পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।
সেদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠানে নেমে দেখি নানু তার কোরাণপাঠ ক্লাসের প্রস্তুতি ছেড়ে ডালিম গাছের নিচে মোড়ায় বসে পরম যত্নে ছোট মামার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ডালিম গাছের ডালে একটা বালতি ঝুলছে। তা থেকে বেরিয়ে এসেছে শাপলার ডাঁটি। মামার মাথার উপর লটকে থাকা ডাঁটি থেকে চিকন লহরে পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মামার মাথা। আমরা পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দেখি মামা ঘুমাচ্ছে। তবুও নানুর হাত বেয়ে মামার মাথায় ঝরছে সহস্র স্নেহধারা। যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রকৃতির আশীর্বাদের মতো নির্মল প্রস্রবণ । আমাদের দেখে নানু ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে আওয়াজ না করার ইশারা দেয়। শিরি খালাকে ফিসফিসিয়ে বলে চাটিগুলো বিছিয়ে দিতে। আমরা নিঃশব্দে যে যার প্রাত্যহিক কাজে লেগে পড়ি। তিন জনই তাজ্জব হয়ে ভাবি এমন হঠাৎ করে না বলেকয়ে মামা অসলো কখন?
দুই দিন আগে দেখি বড়ঘরের পিছনে জাম্বুরা গাছের ছায়ায় জমিলার মা গাঁইল ছেহাইট দিয়ে কী যেন গুঁড়া করছিলো। কাছে গিয়ে দেখি চুলা থেকে তুলে ধুয়ে পরিষ্কার করা কাঠকয়লা। জিজ্ঞেস করলাম যে এটা দিয়ে কী হবে। ঝকঝকে দাঁত বের সে শুধু একটু মিচকি হাসে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করে বিরক্ত হয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি আমি। তারপর বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ দেখি নানু ওগুলোতে সদ্য রান্না হওয়া ভাতের মাড় ও আরো কি কি মিশিয়ে গামলা ভর্তি করে উঠানের এই কোনায় জলচৌকি পেতে বসে।
আমাকে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বাঁশের চিলতা তুলে বানানো ছোট ছোট চারটা চাটাই আনায়। তার আগে আমি এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়ে ঠোঁট গোল করে মৃদু হাসির ভঙ্গি করে জমিলার মায়ের মতই এড়িয়ে যায়। যেন আমি নিষিদ্ধ গোপন কিছু জানতে চাচ্ছি। আমার আগ্রহ বেড়ে যায় । এখানে বসে নিজের চোখেই দেখব সব জারিজুরি। চাটাইয়ে সঙ্গে একটা জলচৌকি এনে আমি নানুর উল্টা দিকে জুৎ হয়ে বসি।
: এগুলো দিয়ে কি বানাবেন নানু?
: কাঠকয়লার বরি। মাছ দিয়া রানলে পোলাওয়ের সঙ্গে খুব মজার।
: ধ্যাত্তেরি। কেন যে উল্টা পুল্টা বলেন। মাশকলাই আর চালকুমড়া লাগে বড়ি বানাতে। কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা যায় খাওয়া যায় না। বলেন না কি এগুলো?
: তোর বড় নানার জন্য টিক্কা বানাই টিক্কা। গ্রামে বিরি সিগারেটের চাইতে হুক্কা খাওয়ার চলন বেশি। আমার দাদি নানি সবারই এই অভ্যাস আছিলো। আমার মাইয়া কিন্তু খাইতো না। তার নেশা আছিলো সাদা পাতায়। টিক্কা দিয়া ডাবার কল্কিতে আগুন জ্বালায়। তখন তামাক পুরতে থাকে ধিমাইয়া ধিমাইয়া। আমার বাবা টানতো ফুরসি। তিন হাত লাম্বা তার রেশমি নল। তার আম্বুরি তামাকের গন্ধ আতরের চাইতে বেশি সুঘ্রাণের। বারবৈঠকের পালকির চিপায় রাখা আছে বাবার ফুরসি। ভাইজানের অভ্যাস অন্যরকম। গ্রামের আর দশজনের মতো। তার আবার দাওকাটা কড়া বদগন্ধ তামাকের নেশা না হইলে চলে না। শেষ হইয়া আসছে তার টিক্কা। মনে করলাম বানাইয়া দিয়া যাই। আবার কবে আসি ঠিক কি।
: আমিও বানাই ?
