বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
১২
অফিস থেকে ফিরে দেখি হিরা চাচা। বিকালের দিকে এসেছে। সামনের বৃহস্পতিবারে আসার কথা ছিলো। কী একটা সুবিধার কারণে আজকেই এসেছে। বাবাই নাকি আসতে বলেছে। চাচাকে বেশ বয়স্ক দেখা যাচ্ছে। চুলে কলপ দেয়নি। এটা একটা কারণ। দাঁড়ি রেখেছে খোঁচা খোঁচা। এটাও আরেকটা কারণ। তাকে একদম হিমু হিমু লাগছে। আসাদুজ্জামান নূরের মত। কেন জানি আমার মনে হয় হিমুর চেহারাটা আসাদুজ্জামান নূরের মত। আর কাউকেই হিমু মানায় না। আমি বললাম, ‘চাচা তোমাকে হিমুর মত দেখাচ্ছে।’ চাচা হিমুর মতই হাসলেন। চাচা কি জানে, হিমু কে? বাবার সঙ্গে কী একটা জরুরি আলাপ করছিলেন চাচা। কিন্তু হিমুরা তো জরুরি আলাপ করে না। এছাড়া চাচা বাবাকে খুব ভয় পায়। হিমুরা কাউকে ভয়ও পায় না।
শরীরে সাবান মাখতে মাখতে কেমন সেক্স ফিল করছি। ওহ্! দারুণ মজা! আমি আমার শরীরটাকে আলাদিনের চেরাগের মত ঘঁষতে শুরু করলাম। সত্যিই কী আরাম! কেমন নেশা-নেশা লাগে। চেরাগের দৈত্যের মত এখন যদি বিভাস বেরিয়ে আসতো। কী যে দারুণ হতো! না, দারুণ হতো না। বিভাসকে এই গোসলখানায় কেমন মানাচ্ছে না। আচ্ছা, আমাদের বিয়ের পর আমরা তাহলে একসঙ্গে গোসল করবো। সে আমার শরীরে সাবান ঘঁষে দেবে। আমি বলবো, এখানে দাও! এখানে দাও! তারপর বুক এগিয়ে দেবো। বলবো, এখানে জোরে জোরে দাও। আরও জোরে দাও। নাহ্! আমার চিন্তার তার কেটে দিচ্ছে বিভাস। তাকে কোথাও মানাচ্ছে না। এর পেছনে কি তার আর আমার মানসিক দূরত্বই প্রধান কারণ?
শেরপুর থেকে চাচা গরুর ভুড়ি নিয়ে এসেছে। চাচি পাঠিয়েছে। পরী চাচি। কী কী আমাদের পছন্দ। সব উনার মুখস্থ। কাঁচা তো পাঠিয়েছেই। রান্না করেও পাঠিয়েছে। খেতে বসে বাবার খোঁজ নিলাম আমি। বাবা তোমার কী অবস্থা? শরীর স্বাস্থ্য ভালো? বাবা সুবোধ বালকের মত সব জবাব দিলো। আমার কাছ থেকে এধরণের আচরণে প্রথম প্রথম বাবা বিব্রত হতো। এধরণের আচরণ মূলত হিয়া করে। বিব্রত হতে হতে স্বাভাবিক হয়ে গেছে বাবা। জগতের এটাই নিয়ম। বাবাও তার চাল চেঞ্জ করেছে। ইদানিং খুব বেশি বেশি মা ডাকে। মা ডাক ছাড়া একপ্রকার কথাই বলে না। ‘চাচা, এহন তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তুমার দিনকাল তাইলে বেশ যাওয়ার কথা?’, চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম। চাচা আবারও হিমুর মত হাসলেন। অর্থাৎ আসাদুজ্জামান নূরের মত হাসলেন। বললাম, ‘আমার এক বন্ধু আছে, একসঙ্গে চাকরি করি, ও আওয়ামী লীগের, অবশ্য আওয়ামী লীগেরও না, বলতে পারো, বর্তমান সিস্টেমের একজন কট্টর সমালোচক।’ চাচা সিরিয়াস। চোখমুখে একটা বিরক্তি কি উদ্বিগ্নতা বোঝা যাচ্ছে না। বললেন, ‘মা, এরা ছদ্মবেশী বিএনপি-জামাত। অ্যাগর সঙ্গে বেশি মিইশ্শো না। ব্রেনওয়াশ করার ওস্তাদ। যা কবো, তুমি পুলাপান মানুষ, শুইন্যা মনে করবা ঠিকই তো কইছে। আসলে ঠিক নাই। অ্যারা ট্রেনিং প্রাপ্ত।’ চাচা আগে আমাকে মা বলতো না। ইদানিংকার সংস্করণ এটা। বাবার দেখাদেখিও হতে পারে। অবশ্য আদর করে আগে কখনো কখনো ‘দিয়া মামণি’ বলতো। এখন তার কথাতেও মা ডাক যোগ হয়েছে। বাবা আগেও মাঝে মাঝে ডাকতো। চাচার মুখে আজকেই মনে হয় প্রথম।
চাচার কথায় আমি আপত্তি করলাম। বললাম, ‘চাচা, ও বিএনপি-জামাত নয়। এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ও তো দেখি মার্কস-লেনিনের ভক্ত।’ আমি যেন বাচ্চাদের মত কিছু একটা বলে ফেলেছি। চাচা মুরুব্বিদের মত হাসলেন। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন, ‘বুঝছি। বাম। অ্যারা আবার ব্রিলিয়ান্ট হয়। পড়াশুনা করে।’ চাচা থামলেন না। বলেই গেলেন, ‘পচলে আসলে সবই পচে। অ্যাহন অ্যাগর কতাবার্তাও জামাতের মত হইয়া গেছে। আঙ্গর সময়ে ভণ্ড বামগুলারে আমরা কইতাম, মিল্লাতবাম।’ চাচা হাসলেন। আমাদের কথাবার্তায় এবার মা এসে যোগ দিলো। ‘খাওয়ার সুময় এত কতা বালা না। খাও তুমরা। কতা পরে কবার পাবা।’ – চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘হিরা, ডাইল নেও। ডাইল দিয়া মাহাইয়া নেও। বালা লাগবো।’ দাদি তেমন কিছু খেলো না। একটু নাকি জ্বরজ্বর লাগছে। আমি বললাম, মা বললো, গিয়ে রেস্ট নিতে। না, শুনলো না। এরচেয়ে বসে থেকে সব নাতি-নাতনিদের খোঁজ নিতে তার খুব ভালো লাগছে।
হিয়ার পড়াশোনার খোঁজ নিলেন চাচা। উনার পরামর্শ হল, মেইন বই পড়তে হবে ভালো করে। ‘মেইন বই হইল গিয়া আসল। অ্যাহনকার পুলাপানরা মেইন বই পড়ে না।’ হিয়া বললো, সে পড়ে। বোনদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। চাচা জোর দিলেন। এখন চান্স পাওয়া কঠিন। অ্যাপ্লিকেন্ট বেশি। হিয়া বললো, দোয়া করতে। চাচা বললো, ‘দুআ তো মা অবশ্যই করি। পডুন-ও লাগবো।’
কালকেই চাচা চলে যাবে। আমি বললাম, আরও কয়েকদিন থাকতে, শুক্রবারে যেতে। কী নাকি কাজ আছে। বললাম, ‘তুমার পলিটিকাল ঝামেলাও গেছে। তুমার থাকাথাকিও গেছে।’ জোরে সোরে হাসলেন চাচা। বাবা না থাকলে নিশ্চিৎ আরও জোরে হাসতেন।
দাদি সেই একই প্যাঁচাল নিয়ে আছে। ‘হাবিব কিরুম আছে? ফাহিম-জিসান-নার্গিস অরা কিরুম আছে? কতদিন দেহি না!’ এরমধ্যে কেঁদেও নিলো কয়েকবার। তার কথা কী জিজ্ঞাসা করে? এসব বলে বলে কান একেবারে ঝালাপালা করে দিচ্ছে। ‘দাদিরে দেকবার মুন চায় না? নার্গিসরে নিয়াইলেই পাইতি।’ চাচা নিয়ে আসতো নার্গিসকে। আসতেও নাকি চাচ্ছিলো। জেদ ধরেছিলো আসবে। চাচাই আনেনি। বাসে বমি-টমি করে একেবারে বিশ্রী অবস্থা করে। একদিনের জন্য এসব টানা-হ্যাঁচড়া আরও কষ্ট।
সকাল সকালই আমি বেরিয়ে যাবো। দেখা হয়, কি না হয়। চাচা বিদায় নিতে এলো। নিশ্চয়ই চাচা জরুরি কিছু বলবে। নয়তো রুমে আসতো না। আমাকেই ডেকে নিয়ে বসাতো ড্রয়িংরুমে। আমি তো শেরপুর যাওয়া বাদই দিয়েছি। দাদাবাড়িতে না গেলে কি হয়! বাপদাদার ভিটা। চাকরি-বাকরি নিয়ে কী ভাবছি? বিসিএস রিটেনে টিকলে না হয় এমপি-মন্ত্রী ধরে কিছু একটা চেষ্টা করা যাবে। এইসব ছিল চাচার কথাবার্তার বিষয়। কেন জানি আমার সন্দেহ হল, চাচা