লেখাটি লিখেছেন হিমেল বরকতের একজন শিক্ষার্থী — মনিরুল ইসলাম রুবেল; যিনি প্রাচ্যনাটে কাজ করেন, কাজ করেছেন বিবিসিতে। হিমেল ছিলেন তাঁর গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক।
পুরোনো কলাভবনের নিচতলায় তখন বাংলা বিভাগের ক্লাস হতো। যে ক্লাসরুম দুটিতে বসলে বাইরের লেক দেখা যেত সেরকম একটিতে ক্লাস হচ্ছে… কবিতার ক্লাস, চল্লিশের দশকের কবি সমর সেনের কবিতা নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছে, জানালার পাশের বেঞ্চে বসে আমি যদিও মুগ্ধ হয়ে শুনছি কিন্তু হঠাৎ করেই আনমনে চোখ চলে গেল লেকের পানিতে! আর শিক্ষকের চোখ এসে পড়লো আমার দিকে। তিনি ভাবলেন আমি তার আলোচনাকে অগ্রাহ্য করে উদাসীন হয়ে বসে আছি। তাই বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন আমাকে, নাম ধরে ডাকেননি নিশ্চয়ই, কারণ তাঁর সাথে সেটাই আমার মুখোমখি প্রথম সাক্ষাত। ফাঁকিবাজ ছাত্রের ওপর যেমন করে নাজিল হয় তেমন করেই আমার ওপর নির্দেশ এলো, আলোচনা থেকে কি বুঝলাম সেটা জানানোর।
আমি কিন্তু এর আগের ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলাম, তাই আজকের আলোচনার আগের অংশটুকুর আমি কিছুই জানতাম না।কিন্তু আজকের আলোচনা যতযটুকু আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এবং শুনতে শুনতে নির্দিষ্ট কবিতার বাইরেও সামনে থাকা বই থেকে সমর সেনের আরো দুই/তিনটি কবিতা পড়ে ফেলেছিলাম… সেইসব কবিতা ধরেই বেশ একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে দিলাম! আর পুরো সময়টা খুব মনোযোগ দিয়ে শিক্ষক শুনছিলেন… আমি লক্ষ করছিলাম তাঁর আপাত গম্ভীর মুখ আর চশমা পড়া চোখ দুটোর ফাঁক দিয়ে বেশ মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠেছে। আমার অপ্রয়োজনীয় পন্ডিতি বক্তৃতা শেষে তিনি চমৎকার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে নাম-ধাম জানলেন।
সেই আমার প্রথম পরিচয় হিমেল বরকত স্যারের সঙ্গে। যদিও জাহাঙ্গীরনগরের বাংলা বিভাগে ভর্তি হবার পর থেকেই শুনছিলাম, তিনি আসছেন… বিভাগের শিক্ষক হয়ে আসছেন প্রাক্তন মেধাবী শিক্ষার্থী-কবি হিমেল বরকত, যিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছোট ভাই। বিভাগে পা রাখার আগেই তিনি ছাত্রদের অন্তরে এক মিথিক্যাল চরিত্র হয়ে পায়চারি শুরু করে দিয়েছিলেন।
তাঁর ক্লাসে আমার মতো ফাঁকিবাজ ছাত্রও আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম আলোচনা শোনার জন্য, তাঁর কণ্ঠে কবিতা শোনার জন্য। ক্লাসে যে কবিতা পড়ানো হবে সেটি ক্লাসের শুরুতেই আবৃত্তি করা ছিল তাঁর রোজকার চর্চা! মনে আছে এখনো, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা কোর্সের অন্তর্ভুক্ত তাঁর দাদা রুদ্র’র কবিতা যেদিন পড়াচ্ছিলেন, সেদিন কবিতাটা পড়ার সময় তাঁর কণ্ঠ যে কি অদ্ভুত জাদুকরী শোনাচ্ছিল! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল কান্না তাঁর গলায় এসে আটকে যাচ্ছে! পড়া শেষ করে চশমা খুলে আলতো করে চোখ দুটো মুছলেন। আহা! এমন আবেগ নিয়ে মানুষ জন্মায়! আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম ক্রমশ…
