‘আমাদের’ অর্থাৎ ‘দেশ’ বলে যাকে চিহ্নিত করি সেই দেশের মানুষদের সাহিত্য বলতে আমরা কোন সাহিত্যকে বুঝি? কিংবা সংস্কৃতি বলতে? উত্তরটা খুব সহজ। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিকে। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিই হয়ে ওঠে ‘আমাদের সংস্কৃতি’। ‘দেশ’ ধারণার জন্য ‘জাতীয়তাবাদ’ অপরিহার্য উপকরণ। সেই জাতীয়তাবাদের সূত্র ধরে আসে জাত্যাভিমান, শ্রেষ্ঠত্বের গরিমা। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে আমাদের প্রথমত ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র কথাই মনে আসে। বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে বুঝি বাংলা সাহিত্যকেই।
কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? বাস্তবিকই কি ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠা মানচিত্রটি কেবল বাংলা এবং বাঙালির একক সত্তার কথাই বলে? দীর্ঘ অভ্যস্ততায় হয়ত আমার মনে হবে, সেটাই তো সত্যি, এর আবার ব্যতিক্রম কী! প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা এবং আত্মসর্বস্ব মনোভাব থেকে এই ভূ-খণ্ডের ভিন্ন ভাষাধারী, ভিন্নরকম মুখের আদলসম্পন্ন মানুষগুলোকে ‘অন্যকেউ’ বলেই ভাবি আমরা। তাদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বড়োজোর এইটুকু যে, তারা চাকমা। ভাবি, ‘ওরা’ ‘আমাদের’ দেশে বসতি গড়েছে এবং ‘আমরা’ই দয়া পরবশ হয়ে ‘ওদের’কে থাকতে দিয়েছি। একই ঘরের অন্যস্বর যারা সেই তাদের যে আলাদা মুখের ভাষা আছে, মনোবেদনা আছে, গান আছে, কবিতা আছে সেই সন্ধান জানা তো বহু দূরের বিষয়
হিমেল বরকত প্রথাগত চিন্তাগণ্ডির বাইরে, এরকম দূরের বিষয়ের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। সৃষ্টিশীল, কর্মোদ্যমী এই মানুষটি ছিলেন বিবিধ-বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী । তিনি আদিবাসী সাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন রামায়ন নিয়ে, তৃতীয় লিঙ্গ এবং সুন্দরবন নিয়ে কাজ করার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন। সম্প্রতি কাজ করছিলেন শিশুসাহিত্য নিয়ে। তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম এবং সাধনাকে মিলিয়ে দেখলে ব্যক্তি তাঁকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়- খ্যাতি তাঁর কর্ম কিংবা সৃষ্টির অভীষ্ট ছিল না, তিনি মানুষ এবং মঙ্গলের নিমিত্তে নিজের মেধা এবং সক্ষমতাকে নিবেদন করতে চেয়েছেন। এজন্যই হয়ত সম্পাদিত-কর্ম কিংবা গবেষণা-কর্মের তুলনায় তাঁর প্রকাশিত সৃষ্টিকর্ম সামান্য।
চিন্তায়-কর্মে এবং প্রকাশে অভিন্ন মানুষটির নামই হিমেল বরকত। যা বিশ্বাস করেন তাকেই কর্মে রূপান্তর করেছেনে, শব্দরূপ দিয়েছেন। স্বার্থপরতা, ক্ষমতা লোলুপতা, অমানবিকতার বিরোধীপক্ষ তিনি। তিনি শিশুদেরকে মানবিকতার গল্প শোনাতে শুরু করেছিলেন। তিনি সুন্দরবনের গল্প শোনাতে চেয়েছেন শিশুদের। শুদ্ধ পৃথিবীর জন্য চাই প্রকৃতি এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতি, প্রয়োজন প্রকৃত মানবিক সম্পৃক্ততা- এই অনুভবটা তিনি শিশুদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে-যাত্রা তাঁর অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত পড়ে রইল।
যে তিনি মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য, শিশুদের জন্য ভেবেছেন সে-ই তিনিই আদিবাসীদের কথা ভেবেছেন। সংখ্যাগুরুর জ্ঞানের আওতার বাইরে যে আদিবাসী সাহিত্য তাকে তিনি মমতাভরে কুড়িয়ে এনেছেন। দুই মলাটে ঠাঁই দিয়ে প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ গ্রন্থ নামে। তেইশটি ভাষাভাষীর কবিদের কবিতাকে সংকলিত করেছেন এ-গ্রন্থে। এমন নয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার আলাদা বর্ণমালা বা লিখিত রূপ আছে কিংবা নিজের ভাষাতেই চর্চা করেন করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সাহিত্যচর্চার মাধ্যম বাংলা ভাষা। কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে তাদের অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা এবং প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সপ্রাণ হিমেল বরকতের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল বঞ্চিতের সমান্তরালে, নীপিড়িতের পক্ষে। মিতবাক অথচ দৃঢ়, নীরব কিন্তু প্রগাঢ় অনুভূতির মানুষটিকে বঞ্চিত মানুষেরা আপনার বলেই জেনেছে জীবনভর।