কি বাবার প্রতিনিধি হয়ে এসেছে? বাবা কি কিছু বলতে বলেছে চাচাকে? অবশ্য এমনিতেও চাচা খোঁজ নিতে পারে। আমি স্থির করলাম, চাচাকে ঠিক ঠিক জবাব দেব। চাচা নিশ্চিত বাবার সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার করবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম, চাচা কখন বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে। বিয়ের প্রসঙ্গ চাচা তুলবেই। আমি শিউর। ধীরে ধীরে চাচা সত্যিই বিয়ের দিকে গেল। আমাদের মা কি আর ছোটো আছে! বয়স হয়েছে বিয়েসাদি দিতে হবে। এখনকার যুগ আলাদা। চাচাদের যুগ আর নাই। মাঝপথে থেমে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা, কি কও? সবকিছু অ্যাহন ডিজিটাল।’ ভাবেভঙ্গিতে তার কথায় আমি সায় দিলাম। চাচার কথা এগিয়ে চললো। বাবা নাকি টেনশন করে। চাচা বলেছে, আমাকে আগে জিজ্ঞাসা করে দেখতে, পছন্দের কেউ আছে নাকি? ইত্যাদি ইত্যদি।
আমি চুপ করে শুনলাম। চুপ করে শোনা ছাড়া তখন আসলে কিছু করারও ছিলো না। বলতে দিলাম চাচাকে। চাচার চোখমুখ দেখে কেমন অসহায় লাগছিলো। খারাপ লাগছিলো আমার। আমাকে নিয়েই কি তাদের এত টেনশন? আমি কি যাচ্ছেতাই করা শুরু করেছি! কেমন একটু ভয় হলো। সবাইকে কি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছি? ভেতরে ভেতরে কেমন একধরনের বিষাদ অনুভব করছিলাম। কত আপন মানুষ এরা! কত অকৃত্রিম এদের আবেগ!
আমি বললাম, ‘চাচা শুনো, আমিও খেয়াল করছি বিষয়ডা। বাবা দেহি হুদাই টেনশন করে। তুমিই কও, মেয়েদের বিয়া নিয়া বাপ-মায়ে টেনশন করবো, এহন কি ঐ যুগ আছে? মাইয়ারা এহন পড়াশুনা কইরা ধুমধাম চাকরি-বাকরি করতাছে। কত কী! আমি কইছি, টেনশন-ফেনশন কইরো না।’ চাচা সায় দিলো আমার কথায়। তাকিয়ে থাকলো চকচকে চোখমুখ নিয়ে। কেমন অবলা একটা জীবের মত দেখাচ্ছে তাকে। তাকে খুব চিয়ার-আপ করতে ইচ্ছা করলো আমার। বললাম, ‘শুনো, আসলে আমার ঐ-রকম পছন্দ-টছন্দ নাই। বাবারে কইছি, একটা বছর দেহি, বিসিএস-টিসিএসের কী হয়! পরে ঠিক করা যাবো।’ বলে থামলাম। চাচা বললো, ‘তা তো মা ঠিকই কইছো। তুমি খালি রিটেনে টিকো। এমপি সাবরে আমি যাইয়া ধরলে না করবার পাবো না।’ আমি হাসলাম। বললাম, ‘তুমারে ঐসব নিয়া ভাবুন লাগবো না। আর শুনো, আমার কুনো পছন্দ নাই, ঠিক আছে। কিন্তু তুমারে কই, এহনি কাউরে কইয়ো না। আমার সঙ্গে চাকরি করে এক ছেলে আছে, আমারে পছন্দ করে। এহনো তারে কিছু কই নাই। দেহি কী হয়? এই চাকরিই করে নাকি অন্যডা? বুজছো? তুমি আবার কাউরে কইয়ো না। ভাববো, কী না কী!’ – আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম – ‘তুমি আবার ঐ বামটারে মনে কইরো না।’ অত্যন্ত অদ্ভুত বিষয় হলো। যে বর্ণনা আমি দিলাম, তা ইমরানের সঙ্গেই বেশি মানানসই। অন্য চাকরি খোঁজার কথা, বিভাস আমাকে কখনো বলেনি। তার কথা হলো, সব চাকরি একই।
চাচা চুপ করে গেলো। কী মনে করে ঘরের এদিকোদিক দেখতে লাগল। আনমনে আমি তার দৃষ্টিপথ অনুসরণ করলাম। একটা ক্যালেন্ডারের মার্জিনে উপর থেকে সিরিয়ালি লেখা :
