ছত্তিশগড়ের লোকগল্প

ছত্তিশগড় ভারতের একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী রাজ্য। বৈদিককাল থেকেই এই রাজ্য নানারকম সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই বৈষ্ণব, শাক্ত, বৌদ্ধ সংস্কৃতির গৌরব-উজ্জ্বল ইতিহাসের স্বাক্ষর রয়েছে ছত্তিশগড়ে। ভারতের যে দুটো রাজ্যের নাম বিশেষ কারণে পরিবর্তন করা হয়েছিলো তার একটি হলো ছত্তিশগড়। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন রাজ্য ‘দক্ষিণ কোশল’ অঞ্চলটিতে এক সময় ৩৬টি গড় ছিল সেই থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে ছত্তিশগড়। এই অঞ্চলের স্থানীয় আদিবাসীদের সংস্কৃতি অনেক প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষাকেই মূলত ছত্তিশগড়ি ভাষা বলা হয়ে থাকে। মূল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ছত্তিশগরে অঘরীয়া, গোন্ড, কবর, বিঞ্জবার, ওড়াও, হল্বা, ভতরা ও সবরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। সহজিয়ার পাঠকদের জন্য দুটি লোকগল্প উপস্থাপন করা হল।

 

ভূতের দয়া

এক গ্রামের প্রবেশপথে একটি পুরানো বটবৃক্ষে এক ভূতের বসবাস ছিলো। একদিন কিছু গ্রামবাসী সেই গাছের নিচে জটলা পাকিয়ে বসল। গাছে বাস করা সেই ভূত তাতে খুব বিরক্ত এবং রাগান্বিত হয়ে সমস্ত গ্রামবাসীকে মেরে ফেলল। অল্প কদিন আগেই এই গ্রামের এক যুবক গিয়েছিল তার দিদিমার বাড়িতে। ইতোমধ্যে সে ফিরে এসে অবাক হল। পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ, জনশূন্য। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সেই রাতে সে ভয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। সেই ভূত টের পেয়ে কিছুক্ষণ পর সেই যুবকের ঘরে ঢুকে বলল, ‘তুই কেরে এই গ্রামে এসেছিস? তোর এত বড় স্পর্ধা! আমি এই গ্রামের সবাইকে মেরে ফেলেছি। তোকেও মেরে ফেলব।’ যুবক ভূতের হুংকারে ভয় পেলেও ভূতকে সেটা বুঝতে না দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে জবাব দিল, ‘মামা আমি অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছি। অনেক ক্লান্ত। আমাকে একটু দয়া কর। আমার মা বলত তুমি নাকি অনেক দয়ালু। আমাকে দয়া কর মামা।’ ভূতের মন গলে গেল আর সে যুকটিকে আরও কদিন থাকার জন্য অনুমতি দিল।

 

এদিকে ভূতকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দ্বারস্থ হতে হয়। একদিন সেই যুবক কৌতূহল নিয়ে ভূতকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি প্রতিদিন কোথায় যাও মামা?
‘আমার প্রতিদিন হাজিরা। ভগবান ব্রহ্মার নিকট হাজিরা দিতে হয় ভাগিনা’ ভূত জবাব দিল।
‘তুমি পরেরবার গেলে ব্রহ্মা ঠাকুরকে বলো, আমার আয়ু যেনো আরও কদিন বাড়িয়ে দেয়।’ ভূত রাজি হয়ে গেল।

 

