নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান।
আফ্রিকান কল্পকাহিনির ভাষা
ছয়
কাগজ ও কলম ছিল প্রথম সমস্যা। একজন একটি কলম পেতে পারে যদি সে বলে যে সে কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করবে বা স্বীকারোক্তি দিবে। একজন দুই বা তিনটি কাগজও পেতে পারে। কিন্তু একটি উপন্যাসের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাগজ? আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম টয়লেট পেপারের। যখনই আমি কাউকে এটি বলেছি তারা প্রশ্নসূচকভাবে আমার দিকে তাকিয়েছে কিংবা হেসেছে। কিন্তু টয়লেট পেপারে লেখার পেছনে কোন রহস্য নেই। কামিতিতে টয়লেট পেপার ছিল বন্দিদের শাস্তি দেয়ার একটি উপায়। এটি ছিল খুবই অমসৃণ। কিন্তু শরীরের জন্যে যা অনুত্তম, কলমের জন্যে তাই ছিল উত্তম।
তবে সেখানে আরও অনেক সমস্যা ছিল যেগুলোর সাথে সেল ১৬ বা একজনের একান্ত নিজের কক্ষের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যেমন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ। টি. এস. এলিয়ট তাঁর ফোর কোয়ার্টেটস৯-এ শব্দের পিচ্ছিল বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন :
শব্দ প্রসারিত হয়,
ভারে কখনো কখনো ফেটে বা ভেঙে যায়,
উত্তেজনায় পিছলে যায়, গড়িয়ে পড়ে, লোপ পায়,
অযথার্থ্যতায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, থাকবে না তার জায়গায়,
থাকবে না স্থির।
কাইতানি মুথারাবাইনি লেখার সময় এ বিষয়টিকে আমার আরও বেশি সত্য মনে হয়েছিল। উপন্যাস বা কল্পকাহিনী রচনার উল্লেখযোগ্য কোন ঐতিহ্য গিকুয়ু ভাষার ছিল না। গাকারা ওয়া ওয়ানজাউ এমন একটি ঐতিহ্য তৈরির কাজ শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বইগুলো পঞ্চাশের দশকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর তিনি গিকুয়ু ভাষায় গিকুয়ু না মুমবি নামে একটি সামিয়িকী প্রকাশ করেন। কিওয়াই ওয়া এনদিউয়া-র রোমাঞ্চ অভিযান নিয়ে তিনি ধারাবাহিক কল্পকাহিনী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এগুলোর মান তাঁর পঞ্চাশের দশকের রচনাগুলোর মতো ছিল না, যার বেশির ভাগ তখনও আর প্রকাশ হয়নি। টেনস ১০ নিয়েও আমাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল, সেসব নিয়েও যা কাগজে লেখা শব্দের দৃশ্যমানতা তৈরি করে ও তা পরিবর্তন করে। শব্দ ও টেনস আরও বেশি সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল গিকুয়ু ভাষার অসন্তোষজনক বানানরীতির কারণে। ইউরোপীয় মিশনারিদের মতো অস্থানীয় বক্তারা গিকুয়ু ভাষার লিখিত রূপ এমনভাবে তৈরি করেছিল যেখানে স্বরবর্ণগুলোর বিভিন্ন দৈর্ঘ্য শনাক্ত করা সম্ভব হতো না। গিকুয়ু ভাষার গদ্য ও কবিতায় স্বল্প ও দীর্ঘ স্বরবর্ণের পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদ্যমান বানানরীতিতে প্রায়শই পাঠককে ঠিক করতে হতো স্বরবর্ণের ধ্বনি স্বল্প হবে না দীর্ঘ হবে। একটি দীর্ঘ গদ্যের জন্যে পুরো ব্যপারটি খুবই ক্লান্তিকর। স্বল্প ও দীর্ঘ স্বরবর্ণের ধ্বনির ভেতর পার্থক্য করতে না পারার এই দুর্বলতার কারণে এটি ধরে নিতে হতো যে পাঠকের এ বিষয়ে পূর্বলব্ধ জ্ঞান রয়েছে, অর্থাৎ পাঠক এ বিষয়ে অবগত। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে আমি দীর্ঘ স্বরবর্ণগুলোকে চিহ্নিত করতে একটির স্থলে দুইটি স্বরবর্ণ ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু এই ব্যপারটির সাথে অভ্যস্ত হতে আমার কয়েক পৃষ্ঠা লেগে গিয়েছিল। এবং তারপরও দীর্ঘ স্বরবর্ণকে চিহ্নিত করার এই পদ্ধতিটি পুরোপুরি সন্তোষজনক হয় নি। তাছাড়া গিকুয়ু একইসাথে একটি সুর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভাষা, কিন্তু বিদ্যমান বানানরীতিতে এর সুর বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করার কোন উপায় নেই।
এসব কারণে সন্ধ্যায় লেখা একটি অনুচ্ছেদ যা কিভাবে পড়তে হবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম, পরে দেখা যেত সেই একই অনুচ্ছেদ ভিন্নভাবে পড়ার ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে। ব্যাপারটিকে আমি সমাধান করতে পারতাম শুধুমাত্র বাক্যের ভেতর শব্দের প্রেক্ষাপটগুলোকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করে; অনুচ্ছেদে বাক্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে; আর অনুচ্ছেদগুলোকে পরিস্থিতি ও ঘটনার সময় ও স্থানের সাপেক্ষে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। হ্যা, আমার নিজের চোখেই শব্দগুলো পিছলে যাচ্ছিলো ও গড়িয়ে পড়ছিল। তারা তাদের স্থানে থাকছিল না। তারা স্থির থাকছিল না। আর এই ব্যপারটি ছিল খুবই হতাশাজনক।
কিন্তু সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা— যাকে আমি এখনও ভাবি আফ্রিকান উপন্যাসের উৎকর্ষ ও উন্নয়নের জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা — হলো উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে কার্যকর যোগাযোগের জন্যে একটি সঠিক ‘কল্পকাহিনীর ভাষা’ তৈরি করা, যেখানে উপন্যাস নিজেই ভাষার একটি ধরন হিসেবে সামনে আসবে। আর আমার ক্ষেত্রে এই উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী হলো সেসব মানুষ যাদের আমি পেছনে ফেলে এসেছি।
‘কল্পকাহিনীর ভাষা’ ও একজন লেখকের বেছে নেওয়া অডিয়েন্সের ভেতর পরস্পর সম্পর্কিত দুইটি সমস্যা রয়েছে। ধরনের সাথে তার সম্পর্ক, অর্থাৎ খোদ জনরার সাথে; এবং বিষয়ের সাথে তার সম্পর্ক, অর্থাৎ তার সামনে থাকা বাস্তবতার সাথে। সে কিভাবে ধরনটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে? সে কিভাবে তার সামনে থাকা বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে?
প্রথম প্রশ্নটি একটি ধরন হিসেবে উপন্যাস কিভাবে গড়ে উঠেছে তার সাথে সম্পর্কিত। জর্জ এলিয়ট কিংবা বালজাক, জোলা, তলস্তয় ও দস্তয়েভস্কি থেকে দেফ্যো আলাদা। দৃষ্টিভঙ্গি, সময়, চরিত্র ও প্লটের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে জোসেফ কনরাড, জেমস জয়েস এবং ফকনারের অবস্থা কী? আফ্রো-ইউরোপিয়ান উপন্যাসেরও আলাদা আলাদা ধরন তৈরি হয়েছে; চিনুয়া আচেবের থিংস ফল অ্যাপার্ট-এর লিনিয়ার প্লট থেকে ওল সোয়িনকার দ্য ইন্টারপ্রেটার্স, যেখানে আসলে প্লট দেখা যায় না। যারা জেমস জয়েস, জোসেফ কনরাড, ওল সোয়িনকা অথবা আয়ি কোয়েই আরমাহর পাঠক বা তাদের সম্পর্কে সচেতন, এমন অডিয়েন্সের জন্যে লেখা আর যারা কখনো কোন উপন্যাস পড়েনি সেই সব অডিয়েন্সের জন্যে কি একই পদ্ধতিতে লেখা যায়?
আমার আফ্রো-ইউরোপীয়ান উপন্যাস রচনার পূর্ববর্তী চর্চাগুলোতে আমি ‘কারিগরি’ উৎকর্ষের আলাদা আলাদা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। দ্য রিভার বিটউইন ও উইপ নট, চাইল্ড-এর ছিল লিনিয়ার প্লট। সময় ও সিকোয়েন্স চলেছিল একটি ঘটনার মাধ্যমে পরের ঘটনায়, এভাবেই কেটেছিল সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর। চলমান সময়ের ক্যানভাসে একটি ঘটনার সাথে পরবর্তী ঘটনা রিলে রেসের মতো সম্পর্কিত ছিল। এই ধরনটি জীবনকথা বিবৃত করার মতো যেখানে কোন চরিত্র বা ব্যাখ্যাকারী নায়কের আগমন ও বিদায়ের প্রতিটি সময় ও স্থানকে অনুসরণ করে, যেন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় চরিত্রের চোখ দিয়ে মূলত সব দেখা হয়। ব্যাখ্যাকারী হিসেবে সাধারণত থাকেন সর্বজ্ঞ ব্যাখাকারক বা রচয়িতা। উইপ নট, চাইল্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। আর আমি তখনই এই ধরনের প্লটের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ বিষয় হিসেবে জোসেফ কনরাডের কাজগুলো পড়ার সময় আমি দেখেছিলাম কীভাবে তিনি একই উপন্যাসের ভেতর বিভিন্ন সময় ও স্থানকে বিভিন্ন ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। কনরাডের লেখায় একই ব্যক্তি দ্বারা বিভিন্ন সময় ও স্থানে একই ঘটনা দেখানো হতো। আর আরও বেশি তথ্য ও সাক্ষ্য দিয়ে কিংবা ঐ ঘটনার আগের বা পরের কোন ঘটনার উপর এই পদ্ধতিতে নতুনভাবে আলো ফেলা সম্ভব হতো। আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল নস্ত্রমো ১১। আমি এখনো একে একটি দারুণ উপন্যাস মনে করলেও আমার মনে হয় এতে কনরাডের দৃষ্টি ছিল সীমিত। সাম্রাজ্যবাদই তাঁর উপন্যাসের গঠন ও বিষয়বস্তু সরবরাহ করেছিল, তথাপি সাম্রাজ্যবাদের বিষয়াদির প্রতি তাঁর বিপরীতমুখী প্রবণতা তাঁর উপন্যাসগুলোকে কখনো উদার মানবতাবাদের ভেতর ভারসাম্যকরণের অধিক কিছু হতে দেয়নি। কিন্তু সময় ও স্থানের সাথে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি, একাধিক ব্যাখ্যকারীর উপস্থিতি, ব্যাখ্যার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বক্তব্য, তথ্যের বিলম্বিত সরবরাহ যার ফলে একদম শেষ মুহূর্তে এসে কোন বিষয়ের সবগুলো দিক স্পষ্ট হয়ে উঠে যেন পুরানো বিচারের স্থলে পাঠক সাক্ষ্য, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পুনরায় বিচার করতে পারে — এসব কৌশল আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
জর্জ ল্যামিংও আমাকে তাঁর গল্প বলার বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে মুগ্ধ করেছিলেন, বিশেষত তাঁর ইন দ্য ক্যাসেল অব মাই স্কিন-এ। ল্যামিং এর বিভিন্ন উপন্যাস যেমন ইন দ্য ক্যাসেল অব মাই স্কিন, দ্য এমিগ্রেন্টস, অব এইজ অ্যান্ড ইনোসেন্স এবং সিজন অব অ্যাডভেঞ্চার-এ সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী, নাটয়কীয়তা, ডায়েরি, সংবাদ প্রতিবেদন, আত্মজীবিনী, নাম পুরুষের জবানে বিবরণ এবং কোন চরিত্রের পক্ষ নেয়ার জন্যে সরাসরি কর্তৃত্বপূর্ণ অনুপ্রবেশ, এসবই ব্যবহৃত হয়েছিল। ল্যামিং এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধারাবাহিকতা, তৃতীয় বিশ্বের সংগ্রামের প্রতি তার অঙ্গীকার, কৃষক ও শ্রমিকদের ভেতর তাঁর স্পষ্ট ভিত্তি এবং তাঁর কাজে বিদ্যমান সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়াদি আমাকে ও কেনিয়ায় আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে তাঁর নিকটবর্তী করে তুলেছিল।
গোগোল, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, গোর্কি, শলোকভ, বালজাক ও ফকনারের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে উপন্যাসের বিষয়গত সচেতনতা ও কারিগরি দিক সম্পর্কে নতুন নতুন সম্ভাবনার খোঁজ পেয়েছিলাম।
মানুষ সাধারণত কীভাবে কোন ঘটনার বর্ণনা দেয় সে বিষয়ে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল যে তারা বর্ণনায় অনুপ্রবেশ, অপ্রাসঙ্গিকতা, বর্ণনার ভেতর বর্ণনা এবং মূল বিষয়কে না হারিয়ে কোন নাটকীয় উপস্থাপনকে খুশিমনেই গ্রহণ করে। কৃষক সমাজের বাদানুবাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে গল্পের ভেতর গল্পের বিষয়টি ছিল খুবই সাধারণ। কনরাড ও ল্যামিং এর রচনা থেকে একটি ঘটনার লিনিয়ার বর্ণনা করার বিষয়টি বাস্তবিক সামাজিক চর্চা হিসেবে আরও বেশি দূরীভূত হয়েছিল।
আ গ্রেইন অব হুইট-এ যেভাবে ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে গল্পের ভেতর গল্প বলা হয়েছে তা ছিল এই পুনর্বিবেচনারই ফলাফল। সময় ও স্থানের ক্ষেত্রে নমনীয়তার পাশাপাশি এই একাধিক বর্ণনাকারীর বিষয়টি আমাকে একক চরিত্রের উপন্যাস থেকে সরে আসতেও সহায়তা করেছিল। আ গ্রেইন অব হুইট-এর সবগুলো প্রধান চরিত্রই ছিল প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর ইতিহাসের গতিপথে গ্রামের সকল মানুষই ছিল এই উপন্যাসের আসল নায়ক। উপন্যাসটির বর্তমান সময় শুরু হয় ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা লাভের চারদিন আগে থেকে। কিন্তু এর ভেতরই উপন্যাসটি বর্তমান সময় থেকে এই শতাব্দীর শুরুর সময় ও স্থানে চলাচল করতে থাকে। ফ্ল্যাশব্যাক, একাধিক কাহিনী, একাধিক কণ্ঠ, পৃথক পৃথক সময় ও স্থানে ভ্রমণ, সমান্তরাল গল্প ও বর্ণনা পেটাল অব ব্লাড-এ আরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব কৌশল আমাকে সহায়তা করেছে কেনিয়ার শতাব্দী প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সময় ও স্থানে ঘুরে বেড়াতে; আবার উপন্যাসের ক্ষেত্রে বর্তমান, যার দৈর্ঘ্য ১২ দিন, সেখানে ফিরে আসতে।
কিন্তু এই সবগুলো ক্ষেত্রেই ধরে নেয়া হয়েছিল যে পাঠক উপন্যাস, বিশেষত ইউরোপীয় ভাষায় লেখা আধুনিক উপন্যাস পাঠের সাথে জড়িত বিষয়াদি সম্পর্কে অবগত। এই কৌশলগুলো কি কামিরিথুতে যারা এনগাহিকা এনদিনদা দেখতে এসেছিল তাদের জন্যে কাজ করবে? আর কিভাবেই বা আমি আবার লিনিয়ার প্লটে ফেরত যাবো? অন্য কথায়, আমি আসলে আমার নতুন অডিয়েন্সের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন ছিলাম। অথবা, হতে পারে এটি ছিল আসলে ভাষার ব্যাপার। আমার গিকুয়ু ভাষার ব্যবহার থেকে কি একটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস তৈরি হবে?
যাই হোক-না-কেন, কৃষক বা শ্রমিক পাঠকদের তাচ্ছিল্য বা পৃষ্ঠপোষকতা না করে আমি চাচ্ছিলাম একটি সরলতর প্লট, একটি সরল অথবা স্পষ্ট আখ্যান, একটি শক্তিশালী কাহিনী (এরপর কী হলো জাতীয় উপাদান!)।
আমি তিনটি পদ্ধতিতে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম। আমি বেছে নিয়েছিলাম একটি সরল গঠন, একটি সরল ভ্রমণকে। কাইতানি মুথারাবাইনি হলো কার্যত একই পথে দুইটি ভ্রমণের কাহিনি। ওয়ারিঙ্গা একটি মাতাতু ট্যাক্সিতে করে রাজধানী নাইরোবি থেকে একটি কাল্পনিক গ্রামীণ এলাকা ইলমোরগে যায়। এরপর ওয়ারিঙ্গা তার দ্বিতীয় ভ্রমণ করে নাইরোবি থেকে ইলমোরোগ হয়ে নাকুরুতে, একটি গাড়িতে করে। দুইটি ভ্রমণের ভেতর দুই বছরের পার্থক্য ছিল। ছিল কতগুলো ফ্ল্যাশব্যাক। কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকের ভ্রমণগুলোকে নির্দেশ করা প্রকৃত ভ্রমণ দুইটির সময় ও স্থানের অগ্রসরতার সমান্তরাল বিন্যাসের মাধ্যমে ফ্ল্যাশব্যাকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। ভ্রমণ, পরিবহণ ব্যবস্থা এবং নাইরোবি ও নাকুরুর অনেকগুলো স্থান বহু সাধারণ কেনিয়ানের কাছে পরিচিত মনে হবে। আমি মৌখিক আখ্যানের ধরনগুলো থেকে প্রচুর ধার করেছিলাম। বিশেষত, আলাপ-আলোচনার সুর, পৌরাণিক কাহিনি প্রবাদ, গান এবং নিজের বা অন্যের কাব্যিক প্রশংসা। আমি বাইবেলের উপাদান প্যারাবেলকেও১২ স্থান দিয়েছিলাম কারণ অনেক শিক্ষিত মানুষই বাইবেল পড়েছেন। মানুষ এসব বিষয়ের সাথে নিজেকে পরিচিত মনে করবে এবং আমি আশা করেছিলাম এগুলো একটি পরিচিত ঐতিহ্যের নিজস্ব বিষয়াদির সাথে উপন্যাসের সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে।
ভাষা, প্লট, সামাজিক ও ভৌত গঠনের বাস্তববাদ, মৌখিক আখ্যানের বৈশিষ্ট্যসমূহ, সবই ছিল উপন্যাসের ধরনের উপাদান এবং আমি এও জানতাম যে উপন্যাসটি যতই পরিচিত ও আকর্ষণীয় হোক না কেন, খুব বেশিক্ষণ তার নতুন পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে না। ওরাটিউরের পরিচিত বিষয়াদির প্রায় পুনর্গঠন কিংবা শহুরে ও গ্রামীণ দৃশ্যপটের বর্ণনার সাথে একাত্ম হওয়ার চেয়ে তাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। প্রয়োজন ছিল এমন বিষয় বা আধেয় যা তারা শনাক্ত করতে পারবে অথবা যা তাদেরকে কোন একটি পক্ষ নিতে বাধ্য করবে। আধেয়ই হলো আসলে ধরনগুলোর ভাগ্যনিয়ন্তা। ধরন ও আধেয়র সঠিক মিলনের ফলেই উপন্যাস তার কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করে। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল একটি বিষয় বা আধেয় যার সাথে তাদের নিত্যদিনের সংগ্রামের গুরুত্ব, জটিলতা এবং দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত।
