সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কোরিয়ান চলচ্চিত্রকার কিম কি দুক। বিশ্বচলচ্চিত্রে নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। গল্পকার ও চলচ্চিত্র গবেষক মাসুদ পারভেজ লিখেছেন কিমের স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং সিনেমাটি নিয়ে। লেখাটি মাসুদের চলচ্চিত্রনামা বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে সহজিয়ায় প্রকাশ করা হলো।
মানুষের জীবনে বয়সকেন্দ্রিক কয়েকটি স্তর আছে। যে-স্তরগুলোতে উপনীত হলে মানুষ অনুভব করে জীবনের মানে পাল্টানোর দৃশ্যপট। এই দৃশ্যপটে আছে শিশুকালের সরলতা, যৌবনের উদ্যমতা, মাঝবয়সের প্রবল কর্তব্যজ্ঞান, আর বৃদ্ধকালে নিঃশেষ হয়ে যাবার প্রজ্ঞা। মহামানব কিংবা নির্বোধ প্রতিটি মানুষকেই জীবনের এই স্তরগুলো পার হতে হয় বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ফলে এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কাউকে সাধু হিসেবে রূপান্তরিত করে আর কাউকে দুর্বৃত্তে পরিণত করে। যেটাই হোক না — কেন মানুষ শেষপর্যন্ত একটা মুক্তি খোঁজে। এই মুক্তির স্বরূপ আসলে কী? কিংবা ইহজাগতিক মোহমুক্তি নাকি পারলৌকিক মুক্তি কোনটার আকাক্সক্ষা করে মানুষ? তখন আরেকটি প্রশ্ন আসে, এই মুক্তি মানে কি আত্মার শান্তি? এমন কতগুলো প্রশ্নের মধ্য দিয়ে কোরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি দুক নির্মাণ করেছেন স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রটি। যেখানে এই চারটি ঋতু যেমন মানুষের জীবনের বয়সভিত্তিক চারটি অবস্থাকে কেন্দ্র করে তুলে ধরা হয়েছে তেমনি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বুদ্ধের চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে। চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নির্মাতা কিম কি দুক সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।
কিম কি দুক
কোরিয়ান চলচ্চিত্রের যে-কয়েকজন বিশ্বখ্যাত নির্মাতা আছেন তাদের মধ্যে কিম কি দুক অন্যতম। দক্ষিণ কোরিয়ার কিওংসাং প্রদেশে ২০ ডিসেম্বর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন কিম কি দুক। স্কুলের পাঠ শেষ করার আগেই পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে কারখানায় কাজ নেন। সেখান থেকে গির্জায় চলে যান ধর্মযাজক হওয়ার উদ্দেশ্যে। তারপর যোগ দেন নৌবাহিনীতে। সেখানেও তার মন টেকে না। পরবর্তী কালে চলে যান প্যারিসে। সেখানে ১৯৯০-৯৩ এই তিন বছর ফাইন আর্টস বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে আসেন এবং স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেন। প্রথমবার স্ক্রিপ্ট লিখেই পান প্যারিজমস স্ক্রিপ্ট রাইটিং ইন্সটিটিউট পুরস্কার। তারপর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্রোকোডাইল চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একে