মূলত কবি হলেও হিমেল বরকত গবেষণা, সম্পাদনা ও সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রেও অসম্ভব আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ। বাংলাদেশের অবহেলিত ও অনালোচিত সাহিত্য সম্পদের পুনরুজ্জীবনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ। প্রান্তস্বর: ব্রাত্যভাবনা গ্রন্থে ‘ক্ষমতার মোহন মন্ত্রবলে বিন্দুতুল্য কেন্দ্রের সুবিস্তৃত প্রান্তের নিয়ন্ত্রক’ হয়ে ওঠার চিত্র ফুটে উঠেছে। ভাট কবিতা, হাটুরে কবিতা, লম্বা কিস্যা, পুথি কবিতা প্রভৃতি বিলুপ্তপ্রায় সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণা-গ্রন্থ পথ-কবিতার বিলুপ্ত ভুবন প্রকাশের পথে।
হিমেল বরকতের গবেষণাকর্মে তুমুল কেন্দ্রের চাপে প্রান্ত হয়ে ওঠা সাহিত্য ও সাহিত্যিকগণ প্রাধান্য পেয়েছেন — এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এক্ষেত্রে সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু গ্রন্থটিকে কিছুটা দলছুট মনে হলেও তাঁর প্রাতিস্বিক ভাবনায় সমৃদ্ধ। তিরিশের দশকের প্রভাবশালী এ কবি নানামুখী সাহিত্যস্রোতের উদ্গাতা। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রেও তিনি নির্মাণ করেছেন নতুন স্বর ও শৈলী। হিমেল বরকত মোহনীয় ভাষা ও নিবিড় পর্যালোচনায় উন্মোচন করেছেন বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক সত্তার নতুন দিগন্ত।
সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু গ্রন্থটি চারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত; প্রথম পরিচ্ছেদে আছে ‘বুদ্ধদেব বসুর মানসগঠন ও শিল্পদৃষ্টির স্বরূপ’, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে ‘সমালোচক বুদ্ধদেব বসু: সাহিত্যবিচারে মতাদর্শ ও পদ্ধতি’, তৃতীয় পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু ‘বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যবিচার: বিষয় ও মূল্যায়ন’, চতুর্থ পরিচ্ছেদে বিশ্লেষিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য-সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসুর গদ্যশৈলী। সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর সামগ্রিক মূল্যায়ন এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
বুদ্ধদেব বসুকে সাধারণত ‘আবেগপ্রবণ’ সাহিত্য সমালোচক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। এ খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে হিমেল বরকত বুদ্ধদেবকে দাঁড় করান তত্ত্ব ও তথ্যের ভারসাম্যময় এক রসগ্রাহী সাহিত্য-সমালোচকের অভিধায়। লেখকের ভাষায়, ‘বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক -মানস গড়ে উঠেছে অনুশীলিত রসজ্ঞান ও পরিশ্রমী ব্যক্তিত্বের সহযোগে; যেখানে দেশজভিত্তির মর্মজ্ঞানের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে পাশ্চাত্য শিল্পসাহিত্যের চর্চা ও রুচিবোধ। সেই সঙ্গে বিশ শতকের আধুনিক জীবনবেদ, সমকালীন পৃথিবীব্যাপ্ত সামাজিক ক্ষয়, মূল্যবোধের ক্রমাবনতি এবং যুগজ্বর-সম্ভূত ব্যক্তিক সংকট তাঁর শিল্পদর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।’ এ মূল্যায়নে বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক সত্তার মৌল প্রবণতা প্রতিফলিত হয়েছে।
আলোচ্য গ্রন্থে লেখক দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু মূলত তিনটি সাহিত্য-বিচার পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন : ক. ইমপ্রেশনিস্টিক সমালোচনা, খ. তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতি, গ. রূপগত বিচার-পদ্ধতি। ইমপ্রেশনিস্টিক সমালোচনা বা বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘বিম্বধর্মী সমালোচনা’ মূলত উপভোগ-নির্ভর সাহিত্যবিচার। বুদ্ধদেব এ ধারার সমালোচনায় সর্বাধিক সক্রিয় ছিলেন। সমালোচনায় বুদ্ধদেবের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে গিয়ে লেখক বলেন সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, তিনি কোনো মতবাদ বা theory-কে তাঁর আস্বাদন-নির্ভর সমালোচনায় প্রাধান্য দেননি। সমালোচ্য রচনা তাঁর কাছে একটি নতুন আবিষ্কার। তাঁর সুবিস্তৃত সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতাকে আলোচ্য রচনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সেই সৃষ্টিকর্মের অভিঘাত তিনি নিজের মধ্যে সংক্রমিত হতে দেন, এরপর অর্জিত অভিজ্ঞতাকে বিস্তারিত করেন সমালোচনায় এবং নিজস্ব উপভোগের আনন্দকে তিনি পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করেন।’
সমালোচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর উদার দৃষ্টিভঙ্গির দিকটিও হিমেল বরকত তুলে ধরেছেন গুরুত্ব সহকারে। মতাদর্শিক বিরোধ তাঁর সমালোচক সত্তায় কোনো প্রভাব ফেলেনি। মার্ক্সবাদী সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতালোচনায়ও তাঁর স্বভাবসুলভ মুগ্ধতাবোধ লক্ষযোগ্য।
তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য সমালোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের সূচনালগ্নে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে প্রাণ পাওয়া এ সমালোচনা পদ্ধতি বুদ্ধদেব বসুর দক্ষতায় ব্যাপকতা লাভ করে। লেখকের ভাষায়, ‘তুলনামূলক সমালোচনার মাধ্যমে সমালোচকের পাণ্ডিত্য প্রকাশের ও সমালোচনাকে রসগ্রাহী করে তোলার সুযোগ বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনার বিরোধী বুদ্ধদেব বসু দ্বিতীয় পথটিই গ্রহণ করেছেন। তাই দুরূহ তত্ত্ব ও গুরুগম্ভীর বিষয়ও তাঁর অন্তরঙ্গ গদ্যের স্পর্শে মননশীলতার পাশাপাশি রসোপভোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে।’ সাহিত্য-সমালোচনার মতো একটি নীরস বিষয়কে সাহিত্য পদবাচ্য ও উপভোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর অবদানের দিকটি এ বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রূপগত বিচার-পদ্ধতিকে বুদ্ধদেব বসু যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও এটিকে সাহিত্য বিচারের পরিপূর্ণ মানদণ্ড বলে মনে করেননি। রূপবাদী সমালোচকদের শিল্প-সাহিত্যের আধার বা ফর্মের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘আধার ও আধেয়ের সামঞ্জস্য নিরূপণই পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য বিচারের শর্ত’ বলে তিনি রায় দিয়েছেন। হিমেল বরকত আলোচ্য গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসুর এ সমগ্রতাস্পর্শী দৃষ্টিভঙ্গির দিকটি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
মূলত ভালো লাগা, মন্দ লাগা দিয়ে বুদ্ধদেব বসু সাহিত্য-সমালোচনায় সক্রিয় ছিলেন। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের সীমাকে বহুদূর প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তাঁর একক অবদান অনস্বীকার্য । হিমেল বরকত নিবিষ্ট গবেষকের পাণ্ডিত্য এবং হৃদয়স্পর্শী ভাষাভঙ্গিতে বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক সত্তার অভিনব রূপ আবিষ্কার করেছেন। সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুকে নিবিড়ভাবে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে আলোচ্য গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে — এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায।