এক ছিল মা বিড়াল,
নাম তার বিল্লু।
ছিল তার দুটি মেয়ে —
সাল্লু ও কাল্লু।
সাল্লুটা খুব সাদা
ধবধবে ফর্সা।
কাল্লু কালো খুব
কুচকুচে কালসা।
মা বিড়াল দু মেয়েকে
খুব ভালোবাসতো।
দূর থেকে এটা-ওটা
নিয়ে রোজ আসতো।
মজাদার সে খাবার
খেয়ে ওরা হাসতো।
তারপর ভরপেটে
হেলেদুলে নাচতো।
সাল্লুকে দেখে সব
পশুপাখি মুগ্ধ —
‘এতো সাদা! আহা মরি!’
হতো বাকরুদ্ধ।
হাঁস এসে সেই কথা
বিল্লুকে বলল।
খরগোশও একই সুরে
প্রশংসা করল।
এই সব দেখে-শুনে
কাল্লুটা দুঃখে
মা-র কোলে লুকালো যে
জল ভরা চোক্ষে।
মা-ও ঠিক বুঝে নিল
ছানাটার কষ্ট।
গায়ে-পিঠে স্নেহ দিয়ে
জানাল সে পষ্ট :
‘শোনো বাছা, তোমাকেও
হতে হবে এম্নি —
বাইরে না, ভেতরের
রং জ্বালো তেম্নি।
গা-র রং বেশিদিন
কারো মনে ধরে না।
শুভ কাজে ফোটে রং
সেই রং মরে না।’
এদিকে যে সাদা ছানা
রঙে-রূপে-গর্বে
মাতোয়ারা হয়ে রোজ
সাজে তিন পর্বে।
মেশে নাকো কারো সাথে
বেরোয় না বাইরে।
ধুলোবালি বিচ্ছিরি —
লাগে যদি গায় রে!
কাল্ল–টা মেশে ঠিকই
সকলের সঙ্গে।
নিজে থেকে কথা বলে,
খেলে নানা রঙ্গে।
আরো যায় মা-র সাথে
খাবারটা খুঁজতে।
কোথা মেলে মাছ, কাঁটা
ব্যাপারটা বুঝতে।
এই ভাবে ঘুরে-ঘুরে
খেলে-ধুলে শেষটাÑ
কাল্লুর গায়ে ধুলো,
ভিজে গেল লেজটা।
তা-ই দেখে সাদা ছানা
জুড়ে দিল হল্লা —
‘দুর দুর… সরে যাও,
গায়ে এতো ময়লা!
সাল্লুর কথা শুনে
মা যে হলো রুষ্ট।
ক্ষেপে গিয়ে বলল সে :
‘তুমি বড়ো দুষ্ট।
যেই বোন বয়ে আনে
তোমার-ই খাদ্য,
তাকে দূরে যেতে বলো —
কেমন অভদ্র!’
বোনের এ আচরণ
মনে খুব বিঁধলো।
সারারাত মা-র পাশে
কালো ছানা কাঁদলো।
এরপর ধীরে ধীরে
মাস ছয় পেরোলো
ছানারাও হলো তেজি,
লম্বায় বাড়লো।
হঠাৎ সে একদিন
ঝড় এলো রাত্রে।
গুমগুম গর্জনে
এলো মেঘ সাঁত্রে।
পাগলের মতো হাওয়া
জুড়ে দিল লম্ফ।
ডালে ডালে বাড়ি লাগে
যেন ভূমিকম্প।
কড়কড় আওয়াজে
চমকালো বজ্র —
পুড়ে গেল, ভেঙে গেল
গাছ সে অজস্র।
অবশেষে ভোর রাতে
হলো ঝড় শান্ত।
এরই মাঝে এতো ক্ষতি
হবে কেউ জানতো!
কতো গাছ পড়ে আছে
যেন মুখ থুবড়ে,
কতো পাখি ঘর-হারা
বাসা গেছে দুমড়ে।
পরদিন উঠে সব
দেখে এই দৃশ্য —
কাদা-জলে একাকার,
অচেনা সে বিশ্ব।
সাল্লুও বের হয়ে
ওঠে খুব আঁতকে!
দেখে এক হাঁস-ছানা
ডালে গেছে আটকে।
মা হাঁসটি দিশেহারা
ঠোঁট দিয়ে ঠেলছে,
ডাল তবু সরে না যে
এঁটে আরো যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে সেই খানে
আরো পশু জুটলো।
কেউ ঠেলে, কেউ টানে,
কেউ ডালে উঠলো।
সকলের শ্রম তবু
হলো শেষে ব্যর্থ।
এতো ব্যথা নিতে ছানা
পারছে না আর তো!
সাল্লুটা দূরে থেকে
দেখছিল কাণ্ড।
কাছে যাবে? ধুর ধুর —
নোংরা প্রচণ্ড!
এ সময় কাল্লুও
বের হলো বাইরে।
হৈচৈ শুনে সেথা
গেল এক দৌড়ে।
হাত দিয়ে, মুখ দিয়ে
ঠেলছে সে — হেইও!
চাপা পড়া ছানা যেন
বের করবেই ও।
প্রাণপণ চেষ্টায়
বহু ক্ষণ পর সে
চিৎকার দিল জোরে
কী ভীষণ হর্ষে!
সকলেই চেয়ে দেখে
ডাল গেছে উলটে।
মা হাঁসটি ছুটে গেল
ছানাটাকে তুলতে।
ফিরে পেয়ে প্রিয় ছানা
বুকে নিল জড়িয়ে।
কী যে সুখে মা-র চোখে
জল এলো গড়িয়ে।
এদিকে যে কাল্লুটা
কাদা-জলে চুপসে
হায় হায়, এ কী দশা
যেন কালো ভূত সে!
আঙুলের পাশ ফেটে
ঝরছে যে রক্ত!
নাকে-মুখে ধুলোবালি
সারা দেহ শ্রান্ত।
কিন্তু ও-দশা আর
কে যে বলো দেখছে!
সবে মিলে কাল্লুকে
ঘিরে ধরে নাচছে।
পশুপাখি মিলে সব
দিল ডাক — ‘হুররে!
আজ থেকে কাল্লু সে
আমাদের হিরো রে!’
চেঁচামেচি শুনে সেথা
এলো মা বিড়ালও।
সবে তাকে কাল্লুর
বীরত্ব শোনালো।
মা হাঁসটি ছুটে এসে
বলল আনন্দে :
‘তোমার এ কালো মেয়ে
সেরা নিঃসন্দে।
ছানাটিকে বাঁচালো সে —
কী যে সৌভাগ্য!
ওর কাছে চিরকাল
হলাম কৃতজ্ঞ।’
এই দিকে সাল্লুটা
দূরে বসে ভাবছে —
এ কী হলো! কেউ তাকে
দেখছে না আজ যে!
মা বিড়াল দু মেয়েকে
নিয়ে বাড়ি ফিরল।
কাল্লুর দেহ মুছে
দিতে দিতে বলল :
‘মনে পড়ে? একদিন
কেঁদেছিলে কষ্টে?
আজ দেখো কী সুনাম
ছড়িয়েছে রাষ্ট্রে।
রং নয়, রূপ নয়,
আসলে যে চেষ্টা —
ভালো কাজে মন দিলে
জয়ী হবে শেষটা।’
সাল্লুটা এই বার
লজ্জায় ভাসলো।
অনুতাপে কাল্লুর
গায়ে ঘেঁষে বসলো।