একে নির্মাণ করেন ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস্ (১৯৯৬), বার্ডকেস ইন (১৯৯৮), দ্য আইল (১৯৯৮), রিয়েলফিকশন (২০০০), এড্রেস আননোন (২০০১), ব্যাড গাই (২০০১), দ্য কোস্টগার্ড (২০০২), স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং (২০০৩), থ্রি আয়রন (২০০৪), দ্য বো (২০০৫), ব্রেথ (২০০৭, রাফকার্ট (২০০৮), আমেন (২০১১), মোবিয়াস (২০১২), মেড ইন চায়না (২০১৫), দ্য নেট (২০১৬)-এর মতো চলচ্চিত্র। কান, ভেনিস, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে তার চলচ্চিত্র।
কিম কি দুকের চলচ্চিত্রের বিশেষত্ব কিংবা স্বাতন্ত্র্য হলো স্বল্প সংলাপ বা নির্বাকধর্মীতা। এ-প্রসঙ্গে কিম বলেন, ‘আমি মনে করি না, সংলাপই একটা ভালো চলচ্চিত্রের মূল উপাদান।’১ তার চলচ্চিত্রের চরিত্ররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীরব থাকে। এ-প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কিম বলেন :
এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা গভীর দুঃখ পাওয়ার ফলে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। মানুষকে ধ্বংস করার বিষয়টিই তখন তাদের বিশ্বাস জুড়ে থাকে। পাশে থাকা অনেক মানুষ, যারা তাদেরকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রাখে না; মুখে বলে এক আর করে আরেক। ফলে তাদের ওপর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কথা বলা। এ-সময় মানুষ জড়িয়ে পড়ে সহিংসতায়। তাদের এই সহিংসতার প্রকাশ কে আমি নেতিবাচক না ভেবে, শারীরিক ভাষা বলতেই বেশি পছন্দ করি।২
কিম কি দুকের এই বার্তা থেকে তার চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য কিংবা ন্যারেটিভ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এমনকি তার ব্যক্তিজীবনও তার চলচ্চিত্রের কাহিনির সাথে সম্পর্কিত।
ছোটবেলায় আমার চেয়ে যারা বয়সে ছোট কিন্তু শারীরিকভাবে শক্তিশালী তারা আমাকে বিনা কারণে মারতো। আমাকে নীরবে সহ্য করতে হতো। এমনকি আমি যখন নৌ-সেনা হিসেবে চাকরি করি তখনও আমার চেয়ে যারা উঁচু পদের ছিলো তারা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই আমাকে আঘাত করতো। এসব অভিজ্ঞতায় আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, কেনো এমনটি হবে? পরিচালক হওয়ার আগ পর্যন্ত এই চিন্তা-ভাবনাগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতো। এখন আমি এই চিন্তা-ভাবনাগুলোর প্রতিফলন আমার চলচ্চিত্রে তুলে ধরি।৩ ফলে কিম কি দুক তার চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটা জগৎ নির্মাণ করেছেন। এবার তার স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রে সেই জগৎটার খোঁজ করা যাক।
কাহিনি সংক্ষেপ
