অন্যমনস্ক দিনগুলি ।। কিস্তি : ৩

এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এই মুহূর্তের গল্প; যে গল্পের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। চমৎকার ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র। এই গল্প নিশ্চিতভাবে টেনে নেবে আপনাকে। কারণ আপনিও সম্ভবত জড়িয়ে আছেন এই উপন্যাসের সঙ্গে।

 

নিজের নতুন শোয়ার ঘরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলাম। জলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। শেষ দিকে আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছিল জলি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো থার্ড ইয়ারে এসে। ডাস বা টিএসসি এরকম কোনো একটা জায়াগায়। প্রথম পরিচয়ের ক্ষণ আমি কখনো মনে করতে পারি না। স্মৃতিশক্তি দুর্বল। আমার শুধু সম্পর্কের কথাটা মনে থাকে। নিজের ঘনিষ্ঠ কারো কথা স্মরণে এলে সেটা বুক থেকে আসে, মাথা থেকে আসে না। মাথায় আমি তেমন কিছুই রাখতে চাই না। এটা আমার স্বভাবদোষ। বিষয়টা আমি বুঝি। যে কারণে কম লোকের সঙ্গে আমার সখ্য হয়। জলির সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনক্ষণ যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে আসে না।

 

সে যে এখন কোথায় আছে, কীভাবে আছে জানি না। তবে শুনেছিলাম দেশের বাইরে চলে গেছে। বিয়েও হয়েছে হয়ত, আমি জানি না। আমার বিয়েতে জলির আসাটা কোনো একটা ইঙ্গিত বহন করে। কী সেটা আমি সঠিক জানি না। একবার মনে হয়েছিল সে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এ মেসেজ দিতে আমার বিয়েতে এসেছে। দ্বিতীয়বার মনে হয়েছে সে আমার কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সেটা বোঝাতে চেয়েছি। তৃতীয়ত আমার মনে হয়েছে জলি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছে। আমি তার জন্য যা যা করেছি, সেসবের জন্য সে কখনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। বরং আমাকে দিয়ে সে আরো নিজের স্বার্থ রক্ষা করেই গেছে। কখনো আমাকে কিছু দেয়নি সে। আমি যে চাইনি তা নয়। মুখে চাইনি সেটা ঠিক, কিন্তু সবকিছু কি মুখে চাওয়া যায়? যার সঙ্গে আমি দিনের পর দিন চলেছি, সে তো বুঝেই আমি আসলে কী চাই। আমার এই মুখ ফুটে না-বলার অভিমানের প্রতিদান দিতে জলি আমার বিয়েতে এসেছিল — হতেও পারে।

 

ওর তখনো বিয়ে হয়নি। চাকরি-বাকরিও বিশেষ কিছু পায়নি। বাবার গঞ্জনা হয়েই দিন পার করে দিচ্ছিল বলে শুনেছিলাম। আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছি তাও পাঁচ বছর হবে তখণ। বয়স আমাদের তখন তিরিশের ঘরে। এ বয়সের একটা মেয়ের বা ছেলের চাকরি বা বিয়ে না হওয়া, কোনো সম্পর্ক না থাকা — তা সে যে আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন ঘরেরই হোক না কেন একটা ক্রাইসিস। জলির বাবার অবস্থা খুব একটা খারাপ অবশ্য ছিল না। একটা ফার্স্ট ক্লাস সরকারি অফিসারের চাকরি করতেন তিনি। উত্তরায় তারা বোধহয় দু’টো ফ্ল্যাটের মালিক। ওর ভাই ছিল দু’জন। সবমিলিয়ে মধ্যবিত্ত সুখী পরিবার তারা। জলি পড়ত বাংলায়। আমি সোশিওলজিতে। সে মাঝে মাঝে এসে রোকেয়া হলে থাকত। আমি স্থায়ীভাবে জিয়াউর রহমান হলের বাসিন্দা।

 

আমার বাবাও অবস্থাসম্পন্ন না হোক গরিব ছিল না। আমরা তিন ভাই আর এক বোন। বাবা বিদেশে থাকার পর ফিরে এসে একটা ফার্মেসির দোকান দিয়েছিলন মফস্বল শহরে। আমার দু’ভাইয়ের একজন আবার ইতালি চলে গেছে। ছোটটা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বোনটা বাবা-মার সঙ্গেই থাকে। ওর বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আমাদের আর রেখাদের দু’জনের বাড়িই কুমিল্লা। একদিন ট্রেনে করে কুমিল্লা যাওয়ার পথে রেখার এক চাচার সঙ্গে আমার দেখা। তিনি বাবার ভালো বন্ধু ছিলেন। তার ঘটকালিতে আমার আর রেখার বিয়ে হয়। মাঘ মাসে কুমিল্লার এক কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন ছিল। আমি অল্প কিছু দাওয়াত কার্ড ছাপিয়েছিলাম।

 

বন্ধুদেরও দিয়েছিলাম কিছু কিছু। তাদের থ্রুতেই জলি কুমিল্লায় আমার বিয়েতে অ্যাটেন্ড করেছিল। আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলি নাই। সেও চেষ্টা করে নাই। এমনকি ছবিও তোলে নাই। আমি সৌজন্যতার খাতিরে হাত নেড়েছিলাম। জলি হালকা মাথা দুলিয়ে সায় দিয়েছিল মুখে একটা হাসি নিয়ে।

 