: খারো তোর গালে আগে আদর করি। — নানু কয়লায় কালো ডান হাত তুলে ধরতেই আমি নাঁ — বলে মাথা পিছনে হেলিয়ে দেই। তারপর নানুর শেখানোমতো বানিয়ে চাটাইয়ের উপর সারি সারি জমা করি রোদে শুকানোর জন্য।
আজ বাড়িতে বিচির বস্তা পাকা আঁইট্টা কলা কাটা হয়েছে কলার পিঠা বানানোর জন্য। আমার খালারা পুকুর পাড়ে কেটে রাখা কলাগাছের টুকরা বয়ে এনে রাখছে বড়ঘরের পিছনে জাম্বুরা গাছ তলায়। তাহের মামার ছেলেরা শিকার ধরতে কুমড়া ডগার আঁকশি ছিঁড়ে এনে আমার কাছাকাছিই বসলো। কাল উঠানের যেখানে ধান রোদে দেয়া হয়েছিল সেখানে তীক্ষ্ণ চোখে ছোট ছোট গর্ত খুঁজে তাতে আঁকশির মাথাটা ঢুকিয়ে দিলো। চুপচাপ দেখতে থাকলো আঁকশিটা নড়েচড়ে উঠে কিনা। ঠিক মাছ শিকারীর ফাৎনা দেখার মতো। ঝট করে টান দিলেই একটা ছোট্ট কীড়া উঠে আসে। কম্পিটিশন হয় কে কয়টা তুলতে পারে। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়। কিন্তু কিড়াগুলি যায় মুরগীর বাচ্চাদের পেটে। কী করে যেন বুঝতে পেরেতারা আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। ছোট মামা এখনো ঘুমাচ্ছে। তবে মাথায় আর পানি দেয়া হচ্ছে না। পায়ে রোদের কামড় খেয়ে কি উঠানের এই পাড়ে বাচ্চাদের হৈ চৈ সংসারের ধুমধাম কোনো কিছুতেই তার ঘুম ভাঙছে না ।
: নানু ছোট মামা কখন আসলো জানলাম না। জ্বর নিয়ে না এসে সুস্থ হয়ে আসতো ।
: মমিশিং থে রওনা হওয়ার সমো তো জ্বর ছিলো না। জ্বর আসছে মধ্যিরাতে। এখন জিগা জ্বর কেন আসলো । জ্বর শুধু জীবাণুর জন্য অন্য অসুখের জন্য হয় না। ভয় পাইলেও হয়। শুন। যদি ভয় লাগে তাইলে সবসময় ভয়ের কারণটা খুজবি। তো দেকবি গোরায় কিছুই নাই। একটু সাহস ধর। এইটাই মঞ্জুররে শিকাইতে পারলাম না।
: কাল মামা ভয় পেয়ে জ্বরে পড়েছিল। মামা এত্তো বড় হয়ে এখনো ভয় পায়? মামা কি লিচু গাছে তাহের মামার বোনকে ঝুলতে দেখেছে? নাকি আউয়াল মামা দুই হাত মেলে দেউড়িতে ঢুকতে দিচ্ছিলো না। শিরি খালা বলছিল এমন নাকি মাঝে মাঝে হয়। আবার কানাওলা ধরলে নাকি সারারাত মাঠের মধ্যে ঘোরাতেই থাকে ঘোরাতেই থাকে ।
: ধুর পাগল ! এইগুলি হইলো মানুষের দেখা ভয়ের স্বপ্ন। তুই এইগুলি জীবনেও দেখবি না। তোদের ঢাকায় এইসব হয় না । এইগুলি গ্রামের বিশ্বাস।
: তাহলে মামার জ্বর হলো কেন।
: বল্লাম তো ভয়ে। গ্রামে অনেক কিছু হয় যা শহরে হয় না। কাইল গারি পাকুন্দিয়া আইতে দেরি হৈছে। মালগারির বগি পইরা রাস্তা বন্দ। অতো রাইতে রিশকা নাই দেইক্কা সবাই হাঁটা ধরছে। তর মামা নান্দাইল দলের লগ ধরছে। এরপরে এদিগে আউন্না মানুষ নাই। তহন সে মনে করছে মাডের ভিত্রে দিয়া হাইট্টা গেলে তারাতারি বারি পৌছাইবো। বেশ। এই মনে কইররা যেই না রাস্তা ছাইররা মাডে নামছে টের পায় ঘারে গরম নিঃশ্বাস। চোখের কোণা দিয়া আধা আন্ধাইরে দেখে একটা শাদা ফকফইক্কা ঘোরা। গ্রামে অনেকেরই ঘোরা আছে । কিন্তু সেইগুলি সামনের দুই পাও রাইতে বান্ধা থাকে যাতে দূরে যাইতে না পারে। এইডার পাও খোলা। মঞ্জুর যতো আগায় ঘোরাও তার পিছে পিছে আসে। আসলে মানুষরে বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়। একটু বেশিই খায়। মঞ্জুর পুরাপুরি ঘুইরা গেলে