স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রটির চারটি স্তর। যার শুরুটা হচ্ছে স্প্রিং দিয়ে। স্ক্রিনে ‘স্প্রিং’ লেখা ভেসে ওঠার পর একটি কাঠের দরজার দেখা পাওয়া যায়। দরজার দুই পাল্লাায় দুটি সুঠামদেহী মানুষের মিনিয়েচার। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজা আপনা থেকেই খুলে যাবার পর চোখে পড়ে পাহাড়ি অরণ্যে ঘেরা লেকের পানিতে ভাসমান একটি ঘর। তারপর পুরো দৃশ্যটা একটা ফ্রেমে ধরা হয় আর তখন চোখে পড়ে একটা দরজা যার চারপাশে কোনো দেয়াল নেই, দরজার পাশে একটি বৃক্ষ আর পানিতে ভাসমান একটি ঘর। এভাবেই শুরু হয় স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং। তারপর দেখা যায়, চলচ্চিত্রের দুই চরিত্র একজন বৌদ্ধ গুরু আর তার শিশু শিষ্য। মূলত এই দু’জনকে ঘিরে চলচ্চিত্রের কাহিনি আবর্তিত হয়। যার শুরু হয় ‘স্প্রিং’ দিয়ে। আর এই স্প্রিং হচ্ছে শিশুটির প্রথম শিক্ষাগ্রহণ কাল। শিশুটি নিজে নৌকা চালিয়ে লেক পাড়ি দিয়ে দরজা পেরিয়ে যায়। তারপর আবদ্ধ পাথুরে পানি থেকে একটি ছোটোমাছ, একটি ব্যাঙ ও একটি সাপ ধরে তাদের শরীরে সুতো দিয়ে পাথর বেঁধে ছেড়ে দেয়। মাছ, ব্যাঙ এবং সাপ যখন পাথরটি টানতে পারে না তখন এই দৃশ্য দেখে শিশুটি আনন্দিত হয়। এই দৃশ্যটি তার গুরু দেখে। তারপর শিশুটি ঘরে ফিরে এসে যখন ঘুমায় তখন গুরু শিশুটির পিঠে একটি পাথর শক্ত করে বেঁধে দেয়। ঘুম ভাঙার পর শিশু মানে শিষ্য এটার কারণ জানতে চায় আর তখন তার গুরু জানায়, সে মাছ, ব্যাঙ এবং সাপের সঙ্গে এমন আচরণ করেছিল কি না? শিষ্যটি উত্তরে তা স্বীকার করে। তখন গুরু বলে, ‘যদি কোনো প্রাণি মানে মাছ, ব্যাঙ অথবা সাপ যেকোনো একটি মরে, তাহলে আজীবন এই মৃত্যু পাথর হয়ে তোমার মনে ভর করে বেড়াবে।’ তখন শিষ্যটি আবার ওইসব মাছ, ব্যাঙ এবং সাপ খুঁজতে বের হয়। তখন সে দেখে মাছটি মরে গেছে, ব্যাঙটি জীবিত থাকে এবং তাকে মুক্ত করে দেয় আর সাপটি রক্তাক্ত হয়ে মরে পড়ে থাকে। এই দৃশ্য দেখার পর সে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। তার কান্নার শব্দ ও পাহাড়ি নদীর পানির বয়ে চলার শব্দ মিশে যেতে থাকে।
এরপর স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার …অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় স্তর মানে ‘সামার’ শুরু হয়। আবার দরজাটি ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে আপনা থেকেই খুলে যায়। শিষ্যটি এখন সতের বছরের কিশোর। তখন শহুরে এক নারী তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে সেই বৌদ্ধ গুরুর কাছে আসে। কন্যাটির শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য তাকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। কিশোর শিষ্যের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যায় এই প্রথম কোনো মেয়ের সাক্ষাৎ সে পেল। ফলে মেয়েটিকে যখন কাপড় পাল্টাতে দেখে তখন থেকে তার স্তনের প্রতি চরম আকর্ষণ বোধ করে সে। একপর্যায়ে মেয়েটির সঙ্গে শিষ্যের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক রাতে তারা সঙ্গমের পর নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ে এবং গুরুর চোখে সেই দৃশ্য পড়ে। তারপর গুরুর কাছে শিষ্য তার কর্মের জন্য ক্ষমা চায়। তখন গুরু বলে, ‘যা হয়েছে তা আপানাআপনি ঘটেছে। এটা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা মাত্র।’ তারপর মেয়েটি তার সুস্থতার কথা গুরুর প্রশ্নসাপেক্ষে বলে এবং গুরুর নির্দেশে সে তার বাড়ি ফিরে যায়। কিশোর শিষ্যটি মেয়েটির চরম অভাববোধ করে এবং এক রাতে সে বুদ্ধের একটি মূর্তি নিয়ে মেয়েটির খোঁজে গৃহত্যাগ করে।
এরপর চলচ্চিত্রের তৃতীয় স্তর ‘অটাম’ বা ‘ফল’ শুরু হয়। আবারও ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজা খোলে। গুরু তখন বৃদ্ধ দশায় উপনীত। খাবার মোড়ানো একটা পত্রিকার পাতায় শিষ্যের ছবিসহ হত্যা করে পালিয়ে বেড়ানোর খবর তার চোখে পড়ে। তখন একদিন শিষ্যটি আশ্রমে ফিরে আসে। শিষ্যটি তখন তিরিশ বছর বয়েসি এক যুবক। একপর্যায়ে সে তার স্ত্রীকে হত্যা করার বিষযটি স্বীকার করে। তারপর সে আত্মহত্যা করতে যায় এবং গুরু তাকে রক্ষা করে। তখন গুরু তার মনের শান্তির জন্য প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র খোদাই করতে বলে। এমন সময় পুলিশ আসে। সূত্র খোদাই করা শেষ হলে পুলিশ শিষ্যকে নিয়ে চলে যায়। আর বার্ধক্যে উপনীত গুরু নৌকায় বসে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করে।
এবার চলচ্চিত্রের চতুর্থ স্তর ‘উইন্টার’ শুরু হয়। আবারও দরজাটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দে খোলে। চারপাশ বরফে ঢাকা। শিষ্যটি আবার ফিরে আসে। এবার সে মাঝবয়েসি এক পুরুষ। তখন একদিন এক নারী কান্নারত শিশুকে নিয়ে হাজির হয়। নারীটির চেহারা কাপড়ে ঢাকা থাকে। একরাতে নারীটি তার শিশুপুত্রটিকে রেখে পালিয়ে যাবার সময় বরফের নিচের পানিতে তলিয়ে যায়। তারপর শিষ্যটি একটি গোলাকার শিলে দড়ি বাঁধে আর দড়ির অপরপ্রান্ত কোমরে বেঁধে খালি গায়ে বরফের ওপর দিয়ে টানতে থাকে। তার হাতে একটি বৌদ্ধমূর্তি। সেটা নিয়ে পাহাড়ে ওঠে এবং পাহাড়ের চূড়ায় তা স্থাপন করে।
এবার চলচ্চিত্রের পুনরাবৃত্তি স্তর ‘অ্যান্ড স্প্রিং’। এখানে নারীটি যে-শিশুটিকে রেখে যায় সে চার-পাঁচ বছরে পড়ে। শিশুটি মাছ, ব্যাঙ, এবং সাপের মুখে পাথর আটকিয়ে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করে। পাহাড়ের চূড়ার বৌদ্ধ মূর্তিকে দেখিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়।
কী দেখালেন কিম?
প্রথমেই বলতে হয় কিম কি দুক কোনো সময়ের নির্দিষ্টতার মধ্যে এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট রাখেননি। এটা ইতিহাসের কোনো সময়ের কাহিনিও নয় আবার কারো বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও নয়। মানব মনের চিরায়ত যে-দ্বন্দ্ব সেটাকেই উপজীব্য করেছেন কিম। আর এই দ্বন্দ্বকে সিদ্ধ করেছেন বৌদ্ধধর্মীয় রীতি দ্বারা। যেখানে বৌদ্ধদর্শনের ‘চারটি আর্যসত্য’ লক্ষণীয়।
