হিমেল বরকতের পিএইচডি গবেষণা

বিদ্যায়তনে জ্ঞান উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন হিমেল বরকত। যদিও কবি হিসেবে তিনি সমাধিক পরিচিত। শিশু সাহিত্যিক, আবৃত্তি শিল্পী, গীতিকার, প্রাবন্ধিক হিসেবেও তার বিচরণ ছিল। কিন্তু যে-বিষয়টায় তিনি একেবারেই অনালোচিত কিংবা অপরিচিত রয়ে গেলেন সেটা হলো তার পি-এইচডি গবেষণাকর্ম। অথচ বিদ্যায়তনিক পাটাতনে কিংবা সৃজনশীল সাহিত্যজগতের জন্য গবেষণাকর্মটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস বিশ্লেষণে তা দরকারি।

 

তাঁর পি-এইচডি গবেষণাকর্মটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি ফলে তা পাঠকের হাতেও পৌঁছেনি। কেন এই গবেষণা কয়েক বছরেও বই আকারে প্রকাশিত হলো না তাঁর একটি কারণ আছে। কবি হিমেল বরকত জীবিতাবস্থায় সে বিষয়ে আলাপ করেছিলেন আমার সঙ্গে। আমি জানি না, আর কারো সঙ্গে তিনি এ-বিষয়ে কোনো কথা বলেছিলেন কিনা?

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যে-কক্ষ হিমেল বরকত ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন সেখানকার একটি বুকসেল্ফের নিচের তাকে খয়েরি রংয়ের র‌্যাক্সিনে বাঁধানো ছিল তার পি-এইচডি থিসিস। খয়েরি রংয়ের র‌্যাক্সিনে (সম্ভবত) সোনালি রংয়ে লেখা ‘বাংলাদেশের কবিতা (১৯৪৭-২০০০) : উত্তর-ঔপনিবেশিক কন্ঠস্বর’। এটা হলো তার পি-এইচডি গবেষণার শিরোনাম। তার ব্যক্তিগত কক্ষে অবাধ যাতায়াতের সুবিধার্থে সেল্ফের নিচের তাকে এই গবেষণাপত্রটি বের করার জন্য কয়েকবার টানাহেচড়া করেও যখন বের করতে পারিনি তখন একদিন রাগত স্বরে তাকে বলেছিলাম : এটার বই বের করেন না কেন? এ-প্রসঙ্গে যে-জবাব তিনি দিয়েছিলেন তা আলোচনার শেষে জানাবো। এখন একটু তার গবেষণার বিষয়বস্তুর দিকে আলোকপাত করা যাক।

 

‘বাংলাদেশের কবিতা (১৯৪৭-২০০০) : উত্তর-ঔপনিবেশিক কন্ঠস্বর’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায় : উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য ও বাংলা কবিতা; এর অন্তর্ভক্ত : ক. উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য : তত্ত্ব ও তথ্য, খ. বাংলা কবিতার উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য (১৭৫৭-১৯৪৭)। দ্বিতীয় অধ্যায় : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর : উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিত; এখানে আলোচিত হয়েছে : পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্ব। তৃতীয় অধ্যায় : বাংলাদেশের কবিতা (১৯৪৭-২০০০) : উত্তর-ঔপনিবেশিক কন্ঠস্বর; এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে : ক. ‘মূলধারা’র কবিতা, খ. প্রান্তিক বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কবিতা গ. অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কবিতা। চতুর্থ অধ্যায় : বাংলাদেশের কবিতার শিল্পাঙ্গিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্যের প্রভাব।

 

উল্লিখিত চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত তার পি-এইচডি অভিসন্দর্ভ। এই গবেষণাকর্মটি কেন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে গবেষক তার গবেষণা-প্রস্তাবণায় উল্লেখ করেছেন। পাঠক হিসেবে গবেষণাকর্মটির গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু বলা দরকার।