পর দিন ভূত এসে যুবককে বলল, ভগবান ব্রহ্মাকে তোমার কথা বলেছি ভাগিনা। ভগবান বললো, তিনি যার যতদিন দিয়েছেন সে ততদিনই বাঁচতে পারে। তার চেয়ে একদিন বেশিও না আবার কমও না। তাই তোমার আয়ু চাইলেও আর বাড়ানোও যাবে না, কমানোও যাবে না। যুবকটি ভাবলো যখন ঠাকুর ব্রহ্মা নিজেই কারো আয়ু বাড়াতে বা কমাতে পারেন না, তো এই ভূতের কি সাধ্য তাকে মারার। এটা ভেবে সেই যুবক একদিন ভূত যখন ওপরে ভগবান ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন লাঠি নিয়ে ভূতকে মারার জন্য প্রস্তুতি নিল। ভূত এই আচমকা আক্রমণের বিষয়টি টের পেয়ে গেল এবং ভয়ে আর কখনো সেই গ্রামে ফিরে আসেনি। এইভাবে সেই যুবক পুরো গ্রামকে ভূতের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।

মহুয়ার গাছ

এক গ্রামে সবচেয়ে প্রবীণ এক বৃদ্ধের বসবাস ছিল যেকিনা তার বাড়িতে আসা অতিথিদের ভীষণ আপ্যায়ন করত। সেই বৃদ্ধ সবসময়ই অপেক্ষায় থাকত তার বাড়িতে কখন অতিথি আসবে এবং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবত — আজ তার বাড়িতে অতিথি এলে সে কীভাবে আপ্যায়ন করবে, কী খাওয়াবে যেন অতিথি বেজায় খুশি হয়। অতিথিরা বরাবরই সেই বৃদ্ধার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তার প্রশংসা করত এবং বলত এমন আপ্যায়ন তারা কোথাও পায়নি।

 

বৃদ্ধের ছেলেও তার বাবার মতোই অতিথি সেবায় বেজায় খুশি হত। একবার তার বাড়িতে এক অতিথি এল, যে কিনা আগেও এসেছিলো। বৃদ্ধ এবং তার ছেলে দুজনে মিলে বন থেকে সংগ্রহ করা ফলমূল দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করতে শুরু করল। অতিথিও বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিল। খেতে খেতে অতিথি বলে বসল, ‘এই জঙ্গলে কি শুধু এই ফলই পাওয়া যায়? আমাদের এখানকার জঙ্গলে অনেক রকমের ফলমূল পাওয়া যায়। তবে আমার কাছে এই ফলটা খেতে বেশ দারুণ লাগে।’

 

বৃদ্ধের ছেলে তার পিতার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বৃদ্ধ অতিথিকে জবাব দিল, ‘আমরা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই যেন আরও নানারকম ফলমূল পাই। কিন্তু এই জঙ্গলে এই ফল বেশি পাওয়া যায়।’
অতিথি বলল, ‘আমার কাছে তো এর চেয়ে বেশি ভাল লাগে আপনার অতিথি আপ্যায়ন। এত আদর আর ভালবেসে কেউ অতিথিদের ভোজন করাতে পারে, তা আমি কখনো দেখিনি।’
সেই রাতে বৃদ্ধের ছেলে তার বাবাকে বলল, ‘বাবা আমি কিছুদিনের জন্য এই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে খোঁজ করে আসতে চাই আরো অন্যান্য ফলমূলের গাছ যদি পাওয়া যায়।’
সন্তানের মুখে এই কথা শুনে বৃদ্ধ পিতার বেশ আনন্দ হল। সে তার সন্তানকে গভীর জঙ্গলে গিয়ে খুঁজে আসার অনুমতি দিল।

 

প্রায় বেশ কিছুদিন বৃদ্ধের ছেলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু নতুন কোনো ফলমূলের গাছ তার চোখে পড়ছে না। ঘুরতে ঘুরতে সে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেল। একটা প্রকাণ্ড গাছের ছায়ার নিচে বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। হঠাৎ করে তার মাথার উপর এক পাখি এসে বসলো তারপর লেজ আর পাখা নেড়ে উড়ে চলে গেল।

 

