প্রাণের মানুষ হিমেল বরকতের (১৯৭৭-২০২০) ‘গানের মানুষ’ পরিচয়টা জানা ছিল না। জানা হল মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নেবার পর। আমি ক্ষুদ্র মানুষ। ভালবাসা ছাড়া আমার কোনো জোর নেই। আর আমরা সবাই জানি, ভালবাসা জগতের এক মরমিয়া সংগীতের নাম। যার কিছুই থাকে না, হৃদয়ে অন্তত ভালবাসাটা থাকে। এই জোর দিয়ে আর যাই হোক, মৃত্যু-নামক অপরাজেয় দৈত্যকে ঠেকানো যায় না। সেই দৈত্য আপনি আমি সবাইকে নেবে। হিমেল বরকতকে নিল বড্ড অসময়ে। সবার বুকের পাঁজর ভেঙে দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেন:
দুঃখেরে দেখেছি নিত্য
পাপেরে দেখেছি নানা ছলে
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি
জীবনের স্রোতে পলে পলে।
মৃত্যু করে লুকোচুরি
সমস্ত পৃথিবী জুড়ি
ভেসে যায় তারা সরে যায়
জীবনেরে করে যায়
ক্ষণিক বিদ্রূপ।
আজ দেখো অভ্রভেদী তাহাদের বিরাট স্বরূপ
তার পরে দাঁড়াও সম্মুখে
বলো অকম্পিত বুকে
তোরে আমি নাহি করি ভয়
এ সংসারে প্রতিদিন তোরে করিয়াছি জয়। (বলাকা)
হিমেল তো নিঃসন্দেহে সেই দৈত্যকে জয় করে গেলেন। মৃত্যু ওঁর প্রাণটাই কেবল নিয়েছে। হাসপাতালবাসী হতেই আমরা টের পেয়েছি ওঁর শৌর্য। মৃত্যুর করাল ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে যাওয়া যে হিমেলকে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা অভাবনীয়। তাঁর এই রূপ কি কারো জানা ছিল? মাত্র ৪২ বছরের জীবনে হিমেল যে পৌঁছে গেছে মানুষের ভালবাসা-মন্দিরের গোপন দরোজায়, কজনের ললাটে জোটে এমন জয়তিলক! প্রশ্ন জাগে, প্রবল জীবনবাদী হিমেল কি সেই মহাজাগতিক যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন? ‘গানের ঝরাপাতা’র দ্বিতীয় গানেই কি ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে উঠল না?
দাদু, বাবা আর ছোট ছেলেটি
সকলে মিলেই খুঁজছে ছুটি-
কোথায় ছুটি? কোথায় ছুটি?
কোথায় ছুটি! কোথায় ছুটি!
হিমেলের ছুটি হয়েছে। কিন্তু তারও আগে, প্রথম গান ‘ঝরাপাতা শোনো’-য় কী বললেন হিমেল:
ঝরাপাতা শোনো,
শুনে রাখো প্রিয় ধুলো
আর একটু বাতাস পেলেই
ওড়াবো আমি ওড়াবো
এই ডানা-ভাঙা দিনগুলো।
কবিতা বা শিল্প মানুষের গোপন আত্মার নীরব কথোপকথন। লালন ফকির যে খাঁচার রূপকে মানবদেহ আর পাখির রূপকে আত্মাকে চিহ্নিত করেছেন, ওখানে আত্মার শক্তির ব্যাপারটা তো স্পষ্ট। আমরা যাকে আধ্যাত্মিকতা বলি, তা তো মানুষের চেতন-অবচেতন-ভূত-ভবিষ্যত কিংবা আড়ালের রহস্যাবৃত সত্তার রসায়নকে ঘিরে। আত্মার তো তার খবর জানবার কথা। আত্মার অংশগ্রহণ ছাড়া কি কবিতা হয়? আত্মার ঘনীভূত নিমগ্নতা ব্যতীত কি শিল্পসৃষ্টি হতে পারে? হিমেলের আত্মা কি পাতা ঝরে যাবার নীরব যাত্রার কথকতাই তৈরি করে গেল?
পাঁজরে ফুটেছে হৃদয়ের ঘ্রাণ-
তারই রং আজ পেখম মেলেছে
ছোট ছোট ঘাসফুলে।
আর একটু বাতাস পেলে…
হৃৎপিণ্ডে সেই বাতাসেরই পাল তুলে অনন্ত যাত্রায় শামিল হয়ে গেলেন হিমেল বরকত।
হিমেল বরকত বাতাসের বেগে ঝরাপাতার গান হয়ে মিলিয়ে গেলেন। তাঁর মরমি আত্মা সহজ মানুষের সহজ সৌন্দর্যে বিচরণ করে গেছে, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। একজন স্নিগ্ধ মানুষের রুচিশীল জীবনসত্য। কিন্তু বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর আত্মসর্বস্ব জীবন হিমেল যাপন করেননি। ভেতরটা বারুদে ঠাসা এক আপাত শান্ত ব্যক্তিত্বের আড়ালে মানুষ-সমাজ ও ন্যায়ের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকার ছিল আগাগোড়া স্থিত-প্রাজ্ঞ ও কঠোর। নিজের বিবেক ও কর্তব্যের টানে তিনি পরাঙ্মুখ হননি কখনো। পরিপার্শ্বের দুর্নীতি-অনিয়ম, মানবতার লঙ্ঘন, জীবন ও পরিবেশের ক্ষতির বিষয়ে হিমেল বরাবর প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর শান্ত-স্নিগ্ধ-নিরহঙ্কার ব্যক্তিত্বের ভেতরের বাঘটা এসব হটকারিতার পরিপ্রেক্ষিতে হুঙ্কার ছাড়তে দেখেছি, যেখানে যে ভূমিকায় প্রয়োজন। সশরীরে মাঠে নেমেছেন। কবিতা ও গানে করেছেন সংক্ষুব্ধ মনের প্রকাশ। এমন অনেক গান আছে তাঁর গীতিসংকলন গানের ঝরাপাতায়।
হিমেল সুন্দরবনের সন্তান। বাদাবনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। গোলপাতা, সুন্দরীগাছের বিস্তার, শাসমূলীয় উদ্ভিদের জলজ জীবনাখ্যান, মৌয়াল আর মৌমাছির বিপরীতমুখি জীবনবোধ আর সর্বোপরি ডোরাকাটা বাঘের হিংস্রতায় সংরক্ত নোনাজলের কাব্য হিমেল বরকত। সুন্দরবন তাই তাঁর জন্মসূত্রের অনপনেয় প্লাটফরম। তার পরিবেশের ঝুঁকি তাই হিমেলের নিজের ও মায়ের চোখের সম্ভাব্য বিপদ-অশ্রু, সশঙ্ক প্রতিবাদ:
গাছের তো চোখ নেই–অশ্রু দেখি না,
বাঘ আর বানরের ভাষাও বুঝি না।
হরিণ, কুমির, সাপ, পাখি, মৌমাছি
নিশ্চুপ হয়ে আছে ব্যাকুল ব্যথায়-
যায় যায় যায় যায় সুন্দরবন হায়
দেশের ও রাজনীতির অন্যসব সঙ্কটের মতো সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনেও হিমেল সম্মুখসারির যোদ্ধা। সেই হিমেল ঝরাপাতার গান গাইতে গাইতেই ঘুমিয়ে গেলেন সুন্দরবনের নোনামাটিতে। তাঁর জন্য এই ক্ষুদ্রের ভালবাসার শক্তি সজীব থাকুক চিরকাল।