ক. জীবন দুঃখময়;
খ. দুঃখের কারণ আছে;
গ. দুঃখের নিবৃত্তি আছে;
ঘ. দুঃখ নিবৃত্তির মার্গ বা পথ আছে।
তখন খুব সহজে একটা প্রশ্ন আসে, এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নির্মাতা কি বৌদ্ধধর্মকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে চেয়েছেন? তখন দেখা দরকারি হয়ে পড়ে এই চলচ্চিত্রে ঋতুচক্রে জীবনের পরিবর্তন এবং কয়েকটা সংলাপের মর্ম বিশ্লেষণ। এমনিতে এই চলচ্চিত্রে বেশি সংলাপ নেই কিন্তু কয়েকটি সংলাপ যেন বাণী আকারে প্রয়োগ করেছেন নির্মাতা। এবার সেদিকে নজর দেওয়া যাক।
ক. ‘স্প্রিং’ অর্থাৎ জীবন দুঃখময়
‘স্প্রিং’ অর্থাৎ যখন শিষ্যটি শিশু তখন তার কৃতকর্মের জন্য গুরু একটি সংলাপ বলেন, ‘যদি কোনো প্রাণি মানে মাছ, ব্যাঙ অথবা সাপ যেকোনো একটি মরে, তাহলে আজীবন এই মৃত্যু পাথর হয়ে তোমার মনে ভর করে বেড়াবে।’ চলচ্চিত্রে দেখা যায়, মাছ এবং সাপটি মরে যায়। এই ব্যাপারটি শিষ্যটি সারাজীবন তার মনে বয়ে বেড়ায়। ফলে চলচ্চিত্রের ‘উইন্টার’ অংশে সেটার দৃশ্যায়ন ঘটে। আর এখানে গুরু শিশু শিষ্যকে শিক্ষা দিলেন, ‘জীব হত্যা মহাপাপ।’ অর্থাৎ সর্বজীবে দয়া দেখানোর বুদ্ধের উপদেশ। শিষ্য কিন্তু ক্রূরতা থেকে মাছ কিংবা সাপ মারেনি। নিছক একধরনের সরল আনন্দ থেকেই সে এটা করেছিল। ফলে এখানে উঠে এল, যা তোমার সরল আনন্দের কারণ তা অন্যের জীবননাশের কারণ হতে পারে। আর আনন্দ বা সুখ ক্ষণস্থায়ী। ফলে মরা মাছ আর মরা সাপ দেখে শিশুটি যখন চিৎকার করে কাঁদে তখন বুদ্ধের ‘প্রথম আর্যসত্য — জীবন দুঃখময়’-এর প্রয়োগ ঘটালেন নির্মাতা কিম। ‘এজগতে জীব, ব্যাধি জরা ও মৃত্যুর অধীন। এগুলি দুঃখের সৃষ্টি করে।’৪ তখন গুরুত্ব পেল, হত্যার জন্য শিষ্যের মনে জন্মানো অপরাধবোধের ব্যাপারটা। আর এই অপরাধবোধ মানে দুঃখ। ফলে শিষ্যের জীবনে ‘স্প্রিং’-এর শিক্ষা হলো ‘প্রথম আর্যসত্য — জীবন দুঃখময়’।
খ. ‘সামার’ অর্থাৎ দুঃখের কারণ আছে
‘সামার’ স্তরে শিষ্যটি সতের বছরের কিশোর। এই স্তরে এক কিশোরীকে যখন চিকিৎসার জন্য আশ্রমে আনা হয় তখন গুরু কিশোরীর মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘যখন তার আত্মা শান্তি ফিরে পাবে, তখন তার শরীরও স্বাস্থ্য ফিরে পাবে।’ এই সংলাপের মাধ্যমে দেহসাধনা আর আত্মাসাধনা বিষয় দুটির ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং চলচ্চিত্রে সেটা দেখানোও হয়েছে যে, একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। ফলে কিশোরীটি যখন শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় তখন সে মানসিকভাবে প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে এবং তার স্বাস্থ্য ফিরে পায়। শিষ্য ও কিশোরী যৌনক্রিয়ার পর গুরুর কাছে ধরা পড়লে শিষ্য ক্ষমা চায়। তখন গুরু বলে, ‘যা ঘটেছে তা আপনাআপনি ঘটেছে। এটা প্রাকৃতিক ঘটনা মাত্র।’ তারপর কিশোরীটিকে যখন আশ্রম থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন শিষ্য দ্বিমত করলে গুরু বলে, ‘ব্যভিচারের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলে তা গ্রাস করবে। এবং এটা বাড়তে বাড়তে খুনের দিকে নিয়ে যাবে।’ তখন এই উক্তিটি বুদ্ধের ‘সকাম কর্ম’র প্রেক্ষাপটকে নির্দেশ করে। “রাগ-দ্বেষ-মোহজাত কর্মই হলো সকাম কর্ম। ‘সকাম কর্ম’ মানুষের দুঃখ-কষ্ট আনে ও বন্ধন সৃষ্টি করে”।৫ তখন ‘দ্বিতীয় আর্যসত্য — দুঃখের কারণ আছে’-এর প্রয়োগ ঘটে চলচ্চিত্রে।
বুদ্ধদেবের ২য় আর্যসত্যটি কার্যকারণ নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ ছাড়া কোন কার্য সৃষ্টি হয় না। সংসারে যেমন দুঃখ আছে তেমনি দুঃখের কারণ আছে। এ দুঃখের কারণ হলো জন্ম। জন্মের কারণ হলো পার্থিব জিনিসের প্রতি আসক্তি, আবার এই আসক্তির কারণ হলো অবিদ্যা। অবিদ্যার ফলে মানুষ মিথ্যাকে সত্য, অনিশ্চিত ও অনিত্য বস্তুকে সত্য নিত্য জ্ঞান করে।৬
শিষ্যটি যখন কিশোরীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়ে এবং কিশোরটি যখন আশ্রম থেকে বিদায় হয় তখন শিষ্যের এই কামাসক্ততা তার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে আশ্রম ত্যাগ করে। এখানে শিষ্যটির ইন্দ্রিয়জাত ভোগের স্পৃহা বা তৃষ্ণা জন্মে। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধ বলেন, ‘তৃষ্ণার কারণ হলো বেদনা অথবা আগের অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ অনুভূতি।’৭ আর ‘অটাম’ স্তরে দুঃখ, কষ্টের ব্যপারটার প্রতিফলন ঘটে।
গ) ‘অটাম’ অর্থাৎ দুঃখের নিবৃত্তি আছে
‘অটাম’ স্তরে তিরিশ বছর বয়েসি শিষ্যটি তার স্ত্রীকে হত্যা করে আশ্রমে পালিয়ে আসে। শিষ্যটি যখন জানায় তার স্ত্রী আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে, ফলে সে তাকে খুন করেছে, তখন গুরু বলে, ‘তুমি কি আগে থেকে জানতে না পৃথিবীতে পুরুষেরা কেমন? বেশিরভাগ সময় আমরা যা পছন্দ করি সেটার পেছনে আমরা ছুটি। যা তুমি পছন্দ কর, আরেকজনও সেটা পছন্দ করতে পারে!’ তারপর শিষ্যটি যখন মানসিকভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তখন গুরু তাকে উদ্ধার করে এবং বলে, ‘তুমি যত সহজে অন্যকে হত্যা করতে পার, নিজেকে হত্যা করা তত সহজ নয়।’ গুরু তখন শিষ্যের মানসিক যন্ত্রণা লাঘবের জন্য প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ক্যালিগ্রাফি করে এবং শিষ্যকে তা খোদাই করতে বলে। যে-চাকু দিয়ে সে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছিল সেই চাকু দিয়ে সে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র খোদাই করতে থাকে। এখানে ‘তৃতীয় আর্যসত্যÑদুঃখের নিবৃত্তি আছে’ প্রয়োগ ঘটালেন নির্মাতা। প্রজ্ঞাপারমিতা সম্পর্কে গুরু বলছেন, ‘এটা অন্তরের শান্তি আনতে সহায়তা করে।’ এবং চলচ্চিত্রে তা দেখানো হয়। ফলে উগ্র হয়ে ওঠা শিষ্যটি যখন সারারাত ধরে সূত্র খোদাই করে ঘুমিয়ে পড়ে তারপর সকালে জেগে ওঠে, তখন খোদাইকরা সূত্র দেখে তার মনে একধরনের প্রশান্তি বিরাজ করে। এবং যে পুলিশ শিষ্যটিকে গ্রেফতার করতে এসে পিস্তল তাক করেছিল সেও ঘুমন্ত শিষ্যের গায়ে তার নিজের জ্যাকেট চাপিয়ে দেয়।
