বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
১১
যদিও আমার কাছে মনে হচ্ছে ঠিকই আছে। কিন্তু ঠিক নেই। এই দুই মাসে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বিশেষ করে জঘন্য লাগতে শুরু করেছে চাকরিটা। অফিসে আমার একদম মন বসে না। একপ্রকার হাঁসফাঁস করে কাটে। ছিহ্! এই বিশ্রী চাকরিটা কীভাবে করছিলাম এতোদিন। মোজাম্মেলের ভূত ভর করেছে আমার ওপর। পাটোয়ারীর ওপর মনটা বিষিয়ে থাকে। চাকরি নিয়ে বাড়তি একটা উদ্বিগ্নতাও তৈরি হয়েছে। আগে যা ছিলো না। অফিসের বাধ্যবাধকতার ভেতর সব কাজ ঠিকমতই চলে। কিন্তু এইসব আজাইরা নিয়ম আর ভালো লাগে না। পুরো সময়টাকেই মনে হয় স্রেফ জীবনের অপচয়।
এইসব অফিসিয়াল নিয়মের মধ্যে পড়ে বলতে গেলে অস্থির হয়ে ওঠেছি আমি। ঠিক টাইমে আসো। কাজ শেষ না হলে যাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। এমন টার্গেট ধরিয়ে দেওয়া হয় যা কখনো ফিল-আপ করা সম্ভব না। এই রীতি। সবসময় দৌড়ের ওপর থাকো। এভাবে কি জীবন পার হয়ে যাবে? এমন কিছুও তো করছি না, জাতিকে যা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এই স্যাক্রিফাইসের মানে কী? লিখছি তো গাইড বই। এক অর্থে নিষিদ্ধ কাজ। নিষিদ্ধ কাজই তো এটা। নাম যতই সহায়ক বই দেওয়া হোক না কেন! কেমন জানি ভালো লাগে না। একটা ফিক্সড চাকরির জন্য ট্রাই করা উচিত। পরে আর সময়ও থাকবে না। সার্টিফিকেটে আটাশ বছর হতে আর দু-তিন মাস বাকি।
সম্পর্কচর্চার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বিভাস দা’র সঙ্গে। তার একপ্রকার ভক্ত হয়ে গেছি আমি। তার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। কত সুন্দর করে যে কথা বলে! খুব আরাম লাগে। যদিও এই ভালোলাগার কথা আমি প্রকাশ করি না। কিন্তু এটা তার না বোঝার কথা নয়। প্রায় প্রতিদিন মোজাম্মেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করি। চা-খাই। অনেক অনেক গল্প করি। বলেছি, তার কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। সবধরনের জটিলতাই তার কাছে কেমন সরল। তার কাছে মীমাংসা আছে সবকিছুর। তার প্রতি আমার এই আকর্ষণ প্রথম দিকে আমি লুকাতে চাইতাম। কিন্তু ভেতরটা আমার কেমন জানি নরম হয়ে আসছিলো। না বলে থাকতে পারি না। সত্য কথাটা বলে দিয়েই বরং আমার বেশি ভালো লেগেছে। একদিন বললাম। বললাম, আপনার কথা শুনতেই আমি ছুটে আসি। প্রতিদিন আমি ছুটে আসি। বললাম, একথা বলতে আমার লজ্জা নেই। উত্তরে উনি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, উনি জানেন এটা।
এরমধ্যে উত্তরার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে অ্যাপ্লাই করি। পরীক্ষা পড়েছিল শুক্রবার। বিভাস দা’কে আসতে বলেছিলাম। বললাম, ‘আসেন। আপনি আসলে ভালো লাগবে। কনফিডেন্স পাবো। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই আসেন।’ এসেছিলেন উনি। তাকে খুব আপন মনে হচ্ছিলো আমার। মনে হলো, তার সঙ্গে আমার হৃদয়ের কোনো গভীর যোগ আছে। সেদিন থেকে তাকে আমি ফোন করি। প্রতিদিন ফোন করি। অনেক অনেক কথা বলি। কত কথা যে আমি বলতে পারি! কত রকম যে জিজ্ঞাসা আমার! সব জিজ্ঞাসার উত্তরই যেন তার কাছে আছে। আমি বুঝতেছিলাম, এটা প্রেম নয়। তাই দিনদিন আরও ভালো লাগছিলো তাকে। এভাবেই তার সঙ্গে জড়িয়ে যাই আমি। সে এখন আর বিভাস দা’ নয়। সে শুধু বিভাস। তার সঙ্গে কথা না বললে আটকে থাকে আমার দিন। আমি যেন তার প্রেমেই পড়েছি। হ্যাঁ, পড়েছি। প্রেম খুব সুন্দর। প্রেম মধুর। আমার সারাটাক্ষণের চিন্তাকে সে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবুও আমি শিউর না, এটা কি প্রেম?