যেন বলতে চেয়েছিল সব ঠিক আছে। সে আমাকে ভোলে নাই। জলি থেকে আমি আসলে তখন অনেক দূরে। কারণ তার বিষয়ে আমার ক্রোধ ছিল, বঞ্ছনার অনুভূতি ছিল। নিজেকে একজন লুজার ভাবতাম আমি জলির কথা মনে উঠলে। জলিকে সহজে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আমার বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় নাই। তারপরও বিয়ের মতো পবিত্র একটা অনুষ্ঠানে জলির আসাটাকে আমি নেগেটিভভাবে দেখি নাই। আসছে যখন, তখন ভালোই হইছে — আমি এমনটাই ভাবছিলাম।

 

জলির বিষয়ে রেখাকে আমি কখনো কিছু বলি নাই। বলার প্রয়োজন মনে করি নাই। জলিকে আমি ক্রমাগত ভুলতেই চেয়েছি। এখন এই অখণ্ড অবসরে অপ্রস্তুত অবস্থায় সে আমার মনে এত প্রবলভাবে অনুপ্রবেশ করার আগ পর্যন্ত জলিকে নিয়ে আমি মোটেও ভাবিত ছিলাম না। মাঝে মাঝে মনে আসত। আবার উবে যেত। কত কথাই তো মনে আসে। মানুষের মন একটা কারখানা — সেখানে সারাক্ষণ কিছু না কিছু ঘটে চলে। সেই যজ্ঞের ভেতর জলি কখনো-সখনো মনে উঁকি দেয় নাই তা না। দিয়েছে। আবার সহসাই তাকে ভুলে গেছি। যে কারণে রেখাকে তার বিষয়ে বলার কোনো গ্রাউন্ড তৈরি হয় নাই। বিয়ে মানে যে জীবনের সব অর্গল খুলে বসে থাকা সেটা বোধহয় না। বিয়ে মানে যে কী আমি বুঝিও নাই তেমন এখন পর্যন্ত। ভাবতে গেলে হয়ত কিছু একটা মনে হবে যে — এই হলো বিয়ে।

 

আমার বন্ধু মোনেম যেমন বিয়ে মানে বলত সেক্স করা। সে মিন করে বলত কি না তা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু বলত সেক্সের কথা। তার পছন্দ ছিল সিংহ রাশির জাতিকা। এই রাশিকার জাতিকারা নাকি সেক্স বিষয়ে খুব অ্যাকটিভ হয়। মোনেমের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয় নাই। সে আসলেই সিংহ রাশির কাউরে পাইছে কি না জানি না। আমাদের স্টুডেন্ট লাইফের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সেক্স নিয়ে আলাপ। সেই আলাপ এখন আর মোটেও হয় না কারো সঙ্গে। বউয়ের সঙ্গে যে সেক্স তাতে কোনো আলাপ থাকে না। আগেও না পরেও না। সেটা সেক্সই, কিন্তু কসরতের মতো করে করা।

 

রেখাকে আমার সেক্সি মনে হয়। এখনও সে দারুণ যৌবনা। বিছানায় কখনো আমাকে না করেনি। তবে কখনো সেক্স নিয়ে আলাপ হয় নাই। না নিজের, না অন্যদের। নিজেরা নিজেরাই একই ঘরে দিনে পর দিন থাকার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কথা কমে যায়। যদি আরো লোক থাকত, যদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সখ্য থাকত তাহলে হয়ত আরো কথা বলতাম আমরা। কখনো কারো সঙ্গে যৌন ইশারার আদান-প্রদান হতো। যেটা এখন রোকন সাহেবের সঙ্গে আমার বউয়ের হচ্ছে বলে আমি সন্দেহ করছি। না হলে এত রাতের বেলা ফোনে কী এমন কথা বলছিল রেখা? কার সঙ্গেই বা বলছিল। রোকন ছাড়া আর কারো সঙ্গে কী কথা হওয়ার সুযোগ আছে? ওর পুরানা কোনো বন্ধু? কই কখনো তো শুনি নাই ওর মুখে কারো কথা?

 

আচ্ছা, আমি যখন অফিসে যেতাম তখন কি কিছু আরো কথা বা আরো কিছু হয়েছিল কখনো ওদের মধ্যে? রোকন সাহেবের অবশ্য বউ আছে। বয়সে অনেক ছোট একটা বউ। তাদের ঘরে একটা বাচ্চাও আছে। তা সেই বউয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে, ফ্ল্যাটের এত লোকের কাছ থেকে লুকিয়ে তাদের দু’জনের কিছু করাটা টাফ। বিশেষ করে এই বিল্ডিংয়ের যে মালিক, যে নিজের বাপের জমিতে এত বড় ভবনটা ডেভেলপারকে দিয়ে বানিয়েছে, সে খুব ফিচেল স্বভাবের লোক। তার কাজ নাই কোনো। বিল্ডিংয়ের কোথায় কী হচ্ছে তার সার্বক্ষণিক নজর। সে নজর এড়িয়ে কারো কিছু করাটা খুব মুশকিল। সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কয়েকটা। ছাদেও লাগিয়ে রেখেছে। একবার কোন তলার কোন কাজের মেয়ের সঙ্গে কেয়ারটেকারের ফস্টিনস্টি সে ধরে ফেলেছিল। এ রকম তার আড়ালে কিছু করাটা এ ভবনে সে প্রায় অসম্ভব করে রেখেছে। তার এ নৈতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা আমার নিজের জন্যও স্বস্তিদায়ক মনে হবে — সেটা আগে ভাবনায় আসে নাই।

 

সিগারেট শেষ করে আবার একটা চক্কর দিলাম ঘরের মধ্যে। ডায়রিটা আগের জায়গায় পড়ে আছে। শ্যামলী বা রেখা, রাফা কেউ আর ড্রয়িংরুমে নেই। তারা বোধহয় রেখার রুমেই আছে। সেখানে গিয়ে একবার উঁকি দিলাম। রেখা মোবাইল দেখছে। রাফা আর শ্যামলী খেলছে। রান্না-বান্না বোধহয় শেষ। আমি গোসলে ঢুকলাম বলে জানিয়ে আসলাম।

 

ধীরে ধীরে গোসলের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। করোনায় গরম পানিতে গোসল করার কথা বলা হয়। নিজেই চুলায় গরম পানি বসালাম। শব্দ পেয়ে রেখা ছুটে এল। তাকে বললাম থাক আমি নিজেই করে নিচ্ছি। সে জানতে চাইল কিছু হয়েছে কি না। আমি তাকে কিছুটা ঠান্ডা লাগার মতো অবস্থার কথা জানালাম। সে উদ্বিগ্ন হলো। সমস্যা গুরুতর কি না জানতে চাইল। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সে হয়ত আশ্বস্ত হলো, অথবা হলো না। দাঁড়িয়ে থাকল রান্না ঘরের দরজায়। আমি পানি ফোটার আগে পাতিলের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে থাকলাম — মনে হলো রেখা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সে আসলে দাঁড়িয়ে নাই। আরো যেন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি আমার মানসিক সমস্যা?

 

রেখা বাথরুম থেকে গোসলের বালতিটা নিয়ে এল। বলল বাথরুমে আমার টাওয়েল আর লুঙ্গি রেখে এসেছে সে। টেবিলে ভাত দেবে কি না জানতে চাইল। আমি আগে গোসল শেষ করি বলে জানালাম তাকে। সে আবার তার ঘরে চলে গেল। আমি গরম বালতিতে পারি নিয়ে গোসলে ঢুকলাম। ধীরে ধীরে পানি মেশাতে থাকলাম। আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি বোধহয়। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি। যে রেখা আমার জন্য এতকিছু করছে তাকে আমি সন্দেহ করছি। নিজেকে ছোট আর নীচ মনে হলো একবার। পরক্ষণেই যুক্তি করলাম আরো কিছুটা দেখি। আনমনে গোসল শেষ হলো। গা মুছে লুঙ্গি আর টিশার্ট পরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। তন্দ্রামতো এল। কতক্ষণ এভাবে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। রেখা খাবারের জন্য ডাকতে এল। টেবিলে আমি একা। অন্য সময় সবাই একসঙ্গে খাই। রেখা কখনো আমাকে একা খেতে দেয় না। খেতে বসে সে কথা বলে। আমি শুনি। মাঝে মাঝে আমিও বলি। ওদের পরিবারে অনেক সমস্যা। সম্পত্তি নিয়ে। সেসব আলাপে আমি মাঝে মাঝে বুদ্ধি দেই। সেগুলোর কিছু তার পরিবার শোনে, কিছু শোনে না। আজও সে দূরে বসে থাকল। সতর্কতা হিসেবেই সে দূরে বসেছে। অন্যদিন পাশের চেয়ারেই বসে। আমাকে অবজারভ করছে। জানতে চাইল খাবারে গন্ধ পাচ্ছি কি না। গায়ে একবার হাত দিয়ে দেখতে বলল জ্বর আছে কি না।

 

আমার সবই আসলে স্বাভাবিক। হাঁচিটাও নাই। কিন্তু নাকে একটু জ্বালাপোড়া আছে। মাথাটা কেমন ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে। কথা বেশি না বলে খাওয়ার পর ঘুম দিলাম একটা। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বিকাল। জুনের গরম বিকাল। সন্ধ্যা নামতে দেরি আছে। রেখা পরিপাটি একটা শাড়ি আর কপালে টিপ দিয়ে ছাদে যাব কি না জানতে চাইল রুমে এসে। কী ভেবে যাব না বললাম। শ্যামলী আর মেয়েটাকে নিয়ে তারা ছাদে গেল। ছাদে যেন যেতেই হবে রেখার। প্রতিদিন বিকালে ছাদে সে যাবেই। আর আমি দেখেছি সে ছাদে গেলে রোকন সাহেবও থাকবে। আমি যদি কখনো আগে যাই তখন রোকন সাহেবকে দেখি না। আমার বউ আসার পরপরই তিনি আসবেন। আজ হঠাৎ মনে হলো রেখাকে একা যেতে দেই। আমি তাকে সন্দেহ করছি না এই মুখোশটা দেখাই আগে।

 

ঘুম থেকে ওঠার পর লাল চা করলাম নিজে নিজে। টিভি ছাড়লাম। শরীরটা এখন ভালো লাগছে। করোনা হবে বলে মনে হচ্ছে না। টিভিতে করোনার খবর দেখাচ্ছে। মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছে। ঘরে থাকা কাকে বলে জানে না এদেশের মানুষ। ঢাকায় এসে ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। বাধ্য ছেলের মতো ঘরে থাকতে অভ্যস্ত নয় তারা। যারা বস্তিতে থাকে তাদের খবর তো বাদই দিলাম। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার আছে যারা ছোট একটা ঘরে থাকে অনেকে মিলে, তাদের পক্ষে একটানা সারাক্ষণ ঘরে থাকা অসম্ভব।

 