প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র দিয়ে শিষ্যের দুঃখের কারণ নিবৃত্ত করার প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায়। “এই দুঃখ নিবৃত্তির অবস্থাই হলো ‘নির্বাণ’। ‘নির্বাণ’ অর্থ হলো দুঃখের হাত থেকে চিরমুক্তি পাওয়া।”৮ আর ‘বাসনার বিলুপ্তি ঘটলে নির্বাণ লাভ হয়।’ যা ‘উইন্টার’ অংশে দেখানো হয়।
ঘ) ‘উইন্টার’ অর্থাৎ দুঃখ নিবৃত্তির মার্গ বা পথ আছে
শিষ্য আবার আশ্রমে ফিরে আসে। এবার সে মাঝবয়েসি। আশ্রমে ফিরে সে বরফ-কেটে একটি বুদ্ধমূর্তি বানায়। এটা তার গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তারপর সে শারীরিক-সাধনার একটি বই দেখে এবং ব্যায়াম শুরু করে। এরপর শিশুটিকে সে গ্রহণ করে। এবার সে তার শিশুকালের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে হাতে বুদ্ধের মূর্তি আর কোমরে বাঁধা শিল নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে। তখন ফ্ল্যাশ ব্যাকে পাথর-বাঁধা মাছ, ব্যাঙ আর সাপটিকে দেখানো হয়। এসব দ্বারা ‘চতুর্থ আর্যসত্য — দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে’-এর উপস্থিতি ঘটে। অর্থাৎ শিষ্যটি তার কৃতকর্মের জন্য মৃত মাছ আর সাপের জন্য মনে যে-দুঃখের পাথর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে সে এটা করে। “দুঃখ নিরোধের মার্গ বা পথ আছে — সে পথ অনুসরণ করে দুঃখ থেকে চিরমুক্তি লাভ করা যেতে পার। এই পথের নাম ‘অষ্টমার্গ’।”৯
ক) সম্যক-দৃষ্টি;
খ) সম্যক-সংকল্প;
গ) সম্যক-বাক;
ঘ) সম্যক-কর্ম;
ঙ) সম্যক-আজীব;
চ) সম্যক-ব্যায়াম;
ছ) সম্যক-স্মৃতি;
জ) সম্যক-সমাধি।
‘উইন্টার’-এ শিষ্যের বিভিন্ন কাজের মধ্যে এই অষ্টমার্গকে হাজির করেছেন নির্মাতা। ‘অ্যান্ড স্প্রিং’-এ সেই পুনরাবৃত্তি দেখানো হয়। ফলে শিষ্যটি এখন গুরুর আসনে আর শিশুটি এখন শিষ্য।
কোন ‘যান’-এ গেলেন কিম?
বুদ্ধের তিরোধানের পর তার শিষ্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই মতভেদ দূর করার জন্য বৈশালীতে যে-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে একদল ভিক্ষু আচার ব্যবহারের কঠোরতা শিথিল করতে বলেন কিন্তু আরেকদল ভিক্ষু সেটাতে রাজি হয় না। যারা কঠোরতা শিথিল করার পক্ষে তাদের সঙ্ঘ থেকে বের করে দেওয়া হয়। বহিষ্কৃত ভিক্ষুরা ‘মহাসঙ্গিক’ সম্প্রদায় গঠন করেন যা পরবর্তীকালে ‘মহাযান’ নামে পরিচিতি পায়। আর প্রাচীনপন্থীরা ‘হীনযান’ নামে পরিচিতি পায়। এখন প্রশ্ন জাগে কিম কি দুক স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রে মহাযান নাকি হীনযান কাদের দেখালেন?