আর এটি থেকেই আমি এসেছিলাম পরের সমস্যায়। বিষয়ের সাথে আমার সম্পর্ক, যা ছিল একটি নব্য-উপনিবেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
একজন লেখকের তার বাস্তবতার উপর কর্তৃত্ব প্রভাবিত হয় প্রকৃতি ও সমাজ বিষয়ে তার মৌলিক দার্শনিক অবস্থান এবং প্রকৃতি ও সমাজের বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধানে তার ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর দ্বারা। যেমন কোন একটি ঘটনা বা বিষয়ে অবহিত হয়ে তিনি এর উপর নজর দিতে পারেন এর আন্তঃসস্পর্ক বা বিচ্ছিন্নতা; এর স্থিতি বা গতিময়তা; এর পরবর্তনশীলতা বা অপরিবর্তনীয়তা; এর যা আছে তা কিংবা এটি যা হয়ে উঠছে তার প্রেক্ষিতে; এবং এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এর গতিতে তিনি কোন ধরনের গুণাত্মক পরিবর্তন দেখেন কিনা তার প্রেক্ষিতে। একজন লেখকের বিষয়ের উপর কর্তৃত্বও তার সমাজের বস্তুগত ভিত্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা হলো তার শ্রেণি অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান। আমাকে বলতেই হবে যে এগুলো আসলে ভালো বা খারাপ রচনা তৈরি করে না। অথবা সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি আসলে ভালো বা খারাপ লেখার কোন নির্ধারক নয়। এটি আসলে নির্ভর করে কল্পনা করার এমন গুণের উপর যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। একজন লেখকের শিল্পদক্ষতা হলো সার্বজনীন বিষয়গুলোকে খুবই অল্প সময়ের ভেতর অভিজ্ঞতালব্ধ হিসেবে অবলোকন করার ক্ষমতা, যা সময় ও স্থানের সাপেক্ষে সর্বাপেক্ষা অধিক গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু এগুলো (শ্রেণি অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান) বাস্তবতাকে নির্ভুল করতে তার চেষ্টা কিংবা বাস্তবতাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে তার নির্ভুলতার উপর প্রভাব ফেলে।
কিন্তু কী হয় যখন বাস্তবতা হলো কল্পকাহিনীর চেয়েও আশ্চর্যজনক? একজন ঔপন্যাসিক কিভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে ধরে রাখবেন যেখানে পাঠকদের বাস্তবতা কল্পকাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি আশ্চর্যজনক ও সম্মোহনী? আর এটিই হলো সেই বিষয় যার মুখোমুখি একজন ঔপন্যাসিককে হতে হয় একটি নব্য-ঔপনবেশিক বাস্তবতায় এই নব্য-উপনিবেশ ও তার অডিয়েন্সের সাথে।
চলুন সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেখা যাক।
টীকা ও সূত্র
৯ টি. এস. এলিয়টের চারটি কবিতার সংকলন—অনুবাদক
১০ কাল; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কাল—অনুবাদক
১১ জোসেফ কনরাডের উপন্যাস—অনুবাদক
১২ বাইবেলের নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী—অনুবাদক
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি : ১০