ছবি ভাবনা

লুবনা চর্যা কবি ও চিত্রশিল্পী। সৃষ্টিশীলতার দুই শাখায়ই সমান্তরাল বিচরণ তাঁর। দুই ক্ষেত্রেই তিনি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি লিখেছেন নিজের ছবি সম্পর্কে।

মূলত কবি আমি। ছোটবেলা থেকেই লেখা আর আঁকা দুইটার প্রতিই ঝোঁক ছিল। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর জীবনে এলো থিয়েটার। তখন আমার বয়স পনেরো। লেখা ও আঁকা প্রচ্ছন্নভাবে ভিতরে ছিল। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখতাম অনেক ভালো থিয়েটারকর্মী হবো। কিন্তু একটা মফস্বল শহরে যা হয়, পড়াশোনা ও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই থিয়েটার ছেড়ে দেয়। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, ছেলেরা চাকরিতে ঢুকে যায়, অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বড় শহরে বা দেশের বাইরে যায়। অনেকে আশাহত হয়ে ছেড়ে দেয়। কারণ, তারা এরকম একটা ধারণা নিয়ে আসে যে, থিয়েটারে কাজ করলে নাটকে, সিনেমায় সহজে নায়ক-নায়িকা হওয়া যায়। ফলে অনেকেই ঝরে যায়। আবার নতুন কর্মী সংগ্রহ, আবার নতুন ওয়ার্কশপ, আবার নতুন যাত্রা। এ যেন সিসিফাসের আমৃত্যু পাথর ঠেলার মতো ব্যাপার।

এভাবে কিছু বছর যাওয়ার পর আমিও একটা পর্যায়ে হতাশ হয়ে যাই। নতুন নতুন কাজ ধরা হয়, কিন্তু শেষমেষ আর কাজটা করা হয়ে ওঠে না। ইতিমধ্যে আমার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। তখন ভাবলাম, থিয়েটার তো টিম ওয়ার্ক। টিম ছাড়া আমি অচল। তাই আমি নিজে যা করতে পারি, সেটাই বরং চেষ্টা করি। আমার অনেক শেষ না করা কবিতা জমে গিয়েছিল। দুই লাইন, তিন লাইন, চার লাইন লিখে আর লিখতাম না। একটু অস্থিরতায় ছিলাম। তখন আমি কবিতায় সিরিয়াস হলাম। পড়াশোনাও বেশি করে শুরু করলাম। এই সময় আমি সমসাময়িক বাংলায় চর্যাপদের অনুবাদ করলাম। চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। ওই সময়কার বাংলা থেকে এই সময়ের বাংলার মাঝে অনেক দূরত্ব। আমি দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করলাম। ঐ সময় সহজ নামে একটা লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। পরপর দুইটা কাব্যগ্রন্থ বের হয় জিওগ্রাফি ইন অ্যা জ্যু…শয়তানের অভিনব কারখানা। এরই মধ্যে মাস্টার্স শেষ, ঢাকায় চলে আসি।

এরপর অ্যাড ফার্মে কপি রাইটার হিসাবে কাজ শুরু করি। তখন একদমই সময় পেতাম না। সকাল থেকে রাত চাকরি, ফিরে এসে খাওয়া, ঘুম — এই ছিল জীবন। তখন অনেক কবিতা মনে এলেও সময়ের অভাবে লেখা হয়ে উঠতো না। আর যখন সময় পেতাম, তখন আর কবিতাটা আসতো না। তখন ভাবলাম, এই সময়টাতে তো ছবি আঁকা যায়। কবিতা জোর করে লেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ছবি আঁকতে হাত তো চলতেই পারে। তখন থেকে সিরিয়াসলি আঁকতে শুরু করি। যে কথাগুলো কবিতায় বলতে চাচ্ছিলাম, সেই কথাগুলোর ছবিতে ভিজ্যুয়াল রূপ কী হতে পারে — তাই ভাবতে থাকি। এভাবে ছবি আঁকাটা চলে আসে জীবনে।

এর আগে আমার স্টুডেন্ট লাইফে আমি যেখানে পড়তাম, সেখানে জীবনেও ক্লাস করতে যেতাম না। সারাদিন আর্ট কলেজেই পড়ে থাকতাম। ওখানেই বন্ধুরা, ওখানেই আড্ডা। ওরা সবাই চিনতো কবি হিসাবে। ছবি আঁকা যে জীবনে কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা তখনো জানতাম না।

 

এখন ছবি আর কবিতা দুইটাই “রেল লাইন বহে সমান্তরাল” টাইপভাবে বহে যাচ্ছে। কফিল ভাইয়ের গানের “জমজ বন্ধু, জমজ বোন”। তাই আমার ছবি কথা বলা ছবি। যা কিছু আমাকে ভাবায় অথবা যা কিছুর কাছে আমি হই ভাবনার বিষয় তাদেরই দেখা যায় কাগজে, ক্যানভাসে, কলমে, রং-তুলিতে আর অনেক কিছুতে।

 

ইনস্পিরেশন বলতে কনসেপচুয়্যাল কাজই বরাবর ভালো লাগে। যে কাজগুলো শুধু চোখের তৃপ্তি দিয়েই ফুরিয়ে যায় না, অনেকক্ষণ ধরে ভাবায়। এর মধ্যে আছেন অনেকেই। ফ্রিদা কাহলো, অমৃতা শেরগিল, ভ্লাদিমির কুশ, সালভাদর দালি, ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, কাহলিল জিব্রান, রেনে ম্যাগ্রিট, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম নারায়ণ দাশগুপ্ত, বিকাশ ভট্টাচার্য, রাজা রবি বর্মা, নিমিষা ভানোত ও সমসাময়িক আরো অনেকে।

প্রত্যেকটা ছবিই একেকটা নির্দিষ্ট চিন্তা বা অনুভূতি নিয়ে করা। কোনোটার সাথে কোনোটার যোগসূত্র নাই, সবটার সাথে সবটারই যে যোগসূত্র — তা হলো আমি ও আমার সময়। এখন বেশিরভাগ কাজই কাগজে, কলমে, রঙে ছোট পরিসরে করা। ভবিষ্যতে বড় ক্যানভাসে আরও ডিটেইল কাজ করার ইচ্ছা আছে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here