এর মধ্যে আমার সেই পুরানা বন্ধু আবার ফোন দিল। সে এখন রাজশাহীর ইউএনও। আমার সবচেয়ে বোজম ফ্রেন্ড ছিল সে। ওর সূত্রেই জলির সঙ্গে পরিচয়। সেই বন্ধুর নাম হাসনাত। করোনা মাহামরি শুরু হওয়ার পর ফোন দিয়েছিল কয়েকবার। সে হলো হাই ইনটেলেকচুয়াল। সে বলে, এদেশের মানুষ ঘরে থাকতে জানে না। হাসনাত হচ্ছে প্রচুর কথা বলত। দুনিয়ার তাবত বিষয় নিয়ে তার জ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে ঘটনাচক্রে তাকে আমি জিয়া হলের আমার সিটটা ছেড়ে দিয়ে আসি। সে অবশ্য ছিল অন্য হলে অ্যালটেড। কিন্তু সিট পাচ্ছিল না। ফটিকছড়ির ছেলে। কথায় একটা চিটাইঙ্গা টান এখনো আছে তার। আমি তাকে ডাকতাম বুদ্ধিজীবী বলে। ওর সঙ্গে আগের সেই বন্ধুত্বের আমেজটা পাই।

 

এর মধ্যেই বেল বেজে উঠল। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে দরজা খুললাম। দেখলাম রাফাকে কোলে নিয়ে শ্যামলী ফিরে এসেছে। বউ আসে নাই। ছাদের নাকি অনেক গরম। রাফার অসুবিধা হচ্ছে। তাই এতটুকু একটা মেয়েকে শ্যামলীর কোলে তুলে বউ বাসায় পাঠিয়ে দিল। আমি একটু অবাক হলাম। ছাদে আর কে আছে জানতে চাইলাম। শ্যামলী বলল, সেই রোকন ভাই আর আপা আছেন। সন্ধ্যা হতে আর খুব বেশি বাকি নাই। আজ আর ছাদে কেউ যায় নাই? শ্যামলী বলল, দেখি নাই। এই শেষ বিকালের আধো অন্ধকারে আমার বউ আর সেই রোকন মাস্টার তাহলে ছাদে একা? এতই প্রয়োজন হলো আমার বউয়ের ছাদে থাকাটা যে ছোট শ্যামলীর কোলে তার শিশু মেয়েটাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল? তিন তলা বেয়ে তারা নেমে এল, একটু দেখলও না? মাথাটা হুট করে গরম হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদে গিয়ে জানতে চাইব কেন এমনটা করল। তারপর মনে হলো না চুপিচুপি গিয়ে দেখব কী করছে। তবে দ্রুতই মাথা ঠান্ডা হলো। ভাবলাম থাক, এটা একটা পয়েন্ট আমার কাছে জমা রইল। যদি আমার বউয়ের মনে কিছু থাকে, আসলেই আছে কি না আমি তো জানি না, যদি সে রোকন লোকটার সঙ্গে অবৈধ প্রেমে জড়িয়েই পড়ে — তাহলে আজকের ঘটনাটা তাকে ধরার জন্য একটা উপায় হবে। আমার বউয়ের মনে যদি পরপুরুষের প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকেই, তাহলে শুরুতেই সেটা নিয়ে ধরে বসলে হীতে-বিপরীত হতে পারে।

 

এই সাইকো-অ্যানালাইসিসটা আমি শিখেছি জলির এক ফুফুর কাছ থেকে। তিনি বয়সে আমার বড় ছিলেন। যথার্থ ফুফুর বয়সীর তুলনায় কম বয়স যদিও। তখনও তার যৌবন শেষ হয়ে যায় নাই। তার নাম লিসা। আহা সেইসব দিনগুলি ফেলে এলাম কত আগে! লিসা অবশ্য আমাকে ফুফু ডাকতে নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলেন নাম ধরেই ডাকতে। ক্লাসমেটের ফুফুকে ফুফুই ডাকতে হবে এমন কোনো দিব্যি নাই। আমি তাকে নাম ধরে ডাকি নাই, ফুফুও ডাকি নাই। তিনি অবশ্য বুঝতে পারেন, বলতেন তুমি হলে কাকস্বভাবের মানুষ। সেই ফুফু বলেছিলেন, প্রেমের শুরুটা বুদ্বুদের মতো এটা মিলিয়ে যাবে আবার তৈরি হবে, আবার মিলিয়ে যাবে আবার তৈরি হবে। এরপর সেটা বেলুন হয়ে কিছুদিন উড়ে উড়ে বেড়াবে, তারপর ধীরে ধীরে তার হাওয়াটা বের হতে থাকবে। সে চিমসে যাবে। চিমসানো বেলুন এরপর পড়ে থাকবে কোথায় কোথায়, তার কোনো খবরই নেবে না কেউ।

 

ফলে প্রেমের শুরুটা কখনো প্রেম না। আমার বউয়ের ক্ষেত্রে যদি তাই হয় তাহলে তার মনে যে বাবল তৈরি হয়েছে সেটা মিলিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেই। আর আমার সন্দেহটাও তো একটা বাবল হতে পারে। সন্দেহটা আসলেই আমার মনের মধ্যে থাকে কি না দেখি না। তারপর না হয় বউকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাস করা যাবে। সে জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আরো কিছু ঘটনা ঘটাতে দিতে হবে। নিরাপদেই যেহেতু শ্যামলী আর রাফা নেমে এসেছে ছাদ থেকে, এটাকে ধরে বউয়ের সঙ্গে খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না।

 

চুপচাপ তাই আবার টিভি রুমে গিয়ে বসলাম। শ্যামলী রাফাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েরা বোধহয় ছোটবেলা থেকেই মা হওয়ার স্বভাব পায়। শ্যামলীকে আগেও দেখেছি সে যে কায়দায় কোলে নেয়, ঘুম পাড়ায়, মাঝে মাঝে খাওয়ায় মেয়েটাকে, যেন সে একটা মা।