হীনযানী বৌদ্ধরা আত্মার অস্তিত্বে অর্থাৎ নিত্য আত্মায় বিশ্বাসী নন। কিন্তু মহাযানীরা নিত্য আত্মায় বিশ্বাস করেন। নিত্য আত্মা বলে যদি কিছু না থাকে, তবে মানুষ কার মুক্তির জন্য সাধনা করবে।
হীনযানীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না কিন্তু মহাযানীরা বুদ্ধকে ভগবান বা ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত মনে করেন। এদের মতে সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের পূজার মতো বুদ্ধের পূজার্চনা করে তার করুণা ও সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে।১০
এখন চলচ্চিত্রে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, গুরু, শিষ্য এবং আরও যে চরিত্রগুলো পাওয়া যায় তারা সবাই বুদ্ধমূর্তির পূজার্চনা করে। আর হীনযানীদের মতো কোনো কঠোর বা গোঁড়া রীতির মধ্য দিয়ে গুরু জীবন সাধনা করেন না। ফলে তার শিষ্য শারীরিক সম্পর্কের মতো ব্যাপারে জড়িত হবার পর গুরু সেটাকে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
নির্বাণ
স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রে ‘অটাম’ স্তরে গুরু স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। এটাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তখন প্রশ্ন আসে গুরু কেন এটা করলেন? কিংবা নির্মাতা এটা দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাচরণের কোন প্রেক্ষাপটকে হাজির করলেন? তাহলে কি এটাই নির্বাণ? “নির্বাণ কথাটির সাধারণ অর্থ ‘নিভে যাওয়া’। দীপ যেমন উপাদানের অভাবে নির্বাপিত হয় তেমনি নির্বাণে তৃষ্ণার নিরোধ হয়। অনেকে নির্বাণকে জীবনের নিঃশেষে বিনাশকেই বুঝিয়েছেন।”১১ কিন্তু বুদ্ধ নির্বাণকে এভাবে দেখেননি। ‘বুদ্ধদেবের মতে, দুঃখ নিবৃত্তির অবস্থাই হলো নির্বাণ।’১২ ফলে নির্মাতা চলচ্চিত্রে গুরুকে স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্য দিয়ে নির্বাণ ঘটালে এটি প্রশ্ন তৈরি করে। কারণ ‘নির্বাণ অর্থে যদি সত্তার বা অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন হয় তাহলে বৌদ্ধ প্রচারিত বাণীর কোন সার্থকতা থাকে না।’১৩ ‘বুদ্ধদেবের মতে নির্বাণ লাভের পর মুক্ত ব্যক্তি সব রকমের কর্ম ত্যাগ করে জগতের সব বিষয়ে উদাসীন থাকেন না।’১৪ কিন্তু চলচ্চিত্রে গুরুর স্বেচ্ছামৃত্যু একধরনের উদাসীন প্রেক্ষাপটকেই হাজির করেছে।
শেষ কথা
নির্মাতা কিম কি দুক স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রের গূঢ়তত্ত্ব বৌদ্ধাচারের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন। এই বৌদ্ধাচার ছাড়াও যদি সাধারণভাবে এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকে দেখা যায় তাহলে সেখানে মানব জীবনের উত্থান-পতনও উপজীব্য হয়ে ওঠে। ফলে জন্ম-জরা-মৃত্যু সবকিছুই উঠে আসে এই চলচ্চিত্রে।
তথ্যসূত্র
১. দুক, কিম কি; ‘সহিংসতার প্রকাশকে আমি নেতিবাচক না ভেবে শারীরিক-ভাষা বলতেই বেশি পছন্দ করি’; অনুবাদ : কৃষ্ণকুমার; ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ২ সংখ্যা ১; ২০১২; পৃ. ১৪৭; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী
২. প্রাগুক্ত; দুক (২০১২ : ১৪৪)
৩. প্রাগুক্ত; দুক (২০১২ : ১৪৫)
৪. হাই, সাইয়েদ আবদুল (২০১২ : ২৮); ভারতীয় দর্শন; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; ঢাকা
৫. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ৩০)
৬. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ২৮)
৭. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ২৯)
৮. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ২৯)
৯. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ৩০)
১০. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২ : ৪১-৪২)
১১. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২: ৩৩)
১২. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২: ৩২)
১৩. প্রাগুক্ত, হাই (২০১২: ৩৩)
১৪. প্রাগুক্ত; হাই (২০১২: ৩৩)