ফারেনহাইট ১০৬

চিত্রকর্ম : ভ্যানগগ

কপালে হাত রেখে বুঝি শরীরে তাপ ভয়ানক। বাম কাঁত হয়ে শুলে পরে চিনের দুঃখ হোয়াংহোর মতোন সরু নোনাজলধারা চোখ থেকে নেমে বালিশ পর্যন্ত পৌঁছে। শুনেছি মরে যাবার আগে লোকে ভুলভাল দেখে। রুমে মরুভূমির অন্ধকার। চোখ মুছে সোফার দিকে তাকাই। এক ভদ্রলোক বসে টোব্যাকো টানছেন। লম্বা পাইপ। হ্যাটের ছায়ায় ভাঙাচোরা গালের অর্ধেক ঢাকা। “ছেলেবেলায় আপনাকে অনেক পড়েছি। চিরকালই বোহেমিয়ান ছিলেন,” বললাম, “শুধু আরেকটা সমাধান জানতে চাই—অন্ধকারে মানুষ এতো রহস্যপ্রবণ কেন?”

 

আমাদের আর পাশাপাশি বসবার কথা ছিল না। যে শহরের রোদ, বায়ু, ধুলোয় আমাদের শৈশবের চারাগাছ বেড়ে ধীরে বৃক্ষ হয়ে উঠেছে, যেখানে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার: এনজিও, ডাক্তারখানা কিংবা ফ্যাসিলিটির, সেখানে আপনার-আমার কোন কথা নেই, গল্প নেই। দুজন ঘনিষ্ঠ মানুষের দিকে এ শহরে লোকেরা তাকায় কৌতুহল নিয়ে। এখানে চুমুর চাইতে সহিংসতাই গ্রহণযোগ্য, প্রেমের চাইতে বিভেদ। ঘোরলাগা কোনো-এক-দিনে আপনার ঠোঁটের অধিকাংশ গোলাপি এবং অনুগ্রহপূর্বক লাল আমার তেলচিটচিটে গালে ছুঁইয়ে বলেছিলেন, “আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবা লাগবে না।” সত্যিই লাগেনি!

 

এ-জীবন অনবরত বিন্দুর সমষ্টি। শেষ বলে কিছু নেই। যা কিছু আছে তা কেবলি বদল। আজকাল টিভিতে মুখ দেখাতে না পারলে মানুষের দাম কমে যাচ্ছে। অথচ দিনভর সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে যে লোক রাতে ঘরে ফিরে দপ করে মোমের মতো নিভে, গলে, আলো ফুরিয়ে বিছানায় মিশে যায়, কেউ তার খোঁজ রাখে না। রাজনীতি, অর্থ, মন ও মনোবৈকল্য, রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা, কালচার, সততা, সভ্যতা, প্রিয় বই প্রিয় মুখ প্রিয় কবিতার মতো পরিচিত দুঃখ, সকলই পাল্টে যায় আমাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের শিকার হয়ে। আমিও, বদলি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছি অন্যকোনো বনানীতে। আমার জন্যে অপেক্ষায় আছেন মেরিলিন মনেরো।

 

আমি জানি না কাকে বিশ্বাস করবো, কাকে বলবো বন্ধু। কাছের বন্ধু তার বন্ধুর প্রেমিকাকে নিয়ে ভেগে গেলে তো আর ঈশ্বরকে দোষ দেয়া যায় না!

 

আমাদের যারা মানবিকতা শেখায় তারা কালোদের ঘৃণা করে, যারা সভ্যতা শেখায় তারা কাপড় ফেলে যায় হাওয়াই, শোয় সৈকতের রোদস্নাত শয্যায়। যারা সেক্যুলারিজমের সাজানো বাগানের কথা বলে, তাদের মনে মনে কিংবা রাস্তার মোড়ে মোড়ে আসমানি কেতাবের ঘ্রাণ। যদিও মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বর্ণবাদী, ভীরু, এবং নগ্নতাপ্রিয়। তবু বানানো পোশাকে সকলেই আয়নার সামনে দাঁড়ালে ভীষণ সুদর্শন। আমি জানি না কাকে বিশ্বাস করবো, কাকে বলবো বন্ধু। কাছের বন্ধু তার বন্ধুর প্রেমিকাকে নিয়ে ভেগে গেলে তো আর ঈশ্বরকে দোষ দেয়া যায় না!

 

শরীরের মেকানিজম আমি বুঝি না। জলজ্যান্ত এক বন্ধু নিমেষেই মরে দুনিয়া থেকে ভেগে গেল। প্রায়শই সে বলতো, “মিয়া, কেউ কি নিজের ইচ্ছায় মরে!” এইরকম অপূর্ব প্রশ্নমিশ্রিত সত্য আমাকে আগে কেউ বলেনি। এমনকি যারা অন্যের নামে মূর্তি করে, উদ্যান বানায়, তারাও না। শুনেছি আমার বন্ধুর বাবার বেগম সাহেবা যখন বাসায় থাকতেন না তখন তার ঘরে আরেকজন মেহমান আসতেন। যদিও শোনা কথায় আমি কান দেই না। কিন্তু শরীর সম্পর্কে আমি শুধু একটি কথাই জেনেছি—এটি একটি নদী। যে নদীতে বন্ধু, প্রেমিকা, পরিচিত নাক-মুখ-চোখ-ঠোঁট-ভুরু-নাভি-বুক-গাল, তরতর তরতর।

 

শহর হলো অরণ্য। জরা, জীবন, ব্যথা, সুখ, আমি-তুমি-সে-তারা, লোক, কোলাহল, বৈষম্য, আধুনিকতা, সবার মাঝে কেবল একজনকে চাই। আপনাকে। আপনি বুয়েন্দিয়ার সাজানো গ্রামের মতোন নয়নাভিরাম, মনোমুগ্ধকর সুরেলা পাখি। আমি প্রেমিক। প্রেমিক মানে অভিযাত্রী। অববাহিকার খোঁজে যে যায়। একদিন আসুন সন্ধ্যে করে, রোড নাম্বার বাইশ, ঠিক চারতলায়। আধুনিক সভ্যতার আলো আমার ঘরের জানালা দিয়ে আপনার গায়ে এসে পড়বে বিস্তৃত বিছানায়। আপনার পাশে শুয়ে আমি স্ত্রীকেও ভাববোনা।

 

ওর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি চাই ও ভালো থাকুক, জ্যোৎস্না থেকে দূরে থাকুক, একা একা আর কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকুক নির্জনতাপ্রবণ কোনো অঞ্চলে। দূর থেকে দেখবো। অথচ, আমি কিনা ওকে মনে করতে পারছি না! ওর গাল কেমন মলিন ছিল, বিসর্গের মতো চোখ আর উজ্জ্বল পাতার মতো ত্বক কেমন ঘ্রাণমুখর ছিল, মনে পড়ছে না। তবু চাইছি ও ভালো থাকুক, মনে পড়ুক কিংবা না-পড়ুক।

 

ঘরের দেয়ালে লাগানো ঘড়িটা গত দু’বছর যাবৎ প্রতিদিন দু’বার করে সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তৃতীয় একটি সঠিক সময়ের দরকার। আরেকটু পরেই আমার জন্ম নেবার কথা, ঠিক দশটা ত্রিশে। ঘুম ভেঙে কিছু সময় ধরে কাঁদবার কথা। কিন্তু ঘড়ির ডায়ালের রেডিয়ামসমৃদ্ধ উজ্জ্বল কাঁটাটা নড়ছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তাপ বাড়ছে। প্লিজ, ঘড়ি, আরেকটা সময় চাই। দশটা ত্রিশ।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here