শাহীন আখতারের ‘‘তালাশ’’ : ‘‘বীরাঙ্গনা’’ ও বঞ্চনার ইতিহাস

প্রজন্মের পরম্পরা রক্ষা করার মতই পৃথিবীর যাবতীয় শুভ ও কল্যাণকর সৃষ্টিযজ্ঞে নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে এটি শাশ্বত সত্য। মানবসৃষ্টির রহস্য এই সত্যের সূচনা দলিল। একে অপরের পরিপূরক সত্তা হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েই পৃথিবীর সামষ্টিক অগ্রগতির ধারক ও বাহক। ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ পৃথিবী বহুকাল এই সত্যকে আড়াল করে রেখেছে কিংবা অস্বীকার করে গেছে।

 

আধুনিক পৃথিবীতে নারী তার খোলসমুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে। আর এজন্য প্রতিনিয়ত তাকে লড়াইয়ের মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নারীমুক্তির অমসৃণ পথে হেঁটে বাঙালি নারীও তার জয়গাথা লিখে চলেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। যদিও সে ইতিহাস অনেকাংশেই গোচরীভূত নয়। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসেও জড়িয়ে আছে লাখো নারীর ত্যাগ ও সংগ্রামের রক্তাক্ত গাথা।

 

দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সংঘটিত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষের সম্মিলিত ঐক্যের দৃঢ় শপথে দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আমাদের ইতিহাসের এক বিস্ময়। ইতিহাস সৃষ্টির এই ক্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে বাঙালি নারী তাঁর দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু সেই গৌরবের চর্চিত ইতিহাসে নারী থেকেছে উপেক্ষায় এবং এখনো অপেক্ষায়। স্বাধীনতার ইতিহাসে নারীর অবস্থান যেন অনেকটা ‘‘না বললেই নয়’’ অবস্থা। একটি অগণনীয় সংখ্যার আঁধারে ঢেকে দেয়া হয়েছে তাদের সমস্ত ত্যাগ আর বীরত্বকে।

 

মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যেও নারীর অবস্থান বেশ নাজুক। যদিও সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্ম আমরা এখনো পাইনি। খণ্ডিত পরিসরে বিচ্ছিন্নভাবে যা পেয়েছি সেখানেও আমাদের বীরাঙ্গনারা ততটা মনোযোগ পায়নি। ‘‘বীরাঙ্গনা’’ থেকে ‘‘বারাঙ্গনা’’ হয়ে যাওয়া যুদ্ধাক্রান্ত অগণিত নারীর অকথিত কিছু গল্প সামনে এনেছেন ঔপন্যাসিক শাহীন আখতার। তাঁর তালাশ উপন্যাসে তিনি খুঁজে নিয়েছেন যুদ্ধের তোড়ে ভেসে যাওয়া কতিপয় নারীর জীবনচিত্র। কিছু প্রতিনিধি চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন নির্মম ক্ষত ও ক্ষতির বন্ধ দরজাগুলো।

পরিবার ও সমাজবিচ্ছন্ন হয়ে তারা ছিটকে পড়েছে অন্ধকার গুহায়। এসব নারীর জীবন না-জীবন হয়ে যাওয়ার দায় আমদের সমাজ ও রাষ্ট্রের। তালাশের কেন্দ্রীয় চরিত্র মরিয়ম। সে কেবল খড়কুটোর মতো ভেসেছে, কোথাও ঠাঁই পায়নি। বার বার উঠে দাঁড়াতে চেয়ে প্রবঞ্চিত হয়েছে স্বাধীন দেশে। তাই যুদ্ধকাল আর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের মধ্যে মরিয়মরা কোনো পার্থক্য খুঁজে পায়নি। তবে যুদ্ধের ভয়াবহতায় নিমজ্জিত থেকেও চোখে স্বপ্ন ছিল, কিন্তু স্বাধীন দেশে কেবল স্বপ্নভঙ্গই হয়েছে তাদের। যা আরো বেশি অভিমানের-অভিযোগের।

 

পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিপীড়িত ও সম্ভ্রম হারানো মরিয়ম স্বাধীন দেশেও শরীরকে নিরাপদ রাখতে পারেনি। বরং বার বার তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। স্বাভাবিক বাঁচার আকুতি তাকে আপসের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে। কিন্তু স্বস্তির দেখা সে কোনোদিনই পায়নি। ঔপন্যাসিক যার বর্ণনা এভাবেই করেছেন :

মরিয়ম হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর নিজের হয়নি।

মরিয়ম শিক্ষিত এবং সে অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। তাই ব্যক্তিত্ববোধে উচ্চকিত মরিয়ম বার বার নিজের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। কারো গলগ্রহ বা অনুগ্রহের পাত্রী হয়ে থাকার এই অনিচ্ছা তার নিয়তিকে নিয়ত উপহাস করেছে। শরীর বেচে বেঁচে থাকার সহজ পথ সে বেছে নেয়নি, বরং বাঙালি নারীর স্বামী-সংসারের স্বাভাবিক জীবনাকাঙ্ক্ষা তাকে বার বার তাড়িত করেছে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটতে পদে পদে তার কপালে জুটেছে গঞ্জনা আর বঞ্চনা।

 

মরিয়মের মত সাহসী নারীও অসহায়ের মত ধর্না দিয়েছে এর ওর কাছে। আর যারা তা পারেনি তাদের জায়গা হয়েছে জীবনের সরু পথে কিংবা বেশ্যালয়ে। যেন তারা আজীবনের জন্য নিপতিত হয়েছে নিষিদ্ধ পল্লিতে। অনুরাধা সরকার তাদেরই একজন। বিএম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী অনুরাধাকে পাকসেনারা পড়ার জগৎ থেকে তুলে এনে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে, যেখানে মরিয়মসহ আরো অনেকেই বন্দি ছিল। নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়াবহতায় থেকেও সে আনা ফ্রাঙ্কার মত যুদ্ধদিনের ডায়েরি লেখার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে সে তার সেই স্বপ্ন পূরণের পথ পায়নি। উপরন্তু তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল নিষিদ্ধ পল্লিতে। অসম্ভব বাস্তববাদী ও সম্মুখদ্রষ্টা অনুরাধা নিপীড়নের সেলে বন্দি থেকে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় সঙ্গীদের সতর্ক করেছিল। যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে তাদের সামগ্রিক মুক্তি মিলবে, এই ভাবনায় আচ্ছন্ন মরিয়মদের ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অসহায়ত্বের কথা সে এভাবেই ব্যক্ত করেছিল :

তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষেরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এই করুণ সত্যেরই চিত্র দেখা যায়। স্বাধীন দেশ পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে বীরত্বের মর্যাদা আর বীরাঙ্গনাকে দিয়েছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা। যুদ্ধে পরোক্ষ সহযোগিতা করা এবং প্রত্যক্ষ নির্যাতন-নির্মমতার শিকার হওয়া ছাড়াও পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ সমরে লড়াই করেছে অনেক বাঙালি নারী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তাদের অনেকেরই জোটেনি। যাদের স্বীকৃতি মিলেছে তাদেরও পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। মুক্তিযোদ্ধা পারুল একবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় আরেকবার বাদ পড়ে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও পরিবর্তন হয়। রাজনীতির এই হীনচক্রে নারী-পুরুষ সবাই সমানভাবে বলি হয়।

পাকিস্তানি সৈনিক শওকতকে বিশ্বাস করে শ্যামলী নামের আরেক বীরাঙ্গনা প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। ‘‘শওকতকে বিশ্বাস করে শ্যামলী নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’’ বলে মরিয়ম কটাক্ষ করলে অনুরাধা আক্ষেপ করে বলে :

কোন দেশ? যে দেশ তোমার ওপর শ্ত্রুর নির্যাতনকে নির্যাতন বলে দেখবে না, দেখবে বেইজ্জতি হিসেবে, তারপর হয় আমাদের লুকিয়ে না-হয় বেশ্যালয়ের দিকে ঠেলে দেবে — সেই দেশের প্রতি?

