অব্যয়ীভাব সমাসের কী প্রয়োজন?

কোনো ভূমিকা না করে আসল কথাটা আগে বলে নিই। অব্যয়ীভাব সমাসের প্রয়োজন নেই ব্যাকরণে।

 

বাংলা ব্যাকরণে এই সমাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: পূর্বপদে অব্যয় থাকে এবং অব্যয়ের অর্থই প্রধান হয়। এরপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা না করে কিংবা দুর্বল ব্যাখ্যাসহ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা বলতে এটুকুই: সামীপ্য (নৈকট্য), বিপ্সা (পৌনঃপুনিকতা), পর্যন্ত, অভাব, অনতিক্রম্যতা, সাদৃশ্য, যোগ্যতা প্রভৃতি নানা অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়। লক্ষ করুন, ‘অব্যয়’ যদি বাংলা পদের একটি শ্রেণি হয়, তবে উপ, প্রতি, অনু এসব পদ আদৌ কি আমরা বাংলা বাক্যে ব্যবহার করি? প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ থেকে কিছু উদাহরণ দেখা যাক (যাঁরা অব্যয়ীভাব সমাসকে ভয় পান, তাঁরা উদাহরণ পার হয়ে লেখার পরের অংশে চলে যান):

১. সামীপ্য (উপ) : কণ্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ, কূলের সমীপে = উপকূল।
২. বিপ্সা (অনু, প্রতি) : দিন দিন = প্রতিদিন, ক্ষণ ক্ষণ = অনুক্ষণ।
৩. অভাব (নিঃ = নির) : ভাবনার অভাব = নির্ভাবনা, উৎসাহের অভাব = নিরুৎসাহ।
৪. পর্যন্ত (আ) : জীবন পর্যন্ত = আজীবন, সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল।
৫. সাদৃশ্য (উপ) : শহরের সদৃশ = উপশহর, গ্রহের তুল্য = উপগ্রহ।
৬. অনতিক্রম্যতা (যথা) : রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি, এরূপে — যথাসাধ্য।
৭. অতিক্রান্ত (উৎ) : বেলাকে অতিক্রান্ত = উদ্বেল, শৃঙ্খলাকে অতিক্রান্ত = উচ্ছৃঙ্খল।
৮. বিরোধ (প্রতি) : বিরুদ্ধ বাদ = প্রতিবাদ, বিরুদ্ধ ক‚ল = প্রতিক‚ল।
৯. পশ্চাৎ (অনু) : পশ্চাৎ গমন = অনুগমন, পশ্চাৎ ধাবন = অনুধাবন।

 

শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণে ভীতি এমনি এমনি জন্মায়নি। অর্থতত্ত্বের বিষয়কে শব্দতত্ত্বে এনে জটিলতা বাড়ানো হয়েছে। অব্যয়ীভাব সমাসের সমস্ত উদাহরণ নিশ্চিতভাবে উপসর্গের মধ্যে যাবে। কারণ, বাংলা উপসর্গ যোগ হয় শব্দের আগে। কূলের আগে ‘উপ’ বসিয়ে উপকূল, গমনের আগে ‘অনু’ বসিয়ে অনুগমন, ভাবনার আগে ‘নির’ বসিয়ে নির্ভাবনা… উপসর্গযোগে গঠিত ভেবে নিতে সমস্যা কোথায়? মুক্ত রূপমূলের আগে বদ্ধ রূপমূল যুক্ত হয়ে তৈরি শব্দগুলোকে আমরা বলি উপসর্গসাধিত। বাংলা ব্যাকরণে এগুলোকে সমাসসাধিত বললে বরং সমস্যা বেশি হয়। কারণ, সমাসসাধিত শব্দগুলো দুটি মুক্ত রূপমূল একত্র হয়ে গঠিত হয়। উপকূল, অনুগমন, নির্ভাবনা অব্যয়ীভাব সমাসের কোনো উদাহরণেই দুটি মুক্ত রূপমূল নেই।

 

তবে, সংস্কৃত ব্যাকরণে অব্যয়ীভাব সমাসের প্রয়োজন আছে। উপরের উদাহরণগুলোকে সংস্কৃত ব্যাকরণে উপসর্গসাধিত বলা যায় না। কারণ, সংস্কৃত ভাষায় উপসর্গ বসে ধাতুর আগে, শব্দের আগে নয়। আর বাংলা ভাষায় উপসর্গ বসে শব্দের আগে, ধাতুর আগে নয়। প্রাচীন আর্য ভাষার অনেক সাধিত শব্দ বাংলায় একক শব্দ বা শব্দমূল হিসেবে প্রবেশ করেছে। যেমন, ‘জয়’ শব্দটি সংস্কৃতে প্রত্যয়সাধিত। বাংলায় এটি মৌলিক শব্দ। একে উপসর্গ, ধাতু, প্রত্যয়ে বিভাজিত করে শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো শুধু অকারণ নয়, অপরাধ। ‘জয়’ শব্দের আগে বি, পরা উপসর্গ যোগ করে বিজয়, পরাজয় শব্দ তৈরি হয়েছে। আবার ‘জয়’ শব্দের পরে ঈ, আ প্রত্যয় যোগ করে জয়ী, জয়া হয়েছে।

 

সংস্কৃত ব্যাকরণে ধাতুর আগে উপসর্গ বসে এবং এসব উপসর্গের সংখ্যাও নির্দিষ্ট। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাংলা উপসর্গকে সংখ্যা-নির্দিষ্ট করা যায়নি। বরং, উপসর্গকে বাংলা, সংস্কৃত ও বিদেশি — অদ্ভুতভাবে এই তিন প্রকারে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগের কোনো প্রয়োজন নেই। উপসর্গকে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘অব্যয়’ হিসেবে চিহ্নিত করারও দরকার নেই। উপসর্গ অর্থহীন শব্দাংশ (বা বদ্ধ রূপমূল) — এটুকু ধারণাই যথেষ্ট।

 

আরও পড়ুন

লিঙ্গ প্রকরণে নারীবাদের প্রকোপ

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here