দেক্তো তার পিছে কেউ নাই। ভয়। ভয়ের মতো খারাপ আর কিছুই নাই। মইনসে কয় গোরস্তানে জ্বীনভুত থাকে। ভয়। মাইনসের নিজের হাতে বানানো ভয়। আমার বাবার পালা জ্বীন আছিলো। চুপচাপ উডানে শুইয়া থাক্তো আর আজান পরলেই যাইতোগা। কারুর কোন ক্ষতি করতো না। তো তারে ডরের কী? আর আমি তো নিজেই সাক্ষী। তর নানা মারা যাওয়ার পরের দুই মাস তো আমি পাগল ছিলাম। তর নানার হইছিলো যক্ষ্মা। তখন কথা আছিলো যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা। সেও জানতো। একদিন আমি খুব কান্তেছিলাম। চাইরটা সন্তান নিয়া আমি কই যাবো কিবাবে মানুষ করবো। তর নানা শান্ত গলায় কইলো, উপরে আল্লা আর নিচে তোমার বাবা। ওরা মানুষ হবে ভালো জীবন পাবে। আমি এখনো বেতন পাই না থাকলে পাবো না। কিন্তু অফিস কিছু থোক টাকা দিবে। বুদ্ধি করে সেইগুলি খাটাবা। কিন্তু এই বাসা ছারবা না। — আমি তার কথামতো যাগায় তারে কবর দিলাম। মমিসিং ছারলাম না। ঘুম না আইলে উডান পারাইয়া চাইর পা গিয়া তর নানার কবরের শিথানে বইসা সারা রাইত কতো কতা কইতাম কান্তাম বুদ্দি চাইতাম। কুনুদিন জ্বীনভুত দেহি নাই। আসলে মইনসের মনের ভিত্রেই সব। মঞ্জুর একটা গাধা। কতো বুজাইছি। কুনুদিন ডরাইলে ডরের গোরা খুজবি। বুজছস নাতনি? তুই ডরেরে পাইলে ডরেও তরে পাইব। কুনুদিন ডরাবি না। গোরা খুজবি।
নানুর গল্প শেষ হলে টিক্কা বানানোও শেষ হয়। তখন দেউরি পার হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে উত্তর বাড়ির আজিজ আর মন্টু। একজনের হাতে লাটিম অন্যজনের ফটাস। গাছের ছোট ছোট সবুজ ফল বাঁশের কন্চি কেটে বানানো চোঙের ভেতরে রেখে আরেকটা কাঠি দিয়ে হঠাৎ ঠেলা দিলে ফলটা ফটাস শব্দে সামনের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। মন্টু বলে, ফুজি আফনেরা বুলে কলাগাছ কাটছুইন? মাইয়া কইছে দুইডা টুহরা দিতাইন । চেফা দিয়া রান্তো।
: কিরে তরার রবির বৌ যে পলাইছিন অহন ফিরছে? কি অইছিন?
: হ, বাত্তাইছে। কিন্তু কইছে রবি কাকায় আবার পিডাইলে আর পলাইতো না। কিন্তু গলাত রশি দিবো ।
: রবি তো বেডা না বেডার চাক্কাডা। আক্কল অইছে । বৌডা পিডানির আত্তে বাঁচ্চে । অয় ফাঁসি দিলে পুলিশ আইয়া রবিরে বাইন্দা থানায় নিয়া রক্তারক্তি পিডন দিবো হান্টার দিয়া। তরা দুইজনও এই কতা মনো রাখিছ সারা জীবন । মনো থাকবো? – নানু চোখ কুঁচকে দুই জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিটুনির কথা শুনে ওরা ভয়ে ভয়ে মাথা ঝাঁকায় । নানু আমাকে ইশারায় ওদেরকে বড় ঘরের পিছনে নিয়ে যেতে বলে। আমি মন্টুর ফটাসের দিকে হাত বাড়াই। তারপর ওর হাতে ঝোলানো সবুজ বাদি থেকে ফল নিয়ে ফটফট করে কয়েকবার কাঠি ঠেলা দিয়ে ঠাস ঠাস করে ফটাস ফুটাই। মজার খেলা।
জাম্বুরা গাছের ছায়ায় শিরি খালা নিঃশব্দে আমাকে একটা কাচি এগিয়ে দিলো । আমিও তাদের মতো করে কলা গাছের টুকরা ফেড়ে ফেড়ে ভিতরের নরম বুগি বের করার খেলায় মেতে উঠি। কাছেই কোন গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে একটা পাখি বৌ কথা কও বৌ কথা কও বলে অভিমানী বৌয়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসাতে থাকে ।
পড়ুন ।। কিস্তি ৬