বাস্তবে তা-ই হয়েছিল। প্রত্যেকেই পরবর্তী বাস্তবতা দিয়ে এই নিষ্ঠুর সত্যকে উপলব্ধি করেছিল। অন্ধকার জগতে নিজের পরিচয়কে আড়াল করতে বীরাঙ্গনা অনুরাধা নিজের নাম পরিবর্তন করে হয়েছিল রাধারাণী। এরকম নাম পরিবর্তন অনেককেই করতে হয়েছিল। বিন্দুবালা তাদের একজন। শুধু নাম নয়, লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার তাগিদে তাকে ধর্মও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বলা যায়, পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল সে। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে সে মুসলমান হয়ে লাইলি বেগম নাম ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধা নজর আলীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছিল। সীমাহীন অপমান-অপদস্ত থেকে হয়তো আপাত মুক্তি মেলে তার, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব বন্দি হয়ে পড়ে আজীবনের জন্য।

 

তালাশ উপন্যাসটি যুদ্ধের প্রায় ত্রিশ বছর পরে লেখা। মুক্তি নামক এক এনজিওকর্মী কর্তৃক বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্যদিয়ে এখানে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধকালীন ও স্বাধীন-পরবর্তী প্রায় তিন দশকের তাদের নিদারুণ জীবনবাস্তবতা। যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি উঠে এসেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজনীতি-রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ, যেখানে বীরাঙ্গনাদের কোনো অবস্থান নেই। তারা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

 

কতিপয় প্রতিনিধি চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক বীরাঙ্গনাদের বাস্তব চিত্রটি চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। যাদের কেন্দ্রভাগে আছে মরিয়ম। অনুরাধা, বিন্দুবালা, শোভা রানী, জবা, টুকি, শ্যামলী, বেবি, পারুল, এরা প্রত্যেকেই যুদ্ধের ভয়ায়বহতার শিকার। পাকিস্তানি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের সাক্ষী এদের অনেকেই। শরীর-মনে বহমান যুদ্ধের ক্ষত ও ক্ষতিকে তারা পুষিয়ে উঠতে পারেনি, বরং তাদের জীবনে নতুন নতুন ক্ষত যুক্ত হয়েছে। আর সেই ক্ষত তৈরি হয়েছে নিজ দেশের মানুষ ও সমাজ দ্বারা।

 

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি নারীর জন্য আত্মহত্যাটাই যেন সবার স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। তাই বেঁচে ফিরে আসা মরিয়মকে আত্মহত্যা না-করার কৈফিয়ত দিতে হয়। মুক্তির এ সংক্রান্ত কটাক্ষের জবাবে মরিয়ম যখন বলে, ‘‘অহ! আমি কিন্তু আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। বাঁচার কথা ভাবতাম। আত্মহত্যার করার কথা ভেবেছি যুদ্ধের পর’’, তখন প্রশ্ন জাগে — এর জন্য দায়ী কারা? এই প্রশ্নের জবাবও ঔপন্যাসিক খুঁজেছেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, কেউই এই দায় থেকে মুক্ত নয়। যে পারুল যুদ্ধের মাঠে পুরুষের সাথে সমানতালে লড়াই করেছে, সেই পারুল যুদ্ধের পরে পুরুষ সহযোদ্ধার হাতে হয়েছে নিগৃহীত। ‘‘এই যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি?’’, পারুল মুক্তির এই প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘‘না, তখন এরকম কিছু হয়টয়নি। ছেলেতে-মেয়েতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে যাচ্ছি। সমস্যা হইছে যুদ্ধের পর, যখন সহযোদ্ধা শরাফত মিথ্যা কথা বুইলে পতিতালয় বিক্কিরি করতি নিয়া গেল আমারে।’’

 

একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য এরচেয়ে বড় গ্লানি আর কী হতে পারে! অথচ যুদ্ধকালে সকলের সংহতি ছিল সমস্ত স্বার্থ, লোভ আর কামনা-বাসনার উর্ধে। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ঘৃণ্য প্রকাশ আমরা এখানে দেখি, যেখানে একজন বীরাঙ্গনা আরেকজন ‘‘গর্বিত’’ মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়।

 

