাকলে যেতাম না কখনো কখনো। তখন তার টান বেড়ে যেত। আমাকে ঘন ঘন ডাকত। এভাবে চলছিল। বিএনপি সরকারের শেষ দিনে জলিকে হঠাৎ হারিয়ে ফেললাম। পল্টনে তখন ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। আওয়ামী লীগ আর জামায়াতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যে যাকে পারছে তাকে মারছে। হাসনাত বলেছিল পরে, হুতু আর তুতসিরা এভাবে মারামারি করত। সেই যুদ্ধের মধ্যে জলি হারিয়ে গেল। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্যাম্পাসের সব জায়গায় তাকে খুঁজলাম। তার ফোন বন্ধ পেলাম। বাসার কারো নাম্বার তখনো জানা ছিল না। যে ছেলের সঙ্গে তার প্রেম ছিল তাকে ফোন দিলাম। সেও জানে না জলি কোথায়।

 

এদিকে হাসনাতেরও বড় বিপর্যয় ঘটল। আগের রাতে তার পরিচিত এক নারী যাত্রাবাড়ীতে বাসচাপায় মারা গেছে। সেখানে আমাকেও যেতে হয়েছিল। ওই মহিলা সম্পর্কে খালা হন হাসনাতের। কেমন খালা তখন জানার অবস্থা ছিল না। বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মারামারির থেকে বাঁচতে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে তিনি বাস চাপায় মারা যান। সঙ্গে আরেক মহিলাও নিহত হন। ততক্ষণে বোধহয় রাত হয়ে গেছে। ওইদিন রাতেই বিএনপি-জামায়ত সরকারে ক্ষমতা শেষ হয়। তারপরই নানা সংঘর্ষ আর আগুনের খবর আসতে থাকে। ওই মহিলার মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাসনাত মিরপুর থেকে এসে আমাকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী যায়। তারপর সেই লাশ গ্রামের বাড়ি পাঠাতে পাঠাতে ভোর প্রায়।

 

আমরা আবার যখন ফিরে আসছিলাম তখন জানতাম না আরো ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। সেদিন হলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। চারদিকে হৈ চৈ, দুদ্দাড় শব্দ হলে ঘুম ভাঙে। কয়টা বাজে খেয়াল করি নাই। ফ্রেশট্রেশ হয়ে টং দোকানে নাশতা করতে নেমেই বুঝলাম পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। হলে নেতা পাল্টে গেছে। ছাত্রলীগ জায়গা করে নিচ্ছে হলে হলে। ছাত্রদলের ছেলেরা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। টং দোকনের জাকির বলল, পল্টনে রণক্ষেত্র শুরু হয়েছে। ছেলেরা অনেকেই জটলা করছিল। এর মধ্যেই হাসনাতের ফোন। সে জানাল পরিস্থিতি খারাপ, হল থেকে যেন বের না হই। দুপুরের আগে দিকে জলির খোঁজ করে তাকে পেলাম না। ক্যাম্পাসে খুঁজতে বের হলাম তাকে কী মনে করে যেন। কিন্তু চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি। সবাই আশঙ্কার মধ্যে আছে। কী হয় বলা যায় না। মারামারি গুলিস্তান, নগর ভবন, পল্টন, কাকরাইল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জলিরও খোঁজ নেই। দেখে টেনশন বেড়ে গেল। ওর প্রেমিক ছেলেটাকে ফোন দিয়ে কোনো সদুত্তর পেলাম না। খুব বিরক্ত মনে হলো তাকে। কিছু হয় নাই তো তাদের মধ্যে? যে আশঙ্কা ছিল তা এতদিনে সত্য হলো? এমন একটা সান্ত্বনা নিয়ে হলে ফিরে যাচ্ছিলাম।

 

এমন সময়ে নওশেরের সঙ্গে দেখা হলো। ওকে আমরা ঠোঁটকাটা বুদ্ধিজীবী বলে ডাকতাম। ওর সঙ্গে আমার তেমন আড্ডা হতো না। তবে ফার্স্ট ইয়ারের দিকে খাতির ছিল। ছেলেটা ভালো হলেও বেশ নেশা-টেশা করে। আর ওর সঙ্গে কথায় কেউ পারতো না। মল চত্বরে দেখা হলো ওর সঙ্গে। দেখলাম খুব চিন্তিত। আমাকে দেখে কিছুটা ভরসা পেল।