ধীরে ধীরে সেই মুগ্ধতা আরো অনেক আকারে রূপ নিয়েছে। প্রিয় শিক্ষকদের একজনতো ছিলেনই, খুব আপন বড় ভাই হিসেবে একজন বন্ধুর স্থানও দিয়েছিলেন আমাকে! আহারে, সে যে কি গর্বের পরিচয় আমার জন্য! দেখা হলেই মিষ্টি হেসে খুব আন্তরিকভাবে প্রথমেই বলতেন, ‘কি অবস্থা’! ক্লাস রুমের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বাইরেও আলাদা এক সম্পর্ক গড়তে পারতেন তিনি। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে- একবার বিভাগ থেকে আমাদের ব্যাচের সব ছাত্র ছাত্রী মিলে ভাষা জরিপের কাজে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম রাতের ট্রেনে চড়ে।পুরো বগি জুড়ে সবাই মিলে হই-চই হচ্ছিল। আর দুই বগির মাঝখানে মধ্যরাতে শুরু করে প্রায় সারারাত হিমেল স্যারের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিয়েছি।রাতের অন্ধকারে হিমেল বাতাসে চলন্ত ট্রেনে একটার পর একটা সিগারেটের আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে- নানা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গ ঘুরে সেরাতেই বোধ করি দুজনের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের স্টেশনের দিকে যাত্রা করেছিল!
বিভাগে তাঁর রুমে বসে আড্ডা, করিডোরে অল্প সময়ে টুকটাক আলাপ করা, কাজে অকাজে ফোনে আলাপ এসব কিছু মিলিয়ে যে অদ্ভুত বন্ধুত্বের সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছিল তার পূর্ণ চেহারা পেল আমার স্নাতকোত্তর শ্রেণির অভিসন্দর্ভ বা থিসিসের কাজের সময়। বিভাগের আরো দুই প্রিয় শিক্ষক খালেদ হোসাইন আর সুমন সাজ্জাদের নির্দেশ ও অনুপ্রেরণায় এক রকম বাধ্য হলাম থিসিস করতে! নাটকের লোক হিসেবে তাঁরা দুজনেই আমাকে বাংলা সাহিত্যের স্বনামখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর ওপর কাজ করতে বললেন। আর সেই থিসিরের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন হিমেল বরকত! সেই সুযোগে আরো বাড়লো আড্ডা, ফোন আলাপ- বাড়লো বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা! আমি অবাক হয়ে লক্ষ করতে থাকলাম যে, তিনি কি যত্ন করে আমার লেখা প্রতিটি লাইন পড়েন! এমন কি, নিজ হাতে বাক্য ও বানানও সংশোধন করে দেন! সুন্দর হাতের লেখায় ছোট ছোট করে নোটস দেন, সাজেশন দেন।
আমার মনে হচ্ছিল, এত যত্ন করে তো আমি আমার নিজের থিসিস লেখাটাও লিখছি না মনে হয়! আর বারবার বলতেন ‘তোমার গদ্য লেখার ভঙ্গি খুব ভাল। তোমার কাজটা ভাল হবে। খুব দরকারি একটা কাজ হবে।’ আমার আত্ববিশ্বাস আর কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়তে লাগলো তাঁর এমন কথায়। আমি আসলে সেই সময়েই বুঝতে পারলাম যে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ দায়িত্বটি পালন করছেন। একজন ছাত্রের মাঝে উৎসাহ আর বিশ্বাস স্থাপন করে দিচ্ছেন। যখনই কাজটা নিয়ে ছোটখাটো ঝমেলায় পড়েছি তিনি পথ বাতলে দিয়েছেন। একজন শিক্ষকও যে একজন ছাত্র-ছাত্রীকে সম্মান করতে পারেন সেটা আমি তাকে দেখেই জেনেছি। এরকমভাবে সব ছাত্র-ছাত্রীকেই আসলে তিনি উষ্ণতায় ছায়া দিতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালবেসে মায়া দিয়ে তাদের আর্দ্র রাখার বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন হিমেল বরকত।
সেই থিসিসটি গত বছরের বই মেলায় বন্ধু রাহেল রাজিবের প্রকাশন সংস্থা নৈঋতা ক্যাফে থেকে প্রকাশ হলো বই আকারে। হিমেল স্যারকে মেসেঞ্জারে প্রচ্ছদের ছবি পাঠালে বেশ খুশি হলেন। অনেক কথা হলো লেখাটি নিয়ে এবং আরো অনেক বিষয়ে। আমি বললাম, ‘ক্যাম্পাসে গিয়ে নিজের হাতে আপনার হাতে তুলে দিব বইটা’। হাসলেন একচোট! আমি টের পেলাম সেই পুরোনো উষ্ণতা! আর সেই আর্দ্র করা মায়াময় হাসিটা যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপ হানা দিলে আর ক্যাম্পাসে যাওয়া হলো না। চলে গেলেন তিনি… বইটা তুলে দিতে পারলাম না। এ্ আক্ষেপ আমার আমৃত্যু থাকবে!