‘আমরাই সেরা’ কিংবা ‘জাতি হিসেবে আমরাই শ্রেষ্ঠ’ এমন অভিধা নিয়ে যখন জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব কেউ নির্মাণ করতে চায় তখন তা অন্যের সাপেক্ষে তুল্য হয়ে ওঠে। তখন প্রশ্ন জাগে : শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের মাপকাঠি কী? তখনই ‘আত্ম’ ‘অপর’ ধারণাটি জেঁকে বসে। অর্থাৎ আমার যা কিছু আছে সব ভালো আর অপরেরটা নিকৃষ্ট। সেক্ষেত্রে অপরকে নিকৃষ্ট বানানোর প্রক্রিয়া তৈরি করা হয়। যে-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিত অর্থাৎ শাসক এবং শাসিত কাঠামো গড়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী নিজেকে জাহির করার উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিতদের নিকৃষ্ট/অসভ্য হিসেবে পরিচিতি দান করে। যার ফলে উপনিবেশিতরা নিজেদের নিয়ে হীনম্মন্য ভাবনায় ভোগে।

 

আর তখন তারা নিজেদের সকল প্রবণতা অস্বীকার কিংবা জলাঞ্জলি দিয়ে ঔপনিবেশিক গোষ্ঠীর মতো হয়ে উঠতে চায়। তা কি আদৌ তারা পারে? কিংবা একটি উপনিবেশিত ভূখণ্ডের সকলেই কি এই মানসিকতা পোষণ করে? শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই প্রবণতাটি খুবই গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চল সুদীর্ঘকাল ধরে যে-ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় আবদ্ধ ছিল তাতে ওইসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ কাঠামো অনেক উপাদান বিলীন গেছে। ঔপনিবেশিক শাসকের কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থাকেই তারা মানতে বাধ্য হয়েছে। আবার কেউ কেউ সাদরে গ্রহণ করেছে।

 

আবার কেউ কেউ আমৃত্যু বিরোধিতা করে লড়াই জারি রেখেছে। বাংলাদেশের কবিতায় উপনিবেশবাদের বিরোধিতার এই বিষয়টি হিমেল বরকত তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন। যেটাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য হিসেবে। সেক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য হল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধী জ্ঞানভাষ্য।’ বাংলাদেশের কবিতায় এই ‘প্রতিরোধী জ্ঞানভাষ্য’ চিহ্নিত করেছেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :

দৃষ্টিভঙ্গিগত এবং কেন্দ্র-প্রান্তের এই সম্পর্কবিন্যাস মূলত ঔপনিবেশিক চেতনাপুষ্ট। ফলে উত্তর- ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনিবার্য হয়ে ওঠে প্রচলিত কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিন্যাস। সেই আলোকে, বর্তমান অভিসন্দর্ভে বাংলাদেশের কবিতাকে নিম্নোক্ত তিনটি ধারায় উপস্থাপন করা হয়েছে :
ক. ‘মূলধারা’র কবিতা
খ. প্রান্তিক বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কবিতা
গ. অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কবিতা।

বাংলাদেশের কবিতার এই তিন ধারায় স্বতন্ত্রভাবে উত্তর-ঔপনিবেশিক কন্ঠধ্বনি অনুসন্ধান করেছেন তিনি। যার একটি অংশ পাকিস্তানপর্ব (১৯৪৭-১৯৭১) আরেকটি অংশ বাংলাদেশপর্ব (১৯৭১-২০০০)।

 

হিমেল বরকত তার গবেষণায় বাংলা কবিতার বিকাশের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক প্রভাব চিহ্নিত করেছেন। আর সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের উপনিবেশের ইতিহাস বারবার তার গবেষণায় স্থান পেয়েছে। ইউরোপিয় রেনেসাঁসের আদলে ঔপনিবেশিত ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলে যে-রেনেসাঁসের কথা বলা হয়েছে তা আসলে এই অঞ্চলে ইংরেজ শাসনকে আরও সুদৃঢ় করার একটা প্রকল্পমাত্র। ফলে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ক্ষেত্র বিশেষে হাজির হয়েছেন। কারণ ইউরোপের রেনেসাঁস সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদকে আলিঙ্গন করেছে কিন্তু ভারতীয় অঞ্চলে রেনেসাঁস বলতে যা হয়েছে তাতে সেরকম তো হয়নি উলটো এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই একটা ভিনদেশি প্রভাব পড়েছে। যার ফলস্বরূপ যে-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণী তৈরি হয়েছে তাদের জাতীয়তাবাদী বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ করা যায়। হিমেল বরকত এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবটি কবিতার ক্ষেত্রে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন তার গবেষণায়।