 

ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কিছুটা হালকা লাগল। নিজের মেয়ের মুখের দিকে আমি খেয়াল করেছি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। কেমন সজীব ওর সবকিছু। কোনো বিরক্তি তৈরি হয় না। রিফ্রেশমেন্ট তৈরি হয়। সিঁড়িতে তখন খিল খিল করে বউয়ের হাসির শব্দ শুলাম। নেমে আসছে সে ছাদ থেকে, কিন্তু সঙ্গে আরো একটা পায়ের আওয়াজ। পিপ হোল দিয়ে দেখব কি না কে আসছে ভেবে নিয়ে আবার দমে গেলাম। এটাও ঠিক হবে না হয়ত। কিছু একটা দেখে ফেললে আমার সহ্য নাও হতে পারে। কিছু না দেখলেও আমার সমস্যা হয়ে যাবে। কারণ সন্দেহটা তখন ভুল পথে চলে যেতে পারে। আমাকে বুঝতে হবে আমি যে ওদের সন্দেহ করতে পারি সেটা ওরাও নিশ্চয় সন্দেহ করছে। সন্দেহ মনের মধ্যে থাকা আর সন্দেহের বাস্তব রূপ দেখতে পাওয়া — দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

 

কলিংবেল বাজলে দরজা খুললাম। রোকন সাহেব আর আমার বউ দুজনেই এসেছে। বউয়ের মুখে উচ্ছ্বাস। শাড়ি পরে গিয়েছিল একটা অফহোয়াইটের ওপর জরির কাজ করা। বাজুর কাছে কামড়ে থাকা আঁটসাঁট ব্লাউজ। গরমে ভিজে যাওয়া মুখ। মাথা থেকে এলো হয়ে আসা কিছু চুল লেপ্টে আছে মসৃণ গ্রীবায়। মাথার আরো কিছু চুল এলোমেলো। ছাদে গেলে সে চোখে কাজল দিয়ে যায়, আজো দিয়েছে। তবে লিপস্টিকও দেয় না। কানের ফুটোয় ছোট্ট দুল। নাকফুলটা লাইটের আলোয় কিছুটা চকচক করছে। শুধু চোখে-মুখে খুশির প্রগলভতা ছাড়া আরো কোনো বাড়তি কিছু নাই, ব্যতিক্রম নাই কোনো। ঘরে ঢোকার আগে আমাকে বলল, ‘দেখ তোমার জন্য মেহমান নিয়ে এসেছি। ঘরে তো সারাদিন একা একাই থাক।’

 

আমি সরে তাদের দুজনকে ঢুকতে দিলাম। ভাবলাম এতটা উদার অন্তত আমি হয়েছি যে বউকে অন্য পুরুষের সঙ্গে ছাদে আড্ডা দিতে দিচ্ছি এবং এরপর সেই পুরুষকে মেহমান হিসেবে বউয়ের বাসায় নিয়ে আসাটাকেও অনুমোদন দিচ্ছি।

 

রোকন ঘরে ঢুকে প্রথমে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুলো সাবান দিয়ে। তারপর সেই হাত বাথরুমে রাখা টিস্যু পেপারে হাত মুছে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসলেন। আগে কখনো এই ভদ্রলোক আমাদের বাসায় এসেছিলেন কি না আমি জানি না। তবে তার হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি এসেছেন। সোফায় বসে প্রথমে টিভির দিকে তাকালেন। তারপর রাফা আর শ্যামলীর দিকে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আশপাশে দেয়ালের দিকে তাকালেন। একটা বুকশেলফে কিছু বই রাখা আছে সেখানে চোখ বুলালেন। আমার বউ বই পড়ে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পড়তাম কিছু কিছু। হাসনাতের সঙ্গে থাকতে থাকতে কিছু বই কেনা হয়েছিল। চাকরির পর মাঝে মাঝে বই মেলায় গিয়ে বউয়ের সঙ্গে কেনা হয়ছে। সে কী বই কেনে, পড়ে আমার অত খেয়াল থাকে না। আমি শুধু পেপারই পড়ি আর মোবাইলে খবর।

 

সবদিকে মুখ ঘুরিয়ে রোকন আবার আমার দিকেই তাকালেন। বললেন, ‘কী ফুয়াদ ভাই বসেন, করোনার কী অবস্থা বলেন তো শুনি। আমার মনে হয় কী জানেন? করোনার আসল যা অবস্থা তা নিয়ে আমরা কথা বলি না আবার আমরা যা বলি করোনার সেই অবস্থা নাই।’

 

বলে হা হা করে হেসে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে রাফার ঘুম ভেঙে গেল। রেখা দ্রুত ছুটে এসে কোলে তুলে নিল তাকে। সরি সরি বলতে বলতে বেশ কাবু হয়ে গেল রোকন। আমি মনে মনে হাসলাম। শালা প্রথমেই একটা ভুল করে বসেছে। সে যে ভাব জমিয়ে গল্পের আসর শুরু করেছিল তার তাল কেটে গেল। আমি অবশ্য ভদ্রতাবশত ‘না এটা তেমন কিছু নয়’ বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ভণিতা করলাম। লোকটাকে দেখলাম ভালো করে। লম্বা হলেও হালকা শরীর। ফরসা গায়ের রঙ, মুখ দেখে বয়স বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে দু-একটা সাদা চুল। লকডাউনের কারণে হয়ত চুল কাটে নাই বলে কিছু লম্বা। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। চোহারায় তার ভালোমানুষী ভাব।

 

এবার কিছুটা নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন রোকন, ‘আসলে করোনার এ সময়টা খুব অদ্ভূত যাচ্ছে বুঝলেন, কী যে করি আর কী যে বলি বুঝে উঠতে পারছি না, আপনি চলুন আমার বাসায়, দু’জনে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। অভ্যাস আছে নাকি?’

