২০০১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল হিমেল বরকতের চোখে ও চৌদিকে কাব্যগ্রন্থটি; ২০০২-এর মার্চ মাসে অমিত কুমার লেখেন এই বইয়ের প্রথম মূল্যায়নমূলক রচনা। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত অথই পত্রিকায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় অমিত কুমার নিজেও প্রয়াত হয়েছেন।
চোখে ও চৌদিকে হিমেল বরকতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ; এতে তিনি সংকলন করেছেন ২১ থেকে ২৪ বছর বয়সে রচিত কিছু কবিতা। যদিও বয়স অল্প, কাব্যগ্রন্থটিতে হিমেল ধরা দেন সাধারণত সমাজস্থিত হিসেবে, ফ্রয়েডীয় পরিভাষায় reality principle দ্বারা চালিত, ফলে তেমন রোমান্টিক নন, যদিও উন্নততর সময় তাঁর কাম্য। স্বভাবের এক ধরনের সুস্থিতি কবিতাগুলো জুড়ে রয়েছে, এবং সেখান থেকেই তিনি প্রেমে জড়িত, নিজস্ব বিশেষ অনুভব-উপলব্ধিতে মগ্ন এবং সমাজ ও রাজনীতির অপ্রত্যাশিত দিকের প্রতি বিদ্রূপ-মুখর, সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ, এবং সেই উদ্বুদ্ধতার চাপে হঠাৎ উপদেশ পরায়ণও।
সংবেদনশীলতার কোনো বিশেষ অঞ্চল কর্ষণ করে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলেন নি তিনি; কোনো বিশেষ বিষয়ে অবসেশন কাজ করে নি, যদিও কবিতায় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছেন, ফলে কাব্যগ্রন্থটির একটি বড় অংশ আরর্তিত হয়েছে এ-বিষয়টিকে কেন্দ্র করে; তাঁর আকর্ষণ বিচিত্রমুখী; এই বৈচিত্র্য বিন্যস্ত হয়েছে ‘আয়নায় জলে মুখর জলেরা’, ‘হৃৎপংক্তির ঘুড়ি’, ‘কুড়িয়ে পাওয়া পদ্য’, ‘হে দাহ হে দৈর্ঘ্য’ নামের চারটি অংশে।
শুধু চোখে ও চৌদিকে নামের জন্য নয়, কবিতাগুলো পড়লে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে চোখই তাঁর সবচেয়ে সক্রিয়, এবয় দৃষ্টি চৌদিকে নিবদ্ধ; কিন্তু দৃষ্ট বস্তু বা বিষয়ের আন্তর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে সাধারণত অভাবিত রূপান্তর ঘটে না, ফলে তিনি কবিতায় সাম্প্রতিকতাগ্রস্ত থেকে যান। এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে ঘটেছে ‘কুড়িয়ে পাওয়া পদ্য’ ও ‘হে দাহ হে দৈর্ঘ্য’ অংশের বেলায়। আর এই সক্রিয় দৃষ্টি থেকে প্রত্যাশিত যা, কিছু উজ্জ্বল চিত্রকল্প, তাঁর কবিতায় সুলভ নয়; উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্ভাসনী কলাও সাধারণত প্রয়োজনীয় আলো ঢালে না তাঁর কবিতায়। তবে এখানেই হিমেল বরকতের কবিতার নির্মাণের একই সাথে দুর্বলতা ও শক্তির একটি সূত্র লুকিয়ে আছে। যেখানে শক্তি, সেখানে তাঁর চোখ মাঝে মাঝে অভ্যস্ত দৃষ্টির বাইরে অনেক সূক্ষ্ম ভূভাগ আবিষ্কার করে এবং কাব্যিক যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করে যার অভিঘাত পাঠকের পক্ষে এড়ানো কঠিন। ‘আবাস’, ‘অভিসার’, ‘গেরস্থালি’, ‘চশমা’, ‘চোখ’ এবং এ-ধরনের আরও কিছু কবিতার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত ধারণাটি প্রযোজ্য। ভিন্ন নির্মাণ-কৌশলের কিছু ব্যক্তিক কবিতাও চমৎকার অভিঘাত সৃষ্টি করেছে।
শব্দগত প্রতিবেশের প্রেক্ষাপটে হঠাৎ কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দে বা ধ্বনিক অনুরণনে ব্যক্তিগত আসক্তি মাঝে মাঝে তাঁকে বাধ্য করেছে কবিতায় অনিবার্য অনুষঙ্গের পাশে আসক্ত-শব্দ বা ধ্বনিক অনুরণন স্থাপনে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে ইপ্সিত অভীপ্সার পতন, অস্পষ্টতা, যা কবিতাকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বল করেছে। এ-ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে একটি ‘শুশ্রূষা’। নির্মাণদৌর্বল্যও কোনো কবিতার ভুল পাঠের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যেমন : ‘খিদে ও সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কবিতাটি।
মানুষ ও রাজনীতির পতন তাঁকে বারবার উদ্বুদ্ধ করেছে নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কবিতা রচনায়। একজন কবি ও মধ্যবিত্তীয় মূলধারার রাজনৈতিক চরিত্র যুক্ত হয়ে নির্মিত হয়েছে তাঁর প্রতিবাদী ভঙ্গি, নিম্নবর্গীয় প্রতিবাদী রাজনৈতিক চরিত্রটির সাথে তাঁর সম্পর্ক ক্ষীণ।
তাঁর কিছু কবিতা বাংলাদেশের বিশ শতকের ষাট, সত্তর দশকের কবিতার ছাঁচে ঢালাই করা। এ-কথাটি বিশেষভাবে সত্য তাঁর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কবিতাগুচ্ছের ক্ষেত্রে। কিছু কবিতায় বক্তব্যের চাপে প্রশ্রয় পেয়েছে অকাব্যিকতা।
নিজেদের উজ্জ্বল-আলাদা হিসেবে প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মহৎ কবিরা আধার ও আধেয়গত সৃষ্টিশীলতার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে পরবর্তীদের জন্য যে বিপদ সৃষ্টি করে যান, সেই বিপদ হিমেল বরকত অতিক্রম করতে পারেন নি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটিতে; তবে কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিয়ে সন্দেহ থাকে না যে, হিমেল বরকত কবি এবং যাঁর কাছে উৎকৃষ্ট কবিতা প্রত্যাশা করা সম্ভব।