সম্প্রতি বিজু উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে নিধুকটুক নামের একটি অসামান্য সংকলন। প্রতি বছরের মতো এবারও প্রকাশ করেছে রাঙামাটির বনযোগীছড়া কিশোরী কল্যাণ সমিতি। অসামান্য এই জন্য যে, বাংলাদেশের বিচিত্র ভাষাভাষীর সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে বোঝার জন্য সহায়ক হয়ে উঠতে পারে এই প্রকাশনা।
সুগম চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলনটিতে আছে বাংলা, চাকমা, ম্রো, ত্রিপুরা কবিতা; আছে রাঙামাটির চাঁদগায়ে ভাষার কবিতা। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষায় রচিত বেশ কিছু প্রবন্ধ, পুস্তক সমালোচনা, গান, চাকমা গল্প, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘‘মনের খোরাক মিটাতে যদিও সাহিত্যের আশ্রয় নেওয়া হয় তেমনি একটি জাতির আত্মপরিচয় তুলে ধরাতেও সাহিত্য সংস্কৃতি[র] গুরুত্ব রয়েছে।’’ প্রকৃতপক্ষে আত্মপরিচয় একটি দরকারি প্রশ্ন; জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ — সকল প্রান্ত থেকে প্রশ্নটি উত্থিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন প্রধানত জাতি ও সংস্কৃতিগত।
বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের এ অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। শান্তিচুক্তি স্থাপনের পরও আদতে ‘‘শান্তি’’ আসে নি। চলছে স্থানিক ও রাষ্ট্রিক পর্যায় থেকে উৎসারিত বিবিধ মাত্রার সংকট। এ কারণেই বেছে নেয়া হয়েছে ‘‘নিধুকটুক’’ শব্দটিকে — চাকমা শব্দটির অর্থ সংকট। এই সংকলনে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় আছে সংকট মুক্তি এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। লিখেছেন মৃত্তিকা চাকমা, সজীব চাকমা, মুকুল কান্তি ত্রিপুরা, পরিমল বিকাশ চাকমা, ধীর কুমার চাকমা, প্রগতি খীসা, শুভ্র জ্যোতি ঘোষ চাকমা, মীর আবু সালেহ্ শামসুদ্দীন, প্রকট চাকমা, কুলদীপ রায়, মনোজ বাহাদুর গুর্খা, মলয় ত্রিপুরা ইয়াংঙান ম্রো প্রমুখ।
সজীব চাকমা লিখেছেন বাংলাদেশের আদিবাসী, উপজাতি ও নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গে। মুকুল কান্তি ত্রিপুরার প্রবন্ধে উঠে এসেছে বিশ শতকের বাংলাদেশে ত্রিপুরা ভাষার সাহিত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা। পরিমল বিকাশ চাকমার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে চাকমা সমাজের বিবর্তনের বৃত্তান্ত। চাকমা খাদ্য ও রান্নার প্রণালি প্রসঙ্গে লিখেছেন শুভ্র জ্যোতি চাকমা। প্রতিটি লেখা স্ব স্ব অবস্থান থেকে আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের ইঙ্গিত দেয়।
সব চেয়ে তাৎপর্যবহ দিক এই যে, নিধুকটুক সংকলনে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা সাহিত্যিক আধার ও আধেয় বাংলাদেশের বহুসাংস্কৃতিক ও বহুভাষিক অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। যাঁরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে কেবলই ‘‘বাংলা’’ ভাষার সাপেক্ষে সংজ্ঞায়িত করতে চান তাঁদের চিন্তার বিপরীতে বিরুদ্ধ প্রস্তাব হাজির করে নিধুকটুক সংকলনটি; বাংলাদেশের প্রচলিত সাহিত্য ইতিহাসের বিপরীত ভিন্ন স্বরের সম্ভাবনা হাজির করে। যাঁরা বাংলাদেশের অপরাপর ভাষার সাহিত্যচর্চার হদিস নিতে চান, তাঁদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই সংকলন।