 

বলে বুড়ো আঙুলটা পানি ঢালার মতো করে মুখের ওপর নাড়াতে লাগলেন। আমি যদিও মদ খাই না, কিন্তু এক সময় অল্প কিছু খেয়েছিলাম। সেটা জলি, হাসনাত এদের পাল্লায় পড়ে। তারপর দীর্ঘ দিনে মদের সঙ্গে আমার দেখা নাই। আমার সঙ্গে মদ জিনিসটা ঠিক যায় না। হুঁশ রাখতে পারি না তাই আর খাই নাই। কিন্তু রোকন সাহেবের এ ইঙ্গিতে পুরানা লিপ্সা আবার চাগা দিয় উঠল। তারপরও সেটাকে দমন করে না না বলেই গেলাম। এর মধ্যে বউ এলে চা আর কেক, রোল এসব নিয়ে। দু’জনে মিলে খেলাম। খেতে খেতে রোকন আমাকে বার বার বলেই যাচ্ছে, ‘আরে চলুন না ভাই, একা একা আমার আর ভালো লাগছে না। আপনিই বা কী করবেন এই দীর্ঘ সময়টায়। সারাদিন তো বাসায় ছিলেনই। ভালো না লাগলে চলে আসবেন। আসলে আমি শিক্ষক মানুষ তো একটু বকবক না করলে থাকতে পারি না। আপনি তো চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। শুধু শুনে যাবেন আমার কথা, আমার ভালোই লাগবে। আমি ভাবিকে বলেই এসেছি আপনাকে নিয়ে যাব বলে।’

 

আমার বউও যাও যাও করল, গেলে কিছু হবে না বলল। রাতে একা আর কতক্ষণ বাসায় বসে থাকব সেটাও বলল। তাদের দু’জনের মতের ঐক্য আমাকে কিছুটা অবাক করল। আমি কী করব তারা সেটা প্ল্যান করেই এসেছে। তাদের দু’জনের সখ্য তাহলে এতই বেড়েছে?

 

আমিও তাই ভাবলাম যাই, গিয়ে দেখে আসি, কথা বলে আসি। ওদের খেলায় পা না দিলে ওদের ভেতরে আমি ঢুকতে পারব না। ওরা হয়ত আমাকে সন্দেহমুক্ত রাখতেই এম কোনো পরিকল্পনা সাজিয়েছে। কিন্তু আমি তো সেয়ানা। আগে থেকেই সব বুঝতে পারি। আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া অত সহজ হবে না। এসব ভেবে আমি রাজি হলাম। ঘরে গিয় একটা ট্রাউজার আর ফতুয়া পড়ে চলে গেলাম রোকন সাহেবের ঘরে। তিনি দরজা খলে আমাকে ভেতরে যেতে যেতে বললেন, বাসায় কেউ নাই বুঝলেন। বউ আর বাচ্চাকে আমার শ্বশুর এসে ধামরাই নিয়ে গেলেন। ঘরে মধ্যে নাকি তাদের একা একা ভালো লাগছে না। বাচ্চাটা থাকলে খেলবেন, কথা বলবেন। আমি আরো অবাক হলাম। বাসা ফাঁকা রেখে আমার বউয়ের সঙ্গে ছাদে গিয়ে টাঙ্কি মারো আমার অনুপস্থিতিতে, কেমন মাস্টার তুমি! আর ঘরে কেউ ছিল না মানে তারা কি ঘরেও এসেছিল নাকি ছাদ থেকে। এসে তারপর?

 

মাথাটা আমার আবার গরম হতে শুরু করল। রোকন সাহেবদের বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে বের হলাম। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে হবে বলে ভাবলাম। তার ড্রয়িংরুম মতো ঘরের সোফায় গিয়ে বসলাম। সুন্দর করে সাজানো ঘর। মৃদু আলো জ¦লছে। কেমন খড়ের রঙের পর্দা দেওয়া। পুুরু কার্পেট। বড় একটা টিভি ঝুলছে। টেবিল ল্যাম্প, কিছু পেইন্টিংস, বড় বড় শোপিস, ফুলদানি, নকল ফুল, আর প্রচুর বই আছে ঘরটায়। একটা কোণার টেবিলে এলমেল সাদা কাগজ আর কলমও, খোলা বই — এসব দেখলাম। এই লোক কোন সাবজেক্টের টিচার আমি জানি না। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় এটা জানি। ঘরে এসিও আছে। আমি বসে বসে পা নাড়াতে থাকলাম। অপেক্ষায় থাকলাম কখন আসে পানীয়।

 

একটু পর রোকন লোকটা সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখল আমার সামনে। বেশ আদব-কায়দা জানে বলে মনে হলো। অবশ্য টিচারদের কাজই তো আদব-কায়দা মেনে চলা ও সেগুলো শেখানো। সোনালি তরল জল গোল অথচ খাটো গ্লাসে ঢেলে আমাকে দিলেন তিনি, নিজেও নিলেন। জানালেন এটা ‘গ্লিন ফিডিচ’, বাংলাদেশে সহজলভ্যদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। তারপর চিয়ার্স বলে চুমুক দিলেন। আমিও দিলাম। অনেকদিন পর ঝাঁঝালো আর তিতকুটে স্বাদের হুইস্কি আমার গলায় নামল। পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে দিল। বমির একটা ভাব আসাতে জোরে গলা খাঁকারি দিলাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন এতে সমস্যা হবে না। ভদ্র সমাজে গলা খাঁকারি বেমানান কিন্তু আমরা যেহেতু একটা ঘরোয়া পরিবেশে আছি সে জন্য এই গলা খাঁকারি সমস্যার কিছু নেই। এই দিয়ে বলা শুরু করল লোকটা, আর একের পর এক পেগ খেতেই থাকল।

 

বলা এবং খাওয়ার আগে ভণিতাটুকু সেরে নিলেন, ‘বুঝলেন ফুয়াদ ভাই, আমার আবার বেশি কথা বলার অভ্যাস আছে। আজ আবার আপনাকে পেয়েছি। আপনি তো প্রতিবেশী। মানুষ কখন কখন আপন হয় জানেন? যখন মানুষ একই জায়গায় থাকে, একই ভাষায় কথা বলে, একই অর্থনৈতিক অবস্থায় থাকে অথবা একই অপরাধ করে। হা হা… একই ভালো কাজ করা মানুষ কিন্তু নিজেদের আপন নাও ভাবতে পারে। তবে অপরাধীরা নিজেদের আপন ভাবে কারণ তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়’।

 

লোকটা নিজেই বলছে, নিজেই হাসছে। আমারও মজা লাগছে। ‘বুঝলেন অনেকদিন পর মদ খাচ্ছি, বাসায় বোতল আছে কিন্তু খাচ্ছিলাম না। মদ আসলে মানুষ কেন খায় বলুন তো?’ বলে লোকটা আমার দিকে তাকাল, আমি যেন ভাবতে লাগলাম তার প্রশ্নের উত্তর। তবে সে সুযোগ তিনি আমাকে দিলেন না। নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মদ তো ধরেন আমাদের সমাজের জন্য বিশাল ঘটনা। আমি একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। একটু বুদ্ধিজীবী আছি। আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। আমি ভাবি। আমার ভাবার জন্য মদ খাওয়ার দরকার পড়ে। আবার অনেকে বিনোদনের জন্য খায় বলা যায়। সবকিছুর পেছনে আসলে একটা রিজনিং লাগে, মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশন লাগে। মনের তুষ্টি ছাড়া তো লাগায়াও মজা নাই বলেন?’

 

‘লাগানো’ শব্দটা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসব কী ভাষায় কথা বলছেন! আমরা বন্ধুরা এসব শব্দ বলতাম ছাত্র অবস্থায়। কিন্তু এই দীর্ঘ বছরে আমার সামনে কেউ এ শব্দ উচ্চারণ করেনি। তবে এবারও তিনি আমাকে ভাবার সময় দিলেন না। ‘হা হা… আসলে একটু মুখ খুলে কথা না বললে ভালো লাগে না বুঝলেন?’

 

‘না না সমস্যা নেই। আসলে আপনার সঙ্গে সেভাবে কথা বলা হয় নাই তাই এমন মনে হচ্ছে।’
এরপর তিনি দ্বিতীয়বার মদ ঢাললেন গ্লাসে। ঘড়িতে তখনো আটটা বাজেনি। এ লোক কি আমার বউয়ের সামনেও এভাবে কথা বলে? আর বউ শুনে খিলখিল করে হাসে? কে জানে বলতেও পারে। দ্বিতীয় পেগে চুমুক দিলাম। মাথাটা হালকা লাগতে শুরু করল। লোকটা সিগারেট ধরিয়েছে, আমার দিকেও এগিয়ে দিল। তবে আমি সিগারেট খেলাম না। অস্বস্তি হচ্ছিল তাই।

 

‘এই করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আপনার কি মত বলুন তো? আমার মনে হচ্ছে কী জানেন, অনেক মানুষের মৃত্যু ছাড়া করোনায় বাড়তি কিছু ঘটবে না। আমাদের দেশে তো আরও না। সবাই হয়তো যার যার বিষয়ে সাবধান হবে। মানুষ হয়তো আরো স্বার্থপর হবে। মানে খারপটা আরো খারাপ হবে। ভালো কিছুও খারাপের দিকে ঝুঁকে যাবে। অনেকে অনেক কিছু বলছে, এই হবে সেই হবে। আসলে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মানুষ প্রকৃতই উদ্দেশ্যহীন প্রাণী । সে জানে না তাকে কী করতে হবে। সে ডিরেইলড। আদৌ যদি তার কোনো গন্তব্য থাকে তাহলে সেখানে কখনোই তার আর যাওয়া হবে না। আর মানুষের বেসিক সমস্যা হচ্ছে সে অ্যাডাপ্ট করে ফেলতে পারে সহজে। ফলে তার আসলে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল সে ভুলে যায়। নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে তো এক গবেষক বলেছেন, মানুষ আসলে ভিনগ্রহের প্রাণী। পৃথিবীতে এসে আটকা পড়েছে আর যেতে পারে নাই কোথাও। হা হা হা… একটা গল্প বলি আনপাকে, শুনুন। আমার পরিচিত এক লোক। সে একটা কুটির শিল্পটাইপ কারখানা শ্রমিক ছিল। তার চাকরি চলে গেল, কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কেউ তাকে চাকরি দিল না। চাকরি না পেয়ে সে কিছু জমিজমা ছিল বিক্রি করে দিল। তার তো আসলে চলতেই হবে ধরেন। মানুষের মন আর বাজার এ দুই হলো অনন্ত গহ্বর। এর কোনো শেষ নাই। লোকটা জমি বেচার টাকায় কিছু দিন চালিয়ে নিল। এরপর নিস্বঃ হয়ে গেলে সে টুকটাক ফুটফরমায়েস খাটতে লাগল। এভাবে সে রাজনৈতিক নেতার আশ্রয় পেল। তারপর তার কপাল খুলে গেল। সে এখন অনেক টাকার মালিক। সে বাড়ি করেছে। সেই বাড়িতে বাথটাব বানিয়েছে মায়ের জন্য। মা তো আর বাথটাব ইউজ করতে পারে না। তার শরীরে পানির চাপ লাগে। তারপরও বাথটাব হলো তাদের ঘরের অভিজাত্য। তার মা সেই বাথটাবকে এখন ড্রেন হিসেবে ইউজ করে। কাপড় ধোয়া ময়লা পানি অন্যান্য পানি এই বাথটাবে ঢেলে দেয়। আর সেগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়। এই যে লোকটার এতকিছুর মধ্য দিয়ে গেল সে সব ভাবেই কিন্তু সার্বাইভ করল। বিকল হয়ে গেল না। ব্যাপারটা ফিজিক্যাল না মেন্টাল?’

 

লোকটা তো ভালো বলে, ভাবলাম আমি। এ জন্য বোধহয় আমার বউ তাকে এত পছন্দ করে। কথা শুনতে মেয়েরা পছন্দ করে। এটা আমি জানি। জলি বলেছিল আমাকে। জলি আমার সামনে মেয়েদের অনেক বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছিল। এই লোকটাও বোধহয় এসব জানে। সে নিজেকে এভাবে প্রস্তুত করেছে। নিজেকে সব সময় কীভাবে মেয়েদের সামনে উপস্থাপন করবে এটাই বোধহয় তার সারাজীবনের প্রস্তুতি ছল। আমাদের মধ্যে শাহীন ছিল এরকম। সব সময় চুল আঁচড়ানো। নতুন জামাটামা পড়ে সেজেগুজে মেয়েদের সঙ্গে ঘুর ঘুর করাই ছিল তার কাজ। কখনো পাত্তা পেত, কখনো পেত না। সে এখন একটা ব্যাংকে চাকরি করে। আবার মেয়েদের পাত্তা না দিলেও কমলের পিছনে মেয়েরা ঘুরত। ছাত্রলীগ করত। খুব বোল্ড একটা ছেলে ছিল। কখনো খারাপ ব্যবহার করত না কারো সঙ্গে। সব জায়গায় তাকে দেখা যেত। বেশ কয়েকবার মারও খেয়েছিল ছাত্রদলের হাতে।

 

আমার ততক্ষণে তিন পেগ শেষ। আর খাব কি না ভাবছিলাম। অনেক দিন পর এর বেশি খাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। তারপরও রোকন সাহেব আরেক পেগ ঢাললেন। তিনি বেশ খেয়ে যাচ্ছেন। আমি হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। আমার চাকরি, বাজার এসব নিয়ে কথা বললাম তার সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ। ভদ্রলোকের বাড়ি উত্তরবঙ্গে। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে। বিয়েও হয়েছে ভালা জায়গায়। টাকাপয়সা আছে। ফ্ল্যাটটা শ্বশুর বাড়ির দেওয়া। যদিও বউয়ের নামে। নিজেই পটিয়েছেন বউ রিক্তাকে। কোনো একটা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে নাকি রিক্তার পেছন লেগেছিলেন রোকন সাহেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে কোনো বাবা কুণ্ঠা বোধ করেন না। বাবাদের কাছে মেয়েরা হচ্ছে গৃহপালিত। মেয়েটা পরের ঘরে গিয়ে গৃহপালনের উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তাদের আর কিছু লাগে না।

 

হাসনাত বলত, বিশ্ববিদ্যালয় হলো গৃহপালিত একটা ব্যাপার। এর শিক্ষকরা সেই গৃহপালিত খামারের স্থায়ী বাসিন্দা। তারা সরকারি টাকায় নির্দিষ্ট জায়গায় চরে বেড়ায়। এদের বাইরে যাওয়া মানা। আমরা তখন হাসতাম। নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও শিক্ষকদের নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারলে আমাদের ভালোলাগত। এমন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ত দু-চারজন ছিল যে যাকে দেখলে আমাদের মনে একটু রেসপেক্ট তৈরি হতো।

 

এখন এই যে আমি মদ খাচ্ছি যার সঙ্গে বসে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রোকনটাকে তো আমার সিনিক মনে হচ্ছে। শেষে তার সঙ্গে আমার প্রায় তর্ক বেধে গেল। আমি উত্তেজনার বসে পাঁচ পেগ মেরে দিলাম। তারপর সব আউট হয়ে গেল আমার মগজ থেকে। আমি বুঝে গেলাম এই লোক শিবির, এর বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। সে মদ খেতে খেতে সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু করল। শুরুটা হলো করোনায় ত্রাণ চুরির ঘটনা দিয়ে। এরপর ভোটের ঘটনা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সমালোচনা ছিলো আরো বেশি। সে বলতে চাইল আওয়ামী লীগ সব সময় এমনই রাজনৈতিক দল। তখনই আমার মেজাজ খারাপ হলো, আর আউট অব সেন্স হলাম। কীভাবে, রাত কয়টায় বাসায় ফিরলাম মনে করতে পারলাম না।

(চলবে)

পড়ুন ।। কিস্তি : ২

অন্যমনস্ক দিনগুলি ।। কিস্তি : ২

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here