তালাশ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস হলেও এখানে যুদ্ধ সময়ের ভয়াবহতার চেয়েও বেশি উঠে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার চিত্র, যেখানে ঔপন্যাসিকের মূল মনোযোগটি মূলত বীরাঙ্গনা ও বারাঙ্গনাদের প্রতি নিবদ্ধ থেকেছে। বাঙালি নারীর প্রতি সমাজের যে প্রবহমান অবজ্ঞা চালু ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশেও তা কমেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা বেড়েছে। যুদ্ধে অঙ্কিত অহংকারের চিহ্ন বহন করা নারীর জন্য তা ছিল আরো নির্মম। দৃষ্টির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই মানবেতর জীবনের গল্পগুলো ঔপন্যাসিক নিষ্ঠার সাথে উপস্থাপন করেছেন। সেই সাথে তাঁর অভিমান-অভিযোগ আর ক্ষোভের অঙুলি নির্দেশ করেছেন রাষ্ট্রের সচেতন অবহেলার প্রতি। ‘‘দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’’র যে ভাষ্য আমরা শুনি, তা নিমিষেই উপহাসে পরিণত হয় যখন এদের অনেকেরই নাম-পরিচয় ও তালিকা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু বীরাঙ্গনা পরিচয়টিই হয়ে ওঠে ভারবাহী। এটি যেন অপমানের সূত্র হয়ে ওঠে। তাই যন্ত্রণার যত্নে এই পরিচয়টি লুকাতে হয়েছে অনেককেই। সবার শ্যেন দৃষ্টির বাণে জর্জরিত মরিয়ম আক্ষেপ করে বলে — বীরাঙ্গনা উপাধিটা যেন বিষাক্ত পোকা কিংবা ছোঁয়াচে রোগ, মরিয়ম ভয়ানক তিক্ততা নিয়ে বলে, এর ছোঁয়া লাগলে শরীরে ঘা হবে, হাত-পা পচেগলে খসে পড়বে। অথচ তারাই শতমুখে বলত, ‘‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা জাতির গর্ব, তোমরা মহীয়সী নারী!’’

 

মরিয়মের এই গ্লানিমাখা ক্ষোভের জবাব আমাদের কাছে নেই। এ লজ্জা আমাদেরই! দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘‘গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলে পুলসেরাতও পার হওয়া যায়’’ উক্তিটি অতিরঞ্জন হলেও অযৌক্তিক নয়। অথচ সেই বাস্তবতায়ই একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা একজন বারাঙ্গনা তার সামাজিক মর্যাদাটুকুও পায় না। ঔপন্যাসিক এই অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গি গতানুগতিক নয়। এমনকি এটি উপন্যাসের প্রথাগত নিয়মনীতিরও যথাযথ অনুগামী নয়। তবুও এর আবেদন হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে। সেটি বিষয়বস্তুর নিরিখে যেমন, তেমনি তা লেখকের নিবেদনের আন্তরিকতায় অনুভব্য। অসহায় ও বঞ্চিত নারীর প্রতি তাঁর সামাজিক দায়বোধের তাগিদটি আরো অর্থবহ হয়ে উঠেছে যুদ্ধ-পীড়িত নারীর অন্তর্নিহিত আর্তনাদকে চিৎকার করে জানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে। আর এখানেই উপন্যাসটি সফল হয়ে উঠেছে।

 

তবু নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এটিকে ‘‘ডকু নভেল’’ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, লেখিক প্রকাশের এই ভঙ্গিটি কেন নিলেন? ধারণা করি, এটি তাঁর সচেতন প্রয়াস ছিল। কারণ, তিনি যা বলতে চেয়েছেন এবং বলেছেন তার জন্য ফিকশনের প্রথাগত মাধ্যমটি যথাযথ উপযুক্ত নয়। তাতে করে তাঁর অনুভবের মাধুর্য ও উদ্দেশ্য আড়ষ্টতামুক্ত হতো না। তাই তিনি প্রকাশের এমন একটি ঢঙ বেছে নিলেন, যা পাঠককে ঘটনার গভীরে নিয়ে যায়। প্রতিবেদন এবং প্রামাণ্য চিত্রের আবেদন যে কারণে স্বীকৃত, লেখক তাঁর উদ্দিষ্ট প্রসঙ্গের বাস্তব ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার তাগিদে সেরকমই একটি বয়ানকৌশল বেছে নিলেন।

 

বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে এর আলাদা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমাদের সাহিত্যচর্চার পরিসরে যার পরিপক্ব অবস্থান এখনো তৈরি হয়নি হয়তো, যদিও ‘‘ডকু ফিকশন’’, ‘‘ডকু ড্রামা’’ প্রপঞ্চগুলো আমাদের কাছে পরিচিত ও কমবেশি আলোচিত। গত শতাব্দীর বিশের দশকে নবসৃষ্ট সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ায় শিল্প-সাহিত্যচর্চায় বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে এই প্রবণতাটি দেখা যায়। আমেরিকার প্রথাগত শিল্পচর্চার বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের বাস্তব ও জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপন কৌশলের প্রয়োজনে এই ‘‘ডকু ফিকশন’’ ও ‘‘ডকু ড্রামা’’ প্রসঙ্গগুলোর অবতারণা হয়।

 

প্রথাগত গল্প ও উপন্যাসে যেখানে আবেগ-কল্পনার প্রাবল্য থাকে এবং বিবেকের সংযত অবস্থান থাকে, ‘‘ডকু ফিকশন’’ সেখান থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ দেয়। ঔপন্যাসিক শাহিন আখতার আমাদের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়কে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে খুবই যৌক্তিকভাবে এই কৌশলটি বেছে নিয়েছেন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বলবার এই রীতির কারণে তাঁর বক্তব্যের গাঢ়তা ও গুরুত্ব আমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে এবং প্রত্যাশিতভাবেই আমরা বিষণ্ণ ও বিপন্নবোধ করি, লজ্জা ও দায়বোধে কাতর হই।

 

তালাশ রচনাটিতে ঔপন্যাসিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করতে চাননি, বরং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধাক্রান্ত বঞ্চিত অংশটির প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। আর সেই দুর্ভাগা অংশটি আমাদের বীরাঙ্গনা ও বারাঙ্গনারা। আক্রান্তের ভয়াবহতা বুঝাতে তিনি কখনো কখনো নিপীড়নের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন সত্য, তবে সেটি তাঁর মনোযোগের মূল বিষয়কে দৃঢ়তা দেবার জন্য।

 

সাক্ষাৎকারের সূত্রে কাহিনি উপস্থাপিত হলেও চরিত্রের মুখে সংলাপ খুবই কম। লেখক তাঁর নিজের দেখার ও দেখানোর মৌলিকত্ব দিয়ে ঘটনাগুলোকে সূত্রবদ্ধ করে বর্ণনা করেছেন। কখনো কখনো আকস্মিক সংলাপ তুলে দিয়েছেন চরিত্রের মুখে, যা ঘটনাকে আরো জীবন্ত করে তুলেছে। প্রতিবেদনের আকারে এই উপস্থাপনা সংবেদনশীল বিষয়টিকে আরো হৃদয়গ্রাহী করেছে। সার্বিক অর্থে, তাঁর এই বীক্ষণ ও নিরীক্ষণটি যথার্থ সফল বলেই মনে হয়।

একটি জাতিকে চূড়ান্ত অপমান করতে হলে সেই জাতির মাতৃকূল তথা নারী জাতিকে অপমান করার ধ্রুপদী নির্লজ্জ কাজটি পাকিস্তানিরা অত্যন্ত ‘‘নিষ্ঠার’’ সাথেই করেছিল। কিন্তু আফসোস ও গ্লানির বিষয় — প্রায় একই ‘‘নিষ্ঠা’’ সাথে স্বাধীন দেশ তাদের ওপর নিরব নির্লজ্জতা দেখিয়েছে। ঔপন্যাসিক শাহীন আখতার তাঁর তালাশ উপন্যাসে প্রায় অকথিত এই গল্প চমৎকারভাবে নিজস্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। সঙ্গত অর্থেই, তালাশ আমাদের ইতিহাস ও সাহিত্যের গণ্ডিতে একটি ভিন্নমাত্রিক সংযোজন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here