দিয়া
রিয়া
হিয়া
লাল মার্কার পেন্সিলে লেখা। নিশ্চিৎ হিয়ার কাজ। অবশ্য রিয়াও করতে পারে।
সবকিছু কেমন অদ্ভুত। জীবনকে এক জটিল ধাঁধার মত মনে হয়। সবই সহজ। আবার সবই কঠিন। এর মানে কী? এই তো আমি। এই তো আমার চাচা। তাকে আসাদুজ্জামান নূরের মত লাগে। আসাদুজ্জামান নূর আওয়ামী লীগ করেন। তিনি মন্ত্রী। তিনি এমপি। তিনি বাকের ভাই। চাচাও আওয়ামী লীগ করেন। কিন্তু চাচা কিছুই নয়। কিন্তু তার হা-হুতাশও নেই। রাজার মত চলাফেরা। চাচাকে গ্রিক ট্রাজেডির নায়ক হিসেবে খুব মানাবে। কিন্তু সে অভিনয় করবে না। বলবে, তার জীবন ট্রাজেডি নয়। যদি বলি, কেন? এর উত্তর তার আছে। কিন্তু ভাষা নেই। সব ভাষা যেন বিভাসের কাছে। সব উত্তর তার জানা। শব্দ তার দাস। তার ঠোঁটে প্রতিটি শব্দ ঝনঝন করে বাজে। চাচার মধ্যে একটা গোপন বিভাস আছে। কেমন অভিযোগহীন। তার সঙ্গী-সাথীরা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কত কী করে ফেলেছে। চাচা কিছুই করতে পারেনি। চাচা বলে, সবাইরে দিয়ে সব হয় না। খুব আদর্শ থেকে যে বলে, তা নয়। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু করা তার কাছে ঠিকই মনে হয়। দল তার কর্মীদের জন্য কিছু করবে না? আসলে তার কাছে একেকজন একেকরকম। এটা সে ভালো করে বোঝে। তাই অন্যের প্রতি তার কোনো নালিশ নেই। বিভাসও এরকম। কেবল বিভাসের কাছে সব পরিস্কার। চাচার কাছে হয়তো সবকিছু এতো পরিষ্কার নয়।
দিয়া
রিয়া
হিয়া
তাদের দিতে হবে বিয়া। তাইতো! আমাদের নামের সঙ্গে বিয়া শব্দটা কেমন বিল্ট-ইন!
যখনই ফোন করি না কেন, দেখা যাবে বিভাস পড়ছে। অবশ্য যখন বলতে মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়েই তাকে ফোন করা হয়। প্রথম প্রথম ফোনে ওকে কেমন অপরিচিত লাগতো। মনে হতো খুব গম্ভীর ও বয়স্ক কারও সঙ্গে কথা বলছি।
: ছোটো চাচা এসেছে আমাদের এখানে। উনার সঙ্গেই কথা হচ্ছিলো। নয়তো আগেই ফোন করতাম। তুমি কী করো?
: পড়ছি শুয়ে শুয়ে।
: তোমার কি এই একটাই কাজ? যখনি ফোন করি, বলো, পড়ছি পড়ছি। আসলে তোমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করাই উচিত না যে কী করো? ফোন করলে না যে? আমার না-হয় আজকে একটু দেরি হলো। কিন্তু তুমি তো ফোন করতে পারতে? আমি ফোন না-করলে নিশ্চিৎ তুমি ফোন করতে না। সত্যি করে বলো তো? ফোন করতে কিনা?
: পড়ছিলাম তো খেয়াল করিনি, ক’টা বাজে।
: বিভাস, আমার ভালো লাগে না। প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে মিস করি। মনে হয়, এখানে তুমি থাকলে এটা বলতে, ওটা বলতে। কখনো তুমি চুপ করে থাকতে। শুধু এসব মনে হয়। আমার মাথা মনে হয় গেছে।
: কেউ কাউকে কখন মিস করে জানো? যখন সে তাকে হারিয়ে ফেলে। প্রেমের ক্ষেত্রে অবশ্য আরেকটা ব্যাপার ঘটে। এক্ষেত্রে কাছে পাবার পর হারানোর আশঙ্কায় বিরহ কাজ করে। প্রিয়কে কাছে পেয়ে তাকে হারানোর বেদনায় হৃদয় আচ্ছন্ন হয়। তোমার কোনটা?