এ-কারণে আদিবাসীদের কবিতা নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থটি নিছক গ্রন্থ মাত্র নয়। এর অন্যতর ভাষা আছে। অন্যতর বক্তব্য আছে। বইটি প্রশ্ন করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে, প্রশ্ন করে জাতীয়তাবাদের একরৈখিক ধারণাকে। আদিবাসীরাও তাঁর কাছে বঞ্চিতদের দলভুক্ত। তাই তিনি আসলে এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন বঞ্চিতের কণ্ঠকে বৃহত্তর ময়দানে ছড়িয়ে দিতে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে অনুভব করতে পারলে তাঁর সেই অবস্থানটি সুস্পষ্ট হয় পাঠকের কাছেও। কবিতা শুধু প্রেম-প্রকৃতি-আনন্দ কিংবা সুদিনের কথা বলে না। সংকট-দ্বিধা-বৈষম্য-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার ইতিবৃত্তও গচ্ছিত থাকে কবিতার হাড়বাকড় জুড়ে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই একটা কবিতা হয়ে ওঠে একজন মানুষের পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ান। যেমন মান্দি (গারো) কবি জেমস জর্নেশ চিরান লিখেছেন :
একদা অরণ্যে আমার জন্ম ছিল
জন্মদোষে দিয়েছিলে উপসর্গ উপঃ
মনের রাজ্যে আমারো হাজার বৃক্ষ ছিল
তুমি এলে, ধ্বংস হলো তপোবন তপঃ।
চাক কবি ওয়াং চিং চাক লিখেছেন:
সাংগ্রাইং তুমি আসবে বলে
সকলের মনে রঙ লাগে, সাথে নতুনত্ব কিছু
খুশির দোলা লাগে মনে
সকলে মিলেমিশে উৎসব করবে বলে।
সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর মধ্যকার হিসেবটা সহজ নয়। সেই জটিল সমীকরণের সুরঙ্গ দিয়ে বৈষম্য-অবজ্ঞা আর আধিপত্যের মতো জাগতিক প্রকরণ। পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্ত বাঙালি বাংলাদেশ জন্মের প্রারম্ভ থেকে বাঙালিত্বকে গ্রহণ করেছে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তার অহমের কেন্দ্র হিসেবে। আর এই জাতীয়তা বোধের সূত্র ধরে ছিটকে পড়েছে অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রশ্ন, খর্বিত হয়েছে তাদের অধিকার, অবহেলিত হয়েছে তাদের সংস্কৃতি, তাদের অস্তিত্ব। কখনো উন্নয়নের নাম করে, কখনো সংরক্ষণের নাম করে, কখনো অভিবাসন প্রক্রিয়ার জের ধরে, কখানো নেহায়েৎ অধিপতি জাতির ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা হয়েছে অপরাপর জাতিসমূহ। পৃথক পৃথক ভাষাভাষীর পৃথক পৃথক কবিদের কবিতা কোনো না কোনোভাবে একটা দীর্ঘশ্বাসকে ধারণ করে। যেমন, জাতিগত বঞ্চনার সমস্ত যন্ত্রণা উগড়ে দিয়ে কবিতা চাকমা লিখেছেন:
জ্বলি না’ উধিম কিত্তেই!
যিয়ান পরানে কয় সিনে গরিবে-
বযত্তান বানেবে বিরানভূমি
গাভুর বেলরে সাঝ
সরষ মিলেরে ভাচ
বা,
জ্বলে উঠব না কেন!
যা ইচ্ছে তাই করবে-
বসত বিরানভূমি
নিবিড় অরণ্য মরুভূমি,
সকালকে সন্ধ্যা
ফলবতীকে বন্ধ্যা।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। কিন্তু কতটা জানি বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষা আন্দোলনের কথা। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ মণিপুরী তরুণী সুদেষ্ণা সিংহ ভাষার জন্য প্রাণ দেন। তাঁকে নিয়ে মনিপুরী কবি শুভাশিস সিনহা লিখেছেন :
সেইদিন সুদেষ্ণার সবকিছু ভাষা
লাহিঙের পাড়ে
ইনিাফি র রঙে
চোখের আগুনপ্রায়া তারায় তারায়
পেশীর নাচনে
বেদিশা রক্তের স্রোতে
ভাষা যেন ছড়িয়ে পড়ল
[…]
যখন বিঁধল গুলি
রক্তের কণিকাগুলো হল যেন
চন্দনতিলক
মূর্তিমান, জীবন্ত সে ভাষার কপালে
মারা দেহ থেকে জন্ম নিল
জীবনের ভাষা!
লাহিঙ: মনিপুরী মেয়েদের পা থেকে কোমর পর্যন্ত পরিধেয় বস্ত্রবিশেষ
ইনাফি: মনিপুরী মেয়েদের বিশেষ কারুকার্যময় বিশেষ ওড়না
‘আমাদেরর সাহিত্য মানে শুধু বাংলা সাহিত্য’- এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ বইটি। এ বইতে বাংলাদেশের বাংলাভিন্ন অন্য ভাষাভাষী কবিদের কবিতাচর্চার ধারা এবং নমুনাকে তুলে এনেছেন সম্পাদক এবং সংগ্রাহক হিমেল বরকত। আর তাই এ-দেশের সাহিত্য, সাহিত্যের নাড়ী, শিরা-উপশিরা, উত্তাপ উপলব্ধির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ। বিচ্ছিন্নভাবে একটা গ্রন্থ দিয়ে তাঁকে বিচার করা যায় না। তাঁর ভানহীন, অখণ্ড শুভ চৈতন্যকে ধারণ করে আছে তাঁর সামগ্রিক কর্ম এবং কর্মপ্রচেষ্টা- সেই সব মিলেই তিনি হয়ে ওঠেন এক অখণ্ড দলিলের প্রণেতা।
হিমেল বরকত প্রয়োজনীয় ছিলেন এই আত্মস্বার্থমগ্ন পৃথিবীর জন্য। তাঁর যাত্রা স্তব্ধ হলো- তবু তিনি যা দিয়ে গেলেন তা দুর্মূল্য। তিনি বীজ বুনে দিয়ে গেলেন, হয়ত সেখান থেকেই জন্ম নেবে কোনো কিংবা অগণিত মহীরুহ। তিনি বেঁচে রইলেন, বেঁচে থাকবেন।