বুদ্ধিজীবীর দায়ভার ও আমাদের বিদ্বৎসমাজ

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে, প্রত্যেক সমাজে কিছু দ্বন্দ্ব থাকে, সেগুলোর নিরসন হওয়া উচিত পাবলিক আর্গুমেন্টের মাধ্যমে। যাঁরা চিন্তাবিদ তাঁরা জনগণের স্বার্থের দিক বিবেচনা করে নানা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সেই দ্বন্দ্বের সমাধানে এগিয়ে আসেন। কিন্তু মানুষের মঙ্গলের চিন্তায় আত্মনিবেদিত এমন বিদগ্ধ জনের বড়ই আকাল এখন বাংলাদেশে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের ছিলো গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু নব্বই পরবর্তী বাংলাদেশ যেন এর কঙ্কাল বহন করে চলেছে।

 

আমাদের বিদ্বৎসমাজ বিষহীন ঢোরা সাপ হয়ে গেছে। ফোস ফাসঁ করার শক্তিও মনে হয় হারিয়ে ফেলেছে। বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদরা এখানে এখন দু’ভাগে বিভক্ত। স্পষ্ট করলে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে তাদের আশ্রয়। এর বাইরে যারা নিজেদের নিরপেক্ষ মনে করেন, তাদের নানা সময়ের ভূমিকা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। তাদের হাল হকিকতও ’ধরি মাছ, না ছুই পানি’র মতো। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, কারা গণমানুষের দাবির পক্ষে সোচ্চার প্রতিনিধি-বুদ্ধিজীবী-সুশীল সমাজ? রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি তাদের দায়-দায়িত্ব কী?

 

এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় ফিলিস্তিনের প্রয়াত বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ। তাঁর মতে, ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বই হল প্রশ্ন তোলা, রক্ষণশীলতা, কর্তৃত্ব ও অন্ধবিশ্বাস মোকাবেলা করা। তার মধ্যে এমন বোধ কাজ করবে যে, সরকার বা কর্পোরেশন কর্তৃক করায়ত্ত হওয়ার মতো কেউ নন তিনি। তার কাজের ক্ষেত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে কোনো জনসমাজ বা গোষ্ঠী। তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন জনমানুষের।’ ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকোও বলেছেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা পরিচালিত হবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে, সব ধরনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে।’ এ ক্ষেত্রে তাঁরা স্পষ্ট করেছেন বুদ্ধিজীবীর দায় কী। কিন্তু ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় আমাদের চিন্তাবিদ-বিদ্বৎসমাজ কিংবা বিশিষ্টজনরা কতটা অনুভব করেন? কিংবা দেশে কোনো সংকট-দ্বন্দ্ব আদৌ আছে কিনা এবং এর সমাধানের প্রশ্ন উত্থাপন করা কতটা জরুরি, এর তাগিদ তাদের কতটা আছে? নাকি বুঝেও তারা নিশ্চুপ থাকেন কোনো না কোনো ‘পক্ষ’ হওয়ায়?

 

গণতন্ত্রের সংকট, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ব্যবস্থা, গুম-খুন, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের উত্থান ইস্যুতে এদের কোনো পক্ষ নিশ্চুপ, আবার কোনো পক্ষ খুবই উচ্চকণ্ঠ। যারা মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে নিশ্চুপ, তারাই আবার সরব গণতন্ত্রের প্রশ্নে। আবার যারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে উন্নয়নই সব মনে করেন, তারা মিনমিনে হলেও আওয়াজ তুলছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে। সুবিধা-সময় বুঝে এভাবে তারা জনগণের পক্ষ না নিয়ে অবস্থান নিচ্ছেন নিজ দল-সরকার ও ক্ষমতার পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ছাতার তলে থাকা সহস্র নাগরিক কমিটি ও শত নাগরিক কমিটি’র জ্যাকেট পরিধান করেই আরাম বোধ করছেন।

 

এক্ষেত্রে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, বুদ্ধিজীবী কি সরকার বা কোন দলের কাজ সমর্থন করবেন না? বুদ্ধিজীবীর কি থাকবে না কোনো রাজনৈতিক পরিচয়? এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আছে এর পক্ষে-বিপক্ষে মত। কিন্তু দুনিয়ার অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘কোনো বিশেষ দলভুক্ত হলে তিনি কখনও সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না।’ কারণ তিনি মনে করতেন, ‘প্রতিবাদই জীবন’। তবে রাসেল যেভাবে জনমানুষের কথা ভেবে বুদ্ধিজীবীকে রাজনৈতিক ফেরে না পড়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, তার সারমর্ম না বুঝেই বাংলাদেশের একটি পক্ষ অবশ্য সেই পাল্লায় নিজেদের মেপে চলেছেন। দুই রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে-বিপক্ষের বাইরে কিছু বুদ্ধিজীবী এক্ষেত্রে নিজেদের সত্যিকারের প্রতিবাদী ভেবে বসে আছেন। পরিচিত পুরনোদের নিয়ে গঠিত নতুন এই পক্ষের কাগুজে নাম কিছু বছর আগে ছিলো ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’।

 

প্রাক্তন আমলা, অধ্যাপক ও উন্নয়নকর্মীদের এই প্লাটফর্ম এর সদস্যরা সুশীল সমাজের কেতাবি নামেও পরিচিত। গত কয়েক বছর অবশ্য তাদের কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা যাচ্ছে না। ইতালীয় বুদ্ধিজীবী আন্তোনিও গ্রামসি সুশীল সমাজের নামে তাদের কর্মকাণ্ডকে বেধেছেন, ‘সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী’র কাঠামোয়। গ্রামসির মতে, এই ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের কাজ হল, ‘আধিপত্যশীল শ্রেণীর মুনাফা বৃদ্ধি, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রসার এবং সাধারণ মানুষের চেয়ে তার শ্রেণীর রুচি, চিন্তাভাবনা, ধারণা ও আকাঙ্খার বিস্তার।’ তাঁরা গণতন্ত্র রক্ষার নামে যেসব প্রস্তাব দেন, তত্ত্বকথা আওড়ান, তা কতটা সাধারণ মানুষের দাবি, জনমানুষের আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি সেটা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

 

এই প্রশ্নেই স্মরণ করতে পারি প্রয়াত শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী সরদার ফজলুল করিম স্যারকে। যিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটি লাইনের বয়ান দিয়ে তার দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ‘জীবনে জীবন যোগ করা না হলে ব্যর্থ হয় কথার কথা।’ আমাদের বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদদের কথায়, কাজে ও চিন্তায় বড় ঘাটতি হয়তো এই জীবন ঘনিষ্ঠতার, জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে না বোঝার। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি, কথা বলছি সমৃদ্ধি-অগ্রগতির — তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে বারবার ?

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here