বলল, ‘ভাইরে ভাই যা শুরু হইছে না। হেভি কোপাকোপি। আওয়ামী লীগ জামায়াতের পোলাগুলারে ভর্তা বানায়া দিছে। তুই দেখলে বুঝতি। জামায়তিগুলাও কম না। সামনে গুলি চালাইতেছে।’
’তুই দেখছিস?’
‘সরাসরি দেখি নাই। তবে গেছিলাম ওই দিকে হাইকোর্টের সামনে থিকা ফিরা আসছি। ব্যাপক গণ্ডগোল। আশপাশে আওয়ামী লীগে ভরে গেছে। ওদের সঙ্গে কেউ পারবে না’।
‘তাইলে তুই কেমনে জানলি?’
‘আরে মামা তুমি বুঝ না এসব? এগুলা হইল পলিটিক্স। তুমি যতই হাইকোর্ট, শাসন ক্ষমতা দখল কইরা রাখো, মাঠ দখল করতে না পারলে লাভ নাই। আর মাঠ দখলে আওয়ামী লীগের লগে কেউ পারবে না। জামায়াতের তো এ দেশে দাঁড়ানোরই ক্যাপাসিটি তৈরি হয় নাই। আর বিএনপি সবে ক্ষমতা ছাড়ল। সে রাস্তা দখল করতে জানে না। আমরাও তো আওয়ামী লীগ। তোমার বাপে তো বড় আওয়ামী লীগ। তুমি দেখ না আওয়ামী লীগ কী করে, বিকালের মধ্যে পুরা পল্টন, বায়তুল মোকররম দখল করে নিবে।’
‘এখন তাইলে বিএনপির কী হবে?’
‘বিএনপির মূল সমস্যা এখন তারা ক্ষমতা ছাইড়া দিছে। তাদের মেয়াদ শেষ। তারা ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নাই। নির্বাচনও দিতে পারে নাই। শোনো তোমারে বলি। মনে যদি তোমার দূর্বলতা থাকে তাইলে তুমি কী করতে পারবা? বিএনপির মনে দুর্বলতা আছে। আওয়ামী লীগের নাই। সে সাহস করে মাঠে নেমে গেছে।’

 

ওর কথার কিছু আমি বুঝতে পারলাম না। ও যে নিজে বুঝতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমারও। আমার মনে হয় বলে যাওয়াটা ওর স্বভাব। কী বলল পরে আর তেমন মনে থাকে না তার। ছেলেটা ভালো বলে, লেখাপড়া করে দেখে ওর কথা ফেলাও যায় না। আর খুুব সুন্দর করে সিগারেট খায়। চেহারাটা কিছুটা ভাসা ভাসা। আমার সঙ্গে দীর্ঘ দিন পরে এত কথা হলো। এর আগে দেখা হলে কীরে কেমন আছিস এটুকুতেই শেষ হয়ে যেত। আজ ওর কথা শুনে ভাবান্তর হলো। আমি রাজনীতি বুঝি না। ইউনিভার্সিটি শুরর দিকে ছাত্রলীগ করতে চেয়েছিলাম। পরে বাদ দিলাম। এত পরিশ্রম সহ্য হয় না। তাছাড়া ছাত্রদল তখন ক্ষমতায়। ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাই। নওশেরেরও একই অবস্থা। তারপর আমরা দু’জন মিলে আলাপ করলাম, রাজনীতি সব সময় ক্ষমতা দখলের লাড়াই এটা ঠিক আছে। মানুষ না মেরে রাজনীতি করার প্র্যাকটিস আমাদের এখানে নাই। ফলে সেটা আশা করারও বৃথা।

 

তারপরও মনে হয় যারা মারা গেল তারা তো গেলই। যারা বেঁচে থাকল এরপরে এত অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা কী আশা করছে? আমি যতটা বুঝি সর্বস্ব দিয়ে রাজনীতি করতে নাই। কিন্তু রেখে দিতে হয়। কারণ রাজনীতির মাঠে পরাজয় মানে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এ বিপর্যয়ের শেষ কোথায়?

আর চিন্তা না বাড়িয়ে চলে এলাম নওশেরের কাছ থেকে।

এরপর রাতে ফোন করেছিল জলি একটা আননোন নাম্বার থেকে। তার কণ্ঠে কিছুটা শীতলতা। জানালো সে ভালো আছে। তার ফুপুর বাসায় আছে। তার প্রেম ছুটে গেছে গতকাল। সে জন্য সে রাতেই ফুপুর বাসায় চলে এসেছে। তারপর আজ সারাদিনের গণ্ডগোলের কারণে আর বাসায় ফিরে যায় নাই। ফোন বন্ধ রেখেছে কারণ ওই ছেলে ডিস্টার্ব করছিল। নতুন সিম না কিনে ফোন চালু করবে না। এরপর যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তাহলে সে ফোনে আমাকে জানাবে। আমি যেন তাকে নিয়ে তার বাসায় দিয়ে আসি। আর এই সূত্রেই জলির সেই ফুপুর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। সে আরেক রোমাঞ্চ জাগানিয়া চরিত্র আমার জীবনে।

এ পর্যন্ত এসে নিজের জীবনের প্রথম ডায়েরি লেখা শেষ করলাম।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ৩

অন্যমনস্ক দিনগুলি ।। কিস্তি : ৩

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here