 

ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলে যে-রেনেসাঁস প্রসঙ্গ এসেছে তা রেনেসাঁসের বদলে হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণ হয়ে উঠেছে। তেমনি ভারতবর্ষ বিভাজনের পর পাকিস্তান শাসনামলে ইসলামি জাগরণের ঢেউ লক্ষণীয়। এই প্রবণতা কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। হিমেল বরকত তার গবেষণায় বিভাগোত্তোর বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র কবিতায় দুইটি ধরন চিহ্নিত করেছেন। প্রথম ধরন — ইসলামি/পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী কবিতা; দ্বিতীয় ধরন — বুর্জোয়া মানবতাবাদী কবিতা।

 

বাংলাদেশপর্বে প্রান্তিক বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কবিতায় ‘মূলধারা’র বাইরে যারা কাব্যচর্চা করেন তাদের কবিতায় উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রভাব চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। আর এক্ষেত্রে কীসের ভিত্তিতে কিংবা কোন প্রবণতার কারণে ‘মূলধারা’র কবিতা আর প্রান্তিক বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কবিতা ভিন্ন পরিচয় পেল তাও তিনি চিহ্নিত করেছেন। আর এখানেও পাওয়া গেল উপনিবেশের প্রভাব। ফলে ‘কেন্দ্র’ আর ‘প্রান্ত’ ডিসকোর্স হাজির করলেন তিনি। আবার এটার আরেকটি রূপ গবেষণায় উঠে এল যা — অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করলেন তিনি।

 

তখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উঠে এল। এইসব প্রকরণের ভেতর বাংলাদেশের কবিতায় উত্তর-ঔপনিবেশিক কন্ঠস্বর চিহ্নিত করেছেন। ফলে বাংলাদেশের কবিতা বাংলা ভাষার কবিতার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলাদেশ-ভূখণ্ডের বাংলা ভাষার বাইরে অপরাপর ভাষায় যারা কবিতা লেখেন তারাও স্থান পেলেন এই গবেষণায়। ফলে ঔপনিবেশের ক্ষেত্রটাও পেল আরেক মাত্রা। সেক্ষেত্রে কবিতায় ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের একটি রূপ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।

 

হিমেল বরকত উত্তর-ঔপনিবেশিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের যে-প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন তাতে বাংলাদেশের কবিতাকে মূলে রেখে কবির চেতনা ও মনোভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যার ফলে তাঁর গবেষণা শুধু তাত্ত্বিক কাঠামোয় আবদ্ধ থাকেনি। ‘উত্তর ঔপনিবেশিক চৈতন্যের সহগামী প্রাক-ঔপনিবেশিক কাব্যাঙ্গিকের প্রয়োগগত নানা নিরীক্ষার ক্ষেত্রগুলো শনাক্তকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কবিতার নিজস্ব বিকাশের দিগন্তকে’ও চিহ্নিত করেছেন।

 

আবার পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরি, কেন প্রকাশিত হল না হিমেল বরকতের এই পিএইচডি গবেষণাকর্ম? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, তাঁর এই গবেষণাকর্মটি তিনি বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছিলেন। তারপর বেশ কয়েকবছর পেরিয়ে গেলেও একাডেমি কোনো সাড়া দেয়নি।

 

তখন আমি বলেছিলাম, বাংলা একাডেমিতে ফোন দিয়ে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ করলে নাকি কাজ হয়ে যায়। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমিতে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ করে বই বের করার কোনো ইচ্ছা তার নেই।
আমি আবার বলি, অন্য কোনো প্রকাশনীতে দিবেন কিনা?
জবাবে তিনি বলেছিলেন, মাওলা ব্রাদার্সের সঙ্গে নাকি কথা চলছে।

 

এরপর আমি জানি না অভিসন্দর্ভটি কোনো প্রকাশনীতে তিনি দিয়েছিলেন কিনা? তবে এটুকু জানাতে পারি, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অনেক ‘তেলতেলে’ গবেষণা বইয়ের চেয়ে হিমেল বরকতের গবেষণাকর্মটি জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে বেশ ওজনদার।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here