হিমেল বরকত স্যার নেই! আমার মতো আরো অনেক অনেক ছাত্রদের-বন্ধুদের জীবনে নানাভাবে ভালবাসার হিমেল পরশ ছড়িয়ে দেয়া হিমেল বরকতকে হিম করা লাশের গড়িতে দেখেও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যেন! চলে যাবার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে কথা হচ্ছিল। দুইটা গান লিখেছেন, একজন সুরও করেছেন। সেগুলো কেমন হয়েছে সেই মতামত জানাতে বললেন আমাকে! আমি বিব্রত হেসে বললাম, ‘আমি মতামত দিব!’ তিনি বললেন, ‘হ্যা, তোমার মতামত কাজে দিবে’। আমি আবার আর্দ্র হলাম! আবার টের পেলাম অধম ছাত্রকেও শ্রদ্ধা করার কি অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর! এরকম একই ঘটনা এ বছরেরে এপ্রিল-মে মাসের দিকেও হয়েছিল। লক ডাউনের মধ্যে। হঠাৎই ফোনে বললেন, তাঁর লেখা একটা নাটক মেইল করেছেন। সেটা পড়ে আমার মতামত দিতে হবে। কোনো জায়গায় কাজ করার সুযোগ থাকলে সেটা তাকে বলতে হবে! ‘ধরনি দ্বিধা হও আমি লুকাই’ টাইপের একটা অবস্থায় পড়লাম যেন! মহা বিব্রত হয়ে বললাম, ‘আপনি লিখেছেন সেটাতে আমি কি মতামত দিব! আমি কি এত বুঝি নাকি স্যার!’ তিনি সেই মায়াবী হাসি শুনিয়ে বললেন, ‘হ্যা, নাটকটা তুমি ভাল বুঝবে, তোমার মতামত খুব জরুরি!’
এই বিশাল দায়িত্বভার পেয়ে আমি সত্যিই ভারাক্রান্ত! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম ছোট আকারের নাটকটি। কিছু কিছু জায়গায় সাজেশন দিলাম খুব ভয়ে ভয়ে! ভাবলাম, পন্ডিতি দেখানোর সুযোগ তো নিলাম, আসলেই কি সেগুলো কোনো কাজে লাগবে স্যারের! আমাকে আবারো মুগ্ধ করে দিয়ে তিনি জানালেন যে, সাজেশনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি এরকম বিষয়গুলো নিয়েই একটু দ্বিধায় ছিলেন! তারপর দেখলাম তিনি প্রতিটি সাজেশনকে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে সেগুলো পরিবর্তনও করেছেন। আমাকে গর্ব করার সুযোগ দিলেন যেন তিনি! আবারো শিখলাম কি করে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হয়! আবারো শেখালেন কিভাবে একজন মানুষ বড় হন! কিভাবে একজন শিক্ষক মহত্বের ছায়া ফেলেন ছাত্রদের অন্তরে!
সেই ছায়া কিন্তু আজন্ম থাকবে হিমেল বরকত! আপনার মননের ও মেধার হিমেল হাওয়ায় আমাদের অন্তর উষ্ণতায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে, হৃদয় আর্দ্র করা মায়ায় বিলীন হয়ে আছে।
একজন অসাধারণ মানুষ ও শিক্ষকের অসাধারণ ছাত্র।
এমন মানুষ ও শিক্ষক আলো ছড়ান আপনমনে।
সব শিক্ষক যদি এমন হতেন !