মোজাম্মেলের সঙ্গে কিছুটা কি মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। না-ও হয়ে থাকতে পারে। আগের চেয়ে কথাবার্তা একটু কম হয়। এই আর কি! এদিকে আবার ইমরানের সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে আমার কথা হয়। বিভাসের সে খুব ঘনিষ্ঠ। বিভাসের সঙ্গে আমার অনেক আলাপের সে-ও সঙ্গী। প্রথমদিকে ওর উপস্থিতি আমার জন্য দরকার ছিল। কেমন সেইফ ফিল হতো। নয়তো বিভাসের সঙ্গে এতো কথা কন্টিনিউ করার সাহস তখনও আমার ছিলো না। মনে একটা ভাবনা থাকতোই। কে কী মনে করে আবার। আস্তে আস্তে সেইসব মনে করা কোথায় গেলো। এখন ইমরান থাকলেও আমার খারাপ লাগে না। আর না থাকলেও সমস্যা নেই। কোনোই সমস্যা নেই। বরং ভালো লাগে। বেশিই ভালো লাগে। বিভাসকে নিজের করে পেতেই বেশি আনন্দ আমার। ইমরানের কাজই হলো কথায় কথায় আপত্তি করা। বিভাসের প্রতিটি কথায় তার আপত্তি। আমি তখন বিরক্ত হই। খুব বিরক্ত হই। বেশি বোঝা ভাবটা এখনও তার যায়নি। আমি পক্ষ নিই বিভাসের। কিন্তু ইমরানের প্রশ্নকে বিভাস খুব গুরুত্ব দেয়। উত্তর দেয় তার। তাদের সব আলাপ আমি বুঝিও না।
জেসমিন দি’ আগের মতই আছে। ভালো একটা দিন খুঁজছে। দাওয়াত দিবে আমাদের সবাইকে। মাজহার ভাই সপ্তাহে কমপক্ষে একবার করে ধমক খাচ্ছেন পাটোয়ারীর। খুব সিরিয়াসলি নতুন চাকরি খুঁজছেন তিনি। চাকরি না- পেলেও নাকি ছেড়ে দেবেন। বলেছি, চাকরি ছাড়ার আগে অন্তত, বিয়ের দাওয়াতটা খাইয়ে যেতে হবে। রাজি হয়েছেন। এরমধ্যে পাটোয়ারী আমাকেও একবার ডেকেছিলো। বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। পরিবারে কে-কে আছে খোঁজ-খবর নিলেন। আর কিছু না। সামাদকে দেখি না অনেকদিন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সম্ভবত। অথবা অন্য কোনো চাকরি নিয়ে ভেগেছে। মোজাম্মেলের কাছ থেকে আখ্যানটা জেনে নিতে হবে। বিভাস আগের মতই আছে। সহজ-স্বাভাবিক। বদলে গেছি আমি। আকাশ-পাতাল বদলে গেছে তার আর আমার সম্পর্ক।
শান্তা আপুর সঙ্গে সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। বলতে গেলে, কথাই বলেন না আমার সঙ্গে। আমার কোনো পোস্টে লাইক-কমেন্ট করেন না। বিভাসের সঙ্গে আমার মাখামাখিটাই এর জন্য দায়ী। উনি পছন্দ করেন বিভাসকে। উনার পছন্দের ধরন আমি জানি না। তবে করেন। উনি বিবাহিত হলেও হাজব্যান্ডের সঙ্গে ঝামেলা চলছে তার। মোজাম্মেলও এইসব কথাই বলে। হাজব্যান্ডের সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে বিভাসের সঙ্গে লদকালদকি করতে চান। কিন্তু বিভাস ওরকম ছেলে নয়। তাই ফেল মেরেছে। বিভাসকে না পেয়ে এই ঝাল ঝাড়ছে যার তার ওপর। এরমধ্যে আমিও আছি। বিভাসের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথাটা প্রায় সবাই জানে। কিন্তু কেউই এতো খারাপভাবে নেয়নি। আমি ভেবেছিলাম নেবে। মোজাম্মেলকে বলেছি আমিই। বলেছি, বিভাসের ফ্যান হয়ে গেছি আমি। প্রেমেট্রেমেই পড়ে গেলাম কিনা বুঝতেছি না। আমার এই বলাটাকে খুব পজেটিভলি নিয়েছে সে। আমিও এজন্যই তাকে বলেছিলাম। আমি জানতাম, ও বুদ্ধিমান ছেলে, আঁচ করে ফেলবে ঠিকই। বিভাসকে সে পজেটিভলি দেখে। বলেছে, ভেরি গুড। তবে কেয়ারফুল হতে বলেছে। বিভাস একটু অন্যরকম। মোজাম্মেলকে নিয়েই আমার ভয় ছিলো। ও যা ঠোঁটকাটা।