সে অবাক হয়ে চারপাশে লক্ষ্য করে দেখল, এখানকার পাখিগুলো বেশি হাসিখুশি। এক ডাল থেকে আরেক ডালে বেশ আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে, পাখা ঝাপটে হেলেদুলে এক ডাল থেকে আরেক ডালে বসছে। সে বিষয়টা ভাল করে বুঝার চেষ্টা করছিল। আর পাখিগুলোর দিকে মনযোগ দিয়ে দেখছিল। সেই গাছের পাশেই ছিলো একটি কুয়া। সে লক্ষ্য করল, যে পাখিগুলো কুয়া থেকে জল পান করেছে তারা বেশ আনন্দে পাখা ঝাপটে হেলেদুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর যে পাখিগুলো তখনো কুয়া থেকে জল পান করেনি তাদের মধ্যে তেমন আনন্দ দেখা যাচ্ছিল না। সে ভাবলো নিশ্চই এই কুয়ার জলে কিছু একটা আছে।

 

তারপর বৃদ্ধও ছেলে কুয়ার নিকট গিয়ে দুই হাতে কোষ করে কুয়ার জল পান করল। সে দেখল এই জল বড়ই আজব যে, পান করার কিছুক্ষণ পরই তার মাথা দুলছে, আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে। সে ভাবতে লাগল এই জলে কিছু একটা আছে! পরে খেয়াল করে দেখল সে যে গাছের ছায়ার নিচে বসেছিল সেটি মহুয়া গাছ আর মুহুয়া গাছের ফল সেই কুয়ার জলে পরে এমন হয়েছে। সে বুঝতে পারল মহুলা ফলের রসে মাতাল হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। সে মনে মনে বেশ আনন্দিত এবং উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই জিনিসই সে অনেকদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে যুবক সেই গাছের নিচে পড়ে থাকা মহুয়া ফল পুটলিতে বাঁধতে শুরু করে দিল। তারপর সেই পুটলি কাঁধে করে গভীর বন থেতে বাড়ির দিকে রওনা হল।

 

এদিকে বৃদ্ধ তার ছেলের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। তার ছেলের কোনো খোঁজ খবর নেই কতদিন হল। প্রতিদিন বৃদ্ধ এবং তার স্ত্রী মিলে অতিথিদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি করে না। কিন্তু তাদের দুজনের মন বেশ উদাস থাকতো সন্তানের কথা ভেবে। বৃদ্ধের স্ত্রী প্রতিবার অসহায়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
এমনই একদিন বিকেল বেলা তাদের বাড়ি থেকে অতিথি বিদায় নিচ্ছিল এমন সময় বৃদ্ধের ছেলে এসে হাজির। সন্তানকে দীর্ঘদিন পর কাছে পেয়ে বৃদ্ধ এবং তার স্ত্রী জড়িয়ে ধরল। মায়ের কাছে মহুয়া ফলে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল সে। এদিকে মহুয়া ফলের রস খাওয়ার জন্য বৃদ্ধের ছেলে তাদের বাড়িতে আসা অতিথিদের আরও কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু তার মা বলল, ‘ কিন্তু বাবা, জলের মধ্যে অনেকক্ষণ মহুয়া ভিজিয়ে রাখলেই তবে সেই জলে নেশা হয়। তোমার গল্প শুনে তো আমার তাই মনে হলো।’

 

সেও বুঝতে পারল। এরপর সেই বৃদ্ধ এবং তার পরিবার অতিথি আপ্যায়নের জন্য বাড়িতে মহুয়া ফল জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখল। পরদিন তাদের বাড়িতে আসা অতিথিদের মহুয়ার জল দিয়ে আপ্যায়ন করতে পেরে বেশ আনন্দিত হয়েছিল। তারা খেয়াল করলো এই প্রথমবার তাদের বাড়ি থেকে কোনো অতিথি যাওয়ার সময় নেশায় দুলতে দুলতে, হাসি-ঠাট্টা আর আনন্দ করতে করতে বিদায় নিচ্ছিল।

গল্প উৎস: হিন্দি কবিতা ও কাহিনিভিত্তিক একটি অনলাইন ম্যাগাজিন থেকে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here