সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গবেষক হিমেল বরকত (২২ নভেম্বর ২০২০)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাহত বাংলাদেশ। তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী প্রবল ‘উপস্থিতি’ প্রমাণ করে মানুষের কতোটা গভীর জুড়ে ব্যাপ্ত ছিলেন তিনি।
১৯৭৭ সালের ২৭ জুলাইয়ে হিমেল বরকত জন্মেছেন বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠেখালি গ্রামে। পড়ালেখা করেছেন মোংলার সেন্ট পলস হাই স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাবী শিক্ষার্থী হিমেল বরকত শিক্ষাজীবন শেষে যোগ দেন ঢাকা সিটি কলেজে, পরবর্তী কালে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
কবিতাকে মর্ম ও অস্তিত্বে ধারণ করে হিমেল প্রবেশ করেছিলেন সাহিত্যে। পড়েছিলেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে। মৌলিক সাহিত্য ও গবেষণা দুটিতেই সমানভাবে নিজের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণামূলক রচনা, সম্পাদনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টিশীল চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০০১ সালে স্নাতকোত্তর পর্বে পড়ার সময় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চোখে ও চৌদিকে। ২০১২ সালে ‘‘বাংলাদেশের কবিতায় উত্তর-ঔপনিবেশিক কণ্ঠস্বর’’ শীর্ষক গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সতত নিমগ্ন ছিলেন কবিতা, গান ও গবেষণায়। যুক্তিনিষ্ঠ গবেষণায় তাঁর আগ্রহ ছিল কবিতা বা গানের মতোই। আর তাই হিমেল ছুটেছিলেন সমান্তরাল দুটি পথে। শেষ দিকে ঝুঁকেছিলেন কিশোর-উপযোগী সাহিত্য রচনায়; কিশোর-কিশোরীদের জন্য লিখেছেন কবিতা, গল্প ও নাটক। সাহিত্য ও লেখালেখিকে করে তুলেছিলেন জীবন যাপনের অংশ।
তাঁর প্রকাশিত বইয়ের তালিকা ছোট নয়। কবিতা : চোখে ও চৌদিকে (২০০১), বৈশ্যবিদ্যালয় (২০১৩), দশমাতৃক দৃশ্যাবলি (২০১৪); প্রবন্ধ : সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু (২০১৩), প্রান্তস্বর : ব্রাত্যভাবনা (২০১৭) সম্পাদিত বই : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলি (২০০৫), কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতাসমগ্র (২০০৫), চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ (২০১২), বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ (২০১৩), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ (২০১৫) প্রভৃতি। এক সময় সম্পাদনা করেছিলেন হৃদ্যরৌদ্র নামের একটি সাহিত্যপত্রিকা।
বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, কবিতা ও গবেষণা-মনস্ক এই মানুষটি গত কয়েকটি মাস মগ্ন ছিলেন শিশু-কিশোরদের উপযোগী সাহিত্য নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ভুল স্কুল নামে। শেল সিলভারস্টাইনের ‘গিভিং ট্রি’ গল্পটিকে ছড়ায় রূপান্তরিত করে নাম দিয়েছিলেন গাছের মমতা। সাল্লু ও কাল্লু নামে লিখেছিলেন দীর্ঘ একটি ছড়ার বই। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো কিশোরদের জন্য লিখেছিলেন ছন্দ শেখার হাতেখড়ি নামে বই। পাণ্ডুলিপিগুলো থেকে একটি বইও প্রকাশিত হয় নি। লেখাগুলো পাঠ করে মনে হয়েছে শিশুকিশোরদের জন্য তিনি তৈরি করছিলেন অসাধারণ ভুবন।
হিমেল বরকতের সকল ধরনের কাজে ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। জীবনকে তিনি দেখতেন প্রধানত ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর পড়েছে তাঁর সকল লেখালেখিতে। বৈষম্যহীন সমাজ ও সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। প্রান্তিকীকৃত জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর দরদ। সে কারণে মৌলিক রচনার পাশাপাশি গবেষণাকর্মেও এ ধরনের বিষয়বস্তু গ্রহণ করেছিলেন।
আমাদের কালের স্মরণীয় দুর্ভাগ্য এই যে, অত্যন্ত অসময়ে সকলকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল পরিসরে এবং বিদ্যায়তনিক জগতে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হলো। তাঁর মতো ইতিবাচক ও কল্যাণকামী মানুষ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। দেশের সৃষ্টিশীল ও বৈপ্লবিক রূপান্তরে, ইতিবাচক ও জনগণকল্যাণমুখী ভাবনার গঠনে তাঁর ভূমিকা অবশ্য-বিবেচ্য।
আমরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি তাঁকে। সহজিয়ার এ আয়োজনে থাকছে হিমেল বরকতের সাহিত্য ও গবেষণার মূল্যায়ন, স্মৃতিচারণমূলক রচনা; পাশাপাশি হিমেল বরকতের কিছু অগ্রন্থিত লেখাও সংযোজিত হলো। উল্লেখ্য যে, সহজিয়ার পক্ষ থেকে হিমেল বরকতকে ধারাবাহিক গদ্য লেখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল; তিনি সম্মতও হয়েছিলেন, লিখতে চেয়েছিলেন কবিতার ছন্দ ও অলংকার বিষয়ক গদ্য। সে সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। তাঁর ইচ্ছে ছিল সহজিয়ায় যেন কিশোর সাহিত্যের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। আমরা বলেছিলাম, বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনায় আছে। হিমেল বরকতের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি কিশোর সাহিত্যের জন্য আলাদা ক্যাটাগরি — যার সূচনা হবে হিমেল বরকতের লেখা দিয়েই।
শুভকামনা