বিভাসের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় আমার। হতেই হবে। রুটিন দাঁড়িয়ে গেছে একটা। ফেরার পথে। ফোনে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। প্রতিটা শুক্রবার। অর্থাৎ শুক্রবার সারাদিন। বাসায় বলি চাকরির পরীক্ষা আছে। সারাদিন ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াই দু’জন। শুক্রবারটা কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়। সকাল হতে না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসায় একা ফিরতে খারাপ লাগে। বেঁচে থাকার এতো মজা এর আগে আমি উপলব্ধি করিনি। এবার মনে হচ্ছে প্রকৃত প্রেমে পড়েছি আমি। ‘শোনো গো দখিনা হাওয়া/ প্রেম করেছি আমি/ চোখেতে লেগেছে নেশা/ দিক ভুলেছি আমি’। গুণগুণ করে সারাক্ষণ গান গাই। গোসল করি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। সব মজা। সব ভালো লাগে আমার। বাসের বেয়াদব হেল্পার, খিটখিটা মেজাজের ড্রাইভার সবাইকে আমার ভালো লাগে। সবাই কত ভালো। সব কত রঙিন। ভ্যানে করে ফলমূল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকেও আমার ভালো লাগে। মাল্টার হলুদ রঙের আভা গিয়ে পড়ে তার চোখেমুখে। কী সুন্দর সবকিছু। বিভাস বলে, চোখে নয় — সৌন্দর্য হলো মনে। এটাও নাকি তার কথা না। রবীন্দ্রনাথের। কোনো কথাই কি তার না? কেন তার কথা না?
আমার সমস্ত কিছু এখন একজনকে ঘিরেই। শুধু একজনকে ঘিরে। আর এমন একজন মানুষ সে যার সঙ্গে আমি নরকেও যেতে রাজি। যার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চোখ বন্ধ করে জীবনটাকে আমি ধ্বংস করে ফেলতে পারি। তার সঙ্গে আমার কত কথা! তবু কথা যেন ফুরায় না। আমার হৃদয় যেন কথার সমুদ্র। বিভাস বলে, ‘হৃদয় কোনো অঙ্গ নয়/ অঙ্গের চেতনা।’ তার কথা আমি বুঝি না। বলি এটা কার কথা? ও চুপ করে থাকে। চুপ করে থাকলে বুঝি, হয়তো ওরই মনের কথা এটা। আমি শুধু বলি আর বলি। কথা শোনার চেয়ে বলতেই ভালো লাগে আমার। যেন অনেক কথা তাকে আমার বলার আছে। আমার সবকিছু তাকে বলতে ইচ্ছা করে। সব সব সব। আমি বলি। কবে পিরিয়ড শুরু হল। পিরিয়ড কী? কেন হয়? হলে কেমন লাগে? ও শুনলো কি শুনলো না তাতে আমার যায় আসে না। না বলে থাকতে পারি না আমি। যা বলতে লজ্জা লাগবে বলে মনে হয় — তাই বলি। কোনো কিছুতেই সংকোচ রাখতে চাই না আমি। আমি চাই না তার আর আমার মধ্যে গড়ে উঠুক সংকোচের দেয়াল।
সে চাইলে সব করতে পারি আমি। একবার সে মুখ ফুটে বললে, জীবন দিয়ে দিতে পারি তার জন্য। সে চাইলে কালকেই আমি নিজেকে সোপর্দ করতে পারি তার পায়ের কাছে। আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা সে করুক। আমাকে মেরে ফেলুক। ডাটা থেকে ফুলের মত ছিঁড়ে, দুহাতে পিষে, ছুড়ে ফেলুক রাস্তায়। আমি কিছু মনে করবো না। ছিঁচকা চোরের মত শোভন আমাকে চুরি করেছিল। সে আমাকে জয় করেছে। আমার সব কিছু তার। আমার মান-সম্মান সব তার পায়ের কাছে জলাঞ্জলি দিয়েছি আমি। তাইতো যখন যা আমার মনে হয়, তার সঙ্গে আমি তাই শেয়ার করি। তার আর আমার মধ্যে, ক্ষুদ্র কোনো অনুভূতির, সামান্য আড়ালও আমি বরদাশত করবো না।
আমিও তার সব জানতে চাই। আবার কিছুই জানতে চাই না। তার কোনো পরিচয় না থাকুক। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমাকে ডাকাতি করে সে পালিয়ে যাক। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। কেন? কারণ তাকে আমি ভালোবাসি। সারা পৃথিবীর কাছে আমি ঘোষণা করে বলতে পারি। আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তাকে ভালোবাসি। একশবার, হাজারবার, লক্ষ-কোটিবার বলতে পারি আমি।
যদিও আমি জানি না, এটা ভালোবাসা কি-না। ইমরানকে বলেছি আমি। সব বলেছি আমি। তার ব্যাপারে মোজাম্মেল আমাকে যা বলেছিলো। সে স্বীকার করেছে, আমাকে সে ভালোবাসে। আমাকে তার খুব ভালো লাগে। সত্যিই আমাকে সে পছন্দ করে। আমি চাইলে সে আমাকে নিয়ে এগোতে চায় অনেকদূর। আমি তাকে বলে দিয়েছি সব। তাকে নিয়ে কী কী ভেবেছি আমি। তার পরিবার নিয়ে কী কী ভেবেছি আমি। সব বলে দিয়েছি। আমি বলেছি বিভাসের কথা। বলেছি, বিভাসকে আমি ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
ইমরান তারপরও আমার বন্ধু। সে বলেছে, জীবন জটিল। সে আমার পাশে আছে। আমি আছি প্রেমের উন্মাদনায়। প্রেম হয়তো সুন্দর। কিন্তু প্রেমে তার আস্থা নেই। প্রেমের চেয়ে বড় কিছু হল যুক্তি। সে আমাকে ভালোবাসে। আমার সঙ্গে জীবন কাটাতে চায়। যৌক্তিকভাবে সে আমার পাশে আছে। যতটা থাকা যায়। তার অবস্থান সে স্পষ্ট করেছে। ভেরি গুড। সে স্মার্ট। আমি তাকে একথা বলেছি। বলেছি, ইউ আর অ্যাক্সেপ্টেড। আমার বিপদে সে পাশে থাকতে চায়। আমি খুশি হয়েছি তার ওপর। হ্যাঁ, সে আমার প্রকৃত বন্ধু।
কোনো বাঁধন আমাকে আর আটকে রাখতে পারেনি। আমি তা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছি। কোনো কথা লুকিয়ে রাখতে সাহস করেনি আমার মন। সব প্রকাশ করে দিয়েছি আমি। সব বলার ক্ষমতা আমি রাখি। কে কী মনে করবে করুক। যে যা ভাবে ভাবুক। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করি না আমি। কী অসাধারণ কথা লিখেছিলেন, মাওলানা রুমি। হোয়াই ডু ইউ স্টেই্ ইন প্রিজন হোয়েন দ্য ডোর ইজ সো ওয়াইড ওপেন? আমি আমার প্রিজন থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমি এখন মুক্ত। কেবল একটা বিষয় থেকে আমি মুক্ত হতে পারিনি। এত এত আনন্দের মাঝখান থেকে আমাকে সে গ্রাস করে নিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে আমি চমকে উঠি।
বিভাসকে আমি শোভনের কথা বলেছি। সব কথা বলিনি। তাই মনে হয় তার সঙ্গে এখনও আমার যোজন যোজন দূরত্বই রয়ে গেছে। আমি এটা মানতে পারি না। তাকে আমি সেই সব কথাও বলতে চাই। কিন্তু এই একটা বিষয়েই আমার মধ্যে প্রচণ্ড ভয় কাজ করে। তাকে আমি সেই কথা বলতে সাহস পাই না। সে যদি আমার সঙ্গে না মেশে। সে যদি আমাকে ছেঁড়ে যায়। আমি বাঁচবো না। সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে। না সে হতে পারে না। সুইসাইড করবো আমি। খুন করবো আমি শোভনকে। জীবন আমার কাছে তুচ্ছ এখন। পালকের মত তুচ্ছ। সব করতে পারি আমি। জীবন বাজি রেখে সব করতে পারি আমি। শুধু এই একটা বিষয়েই আমি আটকে পড়েছি। আমাকে তা কয়েদ করেছে। আমাকে সে কয়েদ করে রেখেছে আমারই মধ্যে। আমার কষ্টের শেষ নেই। প্রতিবার বিভাসের কাছে বলতে গিয়েও আমি বলতে পারিনি। বলতে পারিনি, বিষয়টা খুন করছে আমাকে। ভেতরে ভেতরে ক্ষরণ হচ্ছে আমার। আমি আমার প্রিয় বিভাসকে সে-কথা বলতে পারিনি। আমার কাছে এরচেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।
এমন ঘটনাও আমি ঘটিয়েছি, আগে যা মরে গেলেও পারতাম না। সত্যিই আমার কাছে তা ছিল মৃত্যুর সমান দুঃসাধ্য। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা ঘটিয়েছি আমি। খেতে খেতে বাবাকে একদিন জানালাম, আমার বিয়ে নিয়ে তিনি যেন দুশ্চিন্তা না করেন। বছরখানেকের মধ্যেই আমি ডিসিশান নিয়ে নেবো। এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলো মা। তার ধারণা হয়েছে, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। বাজে কোনো ছেলের খপ্পরে পড়েছি আমি। যে-কোনো সময় পরিবারের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতেও আমি কার্পণ্য করবো না। বাপের মুখে চুনকালি দিতে বেশি দেরি নেই আমার। চাকরি করে, হাতে টাকা পেয়ে, বেশি সাহস হয়ে গেছে আমার। প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েছে মা। চোখমুখে সবসময় কেমন একটা দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগেই বরং স্বাভাবিক ছিলো। আমি বাসায় না থাকলে ইদানিং আমার রুমে ঢোকে। এটা ওটা হাতড়ায়। আমি ঠিক টের পাই। কিছু বলি না। সবকিছু গোছানোই থাকে। কিন্তু যেখানে যা থাকার, তা থাকে না। আমি জানি, মা এসেছিলো। নিশ্চয়ই প্রেমপত্রটত্রের খোঁজ করে। সেই যুগ কি এখন আছে! নেই। সে যুগ হয়েছে বাসি। মনে হল, একদিন মাকে ডেকে, এই কথা বলি। কিন্তু তাকে আমি ভালোবাসি। আমার মা! আমার প্রিয় মা! তাকে ভালো না-বাসলে ঠিক এই কাজটাই আমি করতাম। মাকে আমি বুঝি। আমার আনন্দ হয় খুব। বুঝি বলেই গভীরভাবে ভালোবাসতে পারি। নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসি তাকে। নয়তো আমাকে এত কথা বলার পর তার ছায়া পর্যন্ত মাড়াতাম না আমি। অথচ তাকে এখন আমার নিজের মেয়ের মত লাগে। দারুণ এক ভালোবাসা টের পাই তার জন্য। ভাবি, মা যদি জানতো!
মা খুব সহজ-সরল। কোনো প্যাঁচগোজ নেই। বাবার মত বুদ্ধিমান স্বামী না-থাকলে কাঁদতে কাঁদতেই তার জনম যেতো। কোনো পরিকল্পনা নেই তার। কখনোই ছিলো না। চিরকাল বাবার পরিকল্পনাই মা এক্সিকিউট করে এসেছে। বাবার পরিকল্পনাকেই মা একসময় তার নিজের পরিকল্পনা বলে বিশ্বাস করে নেয়। তারপর নিজের পরিকল্পনা হিসেবে এক্সিকিউট করে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তাই দেখে আসছি। মার জন্য আমার মায়া হয়। তার জীবনের মত তার দুঃখগুলোও সরল। অনেকের কাছে যা হয়তো দুঃখই নয়। তার এই দুশ্চিন্তাটাও কি সরল! আজ সে যা ভেবে কূল পাচ্ছে না। যার ভয়ে অস্থির। অথচ তার মেয়ে এসব কা-কীর্তি ঘটিয়ে রেখেছে আগেই। আরও বছরখানেক আগেই। সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এমনকি এই বর্তমান পরিবর্তনটা যে কিছুমাত্রায় ইতিবাচক, অন্তত আমার তাই মনে হয়, এটাও বুঝতে পারছে না সে। মার সঙ্গে একদিন কথা বলতে হবে। আলাদা করে। সব বুঝিয়ে বলতে হবে। মার সঙ্গে কথা হওয়া উচিত।
বাবা একদম কিছু বলেনি। এই কিছু না বলাটাও একটা ভাষা। বাবা হয়তো জানে না, এই ভাষা তার মেয়েও কিছুটা রপ্ত করেছে। বাবার চোখেমুখে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বাবা হলো মার ঠিক উল্টা। বাবা তার মেয়ের ওপর আস্থা রেখেছে। কিন্তু আমি কি বাবার আস্থা রাখতে পারবো? আস্থা রাখতেই হবে কেন? আস্থাটাও একটা বন্ধন। কোনো আস্থার দরকার নেই আমার। কিন্তু আমার কথা থেকে বাবা সম্ভবত ভুল মেসেজ পেয়েছে। অন্তত পাবার সম্ভাবনা আছে। সেই দোষ বাবার নয়। বাবা হয়তো মনে করেছে, কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে আমার। এই এক বছরের মধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নেবো, তাকে বিয়ে করা যায় কি না-যায়! কিন্তু ঘটনা তো তা নয়।
বিভাসের সঙ্গে সেই সম্পর্ক আমার নয়। খুব একটা বদলায়নিও সে। স্রেফ আমাকে সে সময় দেয়। আমার ডাকে সে সাড়া দেয়। আমাকে সে ভালোওবাসে। সব ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার কথা হয়নি। বিয়ের চিন্তা আমারও মাথায় আসেনি। বাবাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম, দুশ্চিন্তা না করতে। একবছরের মধ্যে আমি কোনো একটা ডিসিশান নিয়ে নেবো। কমপক্ষে ডিসিশান নিতে বাবাকে হেল্প করতে পারবো। আমার মনে হয়তো বিভাসের বিষয়টা ছিলই। যাই হোক, এতো পরিকল্পনা করে বলিনি। বাবা যা বোঝার বুঝুক। তবে এটা ঠিক, আমি যা চাইবো বিভাস তা করবে। করতে তাকে হবেই। কারণ আমি তাকে ভালোবাসি।
ও যদি তা না করে? না করুক। এতেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাকে ভালোবাসি। এটাই আমার শক্তি। এই শক্তিতে যেকোনো কিছুই করতে পারি আমি। লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারি সব। লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারি আমাকে। আমাকে ঘিরে থাকা যাবতীয় কিছুকে। বাবার সমস্ত আস্থাকে।
সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। আমার মধ্যে বিভাসের ক্রেই্জটা আমি টের পাই। আমি টের পাই আমার হৃদয়ের হাসি। সমস্ত স্নায়ুব্যাপী তোলপাড় করে বেড়ানো অনুভূতিসমূহকে আমি চিনি। শুধু একটা বিষয়ই আমাকে এখন দূরে সরিয়ে রেখেছে আমার বিভাসের কাছ থেকে। আমি আজকেই ফোন করে বলে দেবো সব কথা। সব সব সব বলে দেবো। বলবো শোভন নামের সেই ছিঁচকা ছেলের সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্কের কথা। নিখুঁতভাবে বলবো, বিস্তারিতভাবে বলবো সব। যা যা আমার মন লুকাতে চাইবে ইচ্ছা করে বেহায়ার মত তা-ই আমি শতবার বলবো। নিজেকে শূন্য করার, খালি করার, নিঃস্ব করার একমাত্র কার্যকর পন্থা তো এই। প্রিজন থেকে সসম্মানে নিজেকে বের করার প্রশস্ত তো দরজা এটিই।
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি : ৮