বললাম, তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে, বিভাস। খুব। ‘আমাদের তো দেখা হচ্ছেই।’ আমি বললাম, না, সেভাবে না। তোমাকে আমি নিজের মত করে দেখতে চাই। একান্তই নিজের মত করে। যেখানে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ থাকবে না। তোমার সমস্ত শরীর দেখতে চাই আমি। ও হাসে।
বললাম, শোভনের ব্যাপারে তোমাকে আমার বিশেষ কিছু বলার আছে। বলবো বলবো করেও এতদিন বলতে পারিনি। সাহস হয়নি। যদি কিছু মনে করো। যদি আমাকে ঘৃণা করো। আমার খুব ভয় লাগে বিভাস। তোমাকে না-বলেও আমি থাকতে পারছি না। মরে যাচ্ছি কষ্টে। মনে হয় আমি লুকাচ্ছি তোমার থেকে। আমি প্রতারণা করছি তোমার সঙ্গে। তোমার আর আমার মধ্যে ভয়ের এই ব্যবধান আমার অসহ্য। আগে তুমি কথা দাও, আমাকে ভুল বুঝবে না। আমাকে ঘৃণা করবে না। আমাকে ছেড়ে যাবে না।
বিভাস হাসে। ও শুধু হাসে। আমি বললাম, তুমি শুধু হাসো কেন? আমি কাঁদছি বিভাস।
সে বলে, ও অভয় না-দিলেও নাকি একদিন আমি তা বলবো। বলবোই। আমি না-বলে নাকি থাকতে পারবো না। এতদিন পেরেছি বলেই বলিনি। জন্মের মুহূর্ত আসলে নাকি তাকে দীর্ঘায়িত করা যায় না। সেই ঘটনা নাকি আমার মধ্যে আর থাকতে চায় না। বেরিয়ে আসতে চায়। ফোঁড়ার মত। অনেকখানি দূষিত রক্ত, বীজাণু নিয়ে তা বেরিয়ে আসতে চায়। অনেকদিন সময় নিয়েছে সে। এবার বেরিয়ে আসার উপযোগী হয়েছে। এখন তা অপেক্ষায় আছে উপযুক্ত কোনো মুহূর্তের। উপযুক্ত কোনো ধাত্রীর।
হেঁয়ালিপনা করতে খুব ভালো লাগে তোমার? আমাকে নিয়ে তুমি মজা করছো বিভাস? সত্যিই আমি মরে যাচ্ছি কষ্টে। দিনের পর দিন ঘুম থেকে চমকে উঠেছি আমি। দুঃস্বপ্নের পর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আমি আর পারছি না।
ও বলে, তাহলে ও ঠিকই বলেছে। আমার গর্ভে ব্যথা শুরু হয়েছে। নতুন কিছু জন্ম দিতে যাচ্ছি আমি। তার ভাষায়, কে জানে আমি হয়তো জন্ম দিতে যাচ্ছি আমাকেই। কী সব কথা তার। বলে, খুব সৌভাগ্য হতো তার সে যদি এই প্রক্রিয়ার ধাত্রী হতে পারতো। তার কথার মাথামু-ু আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু আরামে আমার চোখ বুজে আসে। ওর কথায় কোনো রাগ নেই। দ্বেষ নেই। হিংসা নেই।
বললাম, আমি খুব বাজে একটা মেয়ে, বিভাস। তুমি জানো না। তোমাকে আমি জানাইনি। প্রতারণা করে জানাইনি। আমি প্রতারক।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে কিনা জানি না। কেন জানি মনে হচ্ছে ঘুমের ওপার থেকে কথা বলছি আমি। হ্যালো, বিভাস তুমি কি শুনছো? তোমার ওখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে? নাকি তোমার ফ্যানের শব্দ হচ্ছে? যা বলছিলাম, তোমার উচিত হবে, ভালো না-বেসে আমাকে ঘৃণা করা। আমার মুখ না-দেখা। আমার মুখে ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারিত হতে না-দেওয়া। মা ঠিকই বলেছে, বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি দেওয়া মেয়ে আমি।
বিভাস আমাকে বিচার করতে নিষেধ করে। বলে, বিচার কোরো না। বিচার করা তোমার কাজ নয়। না, আমি বিচার করিনি। বিচার করতে চাই না। কিন্তু এসব সত্য। সব সত্য। সত্য সকলেরই জানা উচিত। আমার মত বাজে মেয়েকে সকলে যেন চিনতে পারে। আমার থেকে সকলে যেন দূরে থাকতে পারে। তোমারও উচিত আমার থেকে দূরে থাকা।
তাকে আমি বললাম। স্পষ্টভাবে বললাম। শোভনের সঙ্গে সামান্য অ্যাফেয়ার আমার ছিলো না। দিনের পর দিন আমরা শারীরিক সংসর্গ করেছি। আমি কাঁদতেছিলাম কিনা, জানি না। কিন্তু চোখের পানিতে সব ভেসে যাচ্ছিলো। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে গালে ফোন রেখে আমি শুনছিলাম বিভাসের হাসি। ও হাসছিল। ও হাসছিল কেন? ও কি আমার কথা বিশ্বাস করেনি? ও কি বিদ্রূপের হাসি হাসছে? বিদ্রূপের হাসিই তো হাসবে। আমি আসলে তার পায়েরও যোগ্য নই। আমি তার হাসিরই পাত্র। আমাকে নিয়ে সে তো হাসবেই।
তুমি যে হাসছো, বিভাস? তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করো নি? ও বিশ্বাস করেছে। তাহলে কী বিদ্রূপ করছো? না বিদ্রূপ সে করছে না। এখন থেকে, আমাকে নিশ্চয়ই ঘৃণা করবে তুমি? না, সে ঘৃণা করবে না।
আমি হয়তো ঠিকমত বলতে পারিনি তোমাকে। আমি তোমাকে বিস্তারিতভাবে বলতে চাই, বিভাস। তোমাকে শুনতে হবে। এতদিন তো আমাকে ভালোবাসতে। সেই ভালোবাসার জন্যই শুনতে হবে। আরও কত কী আমি তাকে বললাম। আমার মনে নেই। কিচ্ছু মনে নেই। ও শুধু আমার কথা শুনেই গেলো। শুনেই গেলো। আমিই বলতে দিচ্ছিলাম না তাকে। না, ওর বলার কিছু ছিলো না। ওর বলার কিছু নেই। সব ছিলো আমার বলার কথা। আজ সব কথা আমাকেই বলতে হবে। ও যা বলছিলো, আমি তা বুঝতেছিলামও না। ও হেঁয়ালি করছিলো। ওর হেঁয়ালিপনা অসহ্য লাগছিলো আমার।
কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা, জানি না। হ্যাঁ, গতরাতে বিভাসের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। শোভনের বিষয়ে সব কথা আমি তাকে বলে দিয়েছি। ও বলছিলো, ‘শারীরিক সংসর্গ বলে আলাদা কোনো সংসর্গ নেই, দিয়া।’ এ কথাটাই কি সে বারবার বলছিলো? এ কথাটাই কি সে সবশেষে বলছিলো? আমার কপালে কি সে চুমু দিয়েছিলো একটা? চুমু দিতে চেয়েছিলো কি? এ কথা কি সে বলেছিলো যে, আমার পাশে থাকলে আমার সুন্দর কপালে সে একটা চুমু দিতো? অনেকক্ষণ ধরে চুমু দিতো? আমার চোখের নিচে সে চুমু দিতো? ‘শারীরিক সংসর্গ বলে আলাদা কোনো সংসর্গ নেই’ মানে কী? বিভাসের এই কথাটাকে মাথায় নিয়েই আমার ঘুম ভাঙলো। এত হালকা লাগছিলো নিজেকে! পালকের মত হালকা। ক্ষুধা লেগেছে খুব। আয়নায় নিজেকে দেখলাম। ভালো করে দেখলাম। চোখটা কেমন ফ্রেশ দেখাচ্ছে। মাঝারি গড়নের শরীর আমার। কেউ মোটা বলবে না। মোটা না-বলা গেলেও, আমাকে কেউ হ্যাংলা অন্তত বলবে না। সাদা একটা গেঞ্জি পরে আছি। গেঞ্জি ঠেলে বেরিয়ে আছে স্তনজোড়া। নজরে আসছে বোঁটাগুলো। স্তন নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য। পুরুষের চোখে স্তনই নাকি নারীর ফেইস। বিভাসের সঙ্গে কথাবার্তার পর্বটাকে একদম স্বপ্নের মত লাগছে। স্বপ্ন নয